মানিকলমকারি - ৪৬
আগের পর্বে
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’-তে যেমন খুঁজে পাওয়া যায় ভৃত্যরাজকতার ছবি, তেমনই সত্যজিৎ রায়ের শৈশবেরও একটা বড়ো অংশজুড়ে আছে চাকর-বাকররা। তার মধ্যে গিরিডির ভৃত্য প্রহ্লাদকে তিনি ফিরিয়ে এনেছিলেন প্রফেসর শঙ্কুর কাহিনিতে। আবার ‘যখন ছোট ছিলাম’ থেকে জানা যায় গড়পারের বাড়ির ভৃত্যদের কথাও। গড়পার ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতায় উঠে আসার সময় শিশু সত্যজিৎ স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁদের বামনির ছেলে হরেনকে নিয়ে। স্মৃতিতে ফিরে এসেছে শ্যামা-ঝির ছেলে ছেদির ঘুড়ি ওড়ানোর কথাও। আর উপেন্দ্রকিশোরের খাস ভৃত্য রামদহিনকে তো রীতিমতো হুকুম তালিমের নির্দেশ দিতেন তিনি। ছোটবেলায় আঁকাবাঁকা হাতে ছবি এঁকে বলতেন তা সন্দেশে বেরোবে। আর রামদহিনও মাথা নেড়ে তাতেই সম্মতি জানাতো। ছেদি বা রামদহিনের এই শিল্পী মনই কি পরে উঠে এসেছিল ‘রামধনের বাঁশি’ গল্পে?
সেদিন একটি লেখায় দেখলাম কেউ কেউ বলছেন, ১৯৬১ থেকে প্রফেসর শঙ্কুর জয়যাত্রার শুরু। তাই কি? এখানে একটা মজার অঙ্ক হাজির করা দরকার। স্পষ্ট করে মনে রাখা চাই, ফেলুদার গল্প যেমন গল্প লেখার সময়ের সঙ্গে যুক্ত, প্রোফেসর শঙ্কুর গল্পের ব্যাপারটা কিন্তু আদৌ তা নয়। মানে ধরা যাক, ১৯৭১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকার পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত হল ‘সোনার কেল্লা’। সেখানে তোপসে শুনতে পায় বাইরে বাজছে ‘কাটি পতঙ্গ’ ছবির গান। মানে ১৯৭১ সালের গল্পে ১৯৭১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি ছবির গানই তো শুনছে তোপসে। এই সময়ের সরল হিসেবটা কিন্তু প্রোফেসর শঙ্কুর গল্পের ক্ষেত্রে খাটবে না। সেখানে হিসেবটা একটু জটিল, তাই সেটা একটু খুলে বলা যাক।
লক্ষ করে দেখতে হবে, ১৯৬১ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় যখন ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ বেরোলো, তখন থেকেই সেই গল্পে অনেকগুলো সময়ের খেলা আছে। গল্পটা বলা শুরু হয় এক ‘উত্তম পুরুষীয়’ কথকের বলা দিয়ে। গল্পটা বলতে শুরু করে একজন ‘আমি’ কথক। সেই কথক ‘আমি’ লেখেন, ‘প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর ডায়রিটা আমি পাই তারক চাটুজ্যের কাছ থেকে।’ এই ‘আমি’ একটি পত্রিকার দপ্তরে কাজ করেন, নিজেও গল্প লেখেন, পুজোর সময় পত্রিকায় লেখার প্রুফ দেখেন, সেই ‘আমি’-র কাছেই জনৈক তারক চাটুজ্যে ১৯৬১ সালে হাজির হলেন প্রোফেসর শঙ্কুর ডায়রিখানা নিয়ে। ওই কথকই জানান, ‘প্রোফেসর শঙ্কু বছর পনেরো নিরুদ্দেশ’! বছর পনেরো? মানে, মোটামুটি স্বদেশের স্বাধীনতার আশেপাশে, ১৯৪৬-৪৭ সাল নাগাদ থেকেই প্রোফেসর শঙ্কু নিরুদ্দেশ। তার মানে তিনি যৎযাবতীয় গবেষণা করেছেন স্বাধীনতার অনেক আগেই। তার মানে সারা দেশে যখন ইংরেজদের শাসনকাল চলছে, সেই সময়ে কলকাতা থেকে বেশ দূরে সেই ঔপনিবেশিক আবহে এক বাঙালি বিজ্ঞানী এমন সব গবেষণা করে চলেছে, যার ফলে তামাম দুনিয়ার বিজ্ঞানীমহল অভিভূত। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে তাই যখন দেখি ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের। শুনি তাঁদের মুখে প্রোফেসর শঙ্কুর হরেক প্রশংসা, তার একটা অন্য মানে আছে বই কী! কিংবা ধরা যাক, ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত’ গল্পে যখন গিরিডির এই প্রখর বিজ্ঞানী লেখেন ‘অন্ধকূপ হত্যার ব্যাপারটা জানবার জন্য আজ ভেবেছিলাম সিরাজদ্দৌলাকে একবার আনব’--- তখনো তার মানে বেশ অন্য রকম। এই গল্পে শুনতে পাই বিজ্ঞানী লেখেন ‘সাতাশ বছর হল গিরিডিতে আছি’। পরে দেখব আমরা জন্ম থেকেই, জন্ম থেকেই বলছি কেন, পুরুষানুক্রমে, বাপের আমল থেকেই এই গিরিডির বাসিন্দা শঙ্কু এবং আরেকটা হিসেব থেকে দেখব, তাঁর জন্ম মোটামুটি ১৯১২ সাল নাগাদ। মানে ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু তাঁর স্রষ্টার থেকে ঠিক দশ বছরের বড়ো। এই অঙ্ক মেনে নিলে, ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত’ গল্পের সময়কাল ১৯৩৯।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এই অঙ্ক আমরা মানবো কেন? শঙ্কুর গল্প ডায়রির ধরনে লেখা বটে, কিন্তু কোনো গল্পেই তো সালের উল্লেখ নেই, আছে শুধু তারিখের কথা। সেখান থেকে সালতামামি পাবো কীভাবে? বলা বাহুল্য, ১৯৬১ সালে যখন সত্যজিৎ ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ লিখছেন, তখন তিনি তার পনেরো বছর আগে থেকে শঙ্কুর নিরুদ্দেশ কথাটা লেখার সময় তো নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন এই সময়ের গণিত। তবে, তাঁর সেই অঙ্ক যে আকস্মিক নয়, তার মোক্ষম প্রমাণ প্রায় শেষের দিকে, ১৯৯০ সালে লেখা শঙ্কুর গল্প ‘স্বর্ণপর্ণী’। এই গল্পেই শঙ্কু তার ডায়ারির ভেতরে যে গল্পটা তিনি বলছেন, সেই গল্পের সালটি লিখেছিলেন। তিনি ১৯৩৭ সালের ২৫ অক্টোবর জাহাজে চড়ে ইংলন্ড রওয়ানা হলেন। তবে আগের ওই বাক্যটি একটু জটিল হল, কারণ বিষয়টাই জটিল। লক্ষণীয় মজার ব্যাপার হল, এই গল্পটা ঠিক প্রোফেসর শঙ্কুর ডায়রি নয়। কারণ এই গল্পটা ১৬ জুন-এ লেখা হলেও, এর কাহিনিটি শঙ্কুর জীবনে সেই বিখ্যাত সর্বরোগহর মিরাকিউরল আবিষ্কারের স্মৃতিকথা। সেখানেই দেখি মিরাকিউরল আবিষ্কারের সময়ে শঙ্কুর বয়স ছিল পঁচিশ। গল্পে তার বন্ধু সন্ডার্স তাকে লেখে তাদের দুজনেরই প্রায় সমান বয়স। আর তা হল ২৫। গণিতটি তাহলে সহজ। ১৯৩৭ সালে যার বয়স ২৫, তার জন্ম তার মানে ১৯১২ সালে। সাল ১৯১২ হলেও জন্মদিনে একটা দিনের গণ্ডগোল আছে। এক জায়াগায় দেখা যায় শঙ্কুর জন্ম ১৬ জুন, আর অন্য একটি অপ্রকাশিত গল্পে দেখি শঙ্কুর জন্মদিন ১৬ অক্টোবর। সে এক অন্য মজা। পরে বলবো যথাস্থানে।
আরও পড়ুন
যখন ছোট ছিলাম থেকে-২
সেই ‘স্বর্ণপর্ণী’-তেই অঙ্ক কষে দেখা যাবে শঙ্কুর পুষ্যি মার্জার নিউটনের জন্ম ১৯১৩। শঙ্কু ১৯২৪-এ গিরিডির ইশকুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতায় যায় আই এসসি পড়তে। এরপরে কলকাতা থেকে ১৯২৬-এ আই এসসি আর ১৯২৮-এ ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রিতে ডবল অনার্স নিয়ে বি এসসি। এরই মধ্যে ‘স্বপ্নদ্বীপ’ গল্পের সাক্ষ্যে ১৯২৫ সালে শঙ্কুর মাত্র তেরো বছর বয়সে মাথায় প্রথম পাকা চুল দেখা যায় আর ‘একুশে পড়তে না পড়তেই আমার মাথা-জোড়া টাক--- কেবল কানের দুপাশে, ঘাড়ের কাছটায় আর ব্রহ্মতালুর জায়গায় সামান্য কয়েকগাছা পাকা চুল।’ এটাই তো শঙ্কুর চেনা-চেহারা, যেটা তার মানে ১৯৩২-৩৩ সালে, শঙ্কুর এখনকার চেহারাটা তৈরি হয়ে গেছে তারপরে আর নট নড়ন নট চড়ন।
আরও পড়ুন
যখন ছোট ছিলাম থেকে-১
বিজ্ঞান পড়ার পাট শেষ করার পরে ত্রিলোকেশ্বরের বাবা ত্রিপুরেশ্বর ছেলেকে বললেন, ‘এবার বছর চারেক অন্য বিষয়’ নিয়ে তার পড়াশোনা করা উচিত। ফলে বাবার কথামতো আরো চার বছর শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস আর দর্শন পড়ে স্কটিশচার্চ কলেজে শঙ্কু পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে পড়াতে ঢুকলেন ১৯৩২-এ। এরপরে ১৯৩৫-এ শঙ্কুর বাবা ত্রিপুরেশ্বরের হার্টব্লক, তিনি মারা গেলেন ১৯৩৭-এ পঞ্চাশ বছর বয়সে। তার মানে ত্রিলোকেশ্বরের বাবা ত্রিপুরেশ্বরের জন্ম ১৮৮৭-তে। সালটি নজরে আসতেই একটু থমকে দাঁড়াতে হল--- কারণ কী আশ্চর্য, সত্যজিতের বাবা সুকুমারও জন্মেছিলেন ১৮৮৭-তে আর তিনিও ঠিক ওই কুড়ি বছর বয়সেই, ১৯০৬ সালে, পদার্থবিদ্যা আর রসায়নে ডবল অনার্স নিয়ে বি এসসি পাস করেন। ত্রিলোকেশ্বরের বাবার জন্মসাল আর ত্রিলোকেশ্বরের পড়াশোনার ভেতরে একেবারে অঙ্ক মিলিয়ে সুকুমারকে বসিয়ে নিয়েছেন সত্যজিৎ।
আরও পড়ুন
একটা ঠিকানা আর একটা ধাঁধা
