মানিকলমকারি - ৬০
আগের পর্বে
১৯৬১ সালে সত্যজিৎ রায় একটি খসরা চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু একটি পাতা লেখার পরেই সেটি থামিয়ে দেন। তার বদলে পরের পাতায় শুরু হয় অভিযান সিনেমার চিত্রনাট্য। তবে এই খসরা একটি পাতার ভাবনাই পরে ফিরে আসে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে। সেখানে কিছু চরিত্রের নাম বদলে যায়। কিছু চরিত্র আবার একই থাকে। খসরায় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নামটির কোনো উল্লেখ নেই। তবে সেই খাতারই শেষের দিকে একটি পাতায় ইংরেজিতে কাঞ্চনজঙ্ঘা নামাঙকন চোখে পড়ে। ছবির ইন্দ্রনাথ চরিত্রে প্রথম থেকেই ছবি বিশ্বাসের কথা ভেবে রেখেছিলেন সত্যজিৎ। তবে খসরার সুমন্ত্র, যাকে সিনেমায় অশোক চরিত্রে দেখা যাবে, তার জন্য ভেবেছিলেন শমিত ভঞ্জর কথা। অন্যথায় সৌমিত্র। আর খসরার মণিকা, সিনেমার মনীষা চরিত্রটির জন্য তিনি ভেবেছিলেন শর্মিলা ঠাকুরের কথা। এমনকি শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে মণিকার চারিত্রিক মিলের বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন সেখানে।
সত্যজিৎ ছেলেবেলা থেকেই ধাঁধার কারবারি। স্কুলে বাংলাতে ১-২-৩ সংখ্যাগুলি যখন কথায় লেখা হত, তখন তার ভেতরেও কী মজাতে যে লুকিয়ে আছে বাংলা ১-২-৩, তা তাঁকে দেখিয়েছিলেন ইস্কুলের মাস্টারমশাই। সেই কথা বেশ মজা করে বলেছিলেন সত্যজিৎ তাঁর 'যখন ছোট ছিলাম' বইতে।
সে যেমন এক মজার গল্প, তেমনই মজার ধাঁধা ছিল ওই মাস্টারমশাইয়ের নামেও। তাঁর নাম ছিল যোগেশবাবু, যোগেশচন্দ্র দত্ত। এই যোগেশবাবু ছাত্রদের কাছে হয়ে গেছিলেন 'গাঁজা'। এই নাম বদলের ভাষাতাত্ত্বিক টীকা বানাতে গিয়ে সত্যজিৎ লিখেছিলেন, "হয়ত যোগেশ থেকে যগা, যগা থেকে গজা, গজা থেকে গাঁজা।" অনেক পরে সন্দেশ পত্রিকার পাতায় খুদে সন্দেশীদের জন্য একটা ধাঁধার খেলা বানিয়েছিলেন তিনি। সেখানে একটি শব্দকে বদলে দিতে হবে আরেকটি শব্দতে। খেলার নিয়ম হল, যে শব্দ দেওয়া থাকবে তাকে আগে থেকে বলে দেওয়া আরেকটা শব্দে এমনভাবে ধাপে ধাপে বদলাতে হবে যাতে প্রতি ধাপে একটিমাত্র ধ্বনি বদল করা যাবে আর প্রতিটি বদল-করা শব্দেরও একটা মানে থাকতে হবে। সত্যজিতের সম্পাদনাতে এমন হাজার শব্দ নিয়ে খেলার ছড়াছড়ি।
ফেলুদার আর লালমোহনের নাম নিয়ে ধাঁধার কথা তো সক্কলের জানাই। সকলে জানেন, রয়েল বেঙ্গল রহস্য গল্পটাই বোনা হয়েছে একটা ধাঁধার সূত্র ধরে। ফেলুদার কাহিনিতে আছে 'বোসপুকুরে খুনখারাপি' কাহিনির সেই 'আম আঁটির ভেঁপু' বলা ধাঁধা আর চাবির অঙ্ক মনে রাখার 'ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন একটু জিরো'-র রিডল। এইসব গল্পে রাখা ধাঁধার পাশাপাশি আরো কত ধাঁধাই না গেঁথেছেন তিনি খুদে সন্দেশীদের জন্য। সে এক্কেবারে ধাঁধা মানে ধাঁধা-ই। কখনো তা কথার ধাঁধা, কখনো তা ছবির ধাঁধা। সন্দেশ কর্তৃপক্ষের পক্ষে যদি সম্ভব হয়, এইসব সত্যজিতীয় ধাঁধাগুলিকে একত্র করতে পারেন, তাতে এক অন্য সত্যজিতের রূপ পাওয়া যাবে। এখনো একটু খোঁজ খবর করে, কোন কোন ধাঁধাগুলি সন্দেশ পত্রিকা-র 'ছোটো' সম্পাদক মশাই করেছিলেন, সেগুলো বার করা যেতে পারে কি?
