হারানো এক কলমকারি- ১

মানিকলমকারি - ৪৭
আগের পর্বে

১৯৬১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় প্রফেসর শঙ্কুর কাহিনি। অনেকেই শঙ্কুর কাহিনির সময়কাল শুরু করেন এই ষাটের দশকেই। অথচ একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় শঙ্কু কাহিনির বড়ো অংশ জুড়েই আছে ঔপনিবেশিক ভারত। হিসাব অনুযায়ী প্রফেসরের জন্ম ১৯১২ সালে। তিনি লেখকের থেকে বছর দশেকের বড়ো। আবার আরও ভালো করে দেখলে বোঝা যায় টাফা গ্রহে নিরুদ্দেশের ভিতর দিয়েই শঙ্কু কাহিনি শেষ হয়ে যায় না। তিনি সেখান থেকে ফিরেও এসেছেন। আর সেই পরবর্তী সময়ের কাহিনিও লিখেছেন সত্যজিৎ রায়।

একটা গল্প লেখা হয়। সেই গল্পটা ছাপা হয়। ছাপার সময় লেখাটার নাম ছাপা হয়, ছাপা হয় লেখকের নামও। পত্রিকায় ছাপা এই নাম লেখাটা যে কী চমৎকার করা যেতে পারে, সেটা নিয়েও বেশ ভেবেছিলেন সত্যজিৎ। এই এক আশ্চর্য নতুন কলমকারি তাঁর। অথচ সেভাবে আদৌ সংরক্ষিত হয়নি তাঁর সেই শিল্পরূপ। সন্ধান করে দেখা যাবে, বাংলা একটি পত্রিকার পাতা সাজানোর ক্ষেত্রে এটি সত্যজিতের এক আশ্চর্য অবদান। সাধারণভাবে কী হয়? লেখার শুরুতে ছাপার হরফে একটু বড়ো মাপে লেখার নাম আর লেখকের নাম থাকে। তার থেকে আরেকটা ধরন প্রবাসী, বিচিত্রা আর ভারতবর্ষ পত্রিকার পাতাতে বিংশ শতকের শুরুতে শুরু হয়েছিল। সেটা হল, একটি পাতার মাথায় হাতের লেখায় রচনার নাম লেখা হত, তারপরে একটি ছবির মতো ছাপা হত তা। মনে পড়বে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ বা রবীন্দ্রনাথের  ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস যখন ‘তিন পুরুষ’ নামে প্রকাশিত হচ্ছে তখন তাদের শিরোভূষণ ছিল অসামান্য সেই সব হেড পিস।

সত্যজিৎ নিজে সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদনা করতে এসে আর নিজে লিখতে এসে সেই হেডপিস- অঙ্কনের এক নতুন ধরন সৃজন করলেন। কেবলমাত্র আর আলংকারিক রেখা নয়, তিনি তাকে করে তুললেন অর্থবহ, তিনি তাকে গড়ে তুললেন নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন সময়ের চোখের উপযোগী করে।

সেই ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ থেকে শুরু করে প্রোফেসর শঙ্কুর সমস্ত গল্পে এক-একটি চোখ-ধাঁধানো অভিনব হেডপিস রচনা করেছিলেন। ফেলুদার গল্পেও হেডপিসের একটা নতুন ধরন তৈরি করেছিলেন পাতা-জোড়া অলংকরণের সঙ্গে মানানসই হেডপিস। গল্প হিসেবে যেমন শঙ্কু আর ফেলুদার লেখার ধরন আলাদা, তেমনই তাদের পাতা সাজানোর গড়নপিটনটাও যে তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবে আলাদা করে নিয়েছিলেন, সেটাও কিন্তু লক্ষ করার মতো একটা ব্যাপার। শঙ্কুর গল্পে হেডপিসেই তিনি রচনা করলেন লেখার বৈচিত্র্য। ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার করে নানা রকম তার দেখনশোভা।

