মানিকলমকারি - ৩৩
আগের পর্বে
গুপি-বাঘার প্রতিটি সিনেমাতেই সম্মোহনের একটি সাধারণ বাতাবরণ রয়েছেই। গুপির গান আর বাঘার বাজনায় সম্মোহিত হয়ে যান সবাই। কিন্তু তিন নম্বর ছবিতে এসে দেখা যায় আরও একটি চরিত্রকে, যে তাদের থেকেও শক্তিশালী। আর এই ব্রহ্মানন্দের অদ্ভুত ক্ষমতার সঙ্গে মিশে আছে তার দীর্ঘ জীবনলাভের আকাঙ্খা। এখানেই মিল খুঁজে পাওয়া যায় প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের ‘‘হিপনোজেন’ গল্পটির সঙ্গে। ক্রাগের চেহারার সঙ্গেও সিনেমার অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অদ্ভুত মিল। দুটি গল্প তৈরি হওয়ার মাঝে অবশ্য ১৫ বছরের ব্যবধান। সত্যজিৎ রায় নিজের জীবদ্দশায় শঙ্কুর একটি গল্পেরও চিত্ররূপ দিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু গুপি-বাঘা সিরিজের ভিতর দিয়েই একরকম প্রকাশ দেখা গেল।
দু- দুটো খসড়া আর একটা ফাইনাল লেখা। খসড়া দুটি আগে বেরিয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণের বছর চারেক পরে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায়। পরে সেই খসড়া মুদ্রিত হয়েছে ‘ফেলুদা সমগ্র’-র দ্বিতীয় খণ্ডের শেষে। তবে এই খসড়া পাঠ আর ফাইনাল পাঠের চেয়েও মজার ব্যাপার এর সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে আরো একটা ফেলুদার গল্প--- তার কথা এখন তোলা থাক, পরে সেই কথায় আসছি। প্রকাশিত ফাইনাল গল্পটা হল ‘নেপোলিয়নের চিঠি’ আর খসড়া দুটো লেখা হল ‘তোতা রহস্য’। রহস্যময় এদের রচনাকালের ব্যবধান। ‘তোতা রহস্য’-র প্রথম আর দ্বিতীয় খসড়া লেখা হল ১৯৭৩ সালে আর তার থেকে বেশ কয়েক বছর পরে সত্যজিৎ লিখলেন ‘নেপোলিয়নের চিঠি’। বেশ ক-বছর মানে, তাদের মাঝখানে আট বছরের ব্যবধান। কারণ, ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চার ‘নেপোলিয়নের চিঠি’ গল্প হিসেবে প্রকাশিত হল ১৯৮১ সালের ‘সন্দেশ’ পত্রিকায়। এই দুটি গল্পের খসড়া একটু মন দিয়ে পড়া যাক। প্রথম খসড়া শুরু হচ্ছে একটি সংলাপ দিয়ে ‘তোমার নাম ফেলুদা?’ দ্বিতীয় খসড়াতেও সেই কথাটাই, তবে একটু অন্যভাবে। সেখানে সেই বাক্যটা হল ‘বাবা বলছে তুমি ফেলুদা’। আর ‘নেপোলিয়নের চিঠি’-র প্রথম বাক্য ‘তুমি কি ফেলুদা?’ ঘটনাস্থল দুটি খসড়াতে আর ওই ফাইনাল গল্পতেও পার্ক স্ট্রিট আর রাসেল স্ট্রিটের একটি হবি সেন্টার। কথাটা বলল এক খুদে ফেলুদা-ভক্ত। তবে এই বক্তা ওই খুদে ফেলুদা-ভক্তের নাম এক এক জায়গায় এক এক রকম। প্রথম খসড়াতে সে রজত বোস। দ্বিতীয় খসড়াতে তার নাম হীরক দাশগুপ্ত। আর ফাইনাল গল্পে তার নাম অনিরুদ্ধ হালদার। দুই খসড়া আর ফাইনাল গল্পে ফেলুদাদের সেই হবি-সেন্টারে আসার কারণটাও বিভিন্ন। প্রথম খসড়াতে ফেলুদা আর তোপসে সেখানে হাজির সেখানকার অ্যাকোয়ারিয়ামে ‘ব্রেজিলের রাক্ষুসে মাছ পিরানহার দুটো বাচ্চা’ এসেছে, সেই খবর পেয়ে, তাদের দেখতে। দ্বিতীয় খসড়াতে তারা যেদিন সেখানে যায় সেটা বড়োদিন। পার্ক স্ট্রিটের ‘ঝলমলে চেহারা’ দেখে ফেলুদার ইচ্ছেতে একটা চাইনিজ্ ওয়্যার পাজল-এর সন্ধানে সেই দোকানে আসে তারা। আর তৃতীয় খসড়ায় তাদের এই দোকানে আসার কারণটি ভারি মজাদার। তা হল সিধুজ্যাঠার সত্তর বছরের জন্মদিনে ফেলুদার তাঁকে একটা ভালো দাবার সেট উপহার কিনে দেওয়ার ইচ্ছে।
