মানিকলমকারি - ৫৮
আগের পর্বে
রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ গল্পের অপূর্বকৃষ্ণ সত্যজিতের সিনেমায় নাম বদলে হয়েছে অপূর্ব। একই সিনেমায় আরও নানা নাম বদলের কাহিনি আছে। যেমন যে পোস্টমাস্টারের কোনো নামই রাখেননি রবীন্দ্রনাথ, সিনেমার প্রয়োজনে তার একটি নাম দিতে হল। সত্যজিৎ তাঁর নাম রাখলেন নন্দলাল। আবার ‘নষ্টনীড়’ গল্প অবলম্বনে চারুলতা সিনেমায় চারুর দাদার নাম রবীন্দ্রনাথ দুরকম লিখেছেন। একজায়গায় উমাপতি, এক জায়গায় উমাপদ। ভূপতির সঙ্গে নামের সাদৃশ্য ঘোচাতে উমাপদ নামটাই বেছে নিলেন সত্যজিৎ। ভূপতি আর অমলের পদবীও তাঁরই সংযোজন। তবে ‘তিন কন্যা’-য় অপূর্বকৃষ্ণের নাম বদল সম্ভবত আরও এক সাদৃশ্য ঘোচানোর জন্য। আর তা হল অপুর নামের সঙ্গে সাদৃশ্য। বিদেশি দর্শকদের মনে হতেই পারে, অপূর্বই বুঝি অপু। এই সাংস্কৃতিক বেড়াজালটাই মুছে দিলেন সত্যজিৎ।
প্রদোষচন্দ্র মিত্র--- নামটি নিয়ে মজা করেছিলেন মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য। ‘গোঁসাইপুর সরগরম’ কাহিনির সেই যে ভদ্রলোক আত্মা নামাতেন, সেই রহস্যময় চরিত্র মৃগাঙ্কবাবু। তাঁর ঘরে পৌঁছনোমাত্র তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘সন্ধ্যাশশী বন্ধুটি কোন জন?’ লালমোহনবাবু বুঝতে না-পারলেও ফেলুদা জানিয়েছিল তারই নাম ‘সন্ধ্যা শশী বন্ধু’--- ‘প্রদোষ মানে সন্ধ্যা, চন্দ্র হল শশী আর মিত্র হল বন্ধু!’ সেই মৃগাঙ্কবাবুই ইঙ্গিতধর্মী ভাবে ফেলুদাকে বলেছিলেন, ‘সূক্ষ্ম সাল শস্যের কাজে এসেছেন আপনি, একথা বললে আপনি ছাড়া আর কেউ কি বুঝতে পারবে?’ সত্যিই কেউ বুঝতে পারেনি যে, সেদিন মৃগাঙ্ক ভটচাজ ‘সূক্ষ্ম সাল শস্য’ বলতে বুঝিয়েছিলেন সূক্ষ্ম মানে অণু, সাল মানে সন আর শস্য হল ধান--- সব মিলিয়ে অনুসন্ধানের কাজেই যে ফেলুদার আসা সেটা যেন বুঝে গেছেন মৃগাঙ্ক, বোঝাতে চেয়েছিলেন তা। আর ফেলুদার নামনিয়ে এত মজার ধাঁধা হতে পারে শুনে পরে লালমোহনবাবু যখন আক্ষেপ করলেন, তাঁকে সান্ত্বনা দিতে লালমোহনের নাম নিয়ে ধাঁধা বেঁধেছিল ফেলুদা স্বয়ং। সেই বিখ্যাত ‘রক্তবরণ মুগ্ধকরণ নদীপাশে যাহা বিঁধিলে মরন।’ রক্তবরণ--- লাল, মুগ্ধকরণ--- মোহন, নদী--- গাং আর যাহা বিঁধিলে মরন, তা হল গুলি। লাল-মোহন-গাং-গুলি! লালমোহন কেন নিজের ছদ্মনাম জটায়ু নিয়েছিলেন, তারও একটা কৈফিয়ত সেই ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে দিয়েছিলেন। রামায়ণের সেই ‘বঢ়িয়া পকষি’ অসমসাহসী জটায়ু-র ওই অসমসাহসিকতার নয়া অবতার হলেন রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনির লেখক জটায়ু।
