মানিকলমকারি - ৪৫
আগের পর্বে
সত্যজিৎ রায়ের ছেলেবেলার স্মৃতি থেকে লেখা ‘যখন ছোটো ছিলাম’ প্রথম পড়া হয় একভাবে। কিন্তু সেই লেখাই যখন তাঁর অন্যান্য সৃষ্টির সঙ্গে মিলিয়ে পড়া হয় তখন অন্যরকম চেহারা নেয়। একেবারে ছোটোবেলার গিরিডির কথা ফিরে এসেছে প্রফেসর শঙ্কুর গল্পে। এমনকি গিরিডির বৃদ্ধ চাকর প্রহ্লাদকে বানিয়ে দিলেন শঙ্কুর চাকর। তাদের চেহারার বর্ণনাতেও অদ্ভুত মিল। আবার দার্জিলিং এবং লখনৌ ভ্রমণের স্মৃতি ফিরে এসেছে ফেলুদার প্রথম গল্প ও প্রথম উপন্যাসে। শৈশবে মনের মধ্যে দাগ কাটা স্মৃতিই ফিরে এসেছে সেখানে। ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ গল্পে পাই হাজারিবাগের অভিজ্ঞতা। সেখানে শিশু সত্যজিতের বাঘ দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি। কিন্তু তোপসে আর লালমোহনবাবুর সেই সৌভাগ্য ঘটালেন। পিসতুতো দাদার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোও ফিরে এল গল্পের নানা পরতে।
‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ের একদিকে ছিল স্থানের স্মৃতি। ফলে সেই স্থানের স্মৃতি ধরেই যেমন ক্রমশ এসেছিল গড়পার রোড থেকে দার্জিলিং- গিরিডির কথা, ঠিক তেমনভাবেই সেই স্মৃতিপথের অনুষঙ্গেই কখনো তৈরি হয়ে উঠছিল তাঁর গল্পের পটভূমি। সেই পটভূমি তৈরির একটা সুলুকসন্ধান করা গিয়েছিল আগের কিস্তিতে। এই কিস্তিতে ওই বইয়ের কিছু মানুষের সন্ধান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মতি’ বইয়ের ভিতরে একটি গোটা অধ্যায়ের নাম ছিল ‘ভৃত্যরাজকতন্ত্র’। সে অধ্যায় শুরুই হয়েছিল এইভাবে, ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসে দাসরাজাদের রাজত্বকাল সুখের ছিল না। আমার জীবনের ইতিহাসেও ভৃত্যদের শাসনকালটা যখন আলোচনা করিয়া দেখি তখন তাহার মধ্যে মহিমা বা আনন্দ কিছুই দেখিতে পাই না।’ ছেলেবেলায় ভৃত্যদের হাতে যে রীতিমতো প্রহার পেতে হয়েছে শিশু রবীন্দ্রনাথকে সেই কথাটা স্বয়ং তিনি বলা সত্ত্বেও, লক্ষ করে দেখি পরবর্তী সমালোচকরা ভৃত্যরাজকতন্ত্রের কথা শুরু করেন ঈশ্বরের কথা দিয়ে। এ এক অদ্ভুত পাঠাভ্যাস আমাদের। বেশির ভাগ চাকর-বাকর শিশু রবীন্দ্রনাথকে নিগৃহ করত, তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘পিঠে যাহা পড়িত তাহা পিঠে করিয়াই লইতাম এবং মনে জানিতাম, সংসারের ধর্মই এই--- বড়ো যে সে মারে, আর ছোটো যে সে মার খায়।’ এইসব ভৃত্য, যাদের হাতে নিগৃহীত হলেন, তাদের কথা সৌজন্যবশত আর লিখলেন না রবীন্দ্রনাথ। উল্টে বিশেষ করে তাদের মধ্যে বেশ ব্যতিক্রমী বলেই তিনি বললেন ঈশ্বরের কথা। আর আমাদের পড়ার ধরনটা এমনই হয়ে দাঁড়াল যে, তাদের সবার কথা ছেড়ে যে-ঈশ্বর ছিলেন বিশেষভাবে ব্যতিক্রমী, তার টুকটাক দোষগুলিকেই আমরা শিশু রবীন্দ্রনাথের ওপর ভৃত্যরাজকতন্ত্রের উৎপাতের নিদর্শন হিসেবে মনে রেখে দিলাম। বেপথু-পাঠের এ এক আশ্চর্য নমুনা!