প্রথম খসড়াতে কোনো রহস্যের সূচনাই নেই। কারণ, সেখানে শুধু ওই খুদে-ভক্ত বলে, তাদের বাড়িতে কোথা থেকে উড়ে-আসা একটা টিয়াকে ধরে তাকে পোষার কথাটুকু। তার শিশুমনের ইচ্ছে, তার সেই টিয়াটিকে দেখতে যেন ফেলুদা একবার তাদের বাড়িতে আসে। দ্বিতীয় খসড়াতে খুদে-ভক্ত বলে, ‘আমার টিয়া কোথায় গেছে বের করে দিতে পারবে?’ ফেলুদা কথা বলে জানতে পারে, সেদিন সকাল থেকে ‘সেটা খাঁচা থেকে উধাও। পালিয়ে টালিয়ে গেছে বোধহয়।’ দ্বিতীয় খসড়াতে ফেলুদা পরে অবশ্য খোঁজ নিয়ে জানতে পারবে, ওই পাখিটি টিয়া ছিল না, ওটা ছিল চন্দনা। ফাইনাল গল্পেও ব্যাপারটা কতকটা তাই। টিয়া এখানে চন্দনা হয়ে গেছে প্রথম থেকেই। খুদে-ভক্তের প্রিয় পোষা পাখিটি উধাও! এই খসড়ায় ফেলুদার খুদে-ভক্তের বক্তব্য, ‘আমার পাখিটা কে নিয়েছে বলে দিতে পারো?’ যারা নেপোলিয়নের চিঠি পড়েছেন, তারা তো জানেনই এই পাখি উধাও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো কত কাণ্ড জড়িয়ে যাবে এই গল্পে। জড়িয়ে যাবে খুদে-ভক্তের ঠাকুরদা পার্বতীচরণের খুন, তাঁর টেবিল থেকে দুর্মূল্য জিনিসের উধাও হওয়ার ঘটনা এমন আরো কত কী! কিন্তু সে কথা এখানে তত দরকারি নয়। রহস্য গল্পটা আমরা খুঁজছি না। আমাদের সন্ধান গল্পলেখার রহস্য।
ওই প্রথম খসড়াতে পাখি দেখতে যাওয়ার সহজ নিতান্ত সাদামাটা ঘটনাতে একটা মাত্রা যোগ হল পরের দিনের খবরের কাগজের একটি বিজ্ঞাপনে। সেখানে দেখা গেল, ভবানীপুরের এক ভদ্রলোক তাঁর পোষা চন্দনা হারিয়ে গেছে বলে, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। ফেলুদার অনুমান, ভবানীপুরের সেই চন্দনাটিকেই শ্রীমান রজত বসুর বাড়ির চাকর ছেলেটি গাছ থেকে ধরেছে টিয়া বলে। ফলে রজতের বাড়িতে যাবে বলে, ফেলুদা রজতের বাবাকে ফোন করে আর সেইখানেই প্রথম খসড়া শেষ। দ্বিতীয় খসড়াতে খুদে-ভক্তের বাড়ি পর্যন্ত যায় ফেলুদারা। সেখানে ওই অন্য এক ভদ্রলোকের পাখি-হারাবার গল্পটা আর আসেনি। তবে, দ্বিতীয় খসড়াতে এসে পড়ে অন্য একটি উপাদান। সেটা হল, এই খুদে ভক্তের দাদু একজন অসামান্য সংগ্রাহক। তিনি সারা দুনিয়ার বিচিত্র সব ঘড়ি জমান। তবে বিচিত্র সব ঘড়ি-জমানোর গল্প ‘নেপোলিয়নের চিঠি’-তে হয়ে যায় নানা ধরনের জিনিস সংগ্রহের কাহিনিতে আর ওই ঘড়ি সংগ্রহের ব্যাপারটা সত্যজিৎ যুক্ত করে দেন তার চার বছর পরে লেখা ‘গোরস্থানে সাবধান’ গল্পের ভেতর। আর এই দ্বিতীয় খসড়াতে দুই ধরনের রহস্য ঘনীভূত হয় দুই দিক থেকে। পাখির রহস্য ঘনীভূত হয় এক দিক থেকে। কারণ, ফেলুদা সেই পাখির খাঁচাতে দেখতে পায় রক্তের ছাপ। অন্য দিকে সেই সংগ্রাহক দাদুর সংগ্রহ থেকে পরের দিন সকালেই খোয়া যায় আড়াইশো বছরের পুরোনো সেল্ফ-ওয়াইন্ডিং ট্যাঁক-ঘড়ি। এখানেই মজা। আসলে, সামান্য একটা পাখির খোয়া যাওয়া থেকে ধীরে ধীরে এক একটা রহস্যের শুরু। সেটাই তো এই গল্পের ইন্টারেস্টিং বিষয়। কী অদ্ভুতভাবে, একটা সামান্য ঘটনা থেকে গল্পের মধ্যে যেমন বড়ো একটা চেহারা নেয়, এই খসড়াগুলিও যেন ঠিক তেমনই। কোন খসড়া যে কোন গল্পে গড়িয়ে যায়!
