ছন্দোশিল্পী সত্যজিৎ

মানিকলমকারি  - ৪৯
আগের পর্বে

প্রফেসর শঙ্কুর গল্পগুলির নামাঙ্কন পত্রিকার পাতায় যেভাবে ধরা দিয়েছিল, বই প্রকাশের সময় তা হারিয়ে যায়। তবে ফেলুদার গল্পের ক্ষেত্রে সেগুলিকে ভিতরের পাতায় অন্যভাবে ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ। এমনকি পত্রিকার পাতায় যে ছবি ছিল চওড়া ধরণের, বই প্রকাশের সময় তার মূল রূপটি অক্ষুণ্ণ রেখেই বদলেছিলেন আকার। সমসাময়িক কালে গোয়েন্দা গল্পের প্রচ্ছদে ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যটিই ফুটিয়ে তোলা হত। সত্যজিৎ সেই ধারা থেকে সরে এসেছিলেন। এমনকি নলিনী দাশের গল্পের নামাঙ্কনের সময়েও ফেলুদার মেজাজটিই তুলে এনেছিলেন। অবশ্য প্রচলিত নিয়মের কথা মাথায় রেখেই জটায়ু বা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী নিশাচরের বইয়ের প্রচ্ছদ চলচ্চিত্রে তুলে এনেছেন। কিন্তু সত্যজিতের এইসমস্ত নামাঙ্কনও পরবর্তীকালে গ্রন্থকারদের অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। বাদশাহি আঙটির অক্ষরলিপি বাদ দিয়েছিলেন লেখক নিজেই। পরবর্তীকালে সন্দীপ রায় তাঁর ছবিতে আবার তুলে আনেন সেই আরবি ছাঁদের রেখাঙ্কন।

সুকুমার রায়ের পুত্র তিনি আর কী আশ্চর্য এক সহজাত ছন্দের হাত তাঁর। চিত্রপরিচালক, লেখক, চিত্রকর আর সংগীত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের বহুমুখী পরিচয়ের আড়ালে সত্যজিতের সেই চমৎকার ছন্দের হাতটিও কিন্তু লক্ষণীয়। জনমনে ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির সংলাপে তাঁর ছন্দের পরিচয় বহুল পরিচিত। কিন্তু গোটা ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ বইতেও যে তিনি অনুবাদ কবিতার ভেতরে কত ধরনের ছন্দের গড়ন পিটন করেছেন--- ভাবলে চমকে যেতে হয়। একজন নিপুণ ছন্দোশিল্পীর মতোই প্রচলিত ছন্দের চলনকে এদিকে ওদিকে করে, শব্দের আর মাত্রার ওজন কমিয়ে বাড়িয়ে ছন্দের খেলাতে নিপুণ এক শিল্পীও মানিকলমকারির একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। সেই দিকটিরও সন্ধান করা দরকার বই কী?

ছড়ার ছন্দ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা জানেন, ছড়ার এক বিশেষ ছন্দোরীতি আছে। ছন্দোবিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকে বলা হয় দলবৃত্ত ছন্দ। সেই ছড়ার ছন্দে সত্যজিতের হাত তো দুরন্ত। ধরা যাক, লিয়রিক লিমেরিক-এ যখন তিনি লেখেন, ‘কুমির পিঠে বামনটারে দেখে/ বিজ্ঞ লোকে বললে তারে ডেকে/ ব্যাপারখানা নয়কো সোজা/ হাবভাবে ওর যাচ্ছে বোঝা/ ভোরের দিকে দেখবে তোমায় চেখে।’ এখানে এক্কেবারে দলবৃত্ত ছন্দের চলনটাকে হুবহু ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ। এখানে এক বিশেষভাবে শব্দগুলো উচ্চারণ করতে হয়। এখানে বলতে হয়, কু-মির্-পি-ঠে-বা-মোন-টা-রে-দে-খে। কিন্তু অন্য একটি ধরনে, এই শব্দের বলার ধরনটা বদলে যায় যখন, তখন তাকে বলা হয় কলাবৃত্ত ছন্দোরীতি। সাধারণভাবে তো তা ছড়ার ছন্দের জন্য ব্যবহার করা হয় না। তা ব্যবহার করা হয় গানের জন্য বা গানের মতো চলনধর্মী কবিতার জন্য। সত্যজিৎ সেই কলাবৃত্তের মতো শব্দ-উচ্চারণের ধরনকেও অনেক সময় ব্যবহার করেছেন তাঁর ছড়াতে। যেমন ধরা যাক, ‘যেখানে যে বই আছে পাখি সম্বন্ধে/ মন দিয়ে পড়ি সব সক্কাল সন্ধে’। এখানে যাঁরা ছন্দ নিয়ে ভাবেন, তাঁরা জানেন, এখানে শব্দগুলো উচ্চারণ করা হয় একটু টেনে-টেনে। মজার ব্যাপার হল, সেই অন্য রকম উচ্চারণেও এক্কেবারে মাপমতো শব্দ গেঁথে গেছেন সত্যজিৎ। ঠিক এইভাবে লিখেছেন, ‘লালুবাবু বাড়ি তাঁর লাউডন স্ট্রিট/ পাতলুনে বসে দ্যাখো অতিকায় কীট।’ এখানেও শব্দ বলতে হলে শব্দগুলো একটু টেনে উচ্চারণ করতেই হবে পাঠককে।