সত্যজিৎ কিন্তু এই নামকরণের নানা রকম ধরন তৈরি করেছেন তাঁর লেখাজোখায়। যেমন ধরা যাক, বিজ্ঞানীর নাম ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু--- নাম হিসেবে অসম্ভব অভিনব। বিজ্ঞানী বলেই আশ্চর্যভাবে পদবি দিয়েছেন শঙ্কু--- একটি জ্যামিতিক আকার যে বাঙালির পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে, সেটাই অভিনব। তার ওপরে নাম তাঁর ত্রিলোকেশ্বর। শঙ্কুর গল্প যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের মনে আছে, আর মানিকলমকারির প্রথম দিকের এক কিস্তিতেও দেখানো গিয়েছিল, শঙ্কুর গল্প প্রথম দিকে পাক্কা সায়েন্স ফিকশন তো ছিল না--- একটা পুরোনো ভারতীয় ও প্রাচীন সভ্যতার অধ্যাত্মলোকের রহস্যলোক আর বিজ্ঞানলোকের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল শঙ্কুর গল্পের জগৎ। তাই নামে সহজেই বসে ত্রিলোকেশ্বর। সেই যুক্তিতেই ফেলুদার নাম প্রদোষচন্দ্র কেন, তার একটা লুকোনো ইঙ্গিত ছিল ‘সোনার কেল্লা’-য় সিধুজ্যাঠার সংলাপে। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের মনের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে তোমার কারবার’। সেই ‘অন্ধকার দিক’ বা সন্ধ্যা-ই ফেলুদার নামে হয়েছে ‘প্রদোষ’। কিন্তু শুধু অন্ধকার প্রদোষ তো নয়, তার মধ্যে চন্দ্ররূপ আলোটাও যে জ্বালিয়ে তিনি বন্ধুর মতো পথ দেখান--- তাই প্রদোষ নাম হলেও, মধ্য নাম চন্দ্র ও পদবি মিত্র। লক্ষণীয়, প্রদোষ ছাড়াও সন্ধ্যা আর অন্ধকার-বাচক বিভিন্ন শব্দের মধ্যে প্র-দোষ শব্দের মধ্যে ওই ‘দোষ’ শব্দটিও আছে, ফলে গোয়েন্দা গল্পে যে দোষ-এর সন্ধানই ফেলুদার মূল কাজ---তাই প্রদোষ নামটিও সবচেয়ে জুতসই। ফেলু--- নামটি হল একেবারে উল্টো শব্দের মজা। তোপসের বাবা যখন তোপসের মা-কে বলেন, ‘ফেলুর মতো মাস্টার আছে কি সেই স্কুলে?’ তখন বোঝা যায়, স্কুলে ফেলুর মতো মাস্টার কথাটার মধ্যেই আছে ফেলুদা নামকরণের মজা।
অথবা ধরা যাক, গল্পবলিয়ে তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন তারিণীখুড়ো। এই গল্প-বলিয়ে-খুড়ো নানা বিপদের ভেতর থেকে তারণ করেন বলেই তিনি হলেন তারিণীচরণ। এই ধরনের ফ্র্যাঞ্চাইজির চরিত্রের নামকরণে কী ধরনের সচেতন ভাবনা থাকে, তা বলে গিয়েছিলেন স্বয়ং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে জিজ্ঞাসা করে হয়েছিল, ‘ব্যোমকেশ যে বক্সী হলেন তা কি নামের অনুপ্রাসের সুবিধার জন্য?’ এর উত্তরে শরদিন্দু বলেছিলেন, ‘তা ঠিক নয়, তবে চেয়েছিলাম ব্যোমকেশ নিজে যেমন অসাধারণ, নামটির মধ্যে তেমনি অসাধারণত্ব থাক। অনেক নাম মনে এসেছিল। কোনোটিই আর পছন্দ হয় না। শেষে ব্যোমকেশ বক্সী পছন্দ হল। নায়কের নামটি ব্যক্তিত্বপূর্ণ হওয়া চাই। ধরুন, শার্লক হোমস না হয়ে যদি হত ডেভিড হোমস, তাহলে কি অমন ব্যক্তিত্ব আসত?’ এমনকি, ব্যোমকেশকে ব্রাহ্মণ না করে কায়স্থ বক্সী পদবি দেওয়ার ব্যাপারেও শরদিন্দুবাবুর একটা ভাবনা ছিল। সে ভাবনা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু ভাবনা তাঁর একটা ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা কায়স্থরা ব্রাহ্মণদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি ধরে।’ তবে ব্যোমকেশ নামের নানাবিধ মাত্রার সন্ধান দিয়েছিলেন আচার্য সুকুমার সেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, ব্যোমকেশের সঙ্গে হোমস-এর নামে অনুপ্রাসের ঝঙ্কারে মিল আছে। তাছাড়া লিখেছিলেন, ‘ব্যোমকেশ নামের ধ্বনিগুচ্ছে ধোঁয়া, বুঁদ হয়ে থাকা, ধ্যানমগ্ন মহাদেব ইত্যাদি প্রাসঙ্গিক- অপ্রাসঙ্গিক শব্দের ইশারা আছে।’ এমনকি বক্সী পদবি যে বকশিস শব্দের ‘স-বর্জিত বকসী’--- এমন কথা বলে, আচার্য সেন বলেছিলেন, ‘ব্যোমকেশ পুলিশের মতো চাকরি করেন না, উকিলের মতো ফী-ও নেন না। তবে বকশিসের--- প্রশংসা, যশ, আত্মতৃপ্তি ইত্যাদি ফাঁকা দক্ষিণার প্রত্যাশা অবশ্যই করেন। তাই ব্যোমকেশের পদবি স-বর্জিত বকসী।’ অন্যদিকে ‘সত্যান্বেষী’ শব্দের মূলে সত্যানুসন্ধান আর সত্যবতীর প্রিয়তম--- এই দুই শব্দের ইঙ্গিতও সকৌতুক লক্ষ করিয়েছিলেন সুকুমার সেন মশাই।
আরও পড়ুন
নামান্তরের অন্তরে
আরও পড়ুন
সত্যজিতের লেখা নাটিকা
এর মধ্যেই চরিত্রের নামকরণ প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির কথাও। ছবির মূল চরিত্র রায়বাহাদুর ইন্দ্রনাথ চৌধুরি। তাঁর স্ত্রীর নাম লাবণ্য। তাঁদের দুই ছেলে মেয়ে--- তাদের নাম অনিল আর মনীষা। ইন্দ্রনাথ শব্দটির মধ্যেই আছে আত্মম্ভরিতার ইঙ্গিত আর তাঁর স্ত্রী লাবণ্য-র নামেই রয়েছে সেই চরিত্রোচিত কোমলতার অনুষঙ্গ। তাঁদের ছেলে অনিল--- নামেও অনিল, কাজেও যে অনিল বা বাতাসের মতোই ফুরফুরে লঘু। তার সেই লঘুত্বেই দোলে যে মেয়েটি, তার নাম লিলি। লিলি-র সঙ্গে আসলে যে-ছেলেটির সম্পর্ক তৈরি হয় তার নাম ববি। লক্ষণীয়, অনিলের ধরনধারণে না-থাক তার নামের মধ্যে যে বাঙালিয়ানা আছে, তাকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলেছে লিলি-র আর ববি-র নাম। ফলে তারা একই সাংস্কৃতিকবৃত্তের ভেতরে যে আছে, তা তাদের নামের মধ্যেই প্রকাশিত। কারণ, ববি চরিত্রটি তো পুরো কাহিনিতে কোথাও উল্লিখিত নয়, তাকেও দেখাও যায় না। নামের ধরনেই লিলি-র সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরি করে দেন চিত্রনাট্যকার। আর এই নামের ধরন নিয়ে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতেই দ্বিতীয় শব্দের খেলাটি ব্যবহার করবেন সত্যজিৎ ছবির একেবারে শেষে। সাধারণ ঘরের ছেলে অশোক, ইন্দ্রনাথের ছোটো মেয়ের নাম ভাবে মণিকা--- সে তাকেও ভেবেছিল ওই ধনাঢ্য পরিবারের একজন কি না--- তাই তার মনে হয়েছিল, তার নামও বুঝি মণিকা। সেই ভুল ভাঙিয়ে দেয় মনীষা। সে মৃদুস্বরে জানায়, তার নাম মণিকা নয়, মনীষা। মানে অর্থগৌরবী নাম ‘মণিকা’ নয়, তার নাম ‘মনীষা’--- মনের ঐশ্বর্যেই সে ধনী। মনীষার ওই নামোচ্চারণেই বোঝা যায় সে শুধু রায়বাহাদুর ইন্দ্রনাথের কন্যা নয়, সে লাবণ্যেরও মেয়ে। একটি নামকে ব্যবহার করেও তাহলে একটা গল্প বলা চলে। এ-ও তো এক আশ্চর্য কলমকারি!!
আরও পড়ুন
নামাঙ্কনের কলমকারি হরফদারি
Powered by Froala Editor