মানিকলমকারি - ৩২
আগের পর্বে
সত্যজিতের কলমকারির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ক্যালিগ্রাফি বা অক্ষরশিল্প। নানা বইয়ের প্রচ্ছদে উঠে এসেছে অক্ষরশিল্পের নানা ধরণ। জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ গ্রন্থের প্রচ্ছদের রঙে উঠে এসেছে সেই ধূসরতা। আবার সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘অর্কেস্ট্রা’-র প্রচ্ছদে তিনটি ভিন্ন চেহারার অক্ষরকেও গেঁথেছেন সুন্দর সামঞ্জস্যে। আবার অক্ষরশিল্পে ব্যবহার করেছেন টাইপরাইটারের চেনা অক্ষরও। সুকুমার রায়ের ‘বর্ণমালাতত্ত্ব ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ তেমনই এক উদাহরণ।
দুটো গল্পের ভেতরে বছর পনেরোর ব্যবধান। প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে লেখা গল্পটা প্রকাশিত হয় ‘সন্দেশ’ পত্রিকার ১৯৭৬ সালে আর অন্য গল্পটি থেকে তৈরি হল একটি ছবি ১৯৯১ সালে। দুটো গল্প দুই ভিন্ন ভঙ্গিতে আর ভিন্ন প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও দুটো গল্পের ভেতরের গঠনে যেন এক অদ্ভুত আশ্চর্য মিল। শঙ্কুর গল্পে অনেকবারই ফিরে ফিরে এসেছে সম্মোহনের কথা। এই সম্মোহনের গল্প দিয়েই লেখা হয়েছিল ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও চি চিং’-এর গল্প আবার সেই সম্মোহনের কাহিনি দিয়েই তৈরি হল এই সিরিজের গল্প ‘হিপনোজেন’। এবার নিশ্চয়ই আর মানিকলমকারির পাঠককে বলতে হবে না, গুপিবাঘার কোন গল্পের কথা বলতে চলেছি আমরা? ছবির নাম ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’। গুপিবাঘার সমস্ত গল্পে একটা সম্মোহনের সাধারণ ব্যাপার কিন্তু আছেই আছে। কারণ, গুপির গান আর বাঘার বাজনাতেই তো সম্মোহিত হয় তাদের শ্রোতারা। সেখানে তাদের সেই সম্মোহন করার ক্ষমতালাভ থেকে হাল্লার রাজাকে সম্মোহন করা আর হাল্লার মন্ত্রী আর সেনাপতিসহ পুরো একটা সেনাবাহিনীকে সম্মোহন করার গল্পই তো সেটা। এ্রর পরে হীরক রাজার দেশেও এই সম্মোহনের গল্পটা চলতে থাকে। সেখানে তাদের গানের জাদুতে সম্মোহিত হয় হীরক রাজার কোশাগারের বাঘ। কী আশ্চর্য ব্যাপার না? গুগাবাবা-র প্রথম ছবিতে সেই জঙ্গলে বাঘ দেখে থমকে থ হয়েছিল গুপিবাঘা আর পরের ছবিতে তাদের গান শুনে থমকে রইল বাঘমামা। যাই হোক, মোট কথা, গুপিবাঘার গল্পের সঙ্গে সম্মোহনের দারুণ যোগ।
এর সঙ্গে গুপিবাঘার তিন নম্বর ছবিতে যুক্ত হল আরো কয়েকটা বিষয়। প্রথমত, গুপিবাঘার চেয়েও শক্তিমান এক লোকের আবির্ভাব। দ্বিতীয়ত, বয়স কমানো আর দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও এই গল্পের একটা প্রধান উপাদান। আর এই দুটি কাহিনিগত উপকরণই অন্যভাবে লুকিয়ে ছিল প্রোফেসর শঙ্কুর ওই ‘হিপনোজেন’ গল্পটাতে। সেখানে গুপিবাঘাকে আমন্ত্রণ জানালেন