মানিকলমকারি - ৬১
আগের পর্বে
ছোটোবেলা থেকেই সত্যজিতের ঝোঁক ধাঁধার দিকে। সেই সময় মাস্টারমশাই যোগেশচন্দ্র দত্ত দেখিয়েছিলেন ১,২,৩ সংখ্যাগুলি কথায় প্রকাশ করার মধ্যে কী মজা লুকিয়ে আছে। ছাত্রদের মুখে আবার মাস্টারমশাইয়ের নাম নিয়েও রসিকতা শুরু হয়ে যায়। পরিণত সত্যজিৎ এইসব ধাঁধা বানাতে শুরু করলেন ছোটোদের জন্য। সেখানে যেমন শব্দ নিয়ে খেলা রয়েছে, তেমনই রয়েছে ক্রসওয়ার্ড পাজল। সন্দেশ পত্রিকার পাশাপাশি দেশ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের তৈরি ক্রসওয়ার্ড পাজল। তবে সন্দেশের শব্দছকের বাড়তি আকর্ষণ হল, তার ধাঁধাগুলি আবার ছন্দে লেখা। এছাড়াও ছিল ছবির ধাঁধা। কোথাও ‘ব’ অক্ষর দিয়ে শুরু সমস্ত বস্তুর নাম খুঁজে বের করা কোথাও আবার ছবির মধ্যে ভুল খোঁজার পালা। আর ফেলুদার গল্পেই বা ধাঁধার ঘাটতি কোথায়?
সত্যজিতের গল্পমালায় পুনরাবৃত্ত চরিত্র একজন শিল্পী। একেবারে প্রথমে লেখা ইংরাজি গল্প ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’ থেকে তিনি চলে যাওয়ার ঠিক বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত ‘শিল্পী’ গল্প পর্যন্ত বারেবারে ফিরে এসেছে এই চরিত্র, নানান চেহারায়। এক ঝলকে মনে করে দেখলেই পরপর স্মৃতিতে আসবে গল্পমালার নাম। ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’ আর ‘শেডস অব গ্রে’ তো ছিলই, তারপরে ‘সহদেববাবুরর পোর্ট্রেট’, ‘মানপত্র’, ‘গগন চৌধুরীর স্টুডিও’, ‘প্রতিকৃতি’, ‘গণেশ মুৎসুদ্দির পোর্ট্রেট’, ‘শিল্পী’। এছাড়া, ফেলুদার গল্পে ‘টিনটোরেটোর যীশু’-র চন্দ্রশেখর নিয়োগী আছেন, আছেন বিশ্বের তাবড় তাবড় চিত্রের সংগ্রাহক সেই অদ্ভুত মানুষ আলেকজান্ডার ক্রাগের কথা প্রোফেসর শঙ্কুর ‘হিপনোজেন’ কাহিনিতে।
ছবির ধরন কেমনটা হবে, তা নিয়ে পিতা সুকুমার রায় আর পুত্র সত্যজিতের দুজনেরই মতই মোটের উপর এক--- অন্তত গল্পের এলাকাতে। সুকুমারের লেখা গল্প ‘কালাচাঁদের ছবি’-তে কালাচাঁদ এঁকেছিল এক ছবি। সেই ছবিতে সে আঁকতে চেয়েছিল ‘খাণ্ডব-দাহন’-এর ছবি। সেইমাফিক রথে চড়ে ঘোড়া চালিয়ে চলেছেন কৃষ্ণ, হাতে তাঁর সুদর্শন চক্র, রথে আছেন স্বয়ং অর্জুন, উড়ছে তাঁর রথের পতাকা, দূরে রয়েছেন দেবতাকুল আর একদিকে দেখা যাচ্ছে গরুড়পাখি একটি সাপকে তাড়া করেছে। এই ছবিটি দেখে তার যা কদর্থ করেছিল নিধিরাম, সে আর কহতব্য নয়। একবার রথকে বলে সেটা নাকি মন্দির আর ঘোড়াদের বলে সেটা নাকি শেয়াল। তারপরে কখনো বলে, ওটাকে বরং ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা’ করে দাও, কখনো বলে ওটাকে ‘শিশুপাল বধ’ বা ‘জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ’-ও করে দিতে পারো। এই এক ছবি দেখে আরেক ছবি-ভাবার গল্পটাই তো ফিরে এল আরেকভাবে সত্যজিতের প্রথম গল্প ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’-এ। ছবির ধরন এমনই যে, সেই ছবির কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক, সেটাই বোঝা যায় না আদৌ। তফাত হল, কালাচাঁদের আঁকা ছবির কদর্থ করে নিধিরামের কপালে জুটেছিল কালাচাঁদের মার আর সত্যজিতের গল্পে শিল্পীর জন্য অপেক্ষা করেছিল প্রথম পুরস্কার। ছবি দেখে সে যে কীসের ছবি তা সেখানে বোঝেনি নিধিরাম আর এখানে বোঝেনি বিশ্বের বড়ো বড়ো শিল্পসমালোচক। তারা শিল্পীর হাতমোছার তোয়ালেটাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পসৃজন বলে পুরস্কৃত করেছে।
অন্যদিকে যে-সত্যজিৎ নিজে সারা জীবন কালি-কলমে প্রচুর দেশি-বিদেশি স্বনামধন্য মানুষের প্রতিকৃতি অঙ্কন করেছেন, পরে কোনো কিস্তিতে সেই প্রতিকৃতির শিল্পগুণ নিয়ে আমাদের কিছু আড্ডা দেওয়ার ভারি ইচ্ছে। তা এ-হেন প্রতিকৃতি-শিল্পী সত্যজিৎ-এর কাহিনিতে প্রথমেই যেটি লক্ষণীয়, তা হল তাঁর গল্পের শিল্পীদের একটি বড়ো অংশই প্রতিকৃতি-শিল্পী আর ঠিক এখানেই জমে থাকে গল্পের স্বাদ।
আরও পড়ুন
সন্ধানে ধন্ধায় সকলে!
আসলে প্রতিকৃতি হল এক অদ্ভুত বিষয়। একটি চেনা-শোনা মুখের প্রতিরূপ অঙ্কন। কে আঁকছেন তার থেকেও কৌতূহলের বিষয় কেমন হবে সে প্রতিরূপ আর কে দেখবেন সেই প্রতিরূপ? সত্যজিৎ এখানেও নিজের অজান্তেই বুঝি পিতা সুকুমার রায়ের একটি অদ্ভুত ছোট্টো লেখা থেকে পেয়েছিলেন এই প্রতিকৃতি নিয়ে মানুষের আগ্রহের সংকেতসূত্র। সুকুমার রায়ের সেই ছোট্ট গল্পটির কথা এই মানিকলমকারি-র খাস পাঠকদের এতক্ষণে নিশ্চয়ই মনে পড়ে গেছে। গল্পটির নাম ‘বাজে গল্প-২’। সেখানে ‘কলকাতার সাহেব বাড়ি থেকে গোষ্ঠবাবুর ছবি এসেছে। বাড়িতে তাই হুলুস্থুল’। আসলে ছবিটি উপলক্ষ্যমাত্র, লক্ষ্য এই ছবিটিকে কেন্দ্র করে বাবুর তাঁবেদার আর মোসাহেবদের চরিত্রবর্ণনা। ওইসব লোকেদের মুখে ছবির সূত্রে বাবুর চেহারা আর গুণপনার ঢালাও প্রশংসাই এই গল্পের প্রথমদিকের বিষয়। পরে বাবু এসে যখন ছবিটির পাশে দাঁড়ালেন আর বললেন, ‘একটা বড়ো ভুল হয়ে গেছে। কলকাতা থেকে ওরা লিখছে যে ভুলে আমার ছবি পাঠাতে গিয়ে কার যেন ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে। ওটা ফিরত দিতে হবে।’ সেই মুহূর্ত থেকে ছবির ওইসব বোদ্ধা দর্শকদের সম্পূর্ণ উল্টো মত একের পর এক আসতে থাকল। গল্প কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, কারণ, ওই গল্পের সঙ্গে লেখক সুকুমারের আঁকা ছবিরও একটা ভূমিকা রয়েছে। সেটা দেখলে তা আরেকটা গল্প। কারণ, আসলি গোষ্ঠবাবুর সঙ্গে যে ওই ছবির বিন্দুমাত্র মিল নেই আর আসল গোষ্ঠবাবুর দেখনশোভার তুলনায় ওই ভুল-ছবির ব্যক্তির যে দেখন-শোভা আছে, সেটা স্পষ্ট। ফলে গল্পের সঙ্গে ছবি মেলালে আরেকটা গল্প বাড়তি লাভ। তবে, এখানেও লক্ষণীয়, ভুল ছবি, ছবির ভুল আর যেমন দেখতে তেমন নয় এই মূল বিষয়টাই কিন্তু নানা ধরনে ফিরে ফিরে এসেছে সত্যজিতের গল্পের ভিতর। তাই বলছিলাম, প্রতিকৃতিতে এই উপাদানটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর ওই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ছবির সাদৃশ্য আর বৈসাদৃশ্য--- এটাও সত্যজিতের এই চিত্রশিল্পীদের নিয়ে লেখা গল্পের একটা অন্যতম মূল মোটিফ।
আরও পড়ুন
নির্মীয়মাণ ‘বাগানবাড়ি’-র গল্পরেখা
আরও পড়ুন
নামের আরো গল্পসল্প
১৯৭৮-এ লেখা ‘সহদেববাবুরর পোর্ট্রেট’ গল্পের সহদেববাবু ছিলেন লোকাল ট্রেনের সামান্য ফিরিওয়ালা, সেখান থেকে তিনি কলকাতায় এক মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। এইবারে নিজের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে তিনি নিজের চারপাশকে বদল করতে থাকলেন, বদলালেন নিজের চেহারা, বদল করলেন নিজের গৃহসজ্জাতে আর সেই গৃহসজ্জার বদল করার জন্য বাহারি ইংরাজি বইয়ের সঙ্গেই তিনি রাখতে চাইলেন নিজের একটি প্রতিকৃতি। তাঁকে এই বড়লোকিয়ানার সঙ্গে ঘরে প্রতিকৃতি রাখার বিষয়টা বুঝিয়েছিলেন যিনি তিনিই বলেন, ‘এ একটা নতুন জিনিস হবে মশাই। আজকাল আর এটার রেওয়াজ নেই, অথচ পাকা হাতে আঁকা একখানা বেশ বড়ো সাইজের পোর্ট্রেট আঁকিয়ে ঘরে টাঙিয়ে রাখলে সে-ঘরের চেহারাই পালটে যায়।’ এই ভাবনায় কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে শিল্পী ডাকলেন, এক শিল্পীকে পছন্দ হল না তার বেশভূষা দেখে আরেক শিল্পী যে ছবি আঁকলেন, তা মাঝপথেই বন্ধ করাতে হল, ঠিক মিলছে না বলে। এই উদ্যোগের বহু পরে, হঠাৎই একেবারে নিজের মতো দেখতে এক অনেক কালের পুরোনো জমিদার বা রাজাগজার ছবি দেখে, সেটা কিনে আনলেন তিনি বাড়িতে। তিনি সম্পন্ন। কিন্তু তিনি তো আর রাজা নন, ফলে এরপরে সেই ছবির রাজার মাপে নিজেকে তৈরি করতে গিয়ে ধীরে ধীরে নিজের অবস্থাই খারাপ হতে থাকল তাঁর। গল্পের শেষের চমকটা অন্য রকম, সেটা বলার দরকার নেই--- লক্ষণীয়, ওই ছবির সঙ্গে নিজেকে মেলাবার গল্পটা। ওটাই আসল।
আরও পড়ুন
নামান্তরের অন্তরে
