একটা ঠিকানা আর একটা ধাঁধা

মানিকলমকারি - ৪৩
আগের পর্বে

ফেলুদার পরের দিকের গল্পের এক অপরিহার্য চরিত্র বৈকুণ্ঠ মল্লিক। তিনি সমস্ত গল্পে থেকেও নেই। তাঁর কবিতা আছে একদা ছাত্র লালমোহন গাঙ্গুলির বয়ানে। এথিনিয়াম ইনস্টিটিউশনের এই কবি-মাস্টার বৈকুণ্ঠ মল্লিক নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর কবিতায় প্রকৃতির প্রভাব থাকবেই। এই মাস্টারমশাইয়ের উপর জটায়ুর এতই শ্রদ্ধা, যে প্রয়োজনে তোপসে এমনকি ফেলুদাকেও দু-কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়েন না। অন্ত্যমিলের ব্যবহার সত্যজিতের লেখাতে আগেও বারবার এসেছে। এমনকি ফেলুদার লেখা লিমেরিকগুলোও রয়েছে। তবে বৈকুণ্ঠ মল্লিকের কবিতার ভাব ফুটিয়ে তুলতে ভাষা ব্যবহারের বেশ পুরনো রীতিও আয়ত্ত করেছিলেন সত্যজিৎ রায়।

লালমোহনবাবুর প্রিয় বাংলার মাস্টারমশাই বৈকুণ্ঠ মল্লিককে সত্যজিৎ পেয়েছিলেন কোথা থেকে? সত্যজিতের নিজের বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের দিনগুলিতে তিনি পেয়েছিলেন একজন স্বনামধন্য বাংলার কবিকে তাঁর বাংলার মাস্টারমশাই হিসেবে। তাঁর কথা বলেও গেছেন ‘যখন ছোট ছিলাম’-এর স্কুল-সম্পর্কিত স্মৃতিকথা অধ্যায়ে। লিখেছিলেন, তাঁর স্কুলজীবনের শিক্ষকদের মধ্যেই ছিলেন, কবি গোলাম মোস্তাফা। তিনি তাঁদের বছরখানেক বাংলা পড়িয়েছিলেন। তাঁর একটি কবিতা আবার সত্যজিতের শৈশবে তাঁদের পাঠ্যও ছিল। সত্যজিতের মনেও ছিল সেই কবিতাটির লাইন। কবিতার শুরুটি ছিল এই রকম,

‘আনমনে একা একা পথ চলিতে/ দেখিলাম ছোট মেয়ে ছোট গলিতে।’

মোস্তাফা সাহেব পূর্ববঙ্গের মানুষ বলে, ছ-কে উচ্চারণ করতেন স-এর মতো। তাই নিয়ে তাঁর এক দুষ্টু সহপাঠী গোপাল স্যরের সঙ্গে কী ধরনের মজা করেছিল তার গল্পও শুনিয়েছিলেন সত্যজিৎ। মোস্তাফা সাহেব ছিলেন সরল মানুষ। তিনি দুষ্টু ছাত্রের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, সত্যিই তিনি গলি দিয়ে যেতে যেতে একটি ছোট্টো মেয়েকে দেখে তার মাথায় টুক করে টোকা মেরে দিয়েছিলেন। ব্যস আর যায় কোথায়, বয়েজ্ স্কুলে এই তো যথেষ্ট! গোপালের প্রত্যুত্তর, ‘টোকা মারলেন স্যার? বাঃ!’ নিজের ছোটোবেলার কবি ও শিক্ষক এই সরল-মনের গোলাম মোস্তাফাই কি তাহলে ফিরে এলেন লালমোহনবাবুর বাংলার মাস্টারমশাই বৈকুণ্ঠ মল্লিক হয়ে?

