বৈকুণ্ঠ মল্লিক: কবি আর মাস্টারমশাই

মানিকলমকারি - ৪২
আগের পর্বে

সত্যজিতের গল্পে নানাভাবে ঘুরেফিরে এসেছে জন্মদিনের প্রসঙ্গ। ফেলুদার ‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’ গল্পটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানকে ঘিরেই। আবার ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ গল্পেও জন্মদিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ঠিক তেমনই তাঁর শর্ট ফিল্ম ‘টু’-এর কাহিনিতে গুরুত্ব পেয়েছে ধনী গৃহস্থের ছেলের জন্মদিনে পাওয়া উপহারগুলি। যেখানে জন্মদিনের উপহারের মধ্যে দিয়েই শিশুদের মনে প্রবেশ করছে ধ্বংস ও যান্ত্রিকতার বীজ। ‘পিকুর ডায়রি’-তেও সমান গুরুত্ব পেয়ীছে এই উপহারের প্রসঙ্গটি। সেখানে পিকুর মা ও তাঁর অবৈধ প্রেমিক উৎকোচ হিসাবে নানা উপহার দেবে পিকুকে। সত্যজিতের নিজের জন্মদিনও পালন হত মহা ধুমধাম করে। ছোটবেলায় মা সুপ্রভা দেবী এবং পরে স্ত্রী বিজয়া রায় সমস্তটা সামলাতেন। অথচ নিজের জন্মদিন নিয়ে সবসময় উদাসীন ছিলেন সত্যজিৎ।

ফেলুদার গল্পের কবি আর বাংলার মাস্টার মশাইয়ের নাম তো সকলেরই জানা। সেই যে লালমোহনবাবুর ছেলেবেলার স্কুলের বাংলার মাস্টার মশাই ছিলেন বৈকুণ্ঠ মল্লিক। ভেবে দেখুন, পুরো ফেলুদা গ্রন্থমালাতে এ এক আশ্চর্য চরিত্র। কোনো গল্পেই তিনি নেই, তাঁর কোনো ছবি নেই --- অথচ, তাঁকে চেনে না ফেলুদা-প্রেমী এমন পাঠকও নেই কোথাও। বৈকুণ্ঠ মল্লিক, বাংলা পড়াতেন, লিখতেন কবিতাও। লালমোহন গাঙ্গুলি ছেলেবেলায় পড়তেন এথিনিয়াম ইনস্টিটিউশনে। সেখানেই নাকি তিনি ছিলেন বাংলার শিক্ষক। এই কবির কথা লালমোহন কতবার না বলেছেন, কত লেখাতেই না শুনিয়েছেন তাঁর লেখা অদ্ভুত সব কবিতা। যেমন, ‘হত্যাপুরী’, ‘এবার কাণ্ড কেদারনাথে’, ‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’, ‘দার্জিলিং জমজমাট’, ‘ভূস্বর্গ ভয়ংকর’, ‘নয়ন রহস্য’ এমনকি ফেলুদার শেষ সম্পূর্ণ কাহিনি ‘রবার্টসনের রুবি’-তেও কবিতাসহ ফিরে ফিরে এসেছেন এই শিক্ষক-কবি। এককথায় কবিহিসেবে বৈকুণ্ঠ মল্লিক প্রকৃতিকে ভালোবাসেন এমন এক কবি। তিনি নানা জায়গায় বেড়াতে যেতেন আর সেখানকার বিশেষ বিশেষ উপাদান নিয়ে লিখে ফেলতেন কবিতা। হয়ত সে কবিতা শোনাতেনও তাঁর ছাত্রদের, তাই তো তাঁর ছাত্র লালমোহন ক্লাস সেভেনেই তাঁর লেখা কবিতা আবৃত্তি করে প্রাইজ পেয়েছিলেন ইস্কুলে। তিনি পুরীর সমুদ্র দেখে কবিতা লেখেন, কবিতা লেখেন ভুনেশ্বরের মন্দির দেখে, তাঁর কবিতা আছে কেদারনাথের যাত্রাপথ থেকে দার্জিলিং- কাশ্মীর নিয়ে যেমন, তেমনই শান্তিনিকেতন আর মাদ্রাজ নিয়েও প্রকাশ করেছেন তাঁর ভাব। এমনকি, তিনি এমনি ভাবের কবিতা লিখলেও সেখানে উঁকি মেরে যায় তাঁর প্রকৃতিপ্রেম।

