মানিকলমকারি – ৫
আগের পর্বে
চিত্রকার সত্যজিতের জন্ম ১৯৪১-এ। চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় এসেছিলেন ১৯৫৫ সালে। কিন্তু প্রাবন্ধিক সত্যজিৎ কাজ শুরু করেছিলেন সেই চারের দশক থেকেই। জন্ম দিয়েছিলেন সিনেমা বিষয়ক প্রবন্ধের। তৈরি করতে চেয়েছিলেন বাঙালির মধ্যে সিনেমা দেখার চোখ। সিনেমার কাহিনি নির্বাচন, সংলাপ, শুটিংয়ের যন্ত্র, অভিনেতা নির্বাচন, সম্পাদনা এবং আবহসঙ্গীত। এই সাতটি বিষয়ের ওপরে সত্যজিতের পৃথক পৃথক প্রবন্ধগুলি যেন এক-একটা কমপ্লিট ক্লাস।
কথাটা চলছিল, সত্যজিতের প্রবন্ধাবলিকে এক বিশেষ অভিপ্রায় থেকে সাজাবার। চিত্রনাট্য অনুসারে চিত্রগ্রহণ যে এক মহা তামঝাম, মূলত ছোটদের জন্য তাঁর লেখা বই 'একেই বলে শুটিং' যেন তার এক মজাদার উদাহরণ। তবে শুধু এই বইটিই নয়, চিত্রগ্রহণ যে কত ঝকমারির একটা পর্ব, সে কথা, তিনি অনেক অন্য প্রবন্ধের মাঝে মাঝেও বলে গেছেন। যেমন, আমাদের এখানে স্টুডিওর বাইরে বেরিয়ে শুটিং করার সময়ে স্থানীয় কৌতূহলী জনতার অত্যুৎসাহকে সামলানোর ঝক্কি থেকে এখানকার স্টুডিওগুলির পরিকাঠামোগত অব্যবস্থা আর যথাযথ যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা এই সকল আপাত বাহ্য দিকগুলিও যে ছবি তৈরির কত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আর সে কথার দিকটিও যে একজন পরিচালককে মনে রাখতে হবে, সেই বিষয়টি মনে পড়িয়ে দেন তিনি। তবে এহো বাহ্য। এই ছবি তোলার সূক্ষ্ম সমস্যাটি সম্পর্কেও তিনি যেন অবহিত করেন নবীন শিক্ষার্থীকে।
শুধু থিওরির বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে তো ছবি তোলা যায় না, বাস্তববুদ্ধিও লাগে। বাস্তববুদ্ধির সঙ্গে লাগে শিল্পবোধ।
মনে পড়বে, 'ছবি তৈরি' নামের লেখাটিতে তিনি বললেন, "আমার চলচ্চিত্র চেতনা ও তত্ত্বগত জ্ঞান সম্পর্কে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল মনে মনে। তবুও কিন্তু প্রথমদিকে ছবি তুলতে গিয়ে হিমসিম খেতে হত।" এই ছবি তোলাতে হিমসিম খাওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে তিনি 'পথের পাঁচালী’ ছবির "ছোট্ট অপু সুদীর্ঘ ঘাসে ভরা মাঠে দিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে" এই দৃশ্যগ্রহণের হাঙ্গামার কথাটি শোনালেন। "প্রথমে অপু কয়েক পা হাঁটবে, থামবে, চারিদিকে তাকাবে, আবার হাঁটতে শুরু করবে" পর্দায় দেখা কেবলমাত্র এইটুকু অংশ তোলার কথা বলতে গিয়ে বললেন, "তখন কী ছাই জানতাম যে, এমনি একটা শটকে নিখুঁত করে তোলার চেয়ে একদল অশ্বারোহী সৈন্যের যুদ্ধের শট তোলাও অনেক সোজা।" মানে, সেখানে আয়োজনের আড়ম্বর বেশি, আর সেটা বেশি বলেই, সেখানে সেই আয়োজনটাই চোখে পড়বে বেশি। এখানে আয়োজনের বাহুল্য নেই বলেই ছবির প্রতিটি সূক্ষ্ম মুহূর্তও দর্শকের চোখে ধরা পড়ে। অপুর প্রতিটি পা ফেলা, প্রতিটি মাথা ঘোরানো, উদার প্রকৃতির মাঝখানে তার ছোট্ট চেহারা সবটাই এখানে দৃশ্যকাব্য তৈরি করে বলেই, এখানে ছবি তোলার ব্যাপারটি অনেক সমস্যাসঙ্কুল। বোঝাই যাচ্ছে, সত্যজিৎ তাঁর ভাবনাতে ছবি তোলা বলতে শুধু তার বাইরের ঝক্কির কথা বলছেন না, বলছেন ছবি তোলায় সূক্ষ্মতাকে ধরতে চাওয়াটাও একটা পরিশ্রমের ব্যাপার।