আরও পড়ুন
প্রোফেসর শঙ্কুর কাল-ক্যালেন্ডার

ওই ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পেই দেখতে পাই শঙ্কুর বানানো মহাকাশযানের ছেড়ে যাওয়া ধোঁওয়ার রেখা দিয়েই লেখা হয় গল্পের নাম। অন্যদিকে ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও চী-চীং’ গল্পে লক্ষ করা যায় তিনি ব্যবহার করেছেন চৈনিক লিপির রেখা আর ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও হাড়’ গল্পের নামাঙ্কনে দেখা যায় তিনি হাড়ের গঠনের সঙ্গে মিলিয়ে লিখেছেন ‘হাড়’ শব্দটাই। আবার ধরা যাক, ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমৎস্য রহস্য’-তে দেখি এমনভাবে ওই ‘রক্তমৎস্য’ শব্দটা লেখা হয়েছে, যাতে জলের নীচে অনেকক্ষণ থাকার ফলে যে ধরনের ফোলা- ফোলা একটা গঠন হয় তার আদলও থাকে আর ওই গড়িয়ে পড়া রক্তের একটা আঁচও যেন সেখানে আছে।  যদিও গল্পটা যারা পড়েছেন, তারা জানেন এখানে রক্তমৎস্য শব্দের সঙ্গে রক্ত বা মৎস্য কোনোটারই যোগ নেই--- তবে পাঠককে গল্পের দিকে টেনে আনতে ছবিতে এমন এক মধুর ছলনা তৈরি করলে মন্দ কী! অথবা ধরা যাক ‘কোচাবাম্বার গুহা’ গল্পের পত্রিকাপাঠের নামাঙ্কনে দেখি গুহার গায়ে লোমশ এক-একটা রেখায় গল্পের নামটি লেখা। গল্পের ভিতর শঙ্কুর সঙ্গে দেখা হয় যাদের, তাদের বিবরণ শঙ্কুর ভাষায় এই রকম ‘‘জঙ্গল থেকে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে আসছে। হাজার হাজার জানোয়ার। প্রথম সারিতে ম্যামথ--- অতিকায় লোমশ প্রাগৈতিহাসিক হাতি’’। অন্ধকার গুহার গায়ে ওই লোমশ প্রাণীর লোমের রেখাচিহ্ন দিয়েই যেন ফুটে ওঠে গল্পের নাম।

আরও পড়ুন
যখন ছোট ছিলাম থেকে-২

সন্দেশ পত্রিকার পাতায় বর্ণযোজনার সম্ভাবনা কম, আই সেখানে রেখার খেলা আর আনন্দমেলা পত্রিকার পাতায় রং ব্যবহার করা যাবে বুঝতে পেরে সেখানে এই নামাঙ্কনে করলেন এক বর্ণাঢ্য আয়োজন। দুই পাতা জুড়ে সুযোগ ও সুবিধামাফিক রংকে ব্যবহার করে যে কত চমৎকার এক-একটি নামাঙ্কন করা যেতে পারে তারও উদাহরণ দেখা যাবে শঙ্কুর এই ধরনের গল্পের অলংকরণে। মনে আছে ‘আনন্দমেলা’-র পুজোসংখ্যাতে প্রকাশিত হয়েছিল ‘শঙ্কুর শনির দশা’ আর ‘মানরো দ্বীপের রহস্য’ গল্পের নামাঙ্কন। সেখানে নাম লেখার কারিগরিতে নয়, দুদিকের পাতা ছবি দিয়ে সাজানোর কারিগরিতে আর তার অসামান্য বর্ণবিন্যাসে সকলের চোখে স্মরণীয় হয়ে আছে তখনকার সেই দৃশ্যরূপ। ছবির মধ্যেই কীভাবে লেখাকে জায়গা করে দিতে হয়, পাতা ফাঁকা রেখেও যে সেই শূন্যস্থানে ছবির মেজাজটা ধরে রাখা যায়, তার অপূর্ব উদাহরণ এই ছবিগুলি। এই সূত্রেই মনে পড়বে ‘কর্ভাস’-এর ছবি। সত্যজিৎ তাঁর শিল্পীজীবনের একেবারে প্রথমে কিছু রঙিন ছবি এঁকেছিলেন, তাঁর রঙিন ছবি আঁকার প্রতিভা সেভাবে আর আমরা দেখতেই পেলাম না এই কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া। এদিক থেকে একেবারে এই শিল্পগুলি এক-একটি ঐতিহাসিক শিল্পগত উপকরণ।

