মানিকলমকারি - ৬
আগের পর্বে
যেখানে আয়োজনের বাহুল্য নেই সেই দৃশ্য তোলাই বেশি সমস্যাসঙ্কুল। সেখানে নজর রাখতে হয় চরিত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়েও। অপুর সুদীর্ঘ মাঠে দিদিকে খুঁজে বেড়ানোর দৃশ্যটি তোলার পিছনেও ছিল তেমনই অমানবিক পরিশ্রম, সে কথা নিজেই লিখেছেন সত্যজিৎ। সপ্তকাণ্ডের বাকি তিনটি বিষয়ের মধ্যে অভিনেতাদের কথা সবথেকে কম এসেছে তাঁর লেখায়। তবে অভিনয়ের ক্ষেত্রেও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং দক্ষতাই শেষ কথা। অন্যদিকে সম্পাদনা বা সম্পাদকের শিল্পবোধ ছবির প্রকৃত ভাষাকে জন্ম দেয় বলে মনে করতেন সত্যজিৎ। ক্যামেরার ধরণ, গল্পের বিন্যাসে বদল আনলে বদল দরকার আবহসঙ্গীতেও। প্রতিটি ছবির মেজাজ অনুযায়ী সঙ্গীত ব্যবহার না হলে, তা অর্থহীন হয়ে যায়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সরাসরি ব্যবহার করার সুযোগ ছবিতে খুবই কম থাকে। সিনেমায় দর্শক এবং সমালোচকদের ভূমিকা নিয়েও কথা বলেছিলেন সত্যজিৎ। সিনেমা দেখতে শেখানোর পাশাপাশিই চলচ্চিত্র চর্চার এই জঁর তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। এক কথায় যা কমপ্লিট সিনেমার ক্লাস।
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাসে কি তাহলে শুধু সিনেমা বানানো শেখানো চলছিল? আমরা বলছিলাম, সত্যজিৎ শুধু নিজে বাংলা সিনেমার জগৎটা তৈরি করছিলেন, তাই নয়। তিনি যেন আমাদের শেখাচ্ছিলেন সিনেমা পড়তে হয় কী করে? সেই শিক্ষণ পর্বের একদিকে যদি থাকে সিনেমা বানানোর হাতেখড়ি তাহলে অন্যদিকে আছে সিনেমা চর্চার যেন একটি পাঠ্যক্রমের প্রস্তুতি। আগের দুই কিস্তিতে আমরা দেখলাম, সত্যজিতের প্রবন্ধাবলিকে এক বিশেষ অভিপ্রায় থেকে সাজিয়ে নিলে বলাই চলে, তিনি একেবারে গল্প বাছাই পর্ব আর চিত্রনাট্য লেখা শুরু থেকে আবহসংগীতের সংযোজন পর্যন্ত ধাপে ধাপে নানা সময় তাঁর ভাবনাসূত্র গেঁথে গিয়েছেন। কিন্তু চলচ্চিত্র চর্চার আরেকটি ধাপ তো সিনেমার ইতিহাস আর তার নন্দনতত্ত্বের আলোচনা, সেই দিক সম্পর্কে কি নীরব ছিলেন তিনি? অবশ্যই নয়, ওই যে বললাম, তিনি যেন আমাদের একটা সামগ্রিক সিনেমা দেখার চোখ তৈরি করার একটা প্রকল্প চিন্তা করে লিখে চলেছিলেন তাঁর প্রবন্ধমালা।
মনে পড়ে যাবে, ১৯৫৫-তে পথের পাঁচালী তৈরির আগে, ১৯৫০-এ সত্যজিৎ লিখলেন একটি প্রবন্ধ, নাম 'বাস্তবের পথে চলচ্চিত্র'। আর কী অদ্ভুত, তিনি সিনেমার কথা বলতে শুরুই করলেন একটি এক্কেবারে অন্য পরিপ্রেক্ষিত থেকে। বললেন, " চলচ্চিত্রের ইতিহাস পরিধিতে সংক্ষিপ্ত হলেও বহু ঘটনায় আবর্তিত। চলচ্চিত্র প্রবর্তনের পরে দুইটি বিশ্বযুদ্ধ গেছে, বিশ্ব বাণিজ্যের বাজারে ক্রমান্বয়ে সাংঘাতিক ওঠাপড়া হয়েছে, এবং বিজ্ঞান গবেষণায় অকল্পনীয় উন্নতির পরিণতি ঘটেছে পরমাণুর চরম বিস্কোরণে। চলচ্চিত্রের প্রধান উপকরণ হচ্ছে মানবজীবন, কাজেই মানব-ইতিহাসের সঙ্গে তার ইতিহাসও অঙ্গাঙ্গি গ্রথিত।" ভাবতে আশ্চর্য মনে হয়, পথের পাঁচালী-র আগে লেখা ওই "বিজ্ঞান গবেষণায় অকল্পনীয় উন্নতির পরিণতি ঘটেছে পরমাণুর চরম বিস্কোরণে" বাক্যের মধ্যে যে ব্যঙ্গ আর তির্যকতা আছে, সেটাই ফিরে আসবে সত্যজিতের শেষ ছবি 'আগন্তুক'-এ মনোমোহন মিত্রের সংলাপে। তিনি প্রচণ্ড ক্ষোভে মনে করিয়ে দেবেন, সভ্যতা তো হল তা-ই যা একটা বোতামের চাপে এক একটা নগর ধ্বংস করতে পারে, আর সভ্য তো হল তারাই, যারা সেই বোমা নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেন।
আসলে, সিনেমার মধ্যে যে বাস্তবকে আমরা লক্ষ করি, তা একান্তই যন্ত্রনির্ভর এবং তিনি স্পষ্ট করে বলে দেন, "ফিল্ম তোলার আনুষঙ্গিক যন্ত্রাদির এতদূর আজ উন্নতি হয়েছে যে কল্পনায় কি বাস্তবের জগতে হেন বস্তু নেই পরিচালকের ইচ্ছামতো যাকে দৃশ্য পরদায় রূপ দেওয়া না যায়।" আর ঠিক এর পরেই অত্যন্ত জরুরি একটা কথা লেখেন: শুধুমাত্র উৎকৃষ্ট উপাদানই উৎকৃষ্ট শিল্পসৃষ্টির একমাত্র শর্ত নয়, উৎকৃষ্ট পোর্ট্রেট আঁকায় যেমন যথেষ্ট নয় উৎকৃষ্ট ইজেল। উপাদান হচ্ছে উদ্দেশ্য সাধনের সহায়ক।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস - ২
যথার্থ শিল্পীর সৃজনশক্তি সম্পর্কে সেই পথের পাঁচালী-পূর্ব পর্বেই বলেছিলেন, "যিনি সৃষ্টি করেন তাঁর অনুভবের প্রকৃতির উপরেই চলচ্চিত্রের তথা সমস্ত সৃষ্টিকর্মের উৎকর্ষের নির্ভর। যদি রুচি না থাকে, যদি কল্পনা পঙ্গু হয়, তাহলে পৃথিবীর সমস্তের সেরা উপাদান একত্র করেও সিদ্ধ হবে না।"
এর বেশ কিছু আগে, একটি ইংরাজি প্রবন্ধে সত্যজিৎ আলোচনা করেছিলেন, প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক জাতিসত্তার একটি নিজস্ব বাস্তবতার রূপ থাকে, গুণী স্রষ্টা সেই নিজস্বতার সন্ধান করেন। প্রবন্ধটির নাম ছিল, "ন্যাশনাল স্টাইলস ইন সিনেমা"। লিখেছিলেন ১৯৪৯ সালে, দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায়। সেই প্রবন্ধে রুশ ছবিতে বাস্তবতার চিত্রণ আর মার্কিন ছবিতে তার চেহারা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করে শেষে আসেন ভারতীয় সিনেমার প্রেক্ষাপটে তার রূপ কী হতে পারে তার কথায়। আলোচ্য বাংলা প্রবন্ধে তিনি বোঝাতে চাইলেন, যুদ্ধ-সমকালীন বহু চিত্রগ্রহণ আমাদের সামনে আসলে বানিয়ে-তোলা বাস্তবতার চেয়ে প্রত্যক্ষ বাস্তব যে কত গুরুত্বপূর্ণভাবে ছবির বিষয় হতে পারে, সেই ভাবনাটি উপস্থাপন করলেন। তার সঙ্গেই যোগ করলেন ইতালীয় ছবির নব্য বাস্তবতার কথা। উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, সেই নতুন বাস্তবতা দিয়েই বানাতে হবে আজকের ছবির বাস্তবতা।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস - ১
আরও পড়ুন
প্রদোষ ‘মিত্র’ নয়, ফেলুদা-র পদবি ‘দত্ত’ ভেবেছিলেন সত্যজিৎ!