এই চিত্রগ্রহণের শিল্পতত্ত্ব নিয়ে কথা বলার সঙ্গেই তিনি আরেকটি প্রবন্ধে বলছেন, রঙিন ছবি আর সাদা কালো ছবির ভাষাগত তারতম্য বিষয়ে। ছবিতে রং অবশ্যই এক নতুন মাত্রা যোগ করে শিল্পের যুক্তিতে। চরিত্রের বিশেষ রূপ ফুটিয়ে তোলার জন্য রং যে কতখানি দরকারি, সে বিষয়ে যেমন তিনি মনোযোগী, ঠিক তেমনই নাট্যরস সৃষ্টির ব্যাপারেও যে রং একটা বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে, সেই কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি। রংয়ের সংঘাত যেমন নাটকীয়তা তৈরি করে, তেমনই আছে এই রংয়ের সংযত প্রয়োগ। তখন "বক্তব্যের তাগিদেই রং স্নিগ্ধ, প্রশমিত এবং দর্শকও সাময়িকভাবে বিস্মৃত যে সে রঙিন ছবি দেখছে।" আবার এর উল্টোদিকেই আছে তাঁর সেই অসামান্য উদ্ধৃতি: "এই রংয়েরই অমিত প্রয়োগ যে কী বিভীষিকার সৃষ্টি করতে পারে, আজকের যে কোনো হিন্দি ছবিতেই তার প্রমাণ মিলবে।" আনলেন এক অভিনব অভিযোগ, "বিষয়বস্তুর দৈন্য গোপন করার জন্যই এই বহুবর্ণ মোড়কের প্রয়োজন।"
ভেবে দেখার মতো, সংলাপের প্রতি অত্যন্ত আসক্তি ছবির মেজাজকে যে ক্ষুণ্ণ করে সে সম্পর্কে সচেতন যেমন করছেন তিনি, তেমনই যথাযথ পরিমিত সংলাপ যে কেন দরকারি, তার শিক্ষাও দেন তিনি। 'চলচ্চিত্রের সংলাপ প্রসঙ্গে' প্রবন্ধটিতে বোঝালেন, "চলচ্চিত্রে সংলাপের প্রধানত দুটি কাজ। এক, কাহিনিকে ব্যক্ত করা; দুই, পাত্রপাত্রীর চরিত্র প্রকাশ করা। সাহিত্যের কাহিনিতে কথা যে কাজ করে, চলচ্চিত্রে ছবি ও কথা মিলিয়ে সে কাজ হয়।" এর সঙ্গে বললেন, নাটকের সংলাপ থেকে ছবির সংলাপ স্বতন্ত্র।
তবে সেই সংলাপের কথা তো প্রথমেই বলেছি, এখানে মনে রাখতে হবে, ধ্বনির কথা। আমাদের চারপাশে যে বহু বিচিত্র ধ্বনি চলমান, সেই ধ্বনিবিন্যাসের সঙ্গে সিনেমার বাস্তবতার সম্পর্কটি যে ক্লাসে পড়ানো দরকার, সেটিও বিস্মৃত হননি তিনি।
ঙ) অভিনয় আর অভিনেতা
ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারেই বরং সত্যজিৎ সবচেয়ে কম কথা বলেছেন তাঁর প্রবন্ধে। অভিনয় নিয়ে কথা বলেছেন মুখ্যত তাঁর কোনো অভিনেতা শিল্পীর প্রয়াণলেখতে। সে অভিনেতা উত্তমকুমার হতে পারেন আবার তুলসী চক্রবর্তী আর ছবি বিশ্বাস হতে পারেন। স্টার অভিনেতাকেও যে প্রাথমিকভাবে অভিনেতাই হতে হয় আর অভিনেতার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং পরিশ্রম করার আত্যন্তিক ক্ষমতাই যে একজন অভিনেতাকে তৈরি করে, এই প্রয়াণলেখগুলিতে তার চিহ্ন বিস্তারিত।
আর চিত্রাভিনেতার আরেকটি ধরন আছে, যেখানে পরিচালকের দক্ষতাতেই একজন সাধারণ মানুষও কীভাবে হয়ে উঠতে পারেন অভিনেতা, তার কথাও।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস - ১
আরও পড়ুন
প্রদোষ ‘মিত্র’ নয়, ফেলুদা-র পদবি ‘দত্ত’ ভেবেছিলেন সত্যজিৎ!