আরও পড়ুন
নির্মীয়মাণ ‘বাগানবাড়ি’-র গল্পরেখা
কথায় বাঁধা ছড়ার ভেতর ওই শব্দ-বদলের খেলা যেমন ছিল, তেমনই ছিল ক্রস ওয়ার্ড। সত্যজিতের তৈরি ওই শব্দ-বাঁধার একটি খেলা প্রকাশিত হয়েছিল একবার শারদীয় 'দেশ' পত্রিকার পাতায় আরেকটি ছিল সন্দেশ-এ। সন্দেশ-এর শব্দছকের সংকেত ছিল আবার ছন্দোবদ্ধ। মানে সেখানে শব্দ নিয়ে ডাবল খেলা। যেমন ধরা যাক, "এক দুই দাও দেখি খাজনা/ তিন চার পাও তবে ফল/ এক দুই তিন চার বাজনা/ এক চার খুলে পাবে জল।" নিখুঁত ছন্দে বাঁধা ধাঁধা। উত্তর: করতাল। "এক দুই দাও দেখি খাজনা" হল করতালের কর, মানে খাজনা। "তিন চার পাও তবে ফল" হল করতাল-এর তাল। "এক দুই তিন চার বাজনা" মিলে করতাল। আর "এক চার খুলে পাবে জল" হল কল। কিংবা ধরা যাক, "সন্ধানী বোঝো শব্দমূল্য/ বাঁ-যোগে লম্ফঝম্প/ সো-যোগে বুঝিবে ভ্রাতৃতুল্য/ চা-যোগে কমিবে কম্প।" উত্তর হবে "দর"। দর মানে মূল্য, বাঁদর লম্ফঝম্প করে, সোদর হল ভাই আর চাদর শীত কমায়। এটা যেমন শব্দের ধাঁধা, তেমনই এই শব্দের লেজের সঙ্গে ওই শব্দের মুড়ো জুড়ে এ এক অসাধারণ শব্দছক-ও বটে।
আর ছিল হরেক ছবির খেলা। কখনো একটি ছবির মধ্যে আমরা সব সময় যে ছবি দেখি, তার ছোট্টো একটা অংশ এঁকে দিয়ে পাঠকদের জিগেশ করা হল, বলো তো পুরো ছবিটা কী বা কোথায় দেখেছ? তার মধ্যে রবি ঠাকুরের স্বাক্ষরের অংশবিশেষ থেকে ভারতীয় টাকার পিছনে আঁকা ছবির অংশ যেমন থাকত, তেমনই থাকত আবোল তাবোল-এর অদ্ভুতুড়ে কোনো জীবের লেজের অংশ কিংবা টিনটিনের বিশেষ ধরনের চুলের স্টাইল। ছবির খেলাতে তিনি কখনো আঁকেন 'ব-এর বাড়াবাড়ি' আবার কখনো আঁকেন 'ছবির ভুল'। বিরাট বড়ো ছড়ানো ছবিতে পাঠকরা খুঁজে বের করবেন কত কত জিনিস আছে, যাদের শুরু ব-দিয়ে। সেখানে বাংলো বাড়ির সামনে বাগান। বাগানের গাছের ভেতর বট আছে, বেড়া আছে। বেড়াল আছে, বেজি আছে, বেতের ঝুড়ি আছে, পাশে বেলফুল আছে.... এমন কত ব-এর বাড়াবাড়ি।
আরও পড়ুন
নামের আরো গল্পসল্প
একবার প্রকাশিত হল ছবির ভুল। সেখানে দেখা যাচ্ছে এক পড়ুয়ার পড়ার ঘরের ছবি। এমনিতে পুরো পাতা জোড়া ঝকঝকে ছবি, তবে সেখানে কোথাও দেখবেন চশমার ডাঁটি উল্টো দিকে, কোথাও আবার ক্যালেন্ডারের পাতাতে ভুল। কখনো পাখার ব্লেডের সংখ্যা কম আবার কখনো টেলিফোনের তার নেই। কোথাও দেখা যাবে যে বই দেখা যাচ্ছে, তার নীচে অন্য লেখকের নাম। এমনকি ভুল দিকে জামার পকেট থেকে ঘড়ির কাঁটার ভুল অবধি সবই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আরও পড়ুন
নামান্তরের অন্তরে
আরেক রকম খেলার হদিশ দিলেন সত্যজিৎ। সেটা ছিল, "গরিং-এর গানগপ্পো"। জটায়ুর কেতায় এই নামটা অবিশ্যি আমরাই দিলাম। সেই হেঁয়ালিতে একটা ছোট্ট গল্প আছে আর সেখানে সংকেত দিয়ে বলা আছে "উপরের ছোট গল্পটার মধ্যে সংকেতে একটি বিখ্যাত গানের প্রথম পঙক্তি লুকিয়ে আছে। বলো তো পঙক্তিটি কী এবং কী সংকেতে সেটি লেখা হয়েছে!" গল্পে ছিল "রাজভবন পেরিয়ে গরিং দক্ষিণ দিকে চলল। মর্তের শহর যেন ভিড়ে ফেটে পড়ছে।" ইত্যাদি। তার যে উত্তর সংকেত তা এই রকম: "এক অক্ষর বাদ দিয়ে প্রথম অক্ষর, দুই অক্ষর বাদ দিয়ে দ্বিতীয় অক্ষর, তিন অক্ষর বাদ দিয়ে তৃতীয় অক্ষর" নিতে হবে। তাহলে, সেই হিসেবে "রা[জ]ভব[ন] পেরিয়ে [গ]রিং দক্ষি[ণ] দিকে চলল। [ম]র্তের শহর যে[ন] ভিড়ে ফেটে পড়ছে।" উত্তর আসবে "জনগণমন অধিনায়ক" গানটি। ভাবতে পারা যায়, এমন সব দারুণ দারুণ ধাঁধার খেলা বানাতেন তিনি!!