মজার ব্যাপার হল, সত্যজিতের শৈশবেও কিন্তু রয়েছে এমন একটি ভৃত্যরাজকতন্ত্রের অধ্যায়। তবে তার গতিপথ আর মেজাজ সম্পূর্ণ আলাদা। গত কিস্তিতে আমরা পেয়েছিলাম, পিতা সুকুমার চলে যাওয়ার পরে, উশ্রী নদীর ধারে রায়বাড়ির ‘বুড়ো চাকর প্রয়াগ’-এর কথা। দেখেছিলাম, প্রয়াগ-ই কীভাবে একেবারে শিশু সত্যজিৎকে প্রথম শিখিয়েছিলেন মাটি খুঁড়ে জল দেখতে পাওয়া যায়, তার বিজ্ঞানসম্মত কৌতূহলের কথা। দেখেছিলাম, বহু পরে, হয়ত সেই প্রয়াগ-ই আরেকভাবে ফিরে এসেছে গিরিডিতে উশ্রীনদীর ধারে প্রফেসর শঙ্কুর ভৃত্য হয়ে। সেও এক প্রত্যাবর্তন বই-কী।
এই সূত্রেই লক্ষণীয়, সত্যজিৎ ‘যখন ছোট ছিলাম’-এর ভূমিকাতে একটি চমৎকার কথা লিখেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমার এই স্মৃতিকথায়… আছে কিছু নামকরা লোকের পাশে পাশে অনেক সাধারণ লোকের কথা। সাধারণ- অসাধারণের প্রভেদ বড়দের মতো করে ছোটরা করে না, তাই তাদের মেলামেশার কোনো বাছবিচার থাকে না। এ ব্যাপারে গুরুজনদের বিচার যে ছোটরা সব সময় বোঝে বা মানে তাও নয়।’ লক্ষণীয়, ওই ভূমিকাতেই তিনি বলেছিলেন, তাঁর জীবনের একটা বড়ো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যদি হয় ১০০ নং গড়পার রোডের বাড়ি থেকে দক্ষিণ কলকাতায় চলে আসা, তো সেই চলে আসার দিন সম্পর্কে তাঁর মনে হল, ‘পুরোনো বাড়ি থেকে নতুন বাড়ি চলে আসার দিনটা আমি বেমালুম ভুলে গেছি, কিন্তু গড়পারে থাকতে আমাদের রাঁধুনি বামনির ছেলে হরেনের বিষয় একটা খুব সাধারণ স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেটা আজও স্পষ্ট মনে আছে।’ ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ তো ছিল সেই হরেনের কথা। সত্যজিৎ লিখেছিলেন, গড়পার রোডের বাড়িতে ‘আমার নিজের ভাইবোন না থাকলেও, বাড়িতে যে সঙ্গী ছিল না তা নয়। রাঁধুনি বামনির ছেলে হরেন ছিল আমার বয়সী, শ্যামা ঝিয়ের ছেলে ছেদি আমার চেয়ে বছর চার-পাঁচেকের বড়।’ শ্যামা ঝি-র কথায় মতিহারি-র টান থাকলেও তার ছেলে ছেদি বাংলা বলতে পারত। তার অনেক গুণের মধ্যে একটা ছিল ‘ঘুড়ির প্যাঁচের কেরামতি।’ ছোট্ট সত্যজিতের কাজ ছিল সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার সময় তাদের সঙ্গে থাকা আর ঘুড়ি ওড়ানোর সময় তাদের লাটাই ধরা। এই ছেদি সম্পর্কে সেই শৈশব স্মৃতি মনে করে ষাট বছরের সত্যজিৎ লিখলেন, ‘ছেদির হাতের কাজ ছিল বেশ ভালো’। সে কালীপুজোর সময় রঙিন ফানুস বানাতে পারত, চাবি-পটকা বানাতে পারত, দইয়ের ভাঁড় দিয়ে একরকম বাহারি লন্ঠন তৈরি করতে পারত।
আরও পড়ুন
যখন ছোট ছিলাম থেকে-১
এই সমবয়সী সঙ্গীদের সঙ্গেই শিশু সত্যজিতের মনে ছিল বিহারপ্রদেশ থেকে আসা আরেক অভিভাবকস্থানীয় ভৃত্যের কথা। নাম তাঁর রামদহিন। এই রামদহিন খোদ উপেন্দ্রকিশোরের খাসলোক ছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর তাঁকে নিজের হাতে শিখিয়েছিলেন প্রেসের কাজ। এই সময়ের দূরত্ব থেকে ভাবলে চমকে উঠতে হয়, ঈর্ষান্বিত হতে হয় সেই রামদহিনের গুরুভাগ্যে। ভাবা যায়, তিনি খোদ উপেন্দ্রকিশোরের কাছে তিনি শিখছেন প্রেসের কাজ! এই রামদহিনকে একটা কাগজে হিজিবিজি কিছু এঁকে সেই নেহাত শিশু সত্যজিৎ সরলমনে বলতেন, ‘রামদহিন, এটা সন্দেশে বেরোবে।’ সত্যজিৎ লিখেছেন, ‘রামদহিন তক্ষুনি মাথা নেড়ে বলে দিত, ‘হাঁ খোখাবাবু হাঁ।’ শুধু তাই না, আমার ছবি ক্যামেরার নিচের দিকে মুখ করা লেন্সের তলায় বিছিয়ে রেখে আমাকে কোলো তুলে ক্যামেরার পিছনের ঘষা কাঁচে দেখিয়ে দিত সে ছবির উল্টো ছায়া।’ শুধু গুরুভাগ্যই নয়, তার এই অপরূপ মনিবভাগ্যটিও স্মরণীয়। প্রায় একশো বছরের এপারে দাঁড়িয়ে ভেবে দেখতে অবাক লাগে বই কী, খোদ সত্যজিৎ রায়ের প্রথম আঁকা ছবি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল রামদহিনের! আর তাঁর দিক থেকেও ওই খুদে মনিবের প্রতি তাঁর কী অসামান্য এই স্নেহের প্রকাশ। সত্যজিৎ তাঁর শিল্পী জীবনে উৎসাহ কম পাননি, প্রশংসা আর মূল্যায়নও তো এখনো ধারাবাহিক। কিন্তু সেই সবের থেকে বড়ো ওই রামদহিনের ‘হাঁ খোঁখাবাবু হাঁ।’
আরও পড়ুন
একটা ঠিকানা আর একটা ধাঁধা
এখানেও একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করা যায়। সত্যজিৎ রায়ের লেখা রামদহিনকে বলা ওই বাক্যটি দেখা যায়, আমরা ভুলভাবে পড়ি। মনে করে দেখুন, আমরা সাধারণভাবে পড়ি ‘রামদহিন, এটা সন্দেশে বেরোবে?’ অর্থাৎ, শিশু সত্যজিৎ যেন জিজ্ঞাসা করছেন, এই ছবিটি কি সন্দেশ পত্রিকাতে প্রকাশিত হতে পারে? মন দিয়ে দেখুন, সত্যজিতের লেখা বাক্যটি কিন্তু জিজ্ঞাসা-চিহ্ন দিয়ে শেষ নয়--- দাঁড়ি বা পূর্ণযতি দিয়ে লেখা ওই বাক্যটি। অর্থাৎ, খুদে সত্যজিৎ যেন নির্দেশ দিচ্ছেন রামদহিনকে--- এই ছবিটি সন্দেশ-এ প্রকাশিত হবে। এটাই তো স্বাভাবিক সেই শিশুর পক্ষে। রামদহিনকে এই নির্দেশ দিতেই তো শুনেছে শিশু সত্যজিৎ, তার বাবা-কাকার কাছে। তার হাতে ছবি দিয়ে কাকা সুবিনয় রায় তা প্রকাশের নির্দেশ দিচ্ছেন। শিশু সত্যজিৎও সেই নির্দেশই দিচ্ছে রামদহিনকে। মানে, শিশুর কাছে ছবিটি প্রকাশযোগ্য কি না, প্রশ্ন আদৌ সেটা নয়। ওই রমদহিনের বলা, ‘হাঁ খোঁখাবাবু হাঁ’-র অর্থও তার মানে, নিশ্চয়ই বেরোবে খোকাবাবু এই কথাটা নয়, এই ‘হাঁ খোঁখাবাবু হাঁ’-এর মধ্যে আছে বেশ খোকাবাবু, আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য--- এই ভাবটি। ওই ছোট্টো যতিচিহ্নটি দিয়ে পড়লে সেই মুহূর্তটির মজা যেন বহুগুণিত হয়ে যায় শতবর্ষের এ-পার থেকে।
রামদহিনের আসল নাম কী ছিল? রামধন? রামধন-ই কি স্থানীয় উচ্চারণে হয়ে যায় রামদহিন? মনে পড়ে যাবে, ‘যখন ছোট ছিলাম’ লেখার বর চারেক পরে, সত্যজিৎ লিখবেন একটি গল্প ‘রামধনের বাঁশি’। রামধন খগেশবাবুর বাড়িতে কাজ করতে আসে যখন, তখন তার বয়স মাত্র সতেরো। বাড়ির ‘সকলে তাকে দিয়ে ফাইফরমাশ খাটিয়ে নেয় আর কথায় কথায় ধমক লাগায়।’ গড়পারের রামদহিনও কাজে যোগ দিয়েছিল সামান্য বেয়ারা হিসেবে। গড়পারের রামদহিন তার কাজের মধ্যে তার মনিব উপেন্দ্রকিশোরের কাছে ছবি আর ক্যামেরার কাজ শিখেছিল, গল্পের রামধনের বাড়ির সব কাজ করে নিজের অবসর ছিল বাঁশি বাজানোর। একেবারে অন্য রকম দুই মনিবের কাহিনি, একেবারে অন্যরকম দুই মেজাজের কথা। তবে ওই ভৃত্যের ভেতরে এক অন্য শিল্পীমনের সন্ধান শিশু সত্যজিৎ পেয়েছিলেন গড়পারের ছেদি আর রামদহিনের মধ্যে, সেটাই বুঝি অন্যভাবে ফিরে এলো রামধনের কাহিনিতে। ছবি, ফানুস-বানানোর কসরত বদলে গেল বাঁশি-বাজানোর গল্পে। সবাই তো শিল্পী।
আরও পড়ুন
বৈকুণ্ঠ মল্লিক: কবি আর মাস্টারমশাই
Powered by Froala Editor