মানিকলমকারি - ৫৯
আগের পর্বে
যে কোনো গল্প বলায় নাম যে কতটা প্রাসঙ্গিক, তা সত্যজিৎ রায়ের লেখায় বারবার উঠে আসে। ফেলুদার আসল নাম প্রদোষচন্দ্র মিত্র হওয়ার পিছনেও তেমনই ইঙ্গিত রয়েছে। আর সেই ইঙ্গিত লেখক নিজেই খোলসা করেছেন ‘গোঁসাইপুর সরগরম’ গল্পে। পাশাপাশি সেখানে লালমোহনবাবুর নাম নিয়েও রসিকতা করতে দেখা যায় ফেলুদাকে। আর লালমোহনবাবুর ছদ্মনাম জটায়ুর ব্যাখ্যা তো ‘সোনার কেল্লা’-তে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ঠিক তেমনই ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু নামের মধ্যেও একটা আধ্যাত্মিকতার ইঙ্গিত আছে। আর তারিণীখুড়ো জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে তরণ করে এসেছেন, তাই তাও সার্থক নাম। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির চরিত্রগুলোর নাম নির্বাচনেও এই বিষয়গুলি মাথায় রেখেছিলেন সত্যজিৎ। নামের মধ্যে দিয়েই ফুটে উঠেছিল তাদের সমাজ এবং মনের ছবি।
ছবিটির নাম হতে পারত ‘বনভোজন’ কিংবা ‘চড়ুইভাতি’ কিংবা ‘নন্দনকানন’। তবে লেখার ধরন দেখে মনে হয়, শেষ অবধি তিনি ভেবেছিলেন ছবির নাম রাখবেন ‘বাগানবাড়ি’। ছবির গল্পরেখা তখনো তৈরি হয়নি, তবে ক্যারেক্টার স্কেচ একটা করে ফেলেছিলেন। সেই চরিত্রভাবনা থেকে গল্পের একটা ধাঁচাও অনুমান করা যায় বই কী! এমনকি কাকে কোন চরিত্রে নেবেন ভেবে ফেলেছিলেন সেটাও। ছবিটির গল্প ভেবেছিলেন কবে নাগাদ? গল্পের শুরুর লাইনটিই ছিল এই রকম, ‘আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী তিথি। দক্ষিণেশ্বর রায়বাড়িতে আজ বনভোজনের আয়োজন করেছে চাটুজ্যে পরিবার। সবশুদ্ধ চোদ্দজন আত্মীয়স্বজনের অংশগ্রহণ করার কথা আছে। সকাল ৯টা। বৈশাখের খটখটে দিন। রায়েদের বাড়ি প্রায় ৭০ বছরের পুরোনো ৩০০ বিঘে জমির মধ্যে প্রচুর গাছ, পুকুর, ফোয়ারা ইত্যাদি বাগানবাড়ির যাবতীয় অনুষঙ্গ রয়েছে। প্রথম গাড়িতে এসে পৌঁছলেন ইন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, স্ত্রী লাবণ্যলতা, ছোট মেয়ে মনীষা ও ইন্দ্রনাথের শ্যালক অবনীশ।’ এখানেই গল্প লেখা শেষ। আর এগোননি সত্যজিৎ। এরপরের পাতা থেকেই শুরু ‘অভিযান’-এর চিত্রনাট্যের খসড়া। ‘রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী তিথি’ দিয়ে লেখার শুরু হওয়াতে স্পষ্টই বেশ বোঝাই যাচ্ছে ঘটনাকাল ১৯৬১। এমনকি, ওই খসড়া খাতার শুরুতেই এক জায়গায় লেখা অক্টোবর মাসের ১৮-১৯-২০ নাকি ছিল দুর্গাপুজো। এই তারিখের হিসাবেও সময়টা ১৯৬১-ই দাঁড়ায়।
