মানিকলমকারি -২৭
আগের পর্বে
সন্দেশ পত্রিকায় প্রথমদিকে কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখতেই শুরু করেছিলেন তিনি। তখনই তিন কিস্তিতে প্রকাশ পায় প্রফেসর শঙ্কুর প্রথম কাহিনি। এরপর ১৬ মাস আর শঙ্কুর গল্প লেখেননি সত্যজিৎ। তাঁর গল্প ঘোরাফেরা করেছে আরও নানা বিষয়ে। ‘প্রফেসর শঙ্কু ও ইজিপ্সীয় আতঙ্ক’ গল্পে আবারও বিজ্ঞানের ছোঁয়া পেলেন পাঠক। কিন্তু সত্যিই কি শঙ্কু চরিত্রের ভিতর দিয়ে কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ? অন্তত প্রথমদিকের লেখায় দেখা যাবে নানা ধরণের ‘অবৈজ্ঞানিক’ বিষয়ের দিকেই শঙ্কুর আগ্রহ। মিশরের মমিকে নিয়ে অভিশাপের প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, তেমনই এসেছে ভারতীয় তন্ত্র বা চিনের সম্মোহনবিদ্যার গল্পও। এমনকি ভূতেও আস্থা রাখতেন শঙ্কু।
সত্যজিতের গল্পের নায়ক ভাবনার মধ্যেই একটা না-হিরোর কাহিনি থাকে। ফেলুদা, শঙ্কুর মতো চিরকালীন নায়কদের কথা মনে রেখেই বলা চলে, সত্যজিতের গল্প সেই অর্থে তথাকথিত হিরোদের জগৎ নয়। নিতান্তই সাধারণ আর আটপৌরে মানুষের নায়ক হয়ে ওঠার গল্পটাই হল সত্যজিতের নায়ক ভাবনা।
সেই বঙ্কুবাবুর বন্ধু গল্পের বঙ্কুবাবুর কথা থেকেই শুরু করা যাক, কিংবা আরো আগে, তাঁর লেখা 'অ্যাবস্ট্রাকশন' বা 'শেডস অফ গ্রে' গল্পের কথাই ধরা যাক, সর্বত্রই কিন্তু নিতান্ত ছা-পোষা মানুষের গল্প। প্রথমদিকে লেখা দুটি ইংরাজি গল্পেই আছে দুজন চিত্রশিল্পীর কথা। একজন শিল্পীর কাছে নিজের ছবি আঁকা আর নিজের ছবি নিয়ে তার বিশ্বাসের গল্প একটি, অন্যটি হল একজন শিল্পীর চোখে ক্রমশ সমস্ত পৃথিবীর রং ধীরে ধীরে মুছে যাওয়ার কাহিনি।
বঙ্কুবাবুর বন্ধু-র বঙ্কুবাবুর প্রথম পরিচয়টাই এই রকম: "বঙ্কুবাবুকে কেউ কোনোদিন রাখতে দেখেনি। সত্যি বলতে কী, তিনি রাখলে যে কী রকম ব্যাপারটা হবে, কী যে বলবেন, বা করবেন তিনি সেটা আন্দাজ করা ভারী শক্ত। অথচ রাগবার যে কারণ ঘটে না, তা মোটেই নয়।" যে প্রাইমারি স্কুলে তিনি পড়ান, সেখানকার ছেলেরা তাঁকে বিরক্ত করে, তাঁর বন্ধুবান্ধবের কাছেও তিনি ঠাট্টার পাত্র। একেবারে ছেলেছোকরাদের মতো তাঁকে উত্যক্ত করাটা তাঁর আড্ডার সঙ্গীদের নিত্য কর্তব্য। এই বঙ্কুবাবুর ভেতরে নিজের শক্তিকে ফিরে দেখতে পাওয়ার গল্পটা ই তো ওই গল্পের বিষয়। একেবারে নিরীহ মানুষ বঙ্কুবাবুর একটা আলাদা আগ্রহের জগৎ আছে। তিনি এক নিতান্ত গণ্ডগ্রামে শিক্ষকতা করলেও, দেশ বিদেশের নানা অজানা জগৎ নিয়ে তাঁর কৌতূহল, হারিয়ে যাওয়া দেশের কাহিনি থেকে আশ্চর্য সব প্রাণীর গল্প নিজেও পড়েন আর দু চারজন উৎসাহী ছাত্রকেও বাড়িতে ডেকে এনে শোনান।
এইধরনের একেবারেই অনুল্লেখনীয় চরিত্র তো বদনবাবু আর পটলবাবুও। বদনবাবু এক সময় "অফিসের পর কার্জন পার্কে" আসতেন, "ঘণ্টা খানেক চুপচাপ বসে বিশ্রাম করে তারপর ট্রামের ভিড়টা একটু কমলে সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় শিব ঠাকুর লেনে বাড়ি ফিরতেন"। পরে কার্জন পার্কের ভেতরে ট্রাম লাইন ঢুকে যাওয়ার জন্য সেখানকার নির্জনতা উধাও বলে,এই অভ্যাস ছেড়েছেন বদনবাবু। শহরের তথাকথিত অগ্রগতি এমন একাকী মানুষগুলির নিভৃতি কেড়ে নেয় আর এই রকম মানুষ আরেকটা আস্তানা খুঁজে নেয়। এহেন বদনবাবুকে যে আগন্তুক গল্প শোনায় এক প্রাগৈতিহাসিক সময়কালের কিংবা যে লোকটি তাকে বুজরুকি দিয়ে ঠকায়, সেও এক নিরীহ গোবেচারা