মানিকলমকারি - ৪১
আগের পর্বে
মৃত্যুশয্যায় কষ্ট সহ্য করেও নিজের বই ‘আবোল তাবোল’-কে নিজের হাতে সাজিয়ে তুলেছিলেন সুকুমার রায়। কিন্তু প্রকাশিত বই হাতে নিয়ে দেখে যেতে পারেননি। নিজেদের প্রেস ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে বই প্রকাশিত হয়ে আসার সপ্তাহ খানেক আগেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। সত্যজিতের বয়স তখন মাত্র আড়াই বছর। এরপর ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের মালিকানা চলে যায় প্রেসেরই কর্মচারী করুণাবিন্দু বিশ্বাসের হাতে। ‘আবোল তাবোল’-এর একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হলেও কোনো অর্থ হাতে পাননি সুকুমারপত্নী সুপ্রভা দেবী। এর বহু পরে সত্যজিতের উদ্যোগে সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় ‘আবোল তাবোল’-এর নতুন সংস্করণ। তবে সত্যজিতের অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রকাশক দিলীপ কুমারের চাপে তাঁকে বইয়ের সজ্জা বদলাতে হয়। ছেলের হাতে বইয়ের সজ্জার এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারেননি সুপ্রভা দেবী। শোনা যায় দীর্ঘদিন তিনি ছেলের সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
১। গল্পে জন্মদিন
ফেলুদা সিরিজের ‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’ গল্পটা শুরু হয়েছিল এক জন্মদিনের ঘটনা দিয়ে। নিজের পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে পানিহাটির ব্যবসায়ী শঙ্করপ্রসাদ চৌধুরির বাড়ি থেকে তাঁর আমন্ত্রিত তিন বন্ধুর মধ্যে থেকে কোনো একজন হাতিয়ে নেয় তাঁর সংগ্রহের একটি দুর্মূল্য স্বর্ণমুদ্রা। সেই ঘটনার তদন্ত করতে তার এক বছর পরে শঙ্করপ্রসাদের একান্নতম জন্মদিনে আবার সেই বন্ধুদের সঙ্গে শঙ্করপ্রসাদ নিমন্ত্রণ করেন ফেলুদাকেও। সেখান থেকেই কাহিনির শুরু। লক্ষণীয়, আদ্যন্ত সৎ আর বিশ্বাসী একটি মানুষ নিজের দীর্ঘদিনের ব্যবসার সঙ্গী, নিজের পারিবারিক ডাক্তার আর নিজের ছেলেবেলার বন্ধুকে বিশ্বাস করতে পারছেন না বলেই আবার দ্বিতীয়বার তাদের নিমন্ত্রণ করেন--- উদ্দেশ্য বস্তুত চোরকে ধরা। গল্পের কাহিনিগত সহজ এই দিকটি মেনে নিলেও বলতেই হয়, এই আয়োজনের মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে আছে একটা বিশ্বাসহীনতার গল্প। সন্দেহভাজনদের একজন শঙ্কর চৌধুরির অবস্থার সুযোগ নিয়ে এক বছর আগে করেছিল বিশ্বাসভঙ্গ আর সেই ঘটনার সমাধান করার উদ্দেশ্যে শঙ্কর চৌধুরীও ফেলুদাক আমন্ত্রণ জানিয়েছেন পরের বছরের জন্মদিনে। সন্দেহভাজন ওই তিনজনের মধ্যে একজনকে খুঁজে পাওয়ার জন্য এক জায়গায় জড়ো করেছেন। এ-ও কিন্তু উল্টে বললে, আরেক ধরনের বিশ্বাসভঙ্গের কাহিনিই।
