মানিকলমকারি— ৫০
আগের পর্বে
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিভাবান ছড়াকার সুকুমার রায়। আর সত্যজিতের মধ্যেও সেই প্রতিভার স্ফুরন দেখা গিয়েছিল অচিরেই। ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ তো ছন্দের এক অপূর্ব পাঠ। ছড়ার দলবৃত্ত ছন্দকেই আবার নিজের মতো করে ভেঙে নিয়েছেন সত্যজিৎ। কোথাও আবার একই ছড়াকে চার মাত্রার সঙ্গে পড়া যায় পাঁচ মাত্রাতেও। সংলাপ লেখার সময়েও প্রকাশ পেত তাঁর ছন্দের জ্ঞান। এখানে অবশ্য শব্দের মাত্রাজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে সংলাপের গতিকেও কাজে লাগাতেন সত্যজিৎ। ‘হীরক রাজার দেশে’-তে অনুপ্রাসের ব্যবহার তো রীতিমতো মুগ্ধ করে।
দৃশ্যটি ছিল এই রকম। হীরক রাজার সভায় বৈজ্ঞানিক তাঁর অসামান্য মগজধোলাই যন্ত্রের কথা শোনানোর পরে, হীরক রাজা বললেন, ‘গবেষক, হিরা তো তোমার খুব প্রিয়?’ তার উত্তরে বৈজ্ঞানিক বললেন, ‘হিরা বড়ো লোভনীয়।’ বিজ্ঞানীর এই কথায় রাজা তার চোখের সামনে বাক্সো থেকে হিরের হার দোলাতে দোলাতে বলে, ‘তোমার যন্ত্রে যদি কাজ দেয়, তাহলে এটা তুমি নিয়ো।’ তার উত্তরে বিনয়ের অবতার বিজ্ঞানী বলে, ‘দেবে কাজ, মহারাজ, পরীক্ষা প্রার্থনীয়।’ বলা বাহুল্য,এ এক অসামান্য ছন্দের বন্ধন। কোথা থেকে মিলের কাজ শুরু হয়েছিল, সেই একটি চরণে ‘প্রিয়’-র সঙ্গে মিলল তার পরের চরণের ‘লোভনীয়’-র ‘নীয়’। সেই ‘লোভনীয়’-র ‘নীয়’-র সঙ্গে পরের চরণের ক্রিয়াপদ ‘নিয়ো’--- সাধারণভাবে মিল হিসেবে ভালো জমে না। কারণ, দুটোতেই একই রাইমিং ওয়ার্ড আছে। তবু, তাকে অসামান্য দক্ষতায় মিলিয়ে দিয়ে, তার পরের দুটি চরণের ব্যবধানে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এলেন একই শব্দ ‘নীয়’। তবে এবারে এই ‘নীয়’ শব্দটি এলো ‘প্রার্থনীয়’-র ‘নীয়’ হয়ে। তার মানে, ওদিকের লোভনীয় আর এদিকের প্রার্থনীয়-কে যেভাবে মেলালেন সত্যজিৎ--- তা এক সুদক্ষ শব্দশিল্পী ও ছন্দের জাদুকর ছাড়া মেলানো অসম্ভব। আসলে, ওই ‘লোভনীয়’-র ‘ভনীয়’ আর ‘প্রার্থনীয়’-র ‘থোনীয়’-কে মেলালেই এই মিল কানে একটা সুর তৈরি করে, নাহলেই কানে বেসুরো ঠেকবে এই শব্দ-স্থাপন। লম্বা লম্বা চরণের মাঝখানে আনলেন দুটি ছোটো চরণ, ‘দেবে কাজ, মহারাজ’--- এক্কেবারে মাপে গোনা মাত্রাস্থাপন। লম্বা লম্বা চরণের মাঝখানে ছোট্টো চরণে মিল স্থাপনে তো সত্যজিৎ অসামান্য--- তাঁর সেই মকশো হয়েছে লিমেরিক লেখার সূত্রেই। লিমেরিকে তো লম্বা লম্বা সামনে দুটি আর পিছনে একটি অন্ত্যমিল-ওয়ালা চরণের মাঝে থাকে ছোটো মাপের অন্ত্যমিলওয়ালা দুটি চরণ। সেই চর্চা তো তাঁর হয়েই ছিল ‘লিয়রিক লিমেরিক’-এর অনুবাদে। যেমন কিনা,
‘‘খুদে বাবু ফুল গাছে বসে যেন পক্ষী
মৌমাছি এসে বলে, ‘এ তো মহা ঝক্কি!
