মানিকলমকারি - ৩৮
আগের পর্বে
সত্যজিৎ রায় লিয়রের লিমেরিক অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রথাগত নিয়ম ভেঙেছেন বারবার। তিনি বলেছেন, ছড়ার থেকেও অনেক বেশি করে করেছেন ছবির অনুবাদ। আর ভাষায়, ভঙ্গিতে প্রতিটি ছড়া হয়ে উঠেছে একেবারে নিপাট বাঙালি। সত্যজিৎ রায় যেন এই ধারাটি রপ্ত করেছিলেন সুকুমার রায়ের লেখা থেকেই। আর তাই বইয়ের নামেও সুকুমার রায়ের লেখা পঙক্তি তুলে দিলেন হুবহু। ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’। আরও একটি বিষয় এখানে লক্ষ্য করার মতো। ২ মে, ১৮৮৬ সালে বই প্রকাশের দিন সত্যজিৎ পা দিলেন ৬৫ বছরে। আর ওই বছরই সুকুমার রায়ের জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠান শুরু হয়। লিয়রের লিমেরিকের অনুবাদ যেন শৈশবে পিতৃহারা সন্তানের পিতার প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ।
এর আগের কিস্তিতে একটা হিসেব দাখিল করে বলেছিলাম, সত্যজিতের লেখা ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ প্রকাশিত হয়েছিল ২ মে ১৮৮৬। দেখেছিলাম, ওইদিনই সত্যজিৎ পড়লেন ৬৫-তে আর এই বছরটাই তাঁর পিতা সুকুমার রায়ের জন্মশতবর্ষের শুরু। ফলে পিতা সুকুমারের জন্মশতবর্ষে পুত্র সত্যজিতের একটা জানা-নিবেদন যদি হয়, সুকুমার রায়ের ওপর তৈরি তাঁর সেই অসামান্য তথ্যচিত্রটি তাহলে অবশ্যই এই ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ বইটিও শৈশবেই পিতৃহারা এক পুত্রের তাঁর পিতার উদ্দেশে এক অন্য রকম শ্রদ্ধার্ঘ্য। লিয়রের লেখাকে নিজস্ব অসামান্য কলমকারিতে বাংলায় রূপান্তর করেছিলেন সুকুমার। সেই মূল লিয়রের লেখাকেই সত্যজিৎ এবার নিয়ে এলেন বাংলায়। এ যেন ছন্দ-কবিতার কলমকারিতে পিতার উদ্দেশে এক অসামান্য শ্রদ্ধার্ঘ্য সত্যজিৎ-এর। ঠিক সেইভাবেই পিতার প্রতি আরেক উল্টো শ্রদ্ধার্ঘ্য সত্যজিৎ নিবেদন করেছিলেন ১৯৬৯-৭০ সালে। তখন বাবার লেখা ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের কিছু কবিতা সত্যজিৎ অনুবাদ করলেন ইংরেজিতে। অর্থাৎ, পরে মূল লিয়রকে তাঁর ভাষা থেকে তিনি আনবেন বাংলাতে আর তার বহু আগেই বাংলা থেকে সুকুমারের লেখা পুত্র সত্যজিৎ অনুবাদ করলেন ইংরাজিতে। এই অনুবাদের ধরনটি কেমন? অনুবাদের কোন ভাবনা থেকে সত্যজিৎ সুকুমারের অনুবাদ করছিলেন?