ঠিক তেমনই ওই ‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’-র মতোই ‘শাখা প্রশাখা’ ছবির শুরুও তো আনন্দমোহন মজুমদারের সত্তর বছরের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের ঘটনা দিয়ে। সেখানেও এক বিপত্তি, সেখানেও আরেক বিশ্বাসভঙ্গের গল্পের সূচনা। সমস্ত জীবন সৎভাবে যাপন করে এই সত্তর বছরের জন্মদিনের সংবর্ধনা সভায় হঠাৎই বুকের ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন আনন্দমোহন। তাঁর সেই অসুস্থতার সংবাদ শুনেই তো তাঁর সফল তিন ছেলে ছুটে এলো কলকাতা শহর থেকে--- আর তাদের কথাবার্তাতেই আনন্দমোহন শেষতক উপলব্ধি করলেন, তিনি যে আদর্শ নিয়ে সমস্ত জীবনটা যাপন করেছেন, সেখান থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে তাঁর দুই ছেলে আর সেই অসততার পথটাকে তারা মেনেও নিয়েছে অত্যন্তসহজভাবে। আর তৃতীয়জন, ওই অসৎ- অশোভন পৃথিবীর সঙ্গে লড়তে না পেরে, ইস্তফা দিয়ে সরে গেছে নিজের কর্মক্ষেত্র থেকে। এখানেই ব্যর্থ হয়ে যায় তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানের সমস্ত তাৎপর্য।
ফেলুদার আরেকটি উপন্যাস ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ আছে জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটি পিকনিকের প্রসঙ্গ। তারিখটি ছিল ২৩ নভেম্বর ১৯৭৭। সেইদিনটি সম্পর্কে খোদ তোপসে বলে, ‘মহেশ চৌধুরির বার্থ ডে পিকনিকের কথাটা অনেকদিন মনে থাকবে।’ কারণ, জন্মদিনের দিনই তাঁর ওপর সাংঘাতিক আক্রমণ, আর তার পরের দিনই তাঁর মৃত্যু। হেঁয়ালিতে কথা বলতে ভালোবাসতেন মহেশ চৌধুরি। লালমোহনবাবু তাঁকে প্রথম সাক্ষাতেই এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ স্যর।’ তার উত্তরে প্রচণ্ড হেসে উঠে মহেশবাবু বলেন, ‘বুড়োমানুষের আবার জন্মদিন। এসব আমার বৌমার কাণ্ড।’ তিনি সেদিনই ফেলুদাদের সঙ্গে, নিজের কৈলাস [কই-লাশ] নামের বাড়ি খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে, কথা বলতে গিয়ে হেঁয়ালি করে বলেন, ‘হোয়্যার ইজ্ দ্য ডেডবডি খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি তো?’ গল্পে কী আশ্চর্য সমাপতন! সেই জন্মদিনের দিনই ওই পিকনিকের আয়োজনের মধ্যেই রাজরাপ্পায় পাওয়া গেল তাঁর আঘাতপ্রাপ্ত দেহ!
আরও পড়ুন
খোদকারি কলমকারি ও এক অভিমান-গাথা
মনে পড়ছে কি ‘এবারো বারো’ বইয়ের সেই ‘স্পটলাইট’ গল্পটার কথা? স্রেফ নিজের জন্মদিনের সাল বদলানোর গল্প শুনিয়ে এক খোদ নামজাদা ফিল্মস্টারের ওপর থেকে কীভাবে সারা জীবনে মাত্র একটা ব্যর্থ ছবির ততোধিক ব্যর্থ নায়ক নিজের ওপর স্পটলাইটটা সরিয়ে নিতে পারে! অদ্ভুতভাবে, মজার গল্প হলেও এও কিন্তু এক বিশ্বাসভঙ্গেরই গল্প।
আরও পড়ুন
পুত্রের অনুবাদে পিতার ছড়া- ২