লালমোহনের অগাধ শ্রদ্ধা তাঁর এই কবি- মাস্টারমশাইয়ের উপরে। এমনকি, তোপসে ফেলু, তাঁর পিছনে লাগলে কিছু বলেন না বটে, কিন্তু বৈকুণ্ঠ মল্লিকের কবিতা সম্পর্কে কারো একটি কথা বলার জো নেই। সে কথায় পরে আসা যাবে, আগে দেখা দরকার, বৈকুণ্ঠ মল্লিকের কবিতার ভাষারূপ। যেমন, সমুদ্র সম্পর্কিত কবিতায় শুনতে পাওয়া যায়, ‘অসীমের ডাক শুনি কল্লোলে মর্মরে/ এক পায়ে খাড়া থাকি একা বালুচরে।’ কিংবা, ভুবনেশ্বরের মন্দির দেখে তাঁর উপলব্ধি প্রকাশের ভাষা এই রকম, ‘কতশত অজ্ঞাত মাইকেল এঞ্জেলো/ একদা এই ভারতবর্ষে ছেলো---/ নীরবে ঘোষিছে তাহা ভাস্কর্যে ভাস্বর/ ভুবনেশ্বর!’ লালমোহন যাতে কষ্ট না পান, সেইজন্য তোপসে মুখে ‘বাঃ’ বলেও ওই এঞ্জেলোর সঙ্গে ‘ছিল’-র বদলে ‘ছেলো’ লেখায় যেই সামান্য অনুযোগ করেছে, অমনি শান্তশিষ্ট লালমোহনের প্রতিক্রিয়াটি অদ্ভুত। তিনি বলেন, ‘পোয়েটের ব্যাকগ্রাউন্ড না জেনে ভার্স ক্রিটিসাইজ করার বদ অভ্যাসটা কোথায় পেলে, তপেশ? বৈকুণ্ঠ মল্লিক চুঁচড়োর লোক ছিলেন। ওখানে ছিল-কে ছেলো-ই বলে। ওতে বুল নেই।’ ভাবা যায়, স্বয়ং তোপসেকে বকছেন লালমোহন--- গুরুনিন্দা তিনি শুনবেন না। ঠিক এইভাবে দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখা নিয়ে বৈকুণ্ঠবাবুর কবিতার শুরুটা এই রকম, ‘অয়ি কাঞ্চনজঙ্ঘে/ দেখেছি তোমার রূপ উত্তরবঙ্গে/ মুগ্ধ নেত্রে দেখি মোরা তোমারে প্রভাতে/ সাঁঝেতে আরেক রূপ, বুল নেই তাতে/ তুষার ভাস্কর্য তুমি, মোদের গৌরব/ সবে মিলে তোমারেই করি মোরা স্তব।’ লালমোহনের ব্যাখ্যাতে, ওই সম্বোধনে কাঞ্চনজঙ্ঘা যে কাঞ্চনজঙ্ঘে হয়ে গেল, ‘সেটাকে কীভাবে কাজে লাগিয়েছেন কবি দেখেছ, তপেশ?’ ছাত্র লালমোহনের ভাষায় ঠিক এই ভাষার পরীক্ষাটাই হল ‘গ্রেট পোয়েটের লক্ষণ’। সর্বজ্ঞ তপেশ-ও এখানে হার মানে, সে মনে মনে বলে, ‘সংস্কৃত ব্যাকরণটা ভালো জানা নেই বলে ভদ্রলোক ঠিক বলছেন না ভুল বলছেন, সেটা বুঝতে পারলাম না।’