বাংলা রচনার ইংরাজি অনুবাদক হিসেবে এক অত্যন্ত কঠিন দায়িত্ব সত্যজিৎ নিয়েছিলেন। কারণ, বলা বাহুল্য, ‘খিচুড়ি’ যে-সব বাঙালি পাঠক পড়েছেন, তাদের কাছে কীভাবে সম্ভব তার অনুবাদ? কীভাবে সম্ভব, ‘রামগরুড়ের ছানা’ বা ‘বোম্বাগড়ের রাজা’-র অনুবাদ? ‘গোঁফ চুরি’ বা ‘বাবুরাম সাপুড়ে’-কে কি সত্যিই ভাষান্তরিত করা যায়? সেই জন্যই বলছিলাম, সত্যজিৎ অনুবাদক হিসেবে এ এক অত্যন্ত কঠিন দায়িত্ব নিলেন! তিনি অনুবাদ করলেন এই-এই কবিতাগুলিই। প্রথমেই ধরা যাক, খিচুড়ি কবিতাটি। সুকুমারের যে-কবিতাটির মজা দাঁড়িয়েই আছে বাংলা ভাষার খেলা দিয়ে, তাকে কীভাবে অনুবাদ করা যায়? সত্যজিৎ একই সঙ্গে মূলানুগত থেকেও ভাষার প্রয়োজনে একরকম স্বাধীনতা নিয়ে বাঁধলেন তাঁর অনুবাদের ভাষা। সত্যজিতের অনুবাদে ‘খিচুড়ি’ হল ‘Stew Much’। স্ট্যু আমাদের জানা--- একটি শক্ত খাবার আর একটা জলজাতীয় খাবার একসঙ্গে রান্না করা হল স্ট্যু। ভাবতে পারেন সেটাকেই সত্যজিৎ করলেন খিচুড়ি-র ইংরাজি নাম। তবে কিন্না বড্ড বেশি স্ট্যু বলায় সেটার ব্যঙ্গটাও জবরদস্ত তৈরি হয়ে ওঠে। সেখানে কবিতার প্রথম লাইন ছিল, ‘হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),/ হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না।’ সেই বিখ্যাত লাইনটিকে অনুবাদে সত্যজিৎ করলেন,
‘A duck once met a porcupine; they formed a corporation
Which called itself a Porcuduck (a beastly conjugation!).’
আরও পড়ুন
লিয়রের লিমেরিক: এক নতুন গড়া!
হুবহু শব্দের খেলায় না নেমেই যে অনুবাদের মজা করা যায়, এ তার এক চমৎকার উদাহরণ। বাংলার ‘হাঁসজারু’ থেকে সত্যজিৎ তৈরি করলেন নতুন শব্দ ‘পর্কুডাক’। শব্দের শেষ ধ্বনি আর প্রথম ধ্বনি মিলিয়ে পোর্টম্যান্টো শব্দ বানালেন না তিনি বরং বানালেন নতুন শব্দ। সেই নতুন শব্দ বানানো চলল পরের চরণেও। বাংলার ‘বক কহে কচ্ছপে--- বাহবা কী ফূর্তি!/ অতি খাসা আমাদের ‘বকচ্ছপ’ মূর্তি।’’ সেই ‘বকচ্ছপ’ সত্যজিতের অনুবাদে হল ‘স্টর্টেল’। আরেকটি নতুন শব্দ। ‘স্ট্রক’ আর ‘টার্টেল’ মিলিয়ে তৈরি হল এই শব্দ। তিনি অনুবাদে ওই চরণটিকে করলেন,
A stork to a turtle said, 'Let's put my head upon your torso;
We who are so pretty now, as Stortle would be more so !'
আরও পড়ুন
লিয়রের লিমেরিক, কতভাবে ঠিক-ঠিক!