আরও পড়ুন
শঙ্কু আর গুপি-বাঘার গল্প
এখানে, প্রসঙ্গত দুটো কথা বলে রাখা দরকার। এক হল, ফেলুদা-চরিত্রের একটা অন্য রকম দিকের প্রতি আমাদের এই খসড়াতে চোখ না গেলেই নয়। সেটা হল, ছোটোদের সঙ্গে ফেলুদার কথা বলার আর তার কথা শোনার ধরন। ফেলুদা যখন তার খুদে-ভক্তের সঙ্গে তার বাড়িতে কথা বলে, তখন তার গম্ভীর গম্ভীর প্রশ্নে তাদের বাড়ির লোকেরা মুখ লুকিয়ে হাসে, তার সেই গ্রাম্ভারি চাল দেখে। কিন্তু ফেলুদা মন দিয়ে শুনতে থাকে তার কথা, মন দিয়ে লক্ষ করে তার বলা কথা আর তার সেই কথা শোনা থেকেই ফেলুদা লক্ষ করে আপাতদৃষ্টিতে যা তুচ্ছ, তার গুরুত্ব।
দ্বিতীয় কথাটি হল, লক্ষণীয় ফাইনাল ‘নেপোলিয়নের চিঠি’ গল্পে লালমোহনবাবু থাকলেও এইখানে কিন্তু লালমোহনবাবু নেই। যদিও ১৯৭১-এ সোনার কেল্লা লেখা হয়ে গেছে, ১৯৭২-এ লেখা হয়ে গেছে ‘বাক্স রহস্য’। সেখানে লালমোহন প্রবলভাবে হাজির হয়ে যাওয়ার পরেও ১৯৭৩-এর এই খসড়াতে তিনি গরহাজির। এটা বেশ অদ্ভুত। অবশ্য, দেখা যাবে, ওই দুই গল্পের পরে লেখা ‘সমাদ্দারের চাবি’ আর ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’-তেও নেই লালমোহন। তাহলে কি ব্যাপারটা সত্যজিৎ এই রকম ভেবেছিলেন এক সময়, যে, ফেলুদার উপন্যাসে জটায়ুকে রাখবেন, কিন্তু ছোটোগল্পে আর তাকে ডাকাডাকি করবেন না!
আরও পড়ুন
কলমকারিতে শব্দ শোনা
এই দুই খসড়ার ফাইনাল পাঠ ‘নেপোলিয়নের চিঠি’ গল্পেও আছে ওই চন্দনার মুখের বুলির কথা। সেখানেও আছে তার মুখের একটি শব্দ ব্যবহার করে গল্পের একটি ক্লু ধরার ইঙ্গিত। তবে ওই যে আগেই বলেছিলাম, এই দুই খসড়া আর ফাইনাল পাঠের সঙ্গে জুড়ে আছে চার নম্বর একটা গল্প। সেটা হল ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’। লক্ষণীয়, এই পাখির বুলি নিয়ে ‘তোতা রহস্য’ লিখছিলেন ১৯৭৩-এ। আর আগেই বলেছি ‘নেপোলিয়নের চিঠি’ লিখলেন তার আট বছর পর। কিন্তু ১৯৭৩-এ লিখছিলেন এই গল্প আর ১৯৭৪-এর ৩ নভেম্বর তারিখে প্রদোষচন্দ্র মিত্রকে চিঠি লিখলেন কালীকিঙ্কর মজুমদার। গল্পের নাম ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’। সেই গল্পেও তো ছিল ওই পাখির বুলি। সেই গল্পেও ছিল ‘ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন একটু জিরো’-র ধাঁধা। আর কী অদ্ভুত! ওই প্রথম খসড়া-পাঠে ফেলুদার খুদে ভক্ত ফেলুদাকে বলেছিল, তার পোষা পাখি খালি ‘খালি খালি ত্রিনয়ন বলে একজনকে ডাকে।’ বোঝা যাচ্ছে, যার পাখি হারিয়ে যাওয়ার গল্প দিয়ে ওই খসড়া শেষ হচ্ছিল যেখানে, সেখানেই ওই ত্রিনয়ন-এ্রর রহস্য লুকিয়ে থাকবে বলে ভেবেছিলেন লেখক সত্যজিৎ। সে হয়ত আরেকটা গল্প হত। সেটা পাওয়া গেল না। তবে এক গল্প ভেঙে দুটো গল্প হয়ে গেল। একটা তখন লিখলেন ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’ আরেকটা আট বচ্ছর পরে ‘নেপোলিয়নের চিঠি’।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
গল্প-ছবির স্বল্প-ভূগোল