এই খেলার-ই আরো এক দারুণ মকশো পাওয়া গেল সত্যজিতের এক খেরোর খাতার পাতায়। ওই ধাঁধা সত্যজিৎ লিখলেন ১৯৭২-এ আর এই মকশোটা তার বছর দশেক আগেকার। ১৯৬১-র একটি খাতায় দেখা পাওয়া গেল, ন-খানা রবীন্দ্রসংগীতের লাইন। ১। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, ২। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, ৩। গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ, ৪। বাদল বাউল বাজায় রে একতারা ইত্যাদি। তার নীচে নানা অদ্ভুত সব বাক্য লেখা। আপাতত না আছে তার মুণ্ডুমাথা। না আছে তার মানে। যেমন এক জায়গায় লিখেছেন, "বাবার সুবিধা হয়", আরেক জায়গায় লেখা, "মাসিমা আসো না তোমি"। মন দিয়ে এর মাঝের কাটাকুটি লক্ষ করলে বোঝা যাবে, তাঁর মাথার মধ্যে আসলে কোন খেলা চলছিল। আসলে, চিত্রনাট্যের পাতাতেই তিনি তখন বানাচ্ছেন সন্দেশ পত্রিকা-র জন্য ধাঁধা। একটি গানের বিভিন্ন বর্ণগুলো আগুপিছু করে আরেকটা অর্থবহ বাক্য বানিয়ে হয়ত পাঠকদের বলবেন, শব্দগুলো আগুপিছু করে বের করো একটা রবি ঠাকুরের গান। সেই হিসেবে, ওই "মাসিমা আসো না তোমি" তো "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি" গানের কথা নিয়ে না-বানানো খেলা। আবার ওই "বাবার সুবিধা হয়" হল "বাদল ধারা হল সারা বাজে বিদায় সুর"-এর শব্দ আগুপিছুর খেলা।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের লেখা নাটিকা
সন্দেশ সম্পাদক সত্যজিতের খোঁজ নিতে হলে যেমন এই ধাঁধা তৈরির খোঁজ করা দরকার, তেমনই রবীন্দ্র- জন্মশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের ওপর তথ্যচিত্র, রবীন্দ্রনাথের কাহিনি অবলম্বনে 'তিনকন্যা' আর শতবার্ষিকী স্মারক ডাকটিকিটের পরিকল্পনা করা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের গান থেকে যে ছোটোদের জন্য শব্দ নিয়ে ধাঁধা করতে চেয়েছিলেন তিনি, সেই তথ্যটাও বোধহয় মনে রাখা ভালো।
বিশেষ একটি সতর্কীকরণ: নেটের দুনিয়াতে সত্যজিৎ বেল ভিউ নার্সিংহোমে থাকাকালীন নাকি একটি গাছের ছবি এঁকেছিলেন, যেখানে খুঁজলে বেশ কজন মনীষীর মুখ পাওয়া যাবে। ছবিটা যিনি এঁকেছেন তিনি বেশ ভালোই এঁকেছেন। তবে এটি সত্যজিতের আঁকা মনে হয় না। অবশ্য এটা আন্তর্জালে এমন ছড়িয়ে আছে যে, অনেকেই এটিকে সত্যজিতের আঁকা বলে ভাবেন। এইসব আর আরো সব ভ্রান্ত ও জাল তথ্যজাল থেকে ভবিষ্যতের সত্যজিৎ গবেষকদের খুব সাবধান হওয়া দরকার। এরা মানিকলমকারি-র অংশ অবশ্যই নয়।
Powered by Froala Editor