বাংলার বক কহে কচ্ছপে বিষয়টা একই রকম রাখলেন, অনুবাদে বককে ক্রেন না করে করলেন সারস বা স্টর্ক। লক্ষণীয়, স্টর্ক-এ আর টার্টেল-এ ট-ধ্বনিটা থাকলে তাদের মিলিয়ে শব্দ-বাঁধার মজাটা হবে। আর এটাও বেশ চোখে পড়ার মতো, অনুবাদে সত্যজিৎ সারসকে দিয়ে কচ্ছপকে বলালেন যে, তোমার ধড়ের ওপরে আমার মাথাটা বসাও। তার এই আব্দারটা তো বাংলাতে ছিল না। এটা অনুবাদে যোগ করলেন যখন, তখন সত্যজিৎ মনে রেখেছেন, এই ছড়ার ছবিটাও। সেখানে তো কচ্ছপের খোলসের সামনেই ছিল বকের মুন্ডু। আর
বাংলা ‘হাতিমি’ সত্যজিতের অনুবাদে হল ‘Whalephant’। এখানেও একটা সুন্দর শব্দের খেলা। হোয়েল-এর সঙ্গে এলিফ্যান্ট জুড়ে তৈরি এই শব্দ। বাংলাতে ছিল, হাতিমির দশা দেখো, তিমি ভাবে জলে যাই/ হাতি বলে, এই বেলা জঙ্গলে চলো ভাই। সেটা অনুবাদে এই একই মেজাজ রেখে হল, ‘It's obvious the Whalephant is not a happy notion:/ The head goes for the jungle, while the tail turns to the ocean’। এখানেও সুকুমারের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে অনুবাদ করলেন সত্যজিৎ। তাই হাতিমি-র মাথাকে দিয়ে বলালেন জঙ্গলে যাওয়ার কথা আর লেজকে দিয়ে বলালেন সাগরে যাওয়ার কথা। এই তিন দুগুণে ছ-লাইন থেকে এটাও এতক্ষণে স্পষ্ট, সত্যজিৎ কী অসামান্যতায় বজায় রেখেছেন অন্ত্যমিলের বিষয়টাও। সত্যিই তো, আবোল তাবোল-এর এক আসল মজাই তার দুর্দান্ত সব অন্ত্যমিল। তাকে বাদ দিলে, এই ছড়ার পনেরো আনাই উধাও। ফলে, ইংরাজি পাঠককে বঞ্চিত করলেন না অনুবাদক সত্যজিৎ। এক্কেবারে অন্ত্যমিলের মজা রেখে, শব্দের মজা বজায় রেখে, কবিতার বিষযটাকে অবশ্যই অক্ষুণ্ণ রেখে অনুবাদের কঠিন সাধনা এক আশ্চর্য সহজভঙ্গিতে করলেন সত্যজিৎ। অনুবাদের সময়ে মনে রাখলেন এই ছড়ার সঙ্গে ওতপ্রোত ছবিগুলিকেও।
আরও পড়ুন
শব্দ বানাবার ছড়া বা ধ্বনির অনুবাদে ভাবের লেনাদেনা
শব্দের বা বলা ভালো ধ্বনির মজাকে রেখে অনুবাদে ‘বোম্বাগড়ের রাজা’ হল ‘The King of Bombaria’। আর বিদেশি পাঠক ‘আমসত্ত্ব’ –ই বুঝবে না, তো ‘আমসত্ত্ব ভাজা’! ফলে ‘ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা’-কে অনুবাদক সত্যজিৎ করলেন, ‘Gilded frames for chocolates’। অনেকটাই অন্য রকম করলেন ব্যাপারটা। সোনালি ফ্রেমটিকে আনলেন রাজবাড়ির সঙ্গে মানানসই করে, তবে তার ভেতরে রাখলেন আমসত্ত্বর বদলে চকোলেট! রানির গল্পেও ছন্দের খাতিরে যোগ করলেন ছোট্ট একটা অন প্রসঙ্গ। বাংলাতে ছিল শুধু ‘রানির মাথায় অষ্টপ্রহর কেন বালিশ বাঁধা’। সেটাই ইংরাজিতে হল ‘The queen, who seldom goes to bed/ Straps a pillow round her head.’। মানে যে-রানি মোটেও ঘুমোতে যান না, তাঁর মাথায় সারাক্ষণ বালিশ বাঁধা! রানির ঘুমোতে না-যাওয়ার অংশটুকু অনুবাদকের যোগ। এতে রানির না-ঘুমোলেও মাথায় সারাক্ষণ বালিশ বাঁধার উলটপুরাণও হল আর ‘বেড’-এর সঙ্গে ‘হেড’-এর অন্ত্যমিলটাও হল।
আরও পড়ুন
গল্পের ঘরবাড়ি
