গল্পের ঘরবাড়ি

মানিকলমকারি - ৩৪
আগের পর্বে

১৯৭৩ সালে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন ফেলুদার একটি গল্পের দুটি খসড়া। ‘তোতা রহস্য’ নামের সেই গল্প থেকেই পরে তৈরি হল ‘নেপোলিয়ানের চিঠি’-র গল্প। তবে মাঝখানে লেগে গেল ৮ বছর। খসড়ার সঙ্গে মূল গল্পের পার্থক্য অনেক জায়গাতেই। এমনকি খসড়াদুটির মধ্যেও ছিল বৈচিত্র। তবে সব ক্ষেত্রেই ফেলুদার একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। ক্ষুদে ভক্তের গ্রাম্ভারি কথায় বাকিরা হাসাহাসি করলেও ফেলুদা মন দিয়ে শুনেছেন তার কথা। আর এভাবেই আপাত তুচ্ছ তথ্যও হয়ে উঠেছে রহস্য উদ্ঘাটনের চাবিকাঠি। মূল গল্পে জটায়ু থাকলেও খসড়ায় তিনি ছিলেন না। আবার ‘তোতা রহস্য’ খসড়া থেকেই উঠে এসেছিল ত্রিনয়ন রহস্য। পরে ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’-তে সেই কাহিনি পাওয়া যায়। সেখানেও জটায়ু নেই। খসড়া কাহিনিতে রহস্য পরিণতি পায়নি। তবে সেখান থেকেই তৈরি হয়ে গেল দুটি কাহিনি।

চরিত্র তো থাকেই, থাকে চরিত্র হিসেবে মানুষ, আবার পশুপাখিরাও। কিন্তু কখনো কখনো এমন হতেও তো পারে যে, একটা বাড়িই হয়ে যায় গল্পের বিষয়। নিজের ছোটোবেলার কথা বলতে গিয়ে সত্যজিৎ কী অসাধারণ বর্ণনায় উত্তর কালের কাছে মূর্ত করে তুলেছিলেন তাঁদের প্রিয়, বাংলা শিশু কিশোর সাহিত্যের তীর্থভূমি ১০০ নম্বর গড়পার রোড। তার একতলা দোতলা, সামনের অংশ পিছনের ভাগ সবটাই যেন আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে আছে 'যখন ছোট ছিলাম' স্মৃতিকথার বর্ণনা থেকে। বাড়ি আর তার হরেক চেহারা সত্যজিতের একটি বিশেষ প্রিয় ব্যাপার। 

ফলে তাঁর গল্পে বাড়ি আর ঘর মাঝে মাঝেই হয়ে যায় কাহিনির মুখ্য উপকরণ। বাড়ির কথাতেই চলে হরেক কলমকারি। 'অনাথবাবুর ভয়' গল্পে এই বাড়িকথার সূচনা। রঘুনাথপুরের হালদার বাড়ি, দুশো বছরের পুরোনো ভগ্নপ্রায় প্রাসাদ। বর্ণনা থেকে দেখি, "সদর দরজা দিয়ে ঢুকে দেখি বিরাট উঠোন আর নাটমন্দির। একশো দেড়শো বছরে কত উৎসব কত অনুষ্ঠান, কত পূজা পার্বণ, যাত্রা কথকতা এইখানে হয়েছে তার কোনো চিহ্ন আজ নেই। উঠোনের তিন দিকে বারান্দা । ডাইনে বারান্দার যে অংশ তাতে একটা ভাঙা পালকি পড়ে আছে এবং পালকিটি ছাড়িয়ে হাত দশেক গিয়েই দোতলায় যাবার সিঁড়ি।" এরপরে নিখুঁত বর্ণনা দোতলার বারান্দা আর ঘরের। ক্রমশ একটা বাড়ি হয়ে ওঠে গল্পের চরিত্র। সত্যজিতের যেকোনো ভূতের গল্প বা অলৌকিক গল্পের মুখ্য চরিত্র সেই বাড়ি আর তার অনুষঙ্গী সেই বাড়ির বর্ণনা। মনে করে দেখুন, ব্রাউন সাহেবের বাড়ি থেকে তারিণীখুড়োর গল্পমালা। তারিণীখুড়োর 'কনওয়ে কাসলের প্রেতাত্মা', 'ধুমলগড়ের হান্টিং লজ', 'নরিস সাহেবের বাংলো' গল্পে অলৌকিকের মায়া তৈরি করে এই বাড়িগুলির নিপুণ বর্ণময় বর্ণনা। 