আনন্দপুরের রাজা আর সেই রাজার রাজ্যেই লুকিয়ে আছেন আচার্য ব্রহ্মানন্দ। আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত সহজ একজন ভালোমানুষ এই আচার্য ব্রহ্মানন্দই এক সময়ে বহু যোগচর্চা করেও কিছুতেই তাঁর রত্নমাণিক্যের জন্য লালসা ত্যাগ করতে পারেননি। এখানেও নরওয়ের সেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ক্রাগ বহু বিজ্ঞানচর্চা করেও কিছুতেই ত্যাগ করতে পারেননি তাঁর দুর্মূল্য সব জিনিসের প্রতি লোভ। গল্পে তাঁর অনুগত এবং তাঁর নিজের হাতে তৈরি দুটি রোবট তাঁর অনুগত গুপ্তচর আর সর্বক্ষণের সঙ্গী। নাম তাদের ওডিন আর তর। গুপিবাঘার গল্পেও ছিল ব্রহ্মানন্দের দুই বিশ্বস্ত অনুচর। এহো বাহ্য। এই গল্পে ক্রাগ বলে, তার প্রিয় শিক্ষক, যিনি প্রায় তাঁকে নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন সেই প্রোফেসর রাসমুসেনেরও তিনিই ছিলেন প্রিয়পাত্র। গুগাবাবা-র ছবিতে এক পিশাচসিদ্ধের কথা বারেবারে বলে ব্রহ্মানন্দ, যাকে তিনি গুরু বলে মানেন। পিশাচসিদ্ধ চেয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য যেন সিদ্ধিলাভ করে। যদিও মণিমাণিক্যের তার অত্যধিক প্রতি আগ্রহ আর লোভ দেখে পিশাচসিদ্ধ তাকে সিদ্ধিলাভ করাতে পারেননি। অন্যদিকে এই বিজ্ঞানী ক্রাগও যেন ওই ব্রহ্মানন্দ আচার্যের ভাষায় বলে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। প্রোফেসর রাসমুসেনের প্রিয় ছাত্র। বলতেন, তুমি অধ্যাপনা করবে, গবেষণা করবে, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তোমার। কিন্তু আমার চরিত্রের আরেকটা দিক ছিল। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা।’ সে হিরের নেশায় জমিয়ে যেতে থাকে হিরে। হিরে থেকেই সে হয়ে ওঠে ক্রোড়পতি।
এই হিরের সঙ্গে তার আরেক প্রবল আকাঙ্ক্ষার জিনিস হল, বেঁচে থাকার প্রচণ্ড বাসনা। মৃত্যুর পরেও সে নিজেকে যাতে বাঁচিয়ে রাখা যায় কীভাবে, তার পরিকল্পনাতেই সে ব্যস্ত। সেই উদ্দেশ্যেই সে তার কাছে ডেকে নিয়ে আসে তিনজন বিজ্ঞানীকে। একজন শঙ্কু, দ্বিতীজন সমারভিল আর তৃতীয়জন পাপাডোপুলস। ছবির গল্পে অন্য দেশের রত্নমাণিক্য অপহরণ করে নিয়ে আসার জন্যই ব্রহ্মানন্দ কাজে লাগায় গুগাবাবাকে। আর কী আশ্চর্য! দুই গল্পেই, একদিকে শঙ্কুদের সম্মোহন করার ব্যবস্থা করে ক্রাগ আর অন্যদিকে গুগাবাবাকে সম্মোহন করার বন্দোবস্ত করে ব্রহ্মানন্দ। কিন্তু তাদের কেন এই কাজ? দুইজনেরই লক্ষ্য তাদের লোভ। ব্রহ্মানন্দের লোভ তিনটে দেশের তিনটে দামি রত্ন নিজের করায়ত্ত করা আর ক্রাগের উদ্দেশ্য হল, ‘সারা পৃথিবীর একছত্র অধিপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। সারা বিশ্বের লোক থাকবে তার পায়ের তলায়, জগতের যেখানে যত মিউজিয়ম, যত লাইব্রেরি, যত সংগ্রহশালা, যত আর্ট গ্যালারি আছে, তার সমস্ত অমূল্য সম্পদ এসে যাবে তার আওতার মধ্যে। এই জিনিসটা সম্ভব হবে ওই হিপনোজেনের সাহায্যে।’ লক্ষণীয়, ক্রাগের সমস্ত বিশ্বে নিজের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য সমস্ত দুর্মূল্য আর অমূল্য শিল্পসম্ভার নিজের করায়ত্ত করা আর সেটাই ব্রহ্মানন্দে হয়েছে বিশ্বের সেরা তিনটি অমূল্য রত্ন সংগ্রহ।
আরও পড়ুন
কলমকারিতে শব্দ শোনা
যারা হিপনোজেন গল্পটা পড়েছেন, তাঁদের কি মনে আছে ওই ক্রাগের চেহারাটা? নরওয়েতে তার সুবিশাল ক্যাসেলে পৌঁছে দেখা গেল তার চেহারা। ক্রাগ শীর্ণদেহ, রোগক্লিষ্ট তার হাত দুটি শীর্ণ আর দৃষ্টিটি তীক্ষ্ণ। মৃত্যুর পরে শঙ্কুদের ব্যবহার করে সে যখন নজের প্রাণ পেল, তখন দেখা গেল, তার আসল চেহারা। গল্পের সঙ্গে সেই মুহূর্তের ছবিটিও এঁকেছিলেন সত্যজিৎ। সেই ছবিটি দেখলে কারো আর বুঝতে বাকি থাকবে না, এই চেহারাটাই পরে পরিবর্তিত হল অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত ব্রহ্মানন্দ চরিত্রে। দুজনেরই শীর্ণ চেহারা, লম্বা হাত তবে উজ্জ্বল চোখ, মাথায় অল্প চুল সামনের দিকে, পিছনে লম্বা চুলের ঢেউ নেমেছে।
আরও পড়ুন
গল্প-ছবির স্বল্প-ভূগোল
সত্যজিৎ রায় সারা জীবন একটিও শঙ্কু কাহিনির চিত্ররূপ দিয়ে যেতে পারেননি। এই আক্ষেপ বোধ হয় বাঙালির সাংস্কৃতিক না-পাওয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো এক-একটা দীর্ঘশ্বাসের অন্যতম। কিন্তু যখন তিনি গুপিবাঘার জন্য তিন নম্বর গল্প হিসেবে ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’-র কাহিনিটি ভাবলেন, তখন কী অসামান্য উপায়ে নিজের সেই অসম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষার একটা প্রকাশপথ তৈরি করলেন, তাই না? অবশ্য এমনও কেউ বলতে পারেন, এই সমাপতন নেহাতই কাকতালীয়। আমরা তাদের সঙ্গেও বিরোধে যাবো না। তাহলে বলব, এই সমাপতন আমাদের সামনে যেন উন্মোচন করল শিল্পী সত্যজিতের গভীরে লুকিয়ে থাকা সম্মোহন বিষয়ক গল্প রচনার একটা নিগূঢ় আর্কিটাইপকে। সেটাও কম পাওয়া নয়। তবে যদি কেউ এই লেখা থেকে মনে করেন, সত্যজিৎ নিজের লেখাকে দুবার ব্যবহার করেছেন, তাহলে আমরা তীব্র ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দেবো। কারণ, দুটো গল্প মূল উপাদানকে ব্যবহার করে কীভাবে দুটো সম্পূ্র্ণ স্বতন্ত্র স্বাদের দুটো কাহিনি হয়ে উঠতে পারে, তার একটা চমৎকার কর্মশালা। সেই সন্ধানটাই বেশি জরুরি। একই উপাদান থেকে তৈরি হল কল্পবিজ্ঞানের গল্প আর রূপকথার কথাসূত্র। সভ্যতায় কথাসাহিত্যের ইতিহাসে রূপকথার গল্প আগে, পরে আসে কল্পবিজ্ঞান আর এখানে ঘটে গেল ঠিক তার উল্টো পথ!
কৃতজ্ঞতা: শ্রীমান অর্হণ দাশমুন্সী
আরও পড়ুন
অল্প রেখার গল্প
Powered by Froala Editor