ওই আমসত্ত্ব যেমন চকোলেট হয়েছিল বিদেশি পাঠকের জন্য, তেমনই ‘রাজার খুড়ো নাচেন কেন হুকোর মালা পরে’-তে ‘রাজার খুড়োর নাচ’-কে সত্যজিৎ করলেন, ‘While Uncle loves to dance Mazurkas/ Wearing garlands strung with hookaha’। পোলিশ ধীরগতির মাজুরকা নাচটাকেও অনুবাদক যোগ করলেন খুড়োর নাচকে আরো মজাদার করার জন্য যেমন তেমনই আবার পরের লাইনে হুঁকোর মালার ‘হুকা’ শব্দের টানেও।
‘বাবুরাম সাপুড়ে’-র বাবুরাম শব্দটাকে এক রেখেই সত্যজিৎ লিখলেন ‘বাবুরাম দ্য স্নেক চার্মার’। কী অসামান্য সে অনুবাদ। বাংলা ছড়ার পুরো ধরনটাকে বজায় রেখে, অনেকটা সেই ছন্দের প্যাটার্নটাকেও না-বদলে সত্যজিৎ করলেন এই অনুবাদ। তবে সেখানে কবিতায় ছিল মাঝখানে মাঝখানে মিল। এখানে তিনি চরণের শেষে শুধু মিলের জোড় দিলেন। কিন্তু কবিতার পুরো ধরনটাকে রেখে দিলেন। যেমন, পরপর বলে গেলে দেখা যাবে, ‘বাবুরাম সাপুড়ে কোথা যাস বাপুরে?/ আয় বাবা দেখে যা, দুটো সাপ রেখে যা’ অনুবাদে হল, ‘Hullo, there Baburam--- what have you got in there?/ Snakes? Aha --- and do you think there’s one that you could spare’। ‘যে সাপের চোখ নেই, শিং নেই, নোখ নেই/ ছোটে নাকি হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না/ করে নাকো ফোঁসফাঁস, মারে নাকো ঢুঁশঢাঁশ’ অনুবাদে হল, ‘You know, I’d love to have one, but let me tell you this–/ The ones that bite aren’t right for me--- nor the ones that hiss./ I’d also skip the ones that butt/ As well the ones that whistle
Or the ones that slink about/ Or show their fangs, or bristle.’ লক্ষণীয়, কাউকে যে কাটে না হল, The ones that bite, করে নাকো ফোঁসফাঁস হল ones that hiss আর ones that whistle। সবচেয়ে মজার হল, ওই চোখ নেই, শিং নেই, নোখ নেই-এর অনুবাদ। তাকে সত্যজিৎ করলেন, ‘শো দেয়ার ফ্যাঙ্গস অর ব্রিশল’! বাংলায় যেমন এমন ভাবে ওই লাইনটা বলা, যার মানে সাপের যেন শিং আর নোখ থাকার কথাই ছিল, তবে সেগুলি থাকলে চলবে না। ইংরেজিতেও সেভাবেই বললেন সত্যজিৎ। সাপের যেন শ্বদন্ত থাকেই বা তার যেন ব্রিশলের মতো নখ-টখ থাকেই! এমনকি এরপরের লাইনের ‘নেই কোনো উৎপাত/ খায় শুধু দুধভাত’-কেও হুবহু আনলেন অনুবাদে। তাকে করলেন, ‘As for eating habits, I think it would be nice/ To go for ones that only take a meal of milk and rice.’। এরপরে সেই অসামান্য লাইন, এমন নির্বিষ নির্ঝঞ্ঝাট সাপই নাকি আসল সাপ, তাকেই ‘তেড়েমেড়ে ডান্ডা করে দিই ঠান্ডা’। সেই শেষ চরণ অনুবাদে সত্যজিৎ করলেন, ‘I’m sure you know the kind of snake that want from what I’ve said,/ Do let me have one, Baburam, so I could bash its head.’ সত্যিই বেশ চোখে পড়ার মতো, কীভাবে একটি প্রসঙ্গও না বদলে, প্রতিটি শব্দের অনুষঙ্গ আর তাদের খুঁটিনাটি বজায় রেখে কী অসামান্যভাবে পুরো ছড়াটিকে অনুবাদ করলেন সত্যজিৎ। এই ইংরাজি-অনুবাদক সত্যজিতের আরো সৃজনের সংবাদ নিয়ে ফিরে আসব পরের হপ্তায়। দেখব, ‘গোঁফচুরি’-র সেই ‘হেড আপিসের বড়োবাবু’, ‘কাতুকুতু বুড়ো’ আর 'রামগরুড়ের ছানা'-কে কীভাবে সত্যজিৎ নিয়ে আসেন সাগরপারের পাঠকের জন্য।
Powered by Froala Editor