ঠিক এইভাবে কাশ্মীর সম্পর্কে ‘করি নত শির/ তোমারি প্রণমি কাশ্মীর’ এই জাতীয় কবিতা শুনে ফেলুদা লালমোহনকে কষ্ট দেবে না বলে ‘বাঃ দিব্যি’ বললেও তোপসের উপলব্ধি ‘কবিতায় লালমোহনবাবুর রুচিটা যে একটু গোলমেলে তার পরিচয় এর আগেও অনেকবার পেয়েছি।’ এই এক প্রসঙ্গ চলে এলো, কবিতার ব্যাপারে লালমোহনের রুচি। মোটের ওপর অন্ত্যমিলের পক্ষপাতী তো সত্যজিৎও, এমনকি ফেলুদাও যখন মুখে মুখে কবিতা বানায়, সেখানেও সেই অন্ত্যমিলের ব্যাপারটা আছে। যেমন, জটায়ুকে নিয়ে লেখা ফেলুদার বানানো লিমেরিক এরকম, ‘বুঝে দ্যাখো জটায়ুর কলমের জোর/ ঘুরে গেছে রহস্য কাহিনির মোড়/ থোড় বড়ি খাড়া/ লিখে তাড়াতাড়া/ এইবারে লিখেছেন খাড়া বড়ি থোড়।’--- এই যে নতুন ধরনের শব্দের সপ্রতিভতা আর শব্দের খেলা নিয়ে একটা বাক্যবন্ধের গড়ন তৈরি করা, সেটাই ফেলুদা তোপসের কবিতার ধরন আর একটু সেকেলে শব্দে-বাঁধা ওই পুরোনো গতের কবিতা তাদের না-পসন্দ। তাই বৈকুণ্ঠ মল্লিকের লেখা মাদ্রাজ-বিষয়ক কবিতায় ‘ইডলি আর দোসা খেয়ে তৃপ্তিবে রসনা?/ ওরে বাবা এ শহরে কেউ কভু এসো না।’ মিল হিসেবে ওই রসনা-র সঙ্গে এসো না বা আগের জঙ্ঘের সঙ্গে বঙ্গে কিন্তু বেশ মজাদার। তবে ওই চরণে ‘তৃপ্তিবে’ শব্দ নিয়ে ফেলুদা ভুরু কুঁচকোতেই সটান উত্তর দেন লালমোহন, ‘মল্লিকের উপর মাইকেলের দস্তুরমতো প্রভাব ছিল। তৃপ্তিবে হল নামধাতু। আপনি গোয়েন্দা তাই হয়ত জানেন না, আমরা সাহিত্যিকরা জানি। বলছি না হাইলি ট্যালেন্টেড! পোড়া দেশ বলে কলকে পেল না।’ পুনরায় লক্ষ করুন, স্বয়ঁ ফেলুদাকেও এই বৈকুণ্ঠের কবিতার ব্যপারে কড়াকথা শোনাতে ছাড়েন না লালমোহন। তোপসে তো বলেইছিল, ‘আমি দেখেছি বৈকুণ্ঠ মল্লিকের কথা বলতে গেলেই জটায়ু ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন, আর এতটুকু সমালোচনা করলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। আমি আর ফেলুদা তাই চুপ মেরে গেলাম।’ এই বৈকুণ্ঠ অন্ত্যমিল নিয়ে নানান চরণের মাত্রাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষাও একটু সেকেলে ধরনে করতেন, বোঝা যায় তাঁর কবিতা পড়লে। আসলে, বৈকুণ্ঠের কবিতায় পাঠকের ভাব তৈরির থেকে কবিতার মধ্যে তথ্য জানানো, পুরোনোগন্ধী তৎসম শব্দে মূল যে-কথাটা গদ্যে বলা যায়, সেটাকেই কবিতার ভাষায় বলার একটা চেষ্টা আছে, ঠিক সেখানেই ফেলু-তোপসের কাব্যরুচি থেকে লালমোহনের কাব্যরুচির তফাত।

এই বৈকুণ্ঠ মল্লিকের লেখা পড়তে পড়তে আমাদের মনে হয় অন্য একজন কবির কথা। যিনি এই কবিকে তৈরি করলেন, সেই সত্যজিতের কলমকারির কথা। সত্যজিৎ নিজে অন্ত্যমিলের নানা খেলায় যে কতখানি পটু, তার তো সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ গোটা ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ বই আর পুরো ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমাটা। সেই-সত্যজিৎ কীভাবে ওই বৈকুণ্ঠ মল্লিকের কবিতার সেকেলে ভাষাটাকেও রপ্ত করলেন! আসলে যে সত্যজিৎ ‘দেবী’ ছবির জন্য নিজে রামপ্রসাদি ভাষা ব্যবহার করে শ্যামাসংগীত লিখতে পারেন, ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির জন্য পুরোনো সিনেমার ভাষা আর সুর ব্যবহার করে সেকেলে গান লিখতে পারেন, সেই স্রষ্টাই নিজের কলমে বানাতে পারেন বৈকুণ্ঠ মল্লিকের কবিতা। এই যে অন্যের ভাষা আর অন্যের ধরনটাকে নিজের লেখার মধ্যে চমৎকারভাবে আত্মসাৎ করার একটি অসামান্য প্রতিভা--- সেটাও কি সত্যজিৎ প্রতিভার একটা নতুন দিক নয়?

আরও পড়ুন
গল্পে জন্মদিন আর জন্মদিনের গল্প

এর পরের কিস্তিতে এই বৈকুণ্ঠ মল্লিকের উৎস নিয়ে আরো দু-একটা কথা বলে মানিকবাবুর এই নতুন ধরনের কলমকারির ধরনধারণ নিয়ে কিছু কথা বলা যাবে।     

আরও পড়ুন
খোদকারি কলমকারি ও এক অভিমান-গাথা

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
পুত্রের অনুবাদে পিতার ছড়া- ২