গল্পের চরিত্রগুলি কী রকম ছিল? সত্যজিৎ রায়ের ওই খসড়া অনুসারে, গল্পের নায়কের নাম সুমন্ত্র, বয়স ২৮। সে এক বেকার যুবক। সে সেন্সিটিভ, ডিপলি ইন্ট্রোভার্ট। তবে ‘চাকরির জন্য বাধ্য হয়ে পুরোনো বন্ধু, স্কুল ও কলেজের সহপাঠী, প্রবীরের কাছে যায়। ‘তোর কাকাকে বলে দেখ না যদি কিছু হয়।’--- প্রবীর তাকে বলে অমুক দিনে পিকনিক আছে--- আমাদের সঙ্গে চল--- কাকার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো। তারপর চাকরি কিছুই না--- তোর আবৃত্তি শুনিয়ে দিস--- কাকার আবার কালচার্ড হবার খুব শখ---’ ইত্যাদি। এই প্রবীর ছেলেটি কেমন? সে কলেজে ভালো ছাত্র ছিল। অল্পস্বল্প রাজনীতিও করেছে। তবে রাজনীতি থেকে বহুদূরে এবং ‘দূরে রাখাই কাম্য’ মনে করে। ‘পুরোনো কথা বললে অস্বস্তি বোধ করে।’ সে বেশ বড়োসড়ো সাকসেসফুল চাকুরে। বন্ধুকে চাকরি দেওয়ার ব্যাপারের মধ্যে, নিজের যে অনেককিছু হল আর বন্ধুর যে কিছু হল না এখনো, তা নিয়ে তার একটা অপরাধবোধ আছে। ফলে সুমন্ত্রকে সে নিয়ে আসে। তবে তার এখানে আসার একটা অন্য কারণও আছে। সেই কারণটি হল রুক্মিণী। ‘বন্ধুর সঙ্গের চেয়েও বড় তার কাছে রুক্মিণীর সঙ্গ’। রুক্মিণী সম্পর্কে প্রথম শব্দটিই সত্যজিৎ বসিয়েছেন ‘এ ফ্লার্ট’। ওই প্রবীরের বাবা ইন্দ্রনাথ চরিত্রটির নাম সত্যজিৎ আগে ভেবেছিলেন ‘উপেন’, পরে তা কেটে করেন ‘ইন্দ্রনাথ’। তার পরিচয় হল ‘এ সাকসেসফুল ম্যান। পয়সা করেছে।’ তবে খুব সহজপথে সে পয়সা করেনি। ‘তার যতটা ক্ষমতা, তার অনুপাতে তার উন্নতি হয়েছে বেশি--- কারণ সে তোষামোদ ও কম্প্রোমাইজ্ দুইই করেছে অকাতরে।’ সে ওঠার জন্য কতখানি যে নেমেছে, সেটা আর মনে রাখেনি সে। তার একটা ‘ধর্মের ভড়ং’ আছে। ‘ভেবেছে ধর্মকর্ম করলেই বুঝি পাপস্খালন হয়ে যাবে।’ এই ইন্দ্রনাথের স্ত্রী লাবণ্যলেখার বেশ শান্ত। নিজের দুই মেয়ের দুই ধরনের দুঃখ বেশ বোঝে। তার নিজের ভেতরেও একটা চাপা দুঃখ আছে। প্রতিভা তার ছিল, কিন্তু ইন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘বিয়ের পরে সমস্ত চাপা পড়ে গেছে।’ তার সম্পর্কে সত্যজিৎ লেখেন, ‘স্বামীর সঙ্গে থেকে সব শুকিয়ে গেছে। এককালে দুঃখ পেয়েছে--- কিন্তু এখন সব দুঃখ কাটিয়ে উঠেছে।’ ইন্দ্রনাথ- লাবণ্যের এক ছেলে দুই মেয়ে। ছেলের নাম তো শুনলামই, প্রবীর। দুই মেয়ে--- কণিকা আর মণিকা। কণিকার দশ বছর হল বিয়ে হয়েছে। তবে তার বিবাহের সম্পর্কের মধ্যে একটা চিড় ধরেছে। অন্যদিকে ছোটো বোন মণিকা, এই পরিবারে একটু বেমানান। সে কলেজে পড়ছে। সত্যজিতের ভাবনায় ‘তার ভয় আছে আল্টিমেটলি সেন্সিটিভিটিটা নষ্ট হয়ে যাবে এবং তার বড়ো বোনের মতো হালকা সুপারফিসিয়াল হয়ে যাবে।’ মণিকা নিজে সংগীত ও সাহিত্য ভালোবাসে। সঙ্গে সে এনেছে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। তার ভেতের ‘একটু চাপাও বটে’ আছে। এর পাশেই আছে মণিকার দিদি কণিকার বর বরেন। প্রথমে তার সম্পর্কে সত্যজিৎ বসিয়েছিলেন একটি শব্দ ‘লম্পট’। পরে তাকে কেটে দিয়েছেন। পরে তার সম্পর্কে জানিয়েছেন চিত্রনাট্যকার সে এক অত্যন্ত সাধারণ লোক, ‘হি ইজ্ আনসাকসেসফুল হাজব্যান্ড।’ এর উল্টোদিকে তার স্ত্রী কণিকার স্বভাবের একটা অদ্ভুত দিকের কথা সেই খসড়াতে লেখা ছিল, কণিকার দুই সন্তান থাকা সত্ত্বেও তার স্বামী বরেন স্ত্রী ‘কণিকার দৈহিক ক্ষুধা মেটাতে অক্ষম।’ কণিকাকে তার ‘স্বাভাবিক প্রবৃত্তি দমন করে রাখতে হয়েছে।’ ‘সে চায় যে তাকে সুন্দর দেখাক, লোকে তাকে সুন্দর বলুক। অর্থাৎ একদিনের জন্য সে যেন অন্য পুরুষের অ্যাটেনশন পায়’। আর আছে অবশ্যই কাজের জগতে সফল একটি চরিত্র। বেশ শিক্ষিত। বিদেশাগত। নাম তার তপন চৌধুরি। সত্যজিৎ লিখেছেন, ‘হ্যাজ্ সিন দ্য ওয়ার্ল্ড--- বাট নট ডিপলি এনাফ’। তার সম্পর্কে আরেকটি বাক্য ‘বিয়ে করার যথেষ্ট বাসনা আছে’। এদের পাশাপাশি ছিলেন প্রকৃতিকে ভালোবাসেন এমন চরিত্র অবনীশ--- ইন্দ্রনাথের শ্যালক আর ইন্দ্রনাথের বন্ধু পরিমল ও তাঁর স্ত্রী সুলেখা। একেবারে পরিপাটি সাধারণ সুখী বাঙালি মধ্যবিত্ত দম্পতি। এদের সম্পর্কে সত্যজিৎ খসড়া খাতায় লেখেন, ‘স্বামীর পয়সা হয়েছে কিন্তু স্ত্রীর কোনো মানসিক পরিবর্তন হয়নি--- গায়ে কিছু গয়না বেড়েছে হয়ত।’ নির্বিবাদে পরিমল মেনে মেনে চলে ইন্দ্রনাথের কথা আর সেইমতোই সুলেখাও লাবণ্যের সব হ্যাঁ-তে হ্যাঁ বলাটাই স্বাভাবিক মনে করে। পাশে একটা বৃত্তের মধ্যে সত্যজিৎ লিখে রাখেন, গল্পের মাঝখানে এরা ‘দক্ষিণেশ্বরে চলে যায়’। বাগানবাড়িতে পিকনিক করতে গেলেও, মন্দিরে একবার ঘুরে আসাটা তাদের আর পাঁচটা নৈমিত্তিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে বলেই বুঝি ঘুরে আসে তারা।
আরও পড়ুন
নামের আরো গল্পসল্প
নিশ্চয়ই আর পাঠকদের কাছে বলতে হবে না, এটি কোন ছবির পূর্ব-খসড়া? ১৯৬১ সালেই এই ছবির লেখা থামিয়ে সত্যজিৎ লিখতে শুরু করলেন ‘অভিযান’ ছবির খসড়া চিত্রনাট্য আর এই ছবিটিই বেশ বদলে গিয়ে হয়ে উঠল ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিটি। এই ‘বাগানবাড়ি’-র ইন্দ্রনাথ লাবণ্য-র নাম বদলালো না। ইন্দ্রনাথের শ্যালক অবনীশ হলেন জগদীশ। গল্পের বড়োবোন কণিকা পরে হল ‘অণিমা’। তার বর বরেন পরে হল শঙ্কর। অণিমার ভাই প্রবীর হল অনিল। রুক্মিনী হল লিলি। ছোটো বোন মণিকা পরিবর্তিত হল মনীষাতে। তপন চৌধুরি হল মিস্টার ব্যানার্জি আর গল্পের নায়ক সুমন্ত্র হল অশোক। সবচেয়ে বড়ো কথা ওই বাগানবাড়ি হয়ে উঠল দার্জিলিং। প্রথমে গল্প শুরু হয়েছিল বনভোজনে যাওয়া থেকে, শেষে গল্প শুরুই হচ্ছে দার্জিলিং-বেড়ানো শেষ করে এই পরিবারের লোকজনের নীচে নেমে আসার ঠিক আগের দিনটি থেকে।
আরও পড়ুন
নামান্তরের অন্তরে
