মানিকলমকারি - ২৬
আগের পর্বে
১৯৬১ সালে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নতুন করে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার কাজ শুরু করেন সত্যজিৎ রায়। আশ্বিন থেকে বৈশাখ পর্যন্ত ৮টি সংখ্যার মধ্যে ৬টিতে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। এগুলি প্রতিটিই কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি। প্রফেশর শঙ্কুর আত্মপ্রকাশ ছাড়াও আমরা পেয়েছি ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’, ‘টেরোড্যাকটিলের ডিম’ এবং ‘সেপ্টোপাসের খিদে’। ভিনগ্রহীদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কাহিনি যেমন আছে, তেমনই আছে এই পৃথিবীর প্রাচীনতার সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধন। আবার আপাত নিরীহ গাছেরাও যে মানুষের শত্রু হয়ে উঠতে পারে, তেমন কাহিনি পাচ্ছি শেষ গল্পে। প্রতিটি গল্পেই মুখ্য চরিত্র অত্যন্ত সাদাসিধে। প্রথমদিকে বিজ্ঞানের গল্পই লিখতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ। পরে তাঁর কলম অন্য নানা বাঁক ধরে এগিয়ে চলেছে।
কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলে প্রফেসর শঙ্কুর গল্পমালার একটা বেশ মোক্ষম পরিচয় আছে। তবে ধারাবাহিক ভাবে এই সিরিজের গল্পগুলি যদি পরা যায়, তাহলে এই গল্পমালা সম্পর্কে ইতিউতি অন্য কিছু কথাও মনে হতে পারে শঙ্কু-প্রেমী পাঠকদের। আমি প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর একনিষ্ঠ পাঠক রূপে, তেমন কিছু কথা বলার আয়োজন করেছি আজকের মানিকলমকারির এই কিস্তিতে। অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল, ঘনাদার স্রষ্টা প্রেমেন্দ্র মিত্র আর শঙ্কুর স্রষ্টা সত্যজিৎ দুজনেই দুই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দুটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁরা প্রথমে এই দুটো চরিত্রকে নিয়েই আরো আরো গল্প যে লিখবেন, এটা আদৌ ভাবেননি। কথাটা ঠিকই। দেখা যাচ্ছে, যে বছর ঘনাদার আত্মপ্রকাশ, তার পরের বছর কিন্তু ঘনাদা আর প্রকাশিত হয়নি। ঠিক সেই ভাবেই যে বছর তিন কিস্তিতে 'সন্দেশ'-এ শঙ্কুর প্রথম গল্প 'ব্যোমযাত্রীর ডায়রি' প্রকাশিত তার পর পুরো ষোলো মাস পরে শঙ্কুর দ্বিতীয় গল্প 'প্রোফেসর শঙ্কু ও ঈজিপ্সীয় আতঙ্ক' বের হয়। আর এর মাঝখানেই সত্যজিৎ লিখেছেন অন্যান্য ছোটগল্প। আগের কিস্তিতে আলোচিত সত্যজিতের বিজ্ঞানভিত্তিক ছোটগল্পগুলি এই সময় পর্বেই লেখা। লক্ষণীয়, ১৩৬৮-র আশ্বিন থেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত ব্যোমযাত্রীর ডায়রি প্রকাশের পরে পৌষ বাদ দিয়ে মাঘ মাসেই লিখলেন 'বঙ্কুবাবুর বন্ধু' আর তার পরের মাসেই লিখলেন 'টেরোড্যাকটিলের ডিম' আর এর দু মাস পরে 'সেপ্টোপাসের খিদে'। এই বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লেখার পালা থেকে সত্যজিৎ এবার সরলেন তাঁর মানুষের জীবনের অদ্ভুত আর আশ্চর্য অভিজ্ঞতার গল্প বলাতে। সেই পর্বের পরে আবার যখন তিনি ফিরলেন শঙ্কু কাহিনিতে, তখন আমাদের আপাতত মনে হল, ফিরে এলো শঙ্কুর গল্পমালার সূত্রে সেই বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প। এই লেখার অঙ্কটি বা তার গাণিতিক ধরনটি বেশ কৌতূহলপ্রদ হলেও, শঙ্কু-কাহিনি কি আসলে বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প-ই ছিল? নাকি শঙ্কুর যথাযথ বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প আরো পরে শুরু হল?
একটু মন দিয়ে দেখলে মনে না-হয়ে যাবে না যে, শঙ্কু সিরিজের এই পর্বে বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প বলতে যা বোঝায়, তা কিন্তু অনুপস্থিত। বরং সত্যজিতের প্রথম পর্বের লেখাতে যে ধরনের আশ্চর্য বিষয়গুলি আনাগোনা করছিল, শঙ্কুর কাহিনি তারই রকমফের।
প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন বিস্ময়কর উপাদান, যার সমাধান আধুনিক বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে সমাধান করা যায়নি, সেই বিষয়গুলি যেন ফিরে এলো শঙ্কু সিরিজের প্রথমিক গল্পমালাতে। যেমন ধরা যাক ঈজিপ্সীয় আতঙ্কে এলো প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার মমি বানাবার প্রকৌশল আর তা সংক্রান্ত অভিশাপের কাহিনি। আবার তার পরের গল্প 'প্রোফেসর শঙ্কু ও হাড়'-এ এলো প্রাচীন ভারতীয় তন্ত্রমন্ত্রবলে মৃত প্রাণীর হাড় থেকে আবার সেই প্রাণীটির পুনরুজ্জীবন লাভের কাহিনি। এর কিছু পরে লেখা 'প্রোফেসর শঙ্কু ও চী চীং' গল্পের বিষয় হল প্রাচীন চৈনিক সভ্যতার জাদুবিদ্যার জোর।
আরও পড়ুন
তিনি কি চেয়েছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লিখতেই?