আর অবশ্যই আসবে সত্যজিতের তৈরি বিখ্যাত ছবি ‘টু’-র কথা। আগেরদিন একটি ধনী ঘরের ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল। গল্পের সূচনা তার পরদিন। তার ঘরভর্তি সেই জন্মদিনে পাওয়া হরেক উপহার। জন্মদিনে পাওয়া তার প্রতিটি উপহারই এক একটি খেলনা আর প্রত্যেকটা উপহারই এমন এক-একটা খেলনা, যার সঙ্গে বস্তুত যোগ হয়ে আছে ধ্বংস বা যান্ত্রিকতা। এই ছেলেটির উল্টোদিকে রয়েছে আরেক ধরনের খেলনা, যেখানে সে সবের বালাই নেই--- সেখানে খেলা মানে খেলা-ই। সেখানে খেলা বলতে একটি দরিদ্র বালকের নিজস্ব শারীরিক দক্ষতা আর স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের উপকরণ। এই দুই-এর গল্প নিয়েই তো ‘টু’। এই ধনীগৃহের ছেলেটির জন্মদিনের ঘটনাটি সেখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সেই জন্মদিনে পাওয়া উপহারগুলি। মূল ছবিতে মাত্র দুটি বাচ্চা থাকলেও, এই ধনীগৃহের বাচ্চাটিকে, বা বলা ভালো, এই ধরনের শিশুদের মন তো আর নিজে নিজে এই ধ্বংসের খেলায় মেতে ওঠে না। সেই ধ্বংসাত্মক মনটাও তো তৈরি করে বড়োরাই। সেই ছোট্টো সূত্রটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন ওই আগের দিনের জন্মদিনের অনুষ্ঠান আর সেখানে পাওয়া উপহারের প্রসঙ্গটা চমৎকারভাবে জুড়ে দিলেন সত্যজিৎ।
আরও পড়ুন
পুত্রের অনুবাদে পিতার ছড়া- ১
বড়োদের দেওয়া এই উপহারের প্রসঙ্গটিকেই অন্য একভাবে সত্যজিৎ এনেছিলেন ‘পিকুর ডাইরি’ গল্পে। সেখানে পিকুর মা নিজের অবৈধ সম্পর্কের বিষয়ে নিজের অপরাধবোধ ঢাকতেই হোক বা ছেলেকে উপহারের নামে উৎকোচ হিসেবেই হোক, এনে দেন, একের পরে এক উপহার। আর সেখানেও কিন্তু সেই ফিরে আসে এয়ারগান। পিকুকে এই এয়ারগান উপহার দেয়, তার মায়ের প্রেমিক হিতেশ। পিকু তার ডাইরিতে লেখে, ‘‘আমার এআর গানটা খুব ভালো আর খুব বড় একটা কৈটোতে ছররা আছে অনেক একসোটারো বেসি।… চড়াইটা কাল আসেইনি আজো আসেনি বদমাইশ আছে কাল আসবেই আসবে আর আমি তো রেডি হয়ে থাকবো।’’ পিকুর বাড়িতে বড়োদের পার্টি হয়, পিকু তার ডাইরিতে লেখে, ‘কিন্তু আমার জন্মদিন না কিন্তু এমনি পারটি।’
আরও পড়ুন
লিয়রের লিমেরিক: এক নতুন গড়া!
জন্মদিনের দিন সম্পর্কে আরেক ধরনের গল্পের ধাঁচা রয়েছে সত্যজিতের লেখা গল্পমালায়। যেমন ধরা যাক, ‘আর্যশেখরের জন্ম-মৃত্যু’ গল্পে। আর্যশেখরের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা থেকে লেখার শুরু তার চৌদ্দো বছরের জন্মদিনে। গল্পে দেখি, ‘তাঁর চতুর্দশ জন্মতিথিতে আর্যশেখর পিতার টেবিলের দেরাজ খুলে তিনখানা অব্যহৃত ডায়রি বার করে তার মধ্যে সবচেয়ে যেটি বড়ো, তার প্রথম পাতায়’ শুরু করলেন তাঁর লেখা। কিংবা ধরা যাক, গুপি-বাঘা সিরিজের তিন নম্বর গল্প ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’ তো তাঁরই লেখা গল্প। সেখানেও তো বিক্রম নামের ছেলেটির ভেতরে তার আশ্চর্য অলৌকিক ক্ষমতার প্রকাশ ঠিক তার বারো বছরের জন্মদিনেই শুরু। তাই গুপি-বাঘাকে বিক্রমের দাদু বলেন, যেদিন বিক্রম বারো বছরে পা রেখেছে, তখনই সে রওয়ানা দিয়েছে আনন্দগড় কেল্লার দিকে। কারণ সেখানেই রয়েছে দুষ্টু এক মানুষ--- যাকে শাস্তি দিতে পারবে একমাত্র সে-ই! এ সত্যিই তাহলে একটা অদ্ভুত ধরন। সত্যজিতের গল্পে ফিরে ফিরে আসা জন্মদিনের প্রসঙ্গে থাকে বদলে যাওয়ার একটা গল্পসূত্র। সেই বদল কখনো ভালোর দিকে হতে পারে বা কখনো মন্দের দিকে। কিন্তু বদলের একটা ধরন যেন লুকোনো আছে সেখানে।
এবারে দ্বিতীয় পর্বে তাঁর নিজের জন্মদিনেও এমন ছোট্টো কয়েকটি পরিবর্তনের গল্প দিয়ে প্রসঙ্গটি শেষ করা যাক।
২। জন্মদিনের গল্প
১৯৫০ সালের ২ মে। সত্যজিৎ রায়ের জীবনের গল্পে তাঁর এই ত্রিশ বছরের জন্মদিনটিতে ঘটল একটা বিশেষ ব্যাপার। সত্যজিতের এই জন্মদিনে তাঁকে বিজয়া রায় উপহার দিলেন ইয়ার্ডলির একটা সেট। তখন তাঁরা জাহাজে। পয়লা মে মার্সাই শহরে পৌঁছে, সেখানেই তাঁরা দেখলেন মে দিবসের বিরাট মিছিল। আর সেদিন রাত্রেই তাঁরা আবার সেখান থেকে রওয়ানা হলেন জাহাজে চড়ে ইংল্যান্ডের দিকে। ওই জাহাজের জন্মদিন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বিজয়া রায় লিখেছিলেন, ‘দেশে কত জমজমাট করে ওর জন্মদিন পালন করা হয়। জাহাজে আর কে কাকে জানে।’ তাই জাহাজ থেকেই সত্যজিতের জন্য বিজয়া কিনেছিলেন উপহার--- ইয়ার্ডলির সেট। কী ছিল তাতে? ছিল ইয়ার্ডলির সাবান, ল্যাভেন্ডার, ট্যালকম পাউডার আর মাথায় মাখার জন্য ইয়ার্ডলি ব্রিলিয়ান্টাইন। বিজয়া রায়ের আত্মকথন থেকে শোনা, এই উপহারটি সত্যজিতের পারিবারিক জীবনবৃত্তান্তেও বেশ অন্য রকম একটা ঘটনা। কারণ, বিজয়া রায় জানিয়েছিলেন, সত্যজিতের জন্য এর আগে পর্যন্ত তাঁর মা সুপ্রভা রায় মাসকাবারি বাজারের সঙ্গে আনতেন গোদরেজের ভাটনি সাবান। ‘মা কিনেছেন, উনি ব্যবহার করেছেন, এই হল শেষ কথা।’ ফলে, ১৯৪৯-এ বিয়ের এই এক বছরের মাথায় সদ্যবিবাহিত সত্যজিৎকে যখন স্ত্রী বিজয়া রায় জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর ওই ভাটনি সাবান ভালো লাগে কি না, তার উত্তরে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘আমি এসব কোনোদিন ভেবে দেখি না। মা বরাবর কিনে এনেছেন, তাই মেনে নিয়েছি।’ বিজয়া এরপরে সত্যজিতের মা সুপ্রভা রায়ের সঙ্গে কথা বলে নিয়ে, ওই ইয়ার্ডলি সাবানই ব্যবহার শুরু করলেন। বিজয়া রায়ের কথায়, ‘ব্যবহার করে এত খুশি হলেন যে, তারপর থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ইয়ার্ডলির টয়লেট গুডস ব্যবহার করে এসেছিলেন।’