এগুলি তো তবু চার মাত্রার ছন্দ। ঠিক যেমন ধরনটি বাংলা ছড়াতে বেশ প্রচলিত বহুদিন ধরে। সত্যজিৎ রায় তাঁর ছড়াতে এর পাশাপাশি এমন লেখাও লিখেছেন, যেখানে তা পাঠক চাইলে চার মাত্রা বা পাঁচ মাত্রার ছন্দেও পড়তে পারে। তবে চার মাত্রার ছন্দে পড়লে তা হবে দলবৃত্তের গড়ন আর পাঁচ মাত্রার গণনাতে পড়লে তা হবে ওই কলাবৃত্তের ধরন। যেভাবেই পড়া যাক, ছন্দে কিন্তু এক ফোঁটা এদিক ওদিক হওয়ার উপায় নেই, এমনই নিপুণ শব্দ-মাপে বাঁধা সেই ছন্দোবন্ধ। যেমন ধরা যাক,

‘বাজায় বাঁশি। মেমসাহেবে। কেউ আসে না। কাছে
সবাই জানে। বাঁশির তানে। তিন শুয়োরে। নাচে।’

আরও পড়ুন
হারানো এক কলমকারি- ২

আরও পড়ুন
হারানো এক কলমকারি- ১

পাঁচ মাত্রায় এই ছড়া যেমন পড়া যাবে, তেমনই চার মাত্রাতেও সমানভাবে পড়া চলে এই ছড়া। তবে পাঁচ মাত্রায় ছড়া লেখার সবচেয়ে সুন্দর আর কান-ভালো-করা লেখা তাঁর ‘আদ্যি বুড়োর পদ্যি’। যেমন তার ভাষা তেমনই তার শ্রুতিমধুর চলন। লিখছেন, ‘বলবার আছে যা তা বলি আজ তোরে/ বলবার বেশি কিছু নেই/ দেখেছিনু বুড়ো এক ফটকের পরে,/ সব্বার থুত্থুড়ে যেই।’ এই লেখাটি সত্যজিৎ লিখছেন ১৯৬৪ সালে। ১৯৬১ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার প্রকাশ শুরু করেছেন নবপর্যায়ে। ফলে পত্রিকার জন্য টানা লেখা শুরু করতেই হচ্ছে তাঁকে। অন্যদিকে তাঁর তখনো ছবির জন্য গান-লেখার পর্ব অনেকটাই দূরে। অথচ তখন থেকেই কী সুন্দর আর পরিমিত তাঁর ছন্দের কান! এখানেও একেবারে মাপা শব্দ, নিখুঁত মাত্রাবোধ।    

আরও পড়ুন
যখন ছোট ছিলাম থেকে-২

এই ধরনের নিখুঁত কলাবৃত্ত ছন্দোবন্ধে তিনি লিখেছিলেন,‘মেছো গান’ নামে একটি ছড়া। তার শুরুখানা যতখানি ছড়া ততখানিই যেন একটা কবিতাও। এই কবিতার ইমেজারি বা বাকপ্রতিমাও অনন্য সুন্দর। সত্যজিৎ লিখছেন,