প্রসঙ্গত, সত্যজিৎ মোস্তাফা সাহেবের যে কবিতাটির দু-লাইন মনে রেখে এখানে লিখেছিলেন, জানানো দরকার, স্মৃতি থেকে লেখা হলেও লাইন দুটি কিন্তু এক্কেবারে হুবহু ঠিক। গোলাম মোস্তাফার এই কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসী’ পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩২৯ সনে, মানে ১৯২২ সালের শেষে। পরে কবিতাটি তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘রক্তরাগ’-এর অন্তর্ভুক্ত হয়। কবিতাটিতে ছিল ‘ফণিনীর মতো পিঠে বেণি ঝুলিছে/ চঞ্চল সমীরণে দুল দুলিছে/ মঞ্জীর ধ্বনি বাজে চল চরণে/ মিহি নীল ফুরফুরে শাড়ি পরনে।’ এরপরে আবার ছিল, ‘বস্ত্রের আবরণ-কারা টুটিয়া/ অঙ্গের হেম-আভা পড়ে লুটিয়া!/ মিষ্টি মধুর আঁখি, দৃষ্টি চপল,/ বঙ্কিম ক্ষীণাধর, রক্ত কপোল!’ ইশকুল পাঠ্য বইতে ওই বয়সের রক্ত ছলছল করে ওঠার মতো কবিতাই বটে। ফলে সেই কবিতাটি পুরোটা দেখলে বোঝা যাবে দুষ্টু ছাত্র গোপলা কেন ওইভাবে মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসা করেছিল। আর সেই কবিতাতেই ছিল যে, ‘ছুঁয়ে দিনু কেশপাশ ভালোবাসিয়া/ নেচে নেচে গেল সে যে মৃদু হাসিয়া।’ বলা বাহুল্য কোন তাৎপর্যে মোস্তাফা সাহেবের ওই ‘মাথায় টুক করে একটা টোকা মেরে দিলাম’ লাইনটি পড়েছিল সেই চপলমতি বালক ছাত্র। তবে, সত্যজিতের এই কবিতাটি মনে থাকার অন্যতম কারণ বোধ করি অন্য--- কারণ, জানেন কি এই কবিতাটির নাম কী ছিল? কবিতাটির নাম ছিল ‘কুড়ানো মানিক’। স্কুলের বন্ধুদের কাছে নিজের ডাকনাম বলে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ--- ফলে বন্ধুরা তাঁকে সেই নামেই ডাকত। ওই দুষ্টু ছেলের দল, এই কবিতার শিরোনামে সত্যজিতের ডাকনাম দেখে তাঁকে কিছু বলেছিল কি না, সে খবর অবশ্য ওই স্মৃতিকথায় নেই। মোট কথা, গোলাম মোস্তাফার কবিতার ভাষার সারল্য, তাঁর প্রকৃতিপ্রেম আর একটু পুরোনো দিনের ভাষার ধরনটিই যেন সত্যজিৎ ফিরিয়ে আনলেন বৈকুণ্ঠ মল্লিকের কাব্যভাষায়। এই গোলাম মোস্তাফারই লেখা বিখ্যাত চরণ হল, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।

আরও পড়ুন
বৈকুণ্ঠ মল্লিক: কবি আর মাস্টারমশাই

গড়পার রোডের বাড়ির সামনে সত্যজিৎ

 

আরও পড়ুন
গল্পে জন্মদিন আর জন্মদিনের গল্প

এবারে এই বৈকুণ্ঠ মল্লিকের সূত্রেই একটি অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। ফেলুদার গল্পেই দেখি ওই বৈকুণ্ঠবাবুও ছিলেন লালমোহনবাবুর বাংলার শিক্ষক। তিনি আবার যে স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তার নাম এথিনিয়ম ইনস্টিটিউট। এখন লালমোহনবাবুর বয়স ‘সোনার কেল্লা’ গল্পে দেখা যাচ্ছে, তোপসের ভাষায়, ‘কমপক্ষে পঁয়ত্রিশ’। ‘সোনার কেল্লা’ ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। তার মানে অনুমান করা চলে ১৯৩৫-৩৬ সালে তাঁর জন্ম। অনেক পরে, ‘এবার কাণ্ড কেদারনাথে’ তো লালমোহন স্পষ্ট জানিয়েই দেন, তাঁর জন্ম ১৯৩৬-এ। মজার ব্যাপার হল, লালমোহনবাবু এথিনিয়ম ইনস্টিটিউটে তাহলে পড়েছিলেন কবে? ধরা যাক, ১৯৪২-৪৩ থেকে ১৯৫২-৫৩ সময়কাল। বেশ! এটা একটা অঙ্ক। এবার একটা অন্য অঙ্কে যাওয়া যাক, এই এথিনিয়ম ইনস্টিটিউট তার বর্তমান ঠিকানায় স্থানান্তরিত হয় ১৯৩১ সালে। তার মানে, এখন যেখানে এথিনিয়ম ইনস্টিটিউট--- সেই বাড়িতেই পড়াশোনা করেছেন লালমোহন। সেইখানেই তিনি পেয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বাংলার শিক্ষক এই কবিকে। আচ্ছা, লালমোহনবাবুর ঠিকানা তো সকলেরই জানা। সকলেই জানি, সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রিয় ছোটোবেলার বাড়ি ১০০ নম্বর গড়পার রোডের ঠিকানাটি উপহার দিয়েছিলেন লালমোহনবাবুকে। সেই ১০০ গড়পার রোড, যেখানে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী স্থাপন করেছিলেন তাঁর প্রিয় ইউ রায় অ্যান্ড সন্স। এই বাড়ির কথা বলেই তো সত্যজিতের যখন ছোট ছিলাম-এর কথা শুরু হয়েছিল। এইখানেই একটা মজাদার খটকা। আচ্ছা, এথিনিয়ম ইনস্টিটিউটের ঠিকানাও তো ওই ১০০ গড়পার রোড। কলকাতা পৌরসংস্থার ফলক থেকে প্রমাণ ১৯৩১ সালে এই ঠিকানাতে চলে আসে ওই ইশকুল। তাহলে কী করে, একই সঙ্গে যে ঠিকানায় লালমোহনবাবুর বাড়ি, সেখানেই তাঁর ছোটবেলার স্কুল থাকতে পারে? ইতিহাস ভূগোলের নিয়মে অবশ্যই থাকতে পারে না, কিন্তু একজন স্রষ্টার কল্পনায় তা হতে তো বাধা নেই। শৈশবের দিনগুলি জড়িয়ে যে-বাড়িটি ঘিরে, সেই বাড়িটিকে কতভাবে উত্তরকালের মনের কাছে এনে দিলেন সত্যজিৎ। সেই বাড়ির এক বর্ণময় পরিচয় লিখলেন নিজের শৈশবস্মৃতিতে, নিজে অন্তত দুবার আঁকলেন সেই বাড়ির ছবি, সুকুমার রায়কে নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্রে ধরে রাখলেন তার আলোকচিত্র আর সবচেয়ে অদ্ভুত হল সকলের প্রিয় চরিত্র লালমোহন গাঙ্গুলির বাড়ির ঠিকানা আর তার ছেলেবেলার স্কুল বানিয়ে একটি বাড়িকেই পরের প্রজন্মের মনের কাছে একেবারে গেঁথে দিলেন আশ্চর্য মেধাবী নৈপুণ্যে।

