লিয়রের লিমেরিক: এক নতুন গড়া!

মানিকলমকারি - ৩৭
আগের পর্বে

সত্যজিৎ রায়ের অনুবাদের ধরণটি বেশ অন্যরকম। নানা লিমেরিকের অনুবাদে সেই প্রতিভার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। ছড়ার মূল বিষয়টিকে এক রেখে অদ্ভুতভাবে বদলে ফেলেন গল্প বলার ধরণ। তাদের করে তোলেন একেবারে নিপাট বাঙালি। তবে তার জন্য ধ্বনি বাধা পায় না কখনও। বরং ছন্দের দিকটিতেও সমান তাল রেখে গিয়েছেন সত্যজিৎ। এমনিভাবে তাঁর লেখায় ঢুকে পড়েছে নানা নতুন নতুন অনুপ্রাস এবং চিত্রকল্প। আবার লিয়রের ছবি থেকেই লিমেরিক বেঁধেছেন সত্যজিৎ।

বলছিলাম, এডওয়ার্ড লিয়রের ‘দ্য বুক অফ ননসেন্স’ আর ‘মোর ননসেন্স’-এর সত্যজিৎ-কৃত অনুবাদের কথা। বলছিলাম, অনুবাদের পর সেগুলি থেকে বই-তৈরির সময় সত্যজিৎ বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছিলেন, ‘লিয়রের লিমেরিকগুলিকে সরাসরি অনুবাদ না করে লিয়রেরই আঁকা ছবিগুলিকে অনুসরণ করে নতুন লিমেরিক রচনা করা হয়েছে।’ তবে একেবারে নতুন লিমেরিক তিনি কিন্তু একটা অংশে করেননি, আগের কিস্তিতে তা আমরা দেখছিলাম। দেখছিলাম, সত্যজিৎ কীভাবে বিলিতি রীত-রেয়াজকে আর বিদেশীয় ধরন-ধারণকে বেশ বাঙালিয়ানাতে বদলে নিচ্ছিলেন। তাঁর এই অনুবাদের সেটা একটা ধরন আবার আরেকটা রকম অনুবাদও আছে, যেখানে তিনি সত্যিই বদলে নিয়েছেন লিমেরিকের বিষয়। সেখানে ছবিটাকেই ধরেছেন তিনি আর সেই ছবির মেজাজটাকে সামনে রেখেই বুনেছেন তাঁর ছড়া। যেমন ধরা যাক, সেই বুড়োটার ছড়া। লিয়রের লেখাতে সে ছিল শুধুই ‘ওল্ড ম্যান ইন এ ট্রি’। যার শুধু ‘হুইস্কার্স ওয়্যার লাভলি টু সি’। সেখানে গাছের পাখিরা তার গোঁফ তুলে বাসা বানাচ্ছিল। সত্যজিৎ ছড়াটাকে বানালেন পাখির দিক থেকে নয়, বুড়োটার দিক থেকে। লিখলেন, ‘কঞ্জুস বুড়ো বসে গাছে/ পাখিদের বলে, ‘আয় কাছে/ তোরা যদি ঠুকরিয়ে/ দাড়িগুলো নিস নিয়ে/ নাপিতের খরচাটা বাঁচে।’ ঠিক সেইভাবেই সত্যজিৎ মূল ছড়ার এক সাধারণ বৃদ্ধকে করেছিলেন রামখুড়ো। সেখানেও সামান্য বদলে নিয়েছিলেন ছড়ার মেজাজ। লিয়রের ছড়াতে ছিল সেই ‘ওল্ড পার্সন ইন ব্ল্যাক’-এর ঘাড়ে এসে এক ফড়িংয়ের কথা। সেখানে শুধু ‘It chirped in his ear’ তাই ‘He was smitten with fear’। ওই বুড়ো সত্যজিতের অনুবাদে হলেন রামখুড়ো। কবিতাতে ছবির নীচে লেখা ‘ওই দ্যাখো চেয়ারেতে বসে/ রামখুড়ো মরে আপশোষে’। তাঁর এই আপশোষের কারণ কী? না, তাঁর ‘সাধ করে ধরে আনা/ পোষা ফড়িংয়ের ছানা/ আজকাল খুড়োকেই পোষে’। মূলে ফড়িংয়ের বড়ো আর ধেড়ে চেহারাটা ছবিতে ছিল, ছড়াতে ছিল না। সত্যজিৎ ছবির ওই বি-রা-ট ফড়িংটাকেই করে তুললেন একটি চরিত্র। মূলে যেটা ছিল একটা যেকোনো ফড়িং, অনুবাদে সেটা হল একদিন পোষার জন্য আনা ফড়িংয়ের বদলে যাওয়ার গল্প। যে ফড়িংকে পোষার জন্য আনা হয়েছিল, সেই নাকি তার মালিককে পুষছে। একেবারে পারফেক্ট ননসেন্স পদ্য। নাহলে একে তো ফড়িং পোষার বাতিক, তায় ফড়িংয়ের হাতে মানুষ-পোষার গপ্পো! এই উলট পুরাণের গল্পে ননসেন্স কবিতা লেখাটা একটা মজার ধরন সত্যজিতের অনুবাদে। ঠিক এইভাবেই অন্য রকম হয়ে যায় মূলের সেই ‘ওল্ড পার্সন অফ হাইড’-এর ছড়া। মূলে ছড়াটিতে ছিল হাইডের এক দম্পতি হাইড ছেড়ে হাওয়া খেতে এসেছিল সমুদ্র উপকূলে। সেখানে এক বড়োসড়ো কাঁকড়াকে দেখে তাঁদের মনে এমন ভয় ধরল যে, তাঁরা ঠিক করলেন আর তাঁরা হাইড শহর ছাড়বেন না। ব্যস এইটুকুই। বাংলাতে সত্যজিৎ এই লিমেরিককে নিয়ে ফেললেন পুরীতে। লিখলেন, ‘খেয়ে কাঁকড়ার ঝোল পুরী হোটেলেতে/ বাবুবিবি বালুতটে যান হাওয়া খেতে/ সেথা মহা সংকট/ ধেয়ে আসে কর্কট/ দুজনারে চটপট পোরে উদরেতে।’ খাদ্য-খাদকের গল্পটাকে অন্যভাবে বলা হল। পুরী হোটেলে কাঁকড়ার ঝোল খাওয়া আর তার সঙ্গে পুরীর সমুদ্রতটে হাওয়া-খাওয়া যেমন খাওয়া শব্দ নিয়ে খেলা, তেমনই পুরী হোটেলে কাঁকড়ার ঝোল খাওয়া আর পুরীর সমুদ্রসৈকতে কাঁকড়া দেখতে যাওয়া--- এই দুটো মাত্র উপাদানে পুরী-বেড়ানোর মেজাজটাকেও ধরে নিলেন তিনি। তবে সবচেয়ে বড়ো ওই রিভেঞ্জের গল্পটা। এতদিন মানুষ কাঁকড়া মেরে খেয়ে এসেছে এবার কাঁকড়াদের মানুষ ধরার পালা--- ননসেন্স কবিতার ছাঁদে মজা করে হাসতে-হাসতে হাসাতে-হাসাতে পরিবেশের কথা বলা।