আরও পড়ুন
যখন ছোট ছিলাম থেকে-১

শীতকালেতে গাছের পাতা পড়বে যখন ঝরে
          গানটা আমি গাইব তোমার কানে,
বসন্তেতে সবুজ কচি ধরলে গাছের ’পরে
          তোমায় ডেকে বলব গানের মানে।
গ্রীষ্মকালে গাঁয়ের মাটি উঠবে যখন তেতে
          গানের মানে ঢুকবে তোমার মাথায়,
শরৎকালের সোনার ফসল ফললে পরে ক্ষেতে
          গানটা লিখে রাখতে পারো খাতায়।

কী অসামান্য একটি কবিতার কথা! শীতকালে যে গান গাওয়া হবে, তার মানে শ্রোতাকে বোঝানো হবে পরের বসন্তে। আর বসন্ত পার করে গ্রীষ্মকালে সে গানের অর্থ শ্রোতা বুঝে উঠবে আর শরৎকালে সেই গানটা শ্রোতা লিখে রাখবে তার মনের খাতায়। এটা আসল ছড়ার সূচনা। এরপরে এক অদ্ভুত ননসেন্স কবিতার শুরু। সে তো পরে। তার আগে এই টুকরাখানার জবাব নেই।

এই সূচনার পরে এই কবিতাটার মধ্যে আছে আরেক রকম রহস্য। এই কবিতাটি এই রকম ধীর লয়ে বলা শুরু তো হল। কিন্তু কবিতার পরে পরে বিভিন্ন স্তবকে তার শব্দ পড়ার গতিকে কমিয়ে বাড়িয়ে একটা নতুন ধরনের নাটকীয়তা তৈরি করেন সত্যজিৎ। তখনো কিন্তু ‘হীরক রাজার দেশে’ লেখা অনেক দূরে--- একই লেখায় শব্দের মাপজোখ বদলে নিয়ে কবিতা-পড়ার গতিতে কমবেশি করছেন তিনি। বুঝতে পারি, এরপরে যখন ‘হীরক রাজার দেশে’ লিখবেন তিনি, সেখানেও এই ধরনটিকে ব্যবহার করেই তিনি ছড়াতে বাঁধবেন তাঁর সংলাপ। সে কথায় পরে আসছি। এখন লক্ষ করুন, ওই উপরের ধীরগতির শব্দ পড়া কীভাবে পরের স্তবকে হঠাৎ দ্রুত গতির তালে বদলে যেতে পারে। পড়লে বোঝাই যাবে না কীভাবে অকস্মাৎ পাঠক হিসেবে আপনি শব্দ পড়ার গতি বদলে নিয়েছেন। কারণ, ওই উপরের অংশের পরে কী লেখা হচ্ছে? লেখা হচ্ছে, ‘মাতলার উত্তরে আছে যত মৎস্যেরা/ পত্তর লিখে দিনু, শুনো ওহে বৎসেরা/ মৎস্যের বৎসেরা খত পাওয়া মাত্তর/ উত্তর দিল মোরে সত্বর সত্বর।’ শুধু শব্দ পড়ার গতি বেড়ে যে গেছে তাই নয়, ওই বারে বারে ‘ত’ ধ্বনিটি এসে কানে একটি লুকোনো অনুপ্রাস তৈরি করে ফেলেছে। তাহলে, শুধু শব্দের মধ্যে দিয়ে ছড়ার ছন্দ তিনি বাঁধেন না, শব্দের নিপুণ স্থাপনে কানের আরাম তৈরি করতেও তিনি একেবারে সিদ্ধহস্ত। তিনি যেন আরেক রকম ছন্দের জাদুকর।