মজার ব্যাপার হল এই খসড়া খাতায় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ লেখা শুরু হচ্ছে না। কিন্তু এই খসড়াখাতার পিছনের একটি পাতায় একটি ক্যালিগ্রাফিতে কাঞ্চনজঙ্ঘা শব্দটি ইংরিজিতে লেখা ছিল।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের লেখা নাটিকা
আরও পড়ুন
নামাঙ্কনের কলমকারি হরফদারি
শেষে বলা যাক, সেই কলমকারিতে সত্যজিতের প্রাথমিক কাস্টিংয়ের ভাবনাটি কেমন ছিল? গৃহকর্তা ইন্দ্রনাথের চরিত্রের পাশে ‘ছবি’ শব্দটিই ছিল। তবে তার পাশে একটি জিজ্ঞাসা চিহ্ন। তখনো লাবণ্যের চরিত্রের জন্য কারো নাম লেখেনননি সত্যজিৎ, পরে এই চরিত্রটিতে অভিনয় করেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইন্দ্রনাথের ছেলে প্রবীর আর ইন্দ্রনাথের শ্যালক অবনীশের চরিত্রে প্রথম থেকেই ভেবেছিলেন যথাক্রমে অনিল চট্টোপাধ্যায় আর পাহাড়ী সান্যালের নামই। বড়োবোন কণিকার চরিত্রে পরে অভিনয় করেন অনুভা গুপ্ত, কিন্তু তখন সত্যজিৎ ভেবেছিলেন কণিকা মজুমদারের কথা আর এই বড়োবোনের স্বামীর চরিত্রে প্রথমে সত্যজিৎ ভেবেছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। মানে ঠিক এর আগের বছরেই ‘মণিহারা’-র সেই মণিমালিকা- ফণিভূষণের অদ্ভুত জুটিকে আরেকভাবে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন তিনি। সেই গল্পের তপন বা ছবির ব্যানার্জি চরিত্রে প্রথম থেকেই ছিলেন এন বিশ্বনাথন। আর বাকি থাকলেন প্রধান দুই চরিত্র গল্প খসড়ার সুমন্ত্র- মণিকা বা ছবির অশোক- মনীষা। পরে তো আমরা দেখেইছি তখন নতুন দুজন অভিনেতা অরুণ মুখোপাধ্যায় আর অলকনন্দা রায়কে। প্রথমে সেখানে সত্যজিৎ কার কথা ভেবেছিলেন জানেন? সুমন্ত্র বোস চরিত্রের পাশে লেখা ছিল শমিত ভঞ্জ-র নাম। আর বিকল্পে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর ছবির মনীষার চরিত্রে ভেবেছিলেন শর্মিলা ঠাকুরকে। আর এই শর্মিলা ঠাকুরের বিষয়ে একটি অদ্ভুত ছোট্টো নোটস ছিল ওই খসড়া খাতায়। এইভাবে চরিত্রের পাশে তার অভিনেতার সম্পর্ক লিখে রাখার বিষয়টি বেশ চমৎকার আর অভিনব। সত্যজিৎ মনীষা বা গল্পখসড়ার মণিকা সম্পর্কে লিখেছিলেন, সে ‘সঙ্গীত ও সাহিত্যপ্রিয়। তবে হালকা জিনিসের দিকে যে একেবারে ঝোঁক নেই তা নয়। কিন্তু predominatly contemplative’। এই predominatly contemplative বা মূলত অন্তর্মুখী গভীর শব্দটির পাশে একটি বন্ধনীর মধ্যে সত্যজিৎ লিখলেন ‘like রিঙ্কু’। কে না জানে, শর্মিলা ঠাকুরের ডাক নামই তো রিঙ্কু! ভাবা যায়, তাঁর গল্পের চরিত্রের ধরন লিখতে গিয়ে সত্যজিৎ বসাচ্ছেন সেই চরিত্রের যে অভিনেত্রীর কথা তিনি ভেবেছেন, তাঁরই কোনো একটি স্বভাব-স্বাতন্ত্র্যের কথা! শর্মিলা ঠাকুর কি জানেন, তাঁর সম্পর্কে সত্যজিৎ এই বিরাট কথাখানি লিখে গিয়েছেন তাঁর খসড়া খাতায়।
Powered by Froala Editor