মানুষ। তার দিকে তাকিয়ে বদনবাবুর মনে হয়, "একটি লিকলিকে রোগা লোক, বছর পঞ্চাশেক বয়স, পরনে খয়েরি কোন প্যান্ট, কাঁধে চটের থলি।" এই চেহারাটিও চোখে পড়ার মতো নয়। এমন সাধারণস্য সাধারণ দুটি মানুষের আবার আগ্রহের জগৎ বেশ অন্য রকম। আর তা না হলে, ওই আগন্তুক মানুষটি কী করে বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে বলে চলেন প্রাগৈতিহাসিক গল্পগাছা। শুধু পুরাতনী কথা জানেন, তাই নয়, এক অসাধারণ চলনে সে গল্প বলতেও পারেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, বদনবাবু আর ওই আগন্তুকের ভাবনার জগৎ। আগন্তুক বলে, তাঁর হাতের যে যন্ত্র দিয়ে প্রচুর সময় এগিয়ে বা পিছিয়ে যেতে পারেন, সেই যন্ত্র বানাবার তরিকার নাকি তিনি শিখেছেন এক যোগী পুরুষ গণিতানন্দর কাছে। ব্যস। সেখান থেকেই ভারতীয় বিজ্ঞান কত উন্নত আর তার সাধকরা কত নীরবে কাজ করে চলতেন, তার ফিরিস্তি আর সেই সবের গুণগান। সে তো বলেই বসে, "অজন্তার গুহার ছবি কে বা কারা এঁকেছেন, তাঁদের নাম কেউ জানে? হাজার বছরের পুরোনো পাহাড়ের গা থেকে খোদা এলোরার মন্দির খে গড়ল, তার নাম জানে কেউ? ভৈরবী রাগ কার সৃষ্টি?" এই হল তাল ভাবনার জগৎ। আর ছাপোষা বদনবাবুকে চমকে দিয়ে সেই আগন্তুক বলে, এরপর তিনি খুব বেশি দূরের সময়ে যেতে চায় না। এবার যেতে চায়, কলকাতার প্রতিষ্ঠার চালু গল্পে। কারণ চার্নক সাহেব এলো আর কলকাতা প্রতিষ্ঠিত হল, এই কাহিনি তিনি মানেন না। ভাবেন, "চার্নক বাবাজিকে নিয়ে বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করেছে এরা।"
আরও পড়ুন
শঙ্কুর গল্প শুরুতে কি কল্পবিজ্ঞানের?
পটলবাবু ফিল্মস্টার গল্পের পটলবাবুর চারিত্র্যটিও এমনটাই। চেহারাটি তার কেমন? যে চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তাকে বেছে নেওয়া হল, তার ধরন থেকে পটলবাবুর চেহারাটি বোঝা যায়। বছর পঞ্চাশ বয়স, বেঁটেখাটো, মাথায় টাক। পটলবাবুর বাড়ি নেপাল ভটচাজ লেন-এ। বাজার করেন গিন্নির নির্দেশ মেনে। আগে থাকতেন কাঁচরাপাড়াতে, পরে এলেন কলকাতাতে একটু বেশি মাইনের চাকরি পেয়ে। সেই চাকরিটি খুইয়েছেন তিনি তেতাল্লিশে। তারপর, "সেই থেকে আজ অবধি বাকি জীবনটা রোজগারের ধান্দায় কেটে গেছে পটলবাবুর।" কখনো মণিহারি দোকান দিয়েছেন, চলেনি। বাঙালি আপিসে কেরানির কাজ করে সাহেবের চোখ রাঙানি সহ্য করতে না পেরে, নিজেই চাকরি ছেড়ে দেন। এই রকম এক লোক পটলবাবু ওরফে শীতলাকান্ত রায়। সারা জীবন "যে-অভাব যে-টানাটানি, সে আর দূর হয়নি কিছুতেই।" এহেন পটলবাবুর ফেলে আসা প্যাশন, নিজের অভিনয়-সত্তার আসল চেহারাটি নিজের কাছে আবার খুঁজে পাওয়ার গল্প এই কাহিনি। এখানেও, একটি অন্য রকম দিক তাঁর ভেতর আছে, সেটি হল, ওই অভিনয় করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। আসলে এটাই সত্যজিতের গল্পের নায়কদের একটি সাধারণ ধরন। একটা নিজস্ব প্যাটার্ন।
এই না-হিরোরাই তাঁর গল্পের নায়ক।
আরও পড়ুন
গল্পের শিল্পীরা
আমাদের এই না-হিরোদের দুনিয়াতেই বঙ্কুবাবুর আগে এসেছিলেন প্রোফেসর শঙ্কু আর পটলবাবুর পরে আসবে প্রদোষচন্দ্র মিত্র বা ফেলুদা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই পাঠক বুঝতে পেরেছেন, এই যুক্তিপটে আমরা বুঝতে চাইব পরের কিস্তিতে কেন ফেলুদা আর শঙ্কু-ও সেই অর্থে তথাকথিত নায়ক-চরিত্র নন।
আরও পড়ুন
চারুলতার সময় কথা
Powered by Froala Editor