মধু খাবো, সরে যাও!’
বাবু বলে, ‘চোপ রাও!
তুমি আছো বলে গাছে বসবে না লোক কি?’’
লক্ষণীয়, ওই লম্বা লম্বা লাইনের মাঝখানে কীভাবে ছোট্টো লাইনটিকে রাখা হয় লিমেরিকে। মজার ব্যাপারখানা হল, তাহলে, এই লিমেরিককেও প্রতিভার গুণে ব্যবহার করা যেতে পারে তাহলে সিনেমার সংলাপ হিসেবে!
আরও পড়ুন
ছন্দোশিল্পী সত্যজিৎ
‘হীরক রাজার দেশে’-র আগেই কিন্তু গুপিবাঘার প্রথম ছবিতেই সত্যজিৎ শুরু করেছিলেন সংলাপে ছন্দ নিয়ে খেলা। কারণ, ছবি শুরুই হয়েছিল একটি ছন্দের বাঁধনে। সেখানে গুপি বলেছিল, ‘ও দ্বিজুখুড়ো, তুমি চাষা, আমি ওস্তাদ খাসা’। যে গুপি কিনা মুখে মুখে গান বাঁধবে তার ভেতরে তো ছন্দ মেলানোর ব্যাপারটা থাকতে হবে! তাই তার প্রথম সংলাপ যেমন ছন্দে বাঁধা, তেমনই, তাকে গাধার পিঠে তুলে গ্রাম থেকে দূর করে দেওয়ার সময়ও সে কিন্তু গাধার পিঠে যেতে যেতে সংলাপ বলে ছন্দের বাঁধনে। বলে, ‘তৃতীয় সুর ষষ্ঠ সুর/ গুপি চলল বহুদূর/ চলি চলি চলি চলি/ পথের যে নেই শেষ।/ গুপি আছে বেশ।/ কেবল আছে ভাবনা/ আপনা।/ সন্ধ্যা হইলে বনবাদাড়ে/ বাঘে যদি ধরে/ গুপি যদি মরে।’ তাহলে, তানপুরা পাওয়ার আনন্দেই হোক আর গ্রাম ছাড়ার দুঃখে আর ভয়েই হোক, গুপি কিন্তু কথা বলে ছন্দের বন্ধনে। শুধু কি তাই? ওই জঙ্গলে বাঘাকে দেখে তার খুশি, আনন্দোচ্ছ্বাস আর বিস্ময়ও তো প্রকাশিত হয় ছন্দের ভাষায়। সে বাঘাকে বলে, ‘তোমার ঢোল যে জল পড়ে ফুলে ঢোল হয়ে গ্যাছে গো’। এখানে ছন্দ সামনা-সামনি নেই, লুকিয়ে আছে বলার ধরনে। এ-ও তো এক ধরনের ছন্দই বটে! লক্ষ করে দেখা যাবে, ওই ‘তোমার ঢোল যে জল পড়ে ফুলে ঢোল হয়ে গ্যাছে গো’-র মধ্যে আছে ছয় মাত্রার এক ছন্দোবন্ধ। ‘তোমার ঢোল যে’ ছয় মাত্রা, ‘জল পড়ে ফুলে’ আবার ছয় মাত্রা, তারপরে ‘ঢোল হয়ে গ্যাছে’ আবার ছয় মাত্রা। তারপরে ‘গো’-তে একমাত্রা। চরিত্রের এই পূর্বসূত্রটা ছিল বলেই না, পরে যখন গুপি গান বাঁধে, তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে দর্শকের মধ্যে। মনে রাখতে হবে, গুপি তো শুধু গায়ক নয়, সে গীতিকার-সুরকারও বটে এবং সে গায়ক হিসেবে ভূতের রাজার বর পেয়েছে, গীতিকার সে কিন্তু মন্দ ছিল না, সুরটাও বাঁধত ভালোই। তাই বটতলার বাবুদের সামনে যে গান সে শোনায়, সেখানে তো সে ‘দ্যাখোরে নয়ন মেলে জগতের বাহার’ গানটা একই কথা আর সুরেই শুনিয়েছিল। কেবল অভাব ছিল তার গানের গলাতে। ভূতের রাজা সেই বরটাই দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘গান হবে, সুর হবে, তাল হবে, লয় হবে’। তাল আর লয়ের অভাবটাই তো ছিল তাদের। গান লেখার বর আর গানে সুর দেওয়ার বর তিনি স্বাভাবিকভাবেই দেননি। কারণ, গুপির জন্য তা দরকারও ছিল না।
