মানিকলমকারি- ৫৪
আগের পর্বে
তারিণীখুড়োর মতোই সত্যজিতের ছোটকাকা সুবিমল রায় ছিলেন এক অসাধারণ গল্প বলিয়ে। তিনি লিখেছেন খুবই কম। পরে তাঁর বলা গল্পগুলোকেই সংকলন করেন লীলা মজুমদার, আর সেই বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকেন স্বয়ং সত্যজিৎ। তারিণীখুড়োর ১৫টি গল্পেও যেন সেইসব ভূতেদেরই ছায়া ফিরে আসে। এখানে তারিণীখুড়ো ভূতকে চারভাগে ভাগ করেন। একদল প্রেতাত্মা, একদল ছায়ামূর্তি, একদল নিরেট ভূত। আরেকটি হল নরকঙ্কাল। তবে নরকঙ্কাল যে প্রকৃত অর্থে ভূত নয়, সে-বিষয়েও সচেতন করে দেন খুড়ো। তবে এই চাররকম ভূত ছাড়াও আরেক ধরণের ভূতের কথাও এসেছে তাঁর গল্পে। ‘জুটি’ গল্পে মনে করিয়ে দেন ভূত শব্দের আরেক অর্থ অতীত। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তারিণীখুড়োর প্রতিটা গল্পই আসলে সেই ফেলে আসা অতীতের গল্প। নির্বাক যুগের চলচ্চিত্র থেকে ক্রিকেটের মহারাজা রঞ্জি যেখানে মিলেমিশে যান।
সিনেমা দেখা হয়। সিনেমা লেখাও হয়। সিনেমা নিয়ে লেখা? সিনেমা নিয়ে লেখা বলতে, হয় সিনেমার রিভিউ বা সিনেমা নিয়ে নানা তাত্ত্বিক আলোচনা, কিংবা সিনেমার নেপথ্যলোক নিয়ে নানা কিসসা আর খবর। সত্যজিৎ যে শুধু একজন সিনেমা-করিয়ে নন, সিনেমা নিয়ে নানা ধরনের সিরিয়াস লেখালেখিরও সূচনাও যে তাঁর হাতেই শুরু, সে বিষয়ে আমরা এই কলমেই আগে এক সময়ে তিন কিস্তি ধরে আলোচনা করেছি। এবারে সেই সিনেমা-বিষয়ক আলোচনা নিয়েই এক নতুন ধরনের গদ্যের কথা--- সেই লেখার সূচনাও তাঁর হাতে, আর কী আশ্চর্য, এখনো সেই ধারায় তাঁর তেমন উত্তরাধিকার আর তৈরি হল না। একটি অভিনব গদ্যবিষয়ের সূচনা করেছিলেন সত্যজিৎ--- সেটি হল, সিনেমার আড্ডা বা বলা ভালো, শুটিংয়ের বৈঠকি গপ্পো। বইয়ের নাম ‘একেই বলে শুটিং’। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৭৯ সাল। এরপরে বইটি পরপর অনেকবার ছাপা হলেও, বইটির নতুন একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩-৯৪ সালে, অর্থাৎ লেখকের মৃত্যুর পরে। লেখকের মৃত্যুর পরে তাঁর লেখা বইয়ের নতুন সংস্করণ করা উচিত কি না--- তা নিয়ে বইতিহাসিকরা মতামত দেবেন। কিন্তু প্রকাশকের পক্ষ থেকে এই দোষ ঘটানো হয়েছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও! কিন্তু সে এক অন্য গল্প। অন্যত্র আলোচ্য।
আপাতত তথ্য হিসেবে বলে নিই, বইটির প্রথমাবধি সংস্করণে ছিল পাঁচটি লেখা, পরে যুক্ত হল আরো দুই--- হল সাত। বইয়ের বর্তমান সংস্করণের প্রথম ও শেষ লেখাটি পরবর্তী সংযোজন। বইটির বিষয়টি চমৎকার ধরিয়ে দিয়েছেন সত্যজিৎ। সত্যজিৎ এমনিতে তো বইয়ের ভূমিকা লেখার লোক নন, কিন্তু যেহেতু এই বইয়ের বিষয়খানাই নতুন, তাই নতুন পাঠকদের জন্য টুকরো কথায় ধরিয়ে দিলেন বইয়ের সারকথাখানা।
সত্যজিৎ লিখলেন, ‘ফিল্ম তৈরির কাজটাকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম হল লেখা, দ্বিতীয় ছবি তোলা আর তৃতীয় ছবি জোড়া।’ এই মাঝের পর্ব, মানে শুটিং-পর্বের গল্পগাছা নিয়ে গোটা একটা বই। ‘ভূমিকা’-য় লিখলেন, ‘শুটিং পর্বের কাজেই সবচেয়ে বেশি ঝামেলা আর পরিশ্রম। এর কাজটা অনেক সময় স্টুডিওর ভিতর না হয়ে হয় বাইরে, প্রাকৃতিক পরিবেশে।’ সেই ‘সবচেয়ে বেশি ঝামেলা আর পরিশ্রম’-এর পর্বটা নিয়ে, তার হরেক অভিজ্ঞতা আর ঘটনামালা নিয়ে তিনি বই লিখলেন ছোটোদের জন্য। ঘটনাগুলো শুনতে ভালো আর শুনতে বেশ জমজমাটিয়া একটা ব্যাপার শুধু নয়, এই ঘটনাগুলি ছোটোদের শোনানোর অন্য একটা সুগভীর তাৎপর্য আছে তাঁর কাছে। এই বইটি লেখার প্রকৃত উদ্দেশ্য বোধ হয় তাই-ই। সেটি হল, হাজার ঝক্কি আর লাখো-লাখো ঝঞ্ঝাটওয়ালা এই সত্যিকারের গল্পগুলির কথা বলে, সত্যজিৎ লিখলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা ঘটে বলেই অনেক সময় মেহনতটা আর গায়ে লাগে না। আর বাধা যেসব আসে, সেগুলো অতিক্রম করে কাজটা যদি ঠিকমতো উডরে যায়, তাহলে তো আর কথাই নেই।’ এটাই তাহলে মূল ভাবনা। কাজের মধ্যে হাজার-লাখো ঝঞ্ঝাট আসবে তবে সেই ঝুটঝামেলার মধ্য থেকে সুন্দর করে কাজটা করে নেওয়ার প্রেরণাই হল এই লেখাগুলি। মোট তিনটে জিনিস। এক, বিপরীত অবস্থার মধ্যে কাজ করতে জানা। দুই, ধীরস্থির হয়ে কাজ করার গল্প আর তিন, যে সিনেমাটা আজকের খুদেরা এক নিমিষে দেখছে, তার পিছনে তারও তৈরি হওয়ার গল্পটা জানলে, তারাও আগামীদিনে ভালোবাসতে শিখবে ছবিকে--- বুঝতে শিখবে পর্দায় যেটা মাত্র কয়েক মিনিট বা কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখছে তারা, তার পিছনে কত মানুষের কত ধরনের পরিশ্রম আর কত তামঝাম আছে। কোনো সিনেমাকে এক কথায় ভালো আর ভালো-না বলার আগে, সেই অনেক মানুষের পরিশ্রমটাকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে নতুন পড়ুয়া। এতগুলো ভাবনা নিশ্চয়ই তাঁর মনের ভেতরে ছিল, কিন্তু সেই ভাবনাগুলোর উপরিতলের প্রকাশ কতটুকু? প্রকাশ হল, একরাশ গল্প-বলা। ঠাকুর একেও বুঝি বলতেন প্রকৃত লোকশিক্ষে।
আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর পঞ্চভূত
প্রথমে এই বইতে শুটিংয়ের গল্প ছিল ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবি থেকে তিনটে আর ফেলুদা-সিরিজের দুটো ছবি থেকে দুটি। পরে যে দুটি লেখা যুক্ত হল তার একটি ‘পথের পাঁচালী’ অন্যটি ‘হীরক রাজার দেশে’ বিষয়ক। মানিকলমকারি-র পাঠকের কাছে এই লেখাগুলির গল্পগুলি ফিরে-বলা বাহুল্য। বরং অন্য একদিক থেকে পড়ে দেখা যাক লেখাগুলি।