ছ) ছবিতে আবহসংগীত
ছবিতে আবহসংগীতের দরকার কতটা বা আদৌ দরকার আছে কি না, এমন এক বিতর্ককে সামনে রেখেই সত্যজিৎ ছবির আবহসংগীত বিষয়ে আলোচনাটি করেছিলেন। মনে রেখেছিলেন, আবহসংগীত ছবিতে প্রথমত যুক্ত হয়েছিল সিনেমা চলাকালীন যন্ত্রের শব্দ ঢাকার একটা উপায় হিসেবে। কিন্তু যখন তা ছবিতে দৃশ্যের ভাবব্যঞ্জকতার উপাদান রূপে গ্রহণ করা হল, সেই সময়ে তার অবস্থান নিয়ে এক জরুরি আলোচনা এই নিবন্ধটি। ছবিতে দর্শকের প্রান্ত থেকে প্রথমে আসে ছবি তারপরে আসে কথা আর ধ্বনি, শেষে আসে আবহসংগীত।
চলচ্চিত্রের রীতি ও প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই গল্প বলার ধরন, ক্যামেরার ব্যবহার আর সম্পাদনার কৌশল বদলালে বদল ঘটে আবহসংগীতেও। ছবির আবহসংগীত শুধু একটি বিশেষ দৃশ্যের ভাবকে মূর্ত করে না, তা বিশেষ একটি ছবির বিশেষ একটি মুহূর্তকে ব্যক্ত করে। আসলে, শুধু যদি তা একটি মুহূর্তকে সাংগীতিক চেহারা দেয়, তবে তা, ক্রমশ স্টক মিউজিকের জন্ম দেবে, সত্যজিতের কথায়, "ভালো ছবিকে নষ্ট করার একটি উপায় হল বেমানান আবহসংগীত।" প্রতি ছবির বিষয় আর মেজাজ অনুযায়ী সেই ছবির আবহটি তৈরি হবে আর সেই আবহকে কেন্দ্রে রেখে দক্ষ সুরকার তৈরি করবেন নির্দিষ্ট একটি ছবির আবহসংগীত।
আবহ রচনাতে "সংগীতের শাস্ত্রীয় ব্যাকরণ নিয়ে গোঁড়ামি সম্পূর্ণ অর্থহীন, কারণ, নিছক সংগীত হিসাবে আবহসংগীতের মূল্যায়নের প্রয়োজনই নেই।"--- এটা যেমন একটা ভাবনা সত্যজিতের, তেমনই তিনি বললেন, "রাগরাগিনীর শাস্ত্রীয় রূপ অবিকৃত ভাবে ব্যবহার করার সুযোগ ছবিতে প্রায় নেই বললেই চলে।" এরপরে, ছবিতে নাট্যকাহিনির গতিপথ বদল হলে ঘড়ির কাঁটা ধরে কখন যে ছবির প্রয়োজনে রাগের বদল ঘটতে পারে, কখন যে রাগে বে-পরদার প্রয়োগটাই যথাযথ হতে পারে তার বিচিত্র রূপ বুঝিয়ে দিতে দিতে চলেন প্রবন্ধকার।
আরও পড়ুন
শাসমলবাবু, সদানন্দ, সুজন এবং
একদিকে সিনেমা শেখানোর ক্লাসের পাশাপাশি ছবি দেখার চোখটাও তো তৈরি করতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ। নতুন সময়ের দর্শক আর সমালোচকের ভূমিকা কী হতে পারে, ক্রমশ অবহিত আর সচেতন করছিলেন তা নিয়েও। চারের দশকে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের অন্যতম হোতা তিনি, সেদিক থেকে আজ পড়া দরকার সত্যজিতের প্রবন্ধাবলি। বাংলা প্রবন্ধের ইতিহাসে কি তিনি আসলে আস্তে আস্তে জন্ম দিচ্ছিলেন না, চলচ্চিত্রের চর্চা বিষয়ক প্রবন্ধমালার একটি নতুন সংরূপ বা জঁর।
আসলে, আমরা অনেক সময় ভাবি, সংগত কারণেই ভাবি, সত্যজিতের ছবি আমাদের এক নতুন চিত্রভাষা শিখিয়েছে। আমরা জানি, তিনি ভারতীয় ছবিকে দিয়েছেন এক আশ্চর্য পরিণতি। কিন্তু, শুধু ছবি তিনি বানাননি, আগামী সময়ে কীভাবে দেখতে হবে নতুন যুগের ছবি, কোন নতুন যুক্তিপটে একজন নতুন সময়ের নতুন চিত্রনির্মাতা বানাবেন আধুনিক চলচ্চিত্র, তাঁর এই প্রবন্ধমালা যেন তারও এক চমৎকার পাঠ্যক্রম।
এই অবধি বলা গেল, তাঁর ছবি-বানানোর ক্লাস নিয়ে। কিন্তু ছবি তো শুধু একজন বড়ো শিল্পীর কাছে কারিগরি দক্ষতায় বানানো একটা পণ্যমাত্র নয়, তা যে শিল্পীর সৃজন। সেই চলচ্চিত্র শিল্প-সৃজনের অন্তর্লোকের সন্ধানটিও তিনি দিয়েছিলেন। সেদিক থেকে ফিল্ম স্টাডিজের প্রথম পর্বে তিনি এক আচার্যপ্রতিম শিক্ষক। তিনি শুধু শেখান না, তিনি ছবির দর্শনের ক্লাসটিও নেন। পরের রোববার না হয়, সত্যজিতের লেখা থেকে সিনেমাচর্চার সেই অতি দরকারি আশপাশের কথা নিয়ে এক নতুন আড্ডাতে বসা যাবে।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কেমন দেখতে ছিলেন ‘সত্যিকারের’ জটায়ু?