এই অঙ্কটাকে মাথায় রেখে আর তাকে আরো নিপুণভাবে গোনাগাঁথা করে আমাদের এরপরে শঙ্কু-কাহিনি পড়া দরকার। মনে রাখতেই হবে শঙ্কুর গল্পের একটি বিশেষ পর্বের কাহিনিকাল ওপনিবেশিক ভারতবর্ষ। সেই অনুসারেই হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিভিন্ন ডালপালার সঙ্গে শঙ্কুর সম্পর্ক বোঝা দরকার। সত্যজিতের ফেলুদার গল্প থেকে ছবি করলে যেমন তার নিজস্ব সময়ের মাত্রাটিকে ভুলে গেলে ফেলুদা-ফ্যানেরা আহত হন, শঙ্কুর চলচ্চিত্রায়ণেও সেই মাত্রাটি যে আরো জটিল সেটা বোঝাও কিন্তু অত্যন্ত দরকারি।
আরও পড়ুন
বৈকুণ্ঠ মল্লিক: কবি আর মাস্টারমশাই
এবারে আসি শঙ্কুর সেই জন্মদিনের হিসেবে। ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পের পাঠ থেকে মনে হবে, সেই যে পনেরো বছর আগে শঙ্কু হারিয়ে গেছিলেন, তাঁর যে নিরুদ্দেশ সম্পর্কে কেউ ভাবত তিনি মারা গেছেন, কেউ ভাবত তিনি লুকিয়ে কোনো গোপন আবিষ্কারের কাজ করছেন। সেই নিরুদ্দিষ্ট শঙ্কুর ঠিকানা বুঝি টাফা গ্রহ। সৌর সংসারের বাইরে এই টাফা গ্রহে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সত্যজিতের খসড়া খাতায় ১৯৯১ সালে লেখা একটি ড্রাফ্ট ‘ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা’ শুরুই হচ্ছে এই রকম একটা লাইন দিয়ে। শঙ্কু ১৬ অক্টোবর লিখছেন ‘আজ আমার পঁচাত্তর বছর পূর্ণ হল’। অঙ্কে অঙ্কে চমকে উঠতে হয়। ১৯১২ সালে প্রোফেসরের জন্ম হলে, তাঁর পঁচাত্তর বছর পূর্ণ হল কোন সালে? ১৯৮৯!! ফেলুদার গল্পের লেখার সময়ের সঙ্গে ঘটনার সময় মিশে ছিলই, দেখছি শঙ্কুর গল্পেও ক্রমশ লেখার সময়ের সঙ্গে ঘটনার সময় মিলে যাচ্ছে।
ঠিক এই রকমই আরেকটি হিসেব হাজির করি? ওই ‘স্বপ্নদ্বীপ’ গল্পে শঙ্কু নিজের প্রথম পাকা চুল আর টাক পড়ে যাওয়ার কথা বলে লিখেছিল, ‘আজও আমার যা চেহারা, পঁয়তাল্লিশ বছর আগেও ছিল ঠিক তাই’। এ-ও এক নিপুণ পাকা হিসেব। শঙ্কুর যখন চুলে পাক ধরে তার মাথায় টাক পড়তে শুরু করে ওই তেরো বছর বয়স থেকে। তার মানে ক্যালেন্ডারে তখন ১৯২৫-২৬ সাল। সেই ১৯২৫-২৬ সাল থেকে ৪৫ বছর পরের সময়ে চলে আসুন, ক্যালেন্ডার বলবে সালটা হল ১৯৭১। মজার ব্যাপার হল ‘স্বপ্নদ্বীপ’ গল্পটি প্রকাশিত হচ্ছে ওই ১৯৭১ সালেই!!
কীমাশ্চর্যম্ এই হিসেবপত্র!! এই অঙ্ক সত্যি হলে, তো শঙ্কুর গল্পের ক্যালেন্ডারটাই বদলে যায়। তার মানে সেই টাফা গ্রহে তো নিরুদ্দেশ হননি তিনি, সেখান থেকে তো ফিরেও এসেছেন শঙ্কু। তিনি তো ১৯৪৬-৪৭-এ নিরুদ্দেশ হননি! শঙ্কুর জীবনপঞ্জির এইসব খুঁটিনাটি অঙ্ক থেকে শঙ্কুর গল্পমালা নতুন করে পড়ার দরকার নয় কী?
Powered by Froala Editor