মানিকলমকারি - ৩৯
আগের পর্বে
বাঙালি পাঠক মাত্রেই জানেন, সুকুমার রায়ের কবিতা ভাষার থেকে অনেক বেশি ছবির খেলা। নতুন নতুন এবং অদ্ভুত নানা শব্দের অনুবাদ যেন অসম্ভব। তবে এই কঠিন দায়িত্বটিই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ। তবে শব্দের হুবহু অনুবাদ নয়। এখানেও সত্যজিৎ মাথায় রাখলেন ছবির অনুসঙ্গটিকে। সুকুমার রায়ের তৈরি বাংলা শব্দগুলির মতোই ইংরেজিতে তৈরি করলেন নতুন নতুন শব্দ। হাঁসজারু হল পর্কুডাক। বকচ্ছপ হয়ে গেল স্টর্টেল। এখানে ধ্বনির অনুপ্রাস বজায় রাখতে বককে সারস বানিয়ে নিলেন সত্যজিৎ। গভীর অধ্যাবসায় নিয়ে ‘আবোল তাবোল’-এর সফল অনুবাদ করেছিলেন সত্যজিৎ।
সত্যজিৎ রায় পিতা সুকুমার রায়ের মোট দশটি কবিতার ইংরাজি অনুবাদ করেছিলেন ১৯৬৯ সালে। অনুবাদগুলি করেছিলেন সমর সেন সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নাউ’-এর জন্য। গেল হপ্তায় তার মধ্যে ‘খিচুড়ি’, ‘বোম্বাগড়ের রাজা’ আর ‘বাবুরাম সাপুড়ে’-র অনুবাদের অসামান্যতা নিয়ে কিছু কথা বলা গেছে, এবারে আরো তিনটি অনুবাদের ধরন শোনাবার পালা। দেখব, সত্যজিতের অনুবাদে ‘গোঁফচুরি’ হল ‘দ্য মিসিং হুইস্কার’, ‘কাতুকুতু বুড়ো’ হল ‘ওল্ড টিকলার’ আর বাংলা ‘রামগরুড়ের ছানা’ হল ‘দ্য সন্স অফ র্যাঙ্গারু’। সত্যজিতের এই কলমকারি নিয়ে খুব বেশি কথা হয় না বলে ভুল বলা হবে, বলা ভালো কথাই প্রায় হয় না। তাই মানিকলমকারি-তে একটু ছড়িয়েই এই কথাগুলো বলার কথা মনে হল।
প্রথমেই দেখা যাবে, কীভাবে মোটের ওপর এক ছন্দ রেখে সত্যজিৎ অনুবাদ করলেন এর লাইন। সুকুমার লিখেছিলেন,
‘হেড অফিসের/ বড়োবাবু/ লোকটি বড়ো/ শান্ত,
তার যে এমন/ মাথার ব্যামো/ কেউ কখনো/ জানত?’
সত্যজিৎ একে অনুবাদে করলেন,
‘দে অলওয়েজ/ নিউ দ্য বস বাবু/ টু দি জেন্টল/ ফেলো,
হোয়াট হ্যাপেন্স/ ইফ হি ইন আ জিফি/ টার্নস অল ব্লু অ্যান্ড/ ইয়েলো?’
কবিতার ভাষায় পরে আসা যাবে, আগেই কানে পড়ে একই ধরনের ছন্দ কী অনায়াসে অনুবাদ করলেন সত্যজিৎ। ‘তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনো জানত’-কে ইংরাজিতে হুবহু ‘মাথার ব্যামো’ না রেখে সত্যজিৎ করলেন, ‘এক মুহূর্তে তাঁর রেগে যাওয়ার’ কথা। আসলে আগের লাইনে ‘শান্ত’-কে ‘জেন্টল’ করার জন্যই বোধহয়, পরের লাইনে ‘মাথার ব্যামো’ তার বিপরীতে যুক্তিযুক্ত নয় ভেবেই ‘খেপে যাওয়ার’ কথা। অনুবাদ দেখে মনে হল, সত্যিই তো, শান্ত মানুষের মাথার ব্যামো থাকবে না তা কী করে হয়, বরং শান্ত মানুষের ‘ইন আ জিফি’ বা এক লহমায় ‘টার্নস অল ব্লু অ্যান্ড ইয়েলো’ বা ‘খেপে ওঠা’ অনেক যুক্তিযুক্ত। লোভ সামলানো মুশকিল পরের লাইনটির অনুবাদ না-বলার। বাংলাতে যা ছিল ‘দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে/ একলা বসে ঝিমঝিমিয়ে হঠাৎ গেলেন খেপে।’ এর ইংরাজি কী করলেন সত্যজিৎ? লিখলেন, ‘He was seated in his chair/ Relaxed and free from care,/ Indulging in his post-meridian nap,/ When without a warning,/ In the middle of his yawning,/ Something right inside him seemed to snap.’ কত অনায়াস আর কত যথাযথ এই অনুবাদ, এতটুকু ভাবকে না সরিয়ে তরতরে ইংরাজিতে গড়গড়িয়ে পড়ে ফেলা যায়। মনে হবেই, আচ্ছা, ‘গোঁফ গিয়েছে চুরি’ বা ‘এমন গোঁফ তো রাখত জানি শ্যামবাবুদের গয়লা’-র মতো শব্দবন্ধের কী ইংরাজি হবে, কিংবা সেই ‘নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা’-র! মজা হল ‘গোঁফ গিয়েছে চুরি’ ইংরাজিতে ছন্দ মিলিয়ে হল, ‘মাই মুশট্যাশ হ্যাজ্ বিন স্টোলেন’ আর ‘এমন গোঁফ তো রাখত জানি শ্যামবাবুদের গয়লা’-কে তিনি করলেন ‘They make me look a shaggy butcher’। গোঁফদাড়িতে মুখ-ঢাকা এক কসাইয়ের মতো দেখতে লাগছে আমায়। সাগরপাড়ের পাঠকদের জন্য এপারের গয়লা হল গুঁফো-কসাই। নিম্নবর্গীয় আলোচনার তর্ক আপাতত সরিয়ে রেখে, লক্ষণীয়, অনুবাদে কীভাবে অভ্যস্ত চোখের মাপে ছবিটি তৈরি করলেন অনুবাদক। আর শব্দসচেতন অনুবাদক সত্যজিৎ সাবধানে বাংলার এক্কেবারে নিজস্ব ওই ‘নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা’র হুবহু অনুবাদ না করে তাকে ব্যবহার করলেন এই রকম শিল্পীর চোখ দিয়ে। ব্যাপারটা কেমন?
আরও পড়ুন
পুত্রের অনুবাদে পিতার ছড়া- ১
যে-সত্যজিৎ অনুপ্রাসে শব্দ বাঁধতে ভালোবাসেন, তিনি হঠাৎ ‘গোঁফ চুরি’-কে ‘মিসিং মুশট্যাশ’ করার লোভ সামলে ‘মিসিং হুইস্কার’ করলেন কেন? আমার কেমন যেন মনে হয়, ওই ‘নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা’-র ছবিটাকে শব্দে আনার জন্যই তিনি মুশট্যাশ না করে একে হুইস্কার করেছিলেন। মুশট্যাশ মানে নাকের নীচে যেমন গোঁফ থাকে, সেটা। আর হুইস্কার মানে, জুলফি থেকে গালের দিকে বেড়ে যাওয়া রোম যখন বেশ বেড়ে গিয়ে গোঁফের সঙ্গে মিশে মোট্টা গুঁফো চেহারাটা বানায়। এই অ্যাইসা মোট্টা গুঁফো চেহারাটা সাগরপাড়ের পাঠকদের কাছে বেশি পরিচিত। মূল গল্পটা কী? বড়োবাবুর যে গোঁফটা আছে, সেটা আর তাঁর পছন্দ হচ্ছে না, তাই তো! আসলে ‘গোঁফ চুরি’-তে ‘গোঁফ’-টার চুরি যাওয়া বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হল ‘আমার’ যে ‘গোঁফ ছিল, সেটা খোয়া গেছে’। বড়োবাবুর মুখে যে বড়ো উঠে থাকা গোঁফটা আছে, সেটা তাঁর আর ভালো লাগছে না, তিনি একটি বাহারি গোঁফ চান। এই মোটা উঠে থাকা গুম্ফশোভিত মুখটাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতেই কি মুশট্যাশকে সত্যজিৎ করলেন হুইস্কার।
আরও পড়ুন
লিয়রের লিমেরিক: এক নতুন গড়া!
‘কাতুকুতুবুড়ো’-তেও তাই। সেই একই ভাবে ছন্দের স্পন্দন বজায় রেখে সত্যজিৎ করলেন অনুবাদ। সুকুমারের ‘আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার/ কাতুকুতুবুড়োর কাছে যেও না খবরদার।’ সত্যজিতের ছন্দের মজাটাকে রেখেই অনুবাদে হল,
‘Go East or West, go North or south, by land sea or air,
But before you go, make sure the old Tickler isn’t there.’
‘কোথায় বাড়ি কেউ জানে না’ অনুবাদে হল, ‘ইটস হার্ড টু টেল জাস্ট হোয়্যার হি লিভস’। আবার ‘শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি’ কী চমৎকার অনুবাদে হল, ‘হি থিঙ্কস দে আর ফানি, হোয়াইল আদার্স ফাইন্ড দেম গ্রিম’। কাতুকুতু বুড়োর যে গল্প শুনে হাসি না পেলেও বুড়োর পানে তাকিয়ে তোমায় হাসতে হবে, সেই গল্পের নায়িকা বাংলার কেষ্টদাসের পিসি ইংরাজিতে হলেন ‘আন্ট কিটি’। বাংলাতে কেষ্টদাসের পিসি বিক্রি করত, ‘কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম আর তিসি’। ইংরাজিতে তাকে সত্যজিৎ করলেন, ‘পিজিয়নস এগস অ্যান্ড ফিগস অ্যান্ড ক্লোভস অ্যান্ড হানি’। তাদের বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি হল ফর্দ। এই পিসির অষ্ট প্রহরের গানকেই বা কী সুন্দর করে অনুবাদে নিয়ে গেলেন অনুবাদক। বাংলাতে যা ছিল ‘ম্যাও ম্যাও ম্যাও বাকুম বাকুম ভৌ ভৌ চিঁহি’, সেটাকে ইংরাজিতে করা হল, ‘All mew and barks and brays and neighs (Aunt Kitty calls them Prayers)।’ ওই অষ্টপ্রহর গানকে সত্যজিৎ ঘুরিয়ে নিলেন এই শেষ বাক্যে। যেখানে লিখলেন, আন্ট কলস দেম প্রেয়ার্স।
আরও পড়ুন
লিয়রের লিমেরিক, কতভাবে ঠিক-ঠিক!