আরও পড়ুন
হারানো এক কলমকারি- ২
আরও পড়ুন
হারানো এক কলমকারি- ১
লক্ষ করে দেখবেন, গুপি-বাঘার প্রথম দেখা হওয়ার পর তাদের সম্পর্কটা গড়েই ওঠে একটা ছন্দের ভেতর দিয়ে। গুপি তো তাকে ছ-মাত্রার ওই ‘তোমার ঢোল যে জল পড়ে ফুলে ঢোল হয়ে গ্যাছে’ বলে। অন্যদিকে বাঘা কীভাবে নিজেকে পরিচিত করে। বাঘ তাদের দেখে চলে যাওয়ার পর সে লাফিয়ে উঠে বলে, ‘পলায়ছে পলায়ছে’। ভাবটা এমন যেন, বাঘটা চলে যায়নি, বাঘাকে দেখেই বুঝি সেই বাঘ পালিয়েছে। বাঘার বাগাড়ম্বরের সেই শুরু। তা কেন সেই বাঘ পালাবে বাঘাকে দেখে, তারও একটা ছন্দোবদ্ধ কারণ বাতলায় বাঘা। তা হল, ‘যাবে না? আমি তো বাঘের এক কাঠি বাড়া। ব-এ কাঠি, ঘ-এ কাঠি--- বাঘা--- বাঘা বাইন।’ এই প্রথম ছবিতে আমরা বাঘার নাম জানতে পারি এক অসামান্য সংলাপে। বাঘা নামের বানান নিয়ে যে এমন সংলাপ লেখা যায়, তা অবিশ্বাস্য!! ব-এ আকার আর ঘ-এ আকার থাকে--- তা সেই আ-কারের দেখনশোভা সংলাপে হল ‘কাঠি’। তাই সে বলে, আমি হলাম ব-এ কাঠি ঘ-এ কাঠি। এরপরে বাংলা বানানের সঙ্গে বাংলা বাগবিধি মিলিয়ে তৈরি করলেন এক অসাধারণ বাক্য। কথায় বলে ‘এ ওর চেয়ে এক কাঠি বাড়া’--- তার মানে, এ ওর চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে। সেই বাগবিধিকে বাংলা বানানে বাঘ-এর পরে এক কাঠি দিলে যে বাঘা হয়, সেটা স্পষ্ট করে বাঘা নিজের নাম বলে ওই অদ্ভুত ছন্দে, ‘ব-এ কাঠি ঘ-এ কাঠি’ আর ‘আমি তো বাঘের এক কাঠি বাড়া’। সংলাপের এই যুক্তির পাশাপাশি যে সত্যজিৎ বেঁধেছিলেন ছন্দের ধরনটিও। গুপি গান গায় বলে তার সংলাপে ছিল ধীর চলনের ছয় মাত্রার কলাবৃত্ত আর বাঘা ঢোল বাজায় বলেই বুঝি তার কথায় দ্রুত চলনের দলবৃত্ত। তাহলে কে কোন ছন্দে কোন কথা বলবে, তার প্ল্যানটিও নিখুঁত মাপে বাঁধা।
আরও পড়ুন
প্রোফেসর শঙ্কুর কাল-ক্যালেন্ডার