কিন্তু অলৌকিকের বাইরেও এই বাড়ি আর তার আনাচকানাচ কখনো হয়ে ওঠে গল্পের কেন্দ্র। সেখানে যাওয়ার আগে মনে করে দেখতে পারেন, গল্পলেখার আগে সত্যজিৎ যখন আঁকছেন বিজ্ঞাপনের ছবি, তখনকার কথা। প্যালুড্রিন কোম্পানির বিজ্ঞাপন আঁকতে গিয়ে কত যত্ন করে বাড়ির টুকটাক পুঙ্খানুপুঙ্খ মাথায় রেখে তিনি আঁকলেন এক অসামান্য চিত্রমালা। সেও তো তাঁর কলমকারির নমুনা। আহা বিজ্ঞাপনের ভাষা কী! "Insensible households thoughtful India.... SUNDAY is PALUDRINE DAY". ফি সপ্তাহে ঠিক একটি বিশেষ দিন দুপুরের খাওয়ার পরে একটি প্যালুড্রিন বড়ি খাওয়া মানে, ম্যালেরিয়ার হাত থেকে মুক্তি। এই কেজো বার্তা দিতে বাঙালি বাড়ির চমৎকার ডিটেলস। পুরো পরিবার সুরক্ষিত। একটি ছবিতে অভিজাত সাহেবি পরিবারের কর্তা আর মেমসাহেব বাড়ির সমস্ত কাজের লোকেদের ডেকে হাতে তুলে দিচ্ছেন বড়ি। একটি ছবিতে ঘরোয়া পরিবারে মা দিদিরা বাচ্চাদের স্নেহভরে ডাকছে প্যালুড্রিন বড়ি খেতে। আরেকটি ছবিতে রবিবারের হরেক কাজের ফাঁকে মনে করে বড়ি খেয়ে নেওয়ার ডাক। মূল ছবির সঙ্গেই পুরো বাড়ির বিরাট ছবি। ঘরের পরিবেশ, তার আসবাব থেকে নানা চরিত্রের নানা ভঙ্গি আর তাদের বিভিন্ন রকম পোশাক। এ এক সংগ্রহ করে রাখার মতো কাজ। 

আরও পড়ুন
অসমাপ্ত ফেলুদার রহস্য

আর গল্পের দুনিয়াতে? মনে আছে তো দুটো গল্প? এক, 'চিলেকোঠা' আর দুই, 'লোডশেডিং'। দুটো গল্পেরই মূল চরিত্র দুটি বাড়ি। প্রথম গল্পে সেকেলে বাড়ির চিলেকোঠার ঘরের সঙ্গে মানুষের নিজস্ব কিছু লুকিয়ে রাখার কাহিনিও যে একটা বন্ধুত্বের গল্পে গড়াতে পারে, তার সংকেত। আর দ্বিতীয় গল্পের প্রকাশকাল ১৯৭৮। সবে কলকাতার বুকে ফ্ল্যাট কালচার আসছে। এতদিন ছিল সব বাড়ির সব ঘরের আলাদা আলাদা গঠন গড়ন আর এবার এলো পাশাপাশি এক ডিজাইনের একই রকম বাড়ি বা বলা ভালো ঘরের গঠন। এই এক রকম দেখতে বাড়ির গল্প নিয়ে যে প্রায় হাড় হিম করা গল্প হতে পারে, লোডশেডিং বোধ করি তার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। পরিবর্তমান কলকাতার ফ্ল্যাটের গঠন না মনে রাখলে বুঝি বোঝা যাবে না লোডশেডিং গল্পের ভয়ংকর মজাটাই। 

আরও পড়ুন
শঙ্কু আর গুপি-বাঘার গল্প

ছবিতে বাড়ি বানাবার আরেকটি মজা হল সত্যজিতের আঁকা এক মজার ধাঁধার ছবি। সেরা সন্দেশ খুললেই সন্দেশের "ছোটো সম্পাদক" সত্যজিতের করা এক মজাদার ধাঁধা আমরা পাই। বিরাট বড়ো একটা ছবির মধ্য থেকে পাঠককে খুঁজে বের করতে হবে সেই ছবিতে কতগুলো জিনিস এমন আছে, যার নাম শুরু 'ব' দিয়ে। খেলার নাম, 'ব-এর বাড়াবাড়ি'। মানে সেখানে বাংলো, বুড়ো, বল, বেড়াল, বেতের চেয়ার, বেলুন, বাবলের সঙ্গে বাউল, বাঁধাকপি, বটগাছ, বাঁক, বাছুরের ছড়াছড়ি। এখানেও একটা বিরাট বাড়ির গল্প একটি ছবিতেই। এই ছবিটি তো ছোটোবেলা থেকেই সব বাঙালি শিশু কিশোরদের চোখের সঙ্গী। পরে বড়ো হয়ে যেদিন পড়লাম, বিজয়া রায়ের লেখা 'আমাদের কথা', তখন সেই ছবি যেন হয়ে উঠল নতুন। তিনি তাঁদের পান্নার বাড়ির একটি ভাষাচিত্র এঁকেছিলেন সেখানে। লিখেছিলেন, "আমাদের পাটনার বাড়িটা ছিল ভারি সুন্দর লাল ইঁটের বাংলো বাড়ি। নাম ছিল লিলি ভিলা। সামনে গোল ফুলের বাগান। তার চারপাশে লাল সুরকি ঢালা রাস্তা। গেট দিয়ে ঢুকলে ডানদিকে বাগান পেরিয়ে বাবার শখের গোলাপ বাগান তার সামনে টেনিস কোর্ট।" এইভাবে এক দীর্ঘ বর্ণনা পড়তে পড়তে কেমন যেন চোখের সামনে এই ব-এর বাড়াবাড়ির বাংলোবাড়ির ছবিটাই ভেসে ওঠে। ভাবতে থাকি আমরা, এই পাটনার বাড়িতেই তো ছেলেবেলায় প্রত্যেক ছুটিতে আসতেন ছোট্টো মানিক। কোনো ছুটিতে বিজয়া যেতেন কলকাতাতে মানিকদের বাড়ি। কী আশ্চর্য! নিজের ছেলেবেলায় দেখা, তাঁদের সেই চমৎকার ছবির মতো পাটনার বাংলোবাড়ি লিলি ভিলা-ই কি ব-এর বাড়াবাড়িতে এঁকে রাখলেন সত্যজিৎ? সেই ছবি একভাবে আমরা দেখেছি আর আরেকভাবে হয়ত  দেখেছিলেন সত্যজিৎ আর বিজয়া!

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
কলমকারিতে শব্দ শোনা