আরও পড়ুন
যখন ছোট ছিলাম থেকে-১

নামাঙ্কনের এই ধরনটাকেই আরেকভাবে ব্যবহার করেন তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত গল্প ‘বাদুড় বিভীষিকা’-র নামাঙ্কনে। গল্পের নাম ‘বাদুড় বিভীষিকা’ লেখার ধরনটায় ছড়িয়ে রয়েছে বাদুড়ের দুটো ডানা। ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ গল্পের নামাঙ্কনে আরেক ধরনের শৈলী। সেই নামাঙ্কন এক অর্থে পিতা সুকুমার রায়ের লেখা আবোল তাবোল বইয়ের প্রথম কবিতার হেডপিসের প্রতি যেন পুত্রের এক ট্রিবিউট। কারণ ওই কবিতাতে ছিল একধরনের হোর্ডিং টাঙানোর ছবি আর এখানেও তাই। তবে এখানে তার তাৎপর্য আলাদা। এই পটলবাবু ফিল্মস্টার-এর নামাঙ্কনে দেখতে পাওয়া যায় পাঁচজন লোকের কাঁধে যেন বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিরাট বড়ো একটা হোর্ডিং--- বুঝি কোনো সিনেমার জন্য তৈরি সেই হোর্ডিং, যার উপরে লেখা গল্পের নাম আর সেই লেখার মাঝখানে রয়েছে হাসমুখ পটলবাবুর ছবি। এই এমন একটা কিছু ঘটবে বলেই তো ভেবেছিলেন পটলবাবু! কখনো একটু যদি মন দিয়ে দেখেন এই নামাঙ্কনের ওই পাঁচজন লোকের ওই বিরাট হোর্ডিং ধরার ভঙ্গিও কত যথাযথ। একদিকে উঁচু হয়ে গেছে বলে নেমে গেছে অন্যদিক। মাঝখানের জন কোনো রকমে ব্যালান্স করছে তাকে। এমনকি একেবারে ডানদিকে যে লোকটি, যার জন্য হোর্ডিংটা নেমে গেছে সে আবার পিছন ফিরে দেখছে পিছনের লোকেদের অবস্থা। আর একেবারে বাঁদিকে যে লোকটি, তার দিকে হোর্ডিং নেমে যাওয়ার জন্য তার সেই বিরাট বড়ো ওজন ধরে রাখার জন্য কী দম-ফেলা চেষ্টা! ওইটুকুন এক-একটা ফিগার, কিন্তু প্রতিটি চরিত্র যেন কে কী কথা বলছে, তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

আরও পড়ুন
একটা ঠিকানা আর একটা ধাঁধা

এ এক আশ্চর্য অন্য ধরনের অভিনব শিল্পসৃজন সত্যজিতের। অথচ এই শিল্পকলা তো ধরে রাখার চেষ্টা করেনি গ্রন্থশিল্প। উত্তরকালের কাছে তো সত্যজিতের বই নতুন করে তৈরি করার সময় এই শিল্পগুলি পুনরুদ্ধার করার কথা ভাবেনি বাংলা গ্রন্থশিল্প। ফলে পত্রিকার পাতা থেকে হারিয়ে গেছে বা হারিয়ে যাচ্ছে তারা, এই নতুন সত্যজিতের অভিনব কলমকারি-র সংরক্ষণ যে খুব দরকারি পরবর্তীকালের জন্য। শতবর্ষে সত্যজিতের লেখাগুলি এই নতুন ধরনে নতুন চেহারায় রাখার কথা যদি ভাবা যেত, তাহলে কিন্তু একটা ভালো কাজ হতে পারত।

তবে এই কথাগুলো অন্তত এই কলমকারির কথায় চলতে থাকুক। ফলে সেই সূত্রেই ফেলুদার গল্পমালাতে অন্য আরেকভাবে যে নামাঙ্কনের শিল্পরূপ তৈরি করে ছিলেন সত্যজিৎ, পরের কিস্তিতে তা নিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।  

Powered by Froala Editor