আরও পড়ুন
গল্পকার তারিণীখুড়োর গল্প
আরও পড়ুন
সোনার কেল্লার সংলাপ
বইয়ের গুগাবাবা বিষয়ক দুটি লেখার একটির নাম ‘বাঘের খেলা’ আরেকটির নাম ‘হুন্ডি-ঝুন্ডি-শুন্ডি’। প্রথমটি গুপি-বাঘার সামনে সেই বাঘ হাজির হওয়ার বিখ্যাত দৃশ্য আর দ্বিতীয়টি শস্যশ্যামল শুন্ডিতে যাওয়ার আগে গুগাবাবার একবার বরফের দেশ ঝুন্ডি আর তারপরেই মরুপ্রদেশ হুন্ডি-তে যাওয়ার দৃশ্যের শুটিংয়ের গল্প। ছবিতে দুটি দৃশ্য কতক্ষণ দেখা যায়, তার একটা হিসেব কষা যাক। জঙ্গলে বাঘা বাঘকে দেখতে পেল আর বাঘ চলে গেল--- এই গোটা দৃশ্যটার সময় কতক্ষণ? মাত্র এক মিনিট কুড়ি সেকেন্ড। তার মধ্যে পর্দায় বাঘকে দেখা গেছে কুড়ি সেকেন্ড--- বাকি এক মিনিটে পর্দায় গুপিবাঘা আছে, তাদের কথাবার্তা থেকে বোঝা যাচ্ছে বাঘ আছে, কিন্তু পর্দায় বাঘ নেই। তার মানে, বাঘের থাকার ওই মাত্তর কুড়ি সেকেন্ড শুটিংয়ের গল্প ‘বাঘের খেলা’। আর ‘হুন্ডি-ঝুন্ডি-শুন্ডি’-র অংশটুকু পর্দায় দেখা যায় দেড় মিনিট! এই দেড় মিনিটের আর কুড়ি সেকেন্ডের দৃশ্য তোলার হাঙ্গামা নিয়ে দুটো লেখা! শুধু কি হাঙ্গামার কথা? সঙ্গে আছে বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে পারার কত না কৃৎকৌশলের কথা। হলিউডে পশুপাখি ব্যবহার করার জন্য কত ধরনের সুবিধা আছে, আর আমাদের সামনে সেই সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও যে কতভাবে সেই কাজটা হতে পারে, এই লেখা সেই গল্পও তো বলে। এই লেখা তো সেই গল্পও বলে, যেখানে শুনতে পাই, বিজ্ঞানবুদ্ধির আর লগ্নির হাজার তকনিকি সুবিধা না থাকলেও, এখানে সামান্য একটি সহজ উপায়ে কীভাবে তৈরি হতে পারে সোঁ-ও-ও-ও করে গুগাবাবার আকাশে উড়ে যাওয়ার মুহূর্ত আর সাঁ-ই-ই-ই করে আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসার দৃশ্য। ক্যামেরার দৃষ্টিসীমার বাইরে লম্বা মাচা বেঁধে তার উপর থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়ার দৃশ্য তুলে, তাকেই উল্টো করে চালিয়ে গুগাবাবার উড়ে যাওয়ার দৃশ্য আর তাকেই সোজা করে চালিয়ে লাফিয়ে বরফে পড়ার দৃশ্য তো আমাদের চোখে ম্যাজিক তৈরি করে। সেই ম্যাজিকের গল্প বললে, সেই গল্পশোনাটাও তো ম্যাজিকের মতোই আকর্ষক। অথচ, পর্দায় দেখতে পাওয়ার সময় মাত্র ওই দেড় মিনিট। দেড় মিনিটের জন্য সদলবলে বীরভূমের গ্রাম থেকে সিমলা আর সিমলা থেকে রাজস্থানের থর মরুভূমি! সিনেমার ম্যাজিককে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার এই রহস্যটিকে ভালোবাসতে শেখাটাও তো সিনে-পড়ুয়ার কাজ। মনে করে দেখুন, সময়টা তখন সবে সাতের দশক। এক নতুন উপায়ে সিনেমাকে ভালোবাসতে আর সেই সিনেমা-পড়া শেখাচ্ছেন সত্যজিৎ। কথাখানা যে আকস্মিক নয়, তা বেশ বোঝা যাবে, সত্যজিৎ যখন এক্কেবারে অঙ্ক কষে বোঝাবেন ছবির শুটিংয়ের সঙ্গে ছবির সময়ের হিসেবখানা। লিখবেন, ‘‘যারা ফিল্ম তৈরি করে তাদের একটা হিসেব আছে যে, দিনে যদি তিন মিনিটের ছবি তোলা যায়, তাহলে বুঝতে হবে যথেষ্ট কাজ হয়েছে।’’ তারপরে অঙ্কের হিসেব হাজির করবেন তিনি। লিখবেন, ‘‘তিন মিনিটের ছবি মানে পর্দায় দেখাতে যেটা তিন মিনিট সময় নেবে। এই হিসেবেই ছবি পর্দায় চলবে ২ ঘণ্টা অথবা ১২০ মিনিট, সে ছবি তুলতে গড়ে লাগে ৪০/ ৫০ দিন।’’ গল্পের সঙ্গে এই হিসেবটিকে বুঝিয়ে দেওয়ার মধ্যে আসলে আছে ওই সিনেমা-শিক্ষকের পাঠক্রম। শুধু পড়তে জানলেই হল।
আরও পড়ুন
ছন্দের জাদুকর সত্যজিৎ
পুরো ‘একেই বলে শুটিং’ পড়লে এক খুদে পড়ুয়ার কাছে ফিরে ফিরে আসবে অন্য একটি বিষয়ও। সেটি হল, সিনেমায় নানা রকমের জন্তু জানোয়ারের ব্যবহার। যেমন ধরা যাক, ‘বাঘের খেলা’-য় আর ‘তোমার পায়ে পড়ি বাঘমামা’ লেখ দুটিতে বাঘ আর ‘হাল্লার রাজার সেনা’ ও ‘উট বনাম ট্রেন’ লেখায় উট। ‘ফেলুদার সঙ্গে কাশীতে’ ছিল কাশীর ষাঁড়। এমনকি ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে অপুর পিছন পিছন হেঁটে-চলা কুকুর, খুব মজার ছবিতে একটি মনুষ্যেতর প্রাণীকে দেখতে পাওয়া। বিশেষ করে মনুষ্যেতর প্রাণীকে যখন দেখা যায় সুশৃঙ্খলভাবে ক্যামেরার সামনে, তার একটা অন্য আনন্দ আছে। তবে তাকে সামলাবার ঝক্কিটাও তো বুঝতে হবে খুদে দর্শককুলকে।
এবার একটা একেবারে ভিন্ন গল্প বলে আজকের কিস্তি গোটানো যাক। গুগাবাবা-র সঙ্গে ভূতের রাজার দেখা হয়েছিল যে বনে, তার নাম কী? গল্পে নেই, গুপি গাইন বাঘা বাইন সিনেমাতেও নেই। তবে তার একটা নাম পাওয়া যাবে গুগাবাবা সিরিজের তিন নম্বর ছবি ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’-তে। ব্রহ্মানন্দ আচার্য যখন তাদের বশ করার কথা বলে আর তারা যখন ভূতের রাজার কাছে জানতে চায়, তাদের কেউ বশ করতে পারবে কি না, তখন ভূতের রাজাকে কোথায় পাওয়া যাবে, সেই কথায় গুপি বলে, সেই বনের নাম। নতুন গাঁ--- নতুন গাঁয়ের বাঁশবন। কী অদ্ভুত ব্যাপার, যারা ‘একেই বলে শুটিং’ পড়েছেন, তাদের মনে পড়বে, এখানে সত্যজিৎ জানান, ‘সিউড়ি আর রামপুরহাটের কাছাকাছি’ ‘নতুন গাঁ নামে একটা গ্রামকে করা হয়েছিল গুপির গ্রাম। সেখান থেকে মাইল পনেরো দূরে ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে একটা বাঁশবন বাছা হয়েছিল গুপি বাঘার প্রথম সাক্ষাৎ আর বাঘের দৃশ্যটা তোলার জন্য।’ ওই লোকেশনের গ্রামনামই বহু পরে, ফিরে এসেছে নতুন গাঁয়ের বাঁশবন নামে গুগাবাবা-র তিন নম্বর ছবিতে।
Powered by Froala Editor