সেই প্রেক্ষাপটে এমনকি, হলিউডের ছবি সম্পর্কে সত্যজিতের একেবারে ভিন্ন একটি ভাবনা তাঁর প্রথম যুগের চলচ্চিত্র চিন্তায় ছিল। সত্যজিতের হলিউড নিয়ে পরবর্তী ভাবনা থেকে তা একেবারে অন্য রকম, তাই এখানে তা উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৫০-এ বলেছিলেন, "যেসব উপকরণ নিয়ে শিল্পের সৃষ্টি সেই উপকরণই যদি যথার্থ বাস্তবিক জীবনের বিকৃতি হয় তা হলে তার পরিণামে ব্যর্থতা সুনিশ্চিত। হলিউডের অপ্রাকৃত দৃশ্য, জমকালো সাজসজ্জা, লাস্যময়ী নটী আর দর্জির বিজ্ঞাপন সদৃশ নট জীবনের বাস্তবিকতা সৃষ্টির পথে প্রকাণ্ড বাধা।"
এই পর্বের হলিউড ক্রমশ বদলাচ্ছে নিজেকে, পাঁচের দশক থেকে কীভাবে কোন কোন দাবিতে সেকালের হলিউড ধীরে ধীরে তার খোলনলচে বদলানো, তার পিছনেও যে ইউরোপীয় ছবি, এশিয়ার ছবির নতুন গল্প বলার ধরন কতখানি সক্রিয়, বোঝাতে থাকেন সত্যজিৎ।
আসলে, এই নব্য বাস্তবতার তরফদার নিজের কথা বলছেন তিনি, পাশাপাশি বিশ্ব সিনেমার ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করছেন এখনকার পাঠককে।
আরও পড়ুন
শাসমলবাবু, সদানন্দ, সুজন এবং
আরও পড়ুন
কেমন দেখতে ছিলেন ‘সত্যিকারের’ জটায়ু?
এই গোত্রে 'হলিউডের হালচাল', 'সোভিয়েত চলচ্চিত্র' আর জন ফোর্ড, আকিরা কুরোসাওয়া বিষয়ক লেখাগুলি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পরিবর্তমান ইতিহাসের সঙ্গে সেখানকার সিনেমার বিবর্তন যেমন আলোচনা করলেন, তেমনই সেখানকার ছবি কীভাবে আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে, সেদিকেও একটা দিকনির্দেশ ছিল এই লেখাতে।
তৃতীয় আরেকটি ভাবনা-পথ রয়েছে সত্যজিতের গদ্যমালায়। সেটি হল, ছবির নন্দনতত্ত্ব। আর সে ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লেখা হল: ''ছবি' ও 'গান''। ভারি অদ্ভুত এই প্রবন্ধটির বিষয়। কথার শুরুতেই বললেন, "সিনেমার সঙ্গে সংগীতের একটা ফর্মগত মিল আছে--- এ দুটোই এমন শিল্পমাধ্যম সময়ের ওপর যার প্রভাব খুব সক্রিয়।" পাঠকের দিক থেকে সময়টা কেমন? সাহিত্য রেখে রেখে পড়া যায়, কিন্তু গান বা ছবি টানা দেখে বা শুনে যেতে হবে। সেই বাইরের দরকার কীভাবে এই দুই মাধ্যমে একটা গভীর কাহিনি বর্ণনারীতির জন্ম দেয়, প্রবন্ধে আলোচ্য সেটিই। "সাংগীতিক ছন্দের কাঠামোটা খুব জরুরি"--- এই ভাবনা থেকে বোঝালেন কেন "ফিল্মের সংগীত দৃশ্যনির্ভর"। কী আশ্চর্য এক বাক্যবন্ধ! যে সংগীত শ্রুতির বিষয়, তার দৃশ্যরূপ হল ছায়াছবির গতি। আবার সেখানেই তাত্ত্বিকভাবে বোঝালেন, এদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যও কোথায়? বললেন, কানে শোনা সংগীত তালে ফেলা চলে, কিন্তু ছবির সংগীত ধর্ম সেই মানদণ্ডে মাপা চলে না। যাঁরা সত্যজিতের লেখাকে তাত্ত্বিকভাবে দেখতে চান না, বোঝাতে চেষ্টা করেন, তিনি ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট, থিয়োরি তৈরিতে তাঁর নিতান্ত অনীহা, তাঁরা সত্যজিতের এই প্রবন্ধটি পড়ে দেখবেন কি?