এই ছবির সঙ্গে ব্যক্তির নিজেকে মেলাবার কত ধরনই না সত্যজিৎ বার করলেন তাঁর গল্পমালায়। ‘প্রতিকৃতি’ গল্পে দেখা যাবে এক ধনাঢ্য ব্যক্তির চমৎকার প্রতিকৃতি যখন প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে, তখনই তার এমন এক অসুখ করল, যার ফলে তাঁর চেহারা গেল ভেঙে, আঁকার মাঝমধ্যিখানেই বদলে গেল তাঁর চেহারা। আবার ধরা যাক, ‘গণেশ মুৎসুদ্দির পোর্ট্রেট’ গল্পে দেখা যাবে এমন এক অদ্ভুত প্রতিকৃতির কথা, যেখানে যার ছবি আঁকা হচ্ছে তার এখনকার ছবি নয়, তাকে পঁচিশ বছর পরে কেমন দেখতে হবে, তার ছবি আঁকতে হবে। দক্ষ শিল্পী মন দিয়ে লক্ষ করে কীভাবে আঁকলেন সেই ছবি আর সেই চেহারার সঙ্গে কোন নাটকীয়তায় মিলে গেল ভবিষ্যতের চেহারা--- এটাই তো কাহিনির বিষয়। সত্যজিতের প্রায় শেষ জীবনে আঁকা ‘শিল্পী’ গল্পে পাওয়া যাবে এমন এক প্রতিকৃতি-শিল্পীর কথা, যিনি এক সমালোচকের কঠোর সমালোচনার ঠেলায় নিজেকে বদলে নিয়ে আধুনিক ছবি আঁকবেন ঠিক করেন। মজা হল, সেই সমালোচকই কিন্তু তাঁর বাবার স্মৃতিসভায় বাবার কোনো ভালো ফোটোগ্রাফ না পেয়ে এই শিল্পীর কাছেই নিজের পরিচয় গোপন করে সন্ধান করেন এঁর আঁকা সেই অসম্পূর্ণ রিয়ালিস্টিক প্রতিকৃতিরই। আসলে সত্যজিতের লেখা গল্পে প্রথম থেকেই আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্পকলার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে ধ্রুপদি পশ্চিমি ছবি আঁকার ধরনের একটা দ্বৈরথ পুনরাবৃত্ত।
প্রতিকৃতি নিয়ে একেবারে অন্য ধরনের অলৌকিক কাহিনি ‘গগন চৌধুরীর স্টুডিও’। প্রতিকৃতি আঁকা হয় জীবন্ত মানুষকে শিল্পীর সামনে বসিয়ে। এই নিজেকে বসিয়ে ছবি আঁকানোর মধ্যে আসলে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে যখন এই ছবির বিষয় এই পৃথিবীতে থাকবেন না, তখন যাতে এই প্রতিকৃতি তাঁর চেহারাকে অমর করে রাখে। এই গল্পে এই বিষয়টিকেই পুরো অন্য মাত্রায় নিয়ে গেলেন সত্যজিৎ। প্রতিকৃতি আঁকা হচ্ছে মৃত ব্যক্তিকে শিল্পীর সামনে উপস্থিত করে--- সে এক ভয়ংকর কাহিনি। চিত্রশিল্পীর গল্প বলতে কেবল চরিত্র হিসেবে চিত্রশিল্পীকে রাখছেন না সত্যজিৎ--- তাঁর কাহিনির মধ্যে ছবি আঁকার এক নতুন দর্শন যেন প্রতিষ্ঠা করে চলেন তিনি। হতেই পারে তা ছোটদের জন্য লেখা গল্প। ছোটরা হয়ত পড়বে ওই গল্পের কৌতূহল-জাগানিয়া প্লট। কিন্তু বড়ো হয়ে গল্পের ভেতরের এই প্রাণটাকে নতুন করে পড়া দরকার এইবার। পরের মানিকলমকারি-তে এই প্রতিকৃতিশিল্পীর সঙ্গে আরেক নতুন ধরনের ছবি- আঁকিয়ের কথা বলা যাবে। বাংলার শিল্প-ইতিহাসের দীর্ঘকালীন উপেক্ষার গল্পও তো বলেছেন সত্যজিৎ। সত্যজিতের গল্পে সেই উপেক্ষার অন্য-ইতিহাস বরং সন্ধান করা যাবে আগামী সপ্তাহে।
Powered by Froala Editor