আরও পড়ুন
পুত্রের অনুবাদে পিতার ছড়া- ২

 কবি ও শিক্ষক গোলাম মোস্তাফা

 

আরও পড়ুন
পুত্রের অনুবাদে পিতার ছড়া- ১

না হলে, লালমোহনের ওই ঠিকানার ভেতরে কি রেখে দিতেন আরেক ইঙ্গিত? এবার কাণ্ড কেদারনাথ-এই জানা যায়, লালমোহনের গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার ললিতমোহন ছিলেন পেপার মার্চেন্ট--- কোম্পানির নাম ছিল এল এম গাঙ্গুলি অ্যান্ড সন্স, ওই গড়পারের বাড়িটাও তৈরি করেন এল এম-ই। ললিতমোহনের পরে লালমোহনের ঠাকুর্দা আর বাবাও যোগ দেন সেই কাগজের ব্যাবসাতে। তারপরের ব্যাপারটা কেমন? লালমোহনের কথাতেই, ‘বাবা যদ্দিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন ব্যবসায় চালান। ফিফটি টু-তে চলে গেলেন। তারপর যা হয় আর কী? এল এম গাঙ্গুলি অ্যান্ড সন্স-এর নামটা ব্যবহার হয়েছিল কিছুদিন, কিন্তু মালিক বদল হয়ে গেছিল।’

সত্যজিতের জীবনী সাক্ষ্য। উপেন্দ্রকিশোর, সত্যজিতের গ্র্যান্ড ফাদার, প্রতিষ্ঠা করেন ইউ রায় অ্যান্ড সন্স। তাঁদের ছিল কাগজের নয়, মুদ্রণের ব্যাবসা। ১০০ গড়পার রোডের বাড়িটিও বানান ইউ রায়। উপেন্দ্রকিশোরের পর সুকুমার, মানে সত্যজিতের পিতা, যদ্দিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন চালিয়েছেন ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের ব্যাবসা। তাঁর মৃত্যুর পরে, ইউ রায় অ্যান্ড সন্স নামটা থাকল, বদলে গেল মালিকানা--- করুণাবিন্দু আর সুধাবিন্দু বিশ্বাস হলেন নতুন মালিক। ১০০ নং গড়পার রোডের ঠিকানা রইল, ইউ রায় অ্যান্ড সন্স রইল, রইল না রায়-পরিবারের মালিকানা। শিশু সত্যজিৎকে নিয়ে মা সুপ্রভা রায় ১৯২৬-এ উত্তর কলকাতার ওই বাড়ি ছেড়ে চলে এলেন দক্ষিণ কলকাতায়। তাহলে, শুধু ফেলুদার সঙ্গে নয়, জটায়ুজির ভেতরেও আশ্চর্য রসিকতায় নিজের কথা স্থাপন করেছিলেন সত্যজিৎ!

Powered by Froala Editor