‘রামগরুড়’কেই বা কী করে বুঝবে সাগরপাড়ের পাঠক? তবে সুকুমারের আঁকা রামগরুড়ের সঙ্গে ব্যাজারমুখো ক্যাঙারুর মিল ছিল বলেই তাকে সত্যজিৎ ইংরাজিতে করলেন ‘র্যাঙ্গারু’। ক্যাঙ্গারু শব্দের সঙ্গে মিলও হল আর রামগরুড় শব্দের সঙ্গেও মিলল তা। তাই রামগরুড়ের ছানা সত্যজিতের অনুবাদে হল দ্য সন্স অপ র্যাঙ্গারু। পড়লেই দেখা যাবে, এখানেও কী অসামান্যতায় বাংলা ছন্দকে ইংরাজি ধ্বনি দিয়ে ধরে রেখেছেন অনুবাদক। বাংলার লাইন আর ইংরাজির লাইন পাশাপাশি পড়লেই মজাটা ধরা পড়বে। সুকুমারের ‘সদাই মরে ত্রাসে’ সত্যজিতে হল, ‘They live in constant fear’। সুকুমারের ‘ওই বুঝি কেউ হাসে’ সত্যজিতে হল, ‘Of chuckles far and near’। সুকুমারের ‘এক চোখে তাই মিটমিটিয়ে’ সত্যজিতে হল ‘And start and bound at every sound’। আর সুকুমারের ‘তাকায় আশেপাশে’ সত্যজিতে হল ‘That brings a breath of cheer.’
আরও পড়ুন
শব্দ বানাবার ছড়া বা ধ্বনির অনুবাদে ভাবের লেনাদেনা
মন দিয়ে দেখুন, সুকুমারের অন্তমিলের ধরনটিকেও কীভাবে অনুবাদে নিয়ে গেছেন সত্যজিৎ। সুকুমারে ছিল ‘ত্রাসে’-র সঙ্গে ‘হাসে’ আর তার পর একটা লম্বা চরণ ছেড়ে তার সঙ্গে মিলিয়ে ‘পাশে’-র অন্তমিল। সত্যজিৎ ঠিক সেটাই করলেন, তিনি ‘ফিয়ার’-এর সঙ্গে পরের চরণে ‘নিয়ার’ মেলালেন, তারপরে একটি চরণ ছাড় দিয়ে মেলালেন ‘চিয়ার’। এটাই মজার! একে সুকুমারের লেখা অনুবাদ এক মুশকিল, তায় তার ছন্দের ধরনকেও যে ইংরাজিতে নিয়ে যাওয়া যায়, সে আর কে দেখাত এমন ছান্দসিক ছড়াশিল্পী সত্যজিৎ না হলে।
সত্যজিতের করা এইসব অনুবাদ পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল, প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর ইংরাজির শিক্ষক প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত মশাইয়ের সেই বিখ্যাত বই ‘তে হি ন দিবসাঃ’-তে ছাত্র সত্যজিৎ সম্পর্কে সুবোধচন্দ্রের মনভরা আক্ষেপের কথা। সুবোধচন্দ্র লিখেছিলেন, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় মানে এখনকার হায়ার সেকেন্ডারিতে ইংরাজি মৌলিক রচনায় ‘আমার সুপরিচিত একটি ভালো ছেলের সাফল্যে খুব বেশি আনন্দিত হইলাম। মনে করিয়াছিলাম সে ইংরেজি অনার্স পড়িবে, কিন্তু তাহা হইল না। বেশ কিছুকাল পরে একদিন গড়ের মাঠে তাহার সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞাসা করিলাম, একন সে কী করিতেছে, উত্তর পাইলাম আর্ট শিখিতেছে। মনটা দমিয়া গেল, এমন মেধাবী ছেলের এই দুর্মতি।ইহার নাম সত্যজিৎ রায়।’ মাস্টারমশাইয়ের জহুরির চোখ, তিনি ভুল ভাবেননি--- এইসব অসামান্য অনুবাদ পড়লে মনে হয়, ইংরেজি পড়লেও হয়ত তাঁর সেই ছাত্র উজ্জ্বলতম-ই হতো। তবে আর্ট শিখেও যে সে ভুল করেনি--- তার প্রমাণ তো পরবর্তী ইতিহাস।
Powered by Froala Editor