মজা হল, গুপি-বাঘার সংলাপে শুধু কি ছন্দ বলে চরিত্ররা? তা নয়। কখনো দর্শকের মনের গুনগুনানি দিয়েও যে সত্যজিৎ ধরিয়ে নেন ছন্দের প্রবাহ, সেটা কি লক্ষ করি আমরা? সকলেই সেই ছন্দ ছবি দেখার সময় মুখে বলেছি, এমনকি বহুবার দেখার পর যখনই দেখি মুখে আপনমনে গুনগুন করি আমরা। কিন্তু মনে করে দেখুন--- ছবিতে কিন্তু সেই সংলাপটা নেই। দৃশ্যটি হল, ‘হীরক রাজার দেশে’-র সেই দৃশ্য যেখানে উদয়ন পণ্ডিতকে আর তার সব ছাত্রদের ধরে এনেছে হীরক রাজার সেপাইরা। হীরক রাজা উদয়নকে প্রথমে বলে, ‘পণ্ডিত, তুমি এত ধূর্ত এতই চতুর?/ খনি মজুরের সঙ্গে ষড় করে আমাকে করবে ফতুর?/ অ্যাঁ--- অতটা সাহস?/ পাঠশালা চলে গিয়ে এতো আপশোস?’ তারপরে হীরক রাজা হুমকি দেওয়ার সুরে জানায়, ‘শোনো পণ্ডিত, অন্যদেশে রাজদ্রোহের কী শাস্তি হয় শোনো,/ হয় আজীবন কারাবাস/ না হয় মুণ্ডচ্ছেদে প্রাণনাশ।/ তবে হীরকরাজা প্রাণে মারে না/ গারদের ধার ধারে না/ শূলে চড়ায় না/ মাথা মোড়ায় না/ জ্যান্ত পোড়ায় না। হীরক রাজ্যের শাস্তি শুধু একটাই।’ ব্যস! এখানেই দৃশ্য শেষ। এত ছন্দে মেলানো সংলাপের শেষ মিলটা তো পর্দায় হয় না, উচ্চারিত হয় দর্শকের মাথায় বা কারো অস্ফুট স্বরে--- মিলটা হল ‘মগজধোলাই’। সংলাপলেখকের হাতে ছন্দের অন্ত্যমিলকে ব্যবহার করার এই অপূর্ব মগজাস্ত্রটি বোধ হয় সত্যজিতের পক্ষেই ব্যবহার করা সম্ভব।
এখানেই এই ছবিটা আরো বেশি করে বাঙালির ছবি, বাঙালি দর্শক সংলাপের ওই ফাঁকপূরণটা করতে পারেন, ওটা অবাঙালি দর্শকের জন্য নয়। তবে ঠিক এখানেই মনে হয়, আচ্ছা, সে তো নয় হল। দর্শক নয় মনে মনে ‘মগজধোলাই’ উচ্চারণ করে নিল। কিন্তু পর্দায় যে অন্ত্যমিলটা বাকি রয়ে গেল, সেটা কি পূরণ করবেন না সত্যজিৎ? অদ্ভুত ব্যাপার হল, সেই পাদপূরণের অন্ত্যমিলটাও তিনি করেছেন ছবিতে। মনে আছে, হীরক রাজার ওই সংলাপের পরে ঠিক কী কী ঘটে? মনে করিয়ে দিচ্ছি। হীরক রাজা উদয়নকে বলল, ‘হীরক রাজ্যের শাস্তি শুধু একটাই’। ক্যামেরা এগিয়ে এলো উদয়নের মুখের উপর। তার মুখে এবার সত্যিই একটা চিন্তার ছাপ পড়েছে। এই দৃশ্য শেষ হয়ে পরের দৃশ্য সেই মূর্তির মাঠে। সেপাইরা বসে আছে, তাদের দিকে এগিয়ে আসছে বাঘা। তার কাছে কোঁচড়ভর্তি হিরা। সে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে, ‘হিরা চাই? হিরা?’ মজার ব্যাপার হল, ওই আগের দৃশ্যের ‘শাস্তি শুধু একাটই –এর সঙ্গে যে পরের দৃশ্যের ‘হিরা চাই’-এর অন্ত্যমিল আছে, সেটা আমাদের কান শুনে নেয় ঠিক। সেখানেই ছন্দকে কোথায় রাখবেন আর কোথায় ছাড়বেন তার এক আশ্চর্য ম্যাজিক! সেখানেই ছন্দশিল্পী সত্যজিৎ ছন্দের জাদুকরও বটে।
Powered by Froala Editor