আসলে সব মিলিয়ে ঠিক কী বোঝাতে চাইছিলেন তিনি? সিনেমা দেখা মানে কেবল একটি বিশেষ ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যেই প্রচলিত এ এক জনপ্রিয় বিনোদনের উপকরণমাত্র নয় এই নবীন শিল্প মাধ্যমটি। সাহিত্যের যেমন বিশেষ ভাষিক একটি রূপের সঙ্গেই আছে বিশ্বসাহিত্যের এক বড়ো মানচিত্র, শিল্পকলার যেমন ইন্ডিয়ান স্কুল বেঙ্গল স্কুলের সঙ্গেই আছে এক আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, ঠিক সেইভাবে আমাদের গ্রহণ করতে হবে সিনেমাকেও। বিংশ শতাব্দীর মধ্যপর্ব থেকে সত্যজিৎ এই পাঠটিও কি তৈরি করছিলেন না? তিনি একদিকে কলাভবন থেকে চিত্রকলার এই উদার মানচিত্র সম্পর্কে অবহিত হচ্ছিলেন, আবার এখানকার ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের প্রথম যুগের নেতৃত্বও দিচ্ছেন তিনি। এই তাঁর নিজস্ব প্রস্তুতি পর্ব গভীরভাবে তাঁর কলমে তো এক নতুন গদ্য-সংরূপের জন্ম দিয়েছে। তাকে বলা যেতে পারে চলচ্চিত্র বিষয়ক বাংলা গদ্য। সেকালে আরো অনেকেই লিখেছিলেন এই বিষয়ে, তাঁদের মধ্যে কি বিষয় বিস্তারে, কি বিশ্লেষণী দক্ষতায় সবচেয়ে পূর্ণ হয়ত সত্যজিতের প্রবন্ধাবলিই। বাংলাতে কতদিন তো, কতদিন কেন, এখনো তো, সিনেমা বিষয়ক লেখা বলতে সাধারণ মানুষ বোঝেন হয় কী সিনেমা হচ্ছে আর কেমন সিনেমা হল, তার প্রতিবেদন। এর বাইরেও যে চলচ্চিত্র চর্চা একটি ডিসিপ্লিন, সত্যজিৎ যেন সেই বিদ্যাচর্চার প্রথম আচার্য। এদিক থেকে তাঁর গদ্যরচনার নতুন মূল্যায়ন হওয়া দরকার।
পুনশ্চ: শেষে একটি সবিনয় নিবেদন, সত্যজিতের প্রবন্ধ সংগ্রহের সম্পাদক সন্দীপ রায় ও তাঁর সহযোগীদের প্রতি। সত্যজিৎ রায়, 'সন্দেশ' পত্রিকার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৬৭ আর ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ সংখ্যায় ছোটদের জন্য দুই কিস্তিতে একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন "সিনেমার কথা" নামে। প্রবন্ধটি ছিল আবার সচিত্র। সত্যজিৎ ছবি এঁকে শিশু কিশোর পাঠকদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সিনেমার পর্দার মাপজোকের হিসেবও। সেখানেও ছিল যে ছবি খুদেরা দেখে, তা তৈরির বিচিত্র কর্মকাণ্ড। এই লেখাটি কিন্তু 'প্রবন্ধ সংগ্রহ'-তে থাকা দরকার। কোনো কারণে হয়ত বাদ গেছে, এটি পরবর্তী সংস্করণে যুক্ত হওয়া দরকার।
আর শেষে একেবারে অন্য এক কথা। সত্যজিতের প্রবন্ধ সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত তাঁর আরো একটি ধারাবাহিক রচনা।
আমাদের বেশ মনে আছে, আশির দশকে সন্দেশের ছোট সম্পাদকমশাই, টানা বেশ ক বছর সন্দেশে ধারাবাহিক লিখতেন আশ্চর্য সব জন্তু জানোয়ারের আজব কাহিনি। ধারাবাহিকের নাম বোধহয় ছিল "আশ্চর্যন্তু"! সেগুলি উদ্ধার করে সংকলন করলে এক্কেবারে এক অন্য সত্যজিতের সন্ধান পাবে এখনকার পাঠক। এটা করা যায় কি?
Powered by Froala Editor