অদ্ভুত একটা ব্যাপার। বিজয়া রায় লিখেছিলেন তাঁর আত্মজীবনীতে সত্যজিতের জন্মদিন বেশ ধুমধাম করে পালন করা হত। কিন্তু সত্যজিৎ নিজে কিন্তু নিজের জন্মদিন পালন সম্পর্কে তাঁর ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইতে কিছু লিখলেন না। সেখানে অন্য এক স্কুলের বন্ধুর জন্মদিনে তাঁর যাওয়ার কথা আছে, সেই জন্মদিনে তাঁরই এক বন্ধুর দেখানো কাচের গ্লাস চিবিয়ে খাওয়ার জাদুর গল্প আছে, কিন্তু নিজের জন্মদিন নিয়ে কিছু লেখেননি তিনি। বিজয়া রায়ের লেখা থেকেই জানতে পারি সত্যজিতের জন্মদিনে বাড়িতে ভিয়েন বসিয়ে নিমন্ত্রিতদের আপ্যায়ন করার কথা, কখনো বিজলি গ্রিলের ব্যবস্থাপনায় আপ্যায়নের এলাহি আয়োজন, আবার একবার বাড়িতেই ছোটো করে রান্না করে অল্প সংখ্যক নিমন্ত্রিতদের ডাকা হয়েছিল--- কারণ, সেই বছর অত্যন্ত অসুস্থ ছিলেন সত্যজিতের প্রিয় ছোটোকাকা। প্রসঙ্গত সেই বছরেই সত্যজিতের ছোটোকাকা সুবিমল রায় চলে গেলেন ৭ মে তারিখে। তবে সত্যজিতের জন্মদিনের একটা-দুটো মধুর ঘটনা না বললে বোধ হয় আজকের পর্ব শেষ করা যাবে না। প্রথম, বিজয়া রায় নিজে হাতে একটি চাদর বুনে উপহার দিয়েছিলেন সত্যজিতের জন্মদিনের দিন। স্থির করেছিলেন, সেটাই পাতা হবে ২ মে। তার বুনুনি নিয়ে নিজের ব্যগ্রতার কথা লিখেছিলেন বিজয়া। আর দ্বিতীয় গল্পটি হল, সেবার সকলের খাওয়াদাওয়ার পরে, বাড়ির সমস্ত কাজের লোকেদের খাইয়ে, বাকি খাবার গুছিয়ে তুলে রেখে ঘরে যখন এলেন বিজয়া, তখন তিনি দেখেন সত্যজিৎ তখনো ঘরে বই পড়ে চলেছেন। বিজয়া লিখেছেন:
‘‘ঘরে ঢুকে দেখতাম উনি তখনো টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ছেন। আমাকে দেখেই বলতেন, ‘বাব্বা, তোমার এত সময় লাগল?’ তারপরেই বলতেন, ‘খুব খাটুনি গেল না?’ দুর্বল মুহূর্তে চোখে জল এসে যেত। ওঁর পাশে গিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে বলতাম, ‘আমার দুঃখ কী জানো? আমার জীবনের সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট দুটো দিনে, তোমার আর বাবুর জন্মদিনে, দু-দণ্ড তোমাদের কাছে বসবার সময় পাই না? কী খারাপ লাগে?’
হেসে বলতেন, ‘এই তো কাছে এসে বসেছ।’
‘আচ্ছা তোমার জন্মদিন তো কেটেই গেল, এখন কটা বেজেছ জানো? রাত দেড়টা তো হবেই। ইংরেজি মতে এখন তেসরা মে।’
‘আমরা বাঙালি, ইংরিজি মত মানতে যাবো কেন?’
একটু হেসে ওঁর গালে একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে রাত্রে শোওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিতাম।’’
তাঁর জন্মদিনের এমন অসামান্য মধুর মুহূর্তের কথা ধরা রয়েছে বিজয়া রায়ের কলমকারিতে, তাই সে গল্প অন্যত্র বলা চলে, মানিকলমকরি-তে তা বলা বাহুল্য হবে।
কৃতজ্ঞতা: অর্হণ দাশমুন্সী
Powered by Froala Editor