এই শব্দের গতি বাড়ানো-কমানোর অঙ্কেই তিনি লিখবেন ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির সংলাপ ১৯৮০ সালে। সে ছবি শুরুই হল, গুপি-বাঘার সংলাপ দিয়ে। গুপি বলে, ‘বলো কী সমাচার?’ বাঘা বলে, ‘আয়েস করে আলসেমিতে দশটা বছর পার। ভাল্লাগেনা আর।’ চলতি ছড়াতে দুটো চরণেই মাত্রা সমান রাখতে হয়--- সেটাই সাদা নিয়ম। কিন্তু কথার মধ্যে সংলাপে তো আর মাপ ওইভাবে সমান রাখা যায় না। তাকে কীভাবে ছোটো-বড়ো করেও ছড়ার ছন্দের মাপ ঠিক রাখতে হয়, এই সংলাপ যেন তার এক মন-ভালো-করা উদাহরণ। ওই নিখুঁত চার মাত্রার দলবৃত্তে গাঁথা এই সংলাপ। শুধু একটি পদে ছোটো চরণ আর পরের চরণে বড়ো চরণ। লাইনের মাপে এই ছোটো বড়ো করে সংলাপে আনলেন কথা বলার সুর। অন্যদিকে, হীরক রাজার সংলাপ মনে করে দেখুন, কী বলেন তিনি? হীরক রাজা বিজ্ঞানী সম্পর্কে বলেন, ‘জম্বুদ্বীপ থেকে এসে, আজ সাতমাস অন্ন ধ্বংস করেছে সে। বলে আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের হেন কিছু নাই যা না জানি। বলে চাই গবেষণাগার, না জানি কী করবে আবিষ্কার, রাজ্য চালনার সব সমস্যা মিটে যাবে তাতে, আমি ভাবি লোকটারে রাখি হাতে, কথামতো কাজ যদি পাই, লাভ আছে বরঞ্চ ক্ষতি নাই।’ এমনিতে সংলাপ। কিন্তু মিলের ধরনটা দেখুন এবারে,

জম্বুদ্বীপ থেকে এসে,
আজ সাতমাস অন্ন ধ্বংস করেছে সে।
বলে আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী,
বিজ্ঞানের হেন কিছু নাই যা না জানি।
বলে চাই গবেষণাগার,
না জানি কী করবে আবিষ্কার,
রাজ্য চালনার সব সমস্যা মিটে যাবে তাতে,
আমি ভাবি লোকটারে রাখি হাতে,
কথামতো কাজ যদি পাই,
লাভ আছে বরঞ্চ ক্ষতি নাই।

‘এসে’-র সঙ্গে ‘করেছে সে’ যেমন এক চমৎকার দক্ষহাতের অন্ত্যমিল, তেমনই এক একটা বাক্যের একেক রকম দৈর্ঘ্য এতে এনেছে পুরোপুরি সংলাপের ছাঁদ। এমন অসামান্য সব অন্ত্যমিলের জগতে দেখব দুজনের সংলাপে কীভাবে ছড়িয়ে দিতে পারেন সত্যজিৎ। সেই যে, শুন্ডির রাজা যখন তাঁর দুই জামাইকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমরা যে হীরকরাজ্যে যাবে, তা সঙ্গে যাবে কে?’ এর উত্তরে কী বলে গুপি-বাঘা? বলে, ‘আজ্ঞে?’ শুন্ডির রাজা আবার বলেন, ‘বলছি, তোমরা যে যাবে তোমাদের সঙ্গে যাবে কে?’ গুপি বাঘা একসঙ্গে বলে, ‘এর সঙ্গে আমি আর আমার সঙ্গে এ’। কী চমৎকার এক অন্ত্যমিল! অন্ত্যমিলের অঙ্কের মধ্যে নজরই পড়ে না, ওই এককথার ‘আজ্ঞে’ যেমন ‘যাবে কে’-র সঙ্গে অন্ত্যমিলে জোড়া, তেমনই ওই ‘যাবে কে’-র সঙ্গেই মেলানো রয়েছে ‘এর সহ্গে আমি আর আমার সঙ্গে এ’-র ‘সঙ্গে এ’- বাক্যাংশও। এই অদ্ভুত সব মিলের মধ্যে যখন কথা বলা চালু থাকে, তখনই লক্ষ করা যায়, উদয়ন পণ্ডিতের কথা বলায় অন্ত্যমিল রাখেন না সংলাপলেখক সত্যজিৎ। এক বাস্তববাদী সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই উদয়ন পণ্ডিত। তাই তার চরিত্রের ধরনের সঙ্গে মানানসই তার সংলাপের এই অন্ত্যমিলহীনতা। তার মানে কখন ছন্দ রাখবেন, সেটা যেমন একটা পরিকল্পনা, তেমনই ছন্দকে ছেড়ে রাখাটাও একটা নাটকীয় পরিকল্পনা। ছন্দের ভেতর এই ছড়ার ছন্দ বাঁধা আর ছাড়াটাও কিন্তু একটা শৈল্পিক সিদ্ধান্ত। বিশেষ জায়াগাতে নাটকীয়ভাবে ছন্দ না-রাখাটাও কিন্তু একটা ছন্দোময়তারই গল্প বলে।

Powered by Froala Editor