তবে ছবিকে সামান্য আর ছড়াকে এক্কেবারে না-মেনেও কখনো নতুন একটা লিমেরিক যে বেঁধে ফেলা যেতে পারে তার একটা চমৎকার উদাহরণ, ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’-এর শেষ লিমেরিক। মূলে ছিল,

There was an Old Person of Hove,
Who frequented the depths of a grove
When he studied his books,
With the Wrens and the Rooks,
That tranquil Old Person of Hove.

সেটাই অনুবাদে হল,

যেখানে যে বই আছে পাখি সম্বন্ধে
মন দিয়ে পড়ি সব সক্কাল সন্ধে
আজ শেষ হবে পড়া, আর বই বাকি নেই
আপশোষ শুধু--- এই তল্লাটে পাখি নেই।

আরও পড়ুন
লিয়রের লিমেরিক, কতভাবে ঠিক-ঠিক!

শুধু লিমেরিকের গঠন ছেড়ে অন্ত্যমিলের কবিতাই তৈরি করেননি, কবিতাটাই বেশ অন্য রকম একটা খবর বয়ে এনেছে পাঠকের কাছে। শুধু বই পড়ে পাখি সম্বন্ধে জানতে গিয়ে দিন-রাত কাবার করলে, যতদিনে কারো সব বই পড়া হবে, দেখা যাবে হয়ত এই দুনিয়াটাই পাখিছাড়া হয়ে গেছে। মনে পড়ে যাবেই কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবির সেই পাখিপ্রেমী জগদীশবাবুর কথা। তিনি শুধু পাখি নিয়ে পড়তেন না পাখির বই হাতে ঘুরেও বেড়াতেন এখানে-ওখানে। পাখি নিয়ে বা গাছ নিয়ে পড়া মানে শুধু বইমুখো হওয়াটা যে কাজের কথা নয়, এ ছড়া যেন বাড়তি সেই সচেতনতার খবরটাও পৌঁছে দেয় পাঠকের কাছে।  

আরও পড়ুন
শব্দ বানাবার ছড়া বা ধ্বনির অনুবাদে ভাবের লেনাদেনা

আরও পড়ুন
গল্পের ঘরবাড়ি

আসলে কী বলুন তো, ননসেন্স লিমেরিকে মানুষের দিক থেকে পড়াটা যেমন একটা পড়া, তেমনই পশুপাখির দিক থেকে দেখাটাও একটা পড়া। লিমেরিকের এই ছড়াগুলোর ভেতরে নানাভাবে মানুষের জগতের অদ্ভুতত্ব যেমন চোখে পড়ার মতো, তেমনই পশুপাখির জগতের সঙ্গে মানুষের জগতের একটা উলটসম্পর্কের গল্পটাও তো চোখ এড়াবার নয়। মানুষের স্বভাবের অনেক হিংস্রতা অনেক নিষ্ঠুরতার নির্মম আখ্যানগুলিকে যেন মজা করে হাসি মশকরার ছলে পরপর বুনে দেওয়া আছে। লিয়রে যা ছিল হালকাভাবে, সত্যজিৎ তাকেই অনেক স্পষ্ট করে তুললেন।

আরও পড়ুন
অসমাপ্ত ফেলুদার রহস্য

এই নতুন পরিবেশে নতুন ভাবে লিয়রের মেজাজকে বাংলাতে আনার কাজটি প্রথম করেছিলেন সুকুমার রায়। তাই বুঝি, ক্যারল আর লিয়রের ছড়া নিয়ে যে বইটা লিখলেন সত্যজিৎ, তার নামটা তিনি গ্রহণ করলেন পিতা সুকুমারের লেখা থেকে। একই সঙ্গে ননসেন্স রাইম-এর এ একটা চমৎকারি প্রতিশব্দ আবার তা সুকুমার রায়ের প্রতি পুত্রের একটি শ্রদ্ধার্ঘ্যও বটে। সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের শেষ-কবিতার উনশেষ অংশে সুকুমার লিখেছিলেন, ‘আদিম কালের চাঁদিম হিম/ তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’। সেই ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’-ই হল সত্যজিতের বইয়ের নাম। আর তার সঙ্গে একেবারে কিছু তথ্যকে পরপর সাজালে আরো অদ্ভুত মনে হয় বেশ কিছু সংকেত। সত্যজিতের এই বইটি প্রকাশিত হল ২ মে ১৮৮৬। এই দিন সত্যজিৎ পড়লেন ৬৫-তে আর এই বছরটাই সুকুমারের শতবর্ষের শুরু। ফলে সুকুমারের জন্মশতবর্ষে পুত্র সত্যজিতের একটা জানা-নিবেদন যদি হয়, সুকুমার রায়ের ওপর তৈরি তথ্যচিত্র তাহলে অবশ্যই এই গোটা বইটিও শৈশবেই পিতৃহারা এক পুত্রের তাঁর পিতার উদ্দেশে এক অন্য রকম শ্রদ্ধার্ঘ্য। কবিতার কলমকারিতে পিতার উদ্দেশে আরেক রকম শ্রদ্ধার্ঘ্য সত্যজিৎ নিবেদন করেছেন, সে কথায় না হয় পরদিন আসা যাবে।  

Powered by Froala Editor