সেই জাদুবিদ্যার এতটাই জোর যে স্বয়ং চী চীং নামের চিনা জাদুকর খোদ শঙ্কুকেও সম্মোহিত বা হিপনোটাইজ্ করে ফেলে। এই ধরনের বহুকাল ধরে প্রচলিত ভোজবাজি, জাদুবিদ্যা আর নানা অলৌকিক ঘটনা পরম্পরার কাহিনি এই প্রথম পর্বের শঙ্কুর গল্প। এমন কি, এই সময়ের একটি গল্পে তো শঙ্কুর ডায়েরিতে তাকে দিয়ে সত্যজিৎ এই কথাও লিখিয়ে নেন, "ভূতপ্রেত প্ল্যানচেট, টেলিপ্যাথি, ক্লেয়ারভয়েন্স--- এই সবই যে একদিন না একদিন বিজ্ঞানের আওতায় এসে পড়বে, এ বিশ্বাস আমার অনেক দিন থেকেই আছে। বহুকাল ধরে বহু বিশ্বস্ত লোকের ব্যক্তিগত ভৌতিক অভিজ্ঞতার কাহিনি সেই সব লোকের মুখ থেকেই শুনে এসেছি। ভূত জিনিসটাকে তাই কোনোদিন হেসে উড়িয়ে দিতে পারিনি।"
এই ভূত দেখার ইচ্ছের সঙ্গে শঙ্কুর যন্ত্র-আবিষ্কারের বৃত্তান্ত গেল জুড়ে, তৈরি হল শঙ্কুর নিও স্পেক্ট্রোস্কোপ। আজব বিষয় হল এই শব্দের সঙ্গে বিজ্ঞানের স্পেক্ট্রাম- শব্দের যোগ নেই, এর
আরও পড়ুন
গল্পের শিল্পীরা
সঙ্গে যোগ এখনো পর্যন্ত অ-বিজ্ঞানসম্মত স্পেক্টার শব্দের। এই পর্বেই আবার এমন কাহিনিও আছে, যেখানে, শঙ্কু প্রথমে অলৌকিকে অবিশ্বাস করেও ক্রমশ সে বিশ্বাস-বাসতে থাকে এই অলৌকিক।
আরও পড়ুন
চারুলতার সময় কথা
শঙ্কু প্রথমে তাঁর প্রতিবেশী অবিনাশবাবুর মুখে-শোনা সাধুসন্ন্যাসীদের কথাতে বলে, "যত সব বুজরুকি!" তারপর জানায়, সাধু সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে আমার ভক্তির একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। এদের মধ্যে বুজরুকের সংখ্যাই যে বেশি, তার প্রমাণ আমি বহুবার পেয়েছি।" কিন্তু সেখান থেকে এক সাধুর সঞ্জীবনী মন্ত্রের আশ্চর্য অলৌকিক ক্ষমতা দেখে ওই শঙ্কুর মুখেই শুনলাম আমরা: "আমি বৈজ্ঞানিক। [কিন্তু] এরপর চোখের সামনে যা ঘটল তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি না আমি জানি না। হয়তো আছে। হয়তো আমাদের বিজ্ঞান এখনো এসবের কুল কিনারা করতে পারেনি। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে হয়তো পারবে।" আসলে এটাই ছিল শঙ্কুর কাহিনির অভিমুখ। এই অলৌকিকের সঙ্গে এক বিজ্ঞানীর অদ্ভুত সম্পর্কের গল্প, সহস্রাব্দ প্রাচীন সভ্যতার নানা আজুবা-কে আজকের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার কাহিনি ছিল শঙ্কু কাহিনির মূল বিষয়। সেই আশ্চর্য ছিল বলেই বাগদাদের এক তাঁবুতে গিয়ে ফেলে আসা সভ্যতার ফেলে আসা সময়ের চলমান ছবি দেখতে পান শঙ্কু। এক-ই সঙ্গে প্রাচীন সভ্যতার 'লাইভ টেলিকাস্ট'-এর কাহিনি যেন এটি। ওই অলৌকিকতা-মেশানো এক আবহেই এক নতুন ধরনের গল্পমালা তৈরি হচ্ছিল প্রোফেসর শঙ্কুর কাহিনিতে। পরে তা একটি সময় থেকে হয়ে উঠল কল্প- বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পের উপাদান। সেই বাঁক বদলের গল্পের কথায় আমরা পৌঁছব এর পরের কিস্তিতে। প্রথম শঙ্কু-কাহিনিতে যে কল্প বিজ্ঞানের উপাদান ছিল, তা থেকে সূচনা পর্বে যে সরে গিয়ে আবার সেই কল্পবিজ্ঞানের গল্পে প্রবেশ করল শঙ্কুর গল্প, সেটা ভুলে গেলে আমাদের ঠিকঠাক করে শঙ্কু পড়া হবে কী করে? পুরাতনী বিদ্যাবুদ্ধির কথা বা এই সূচনা পর্বের উপাদানগুলি পরে সত্যজিতের আরো নানা কাহিনিতে ফিরে ফিরে আসবে। যেমন সোনার কেল্লার গল্পে আসবে নকল হাজরার সম্মোহন বিদ্যাতে, সেইভাবেই গুগাবাবা সিরিজের তিন নম্বর ছবি 'গুপি বাঘা ফিরে এলো'-র ব্রহ্মানন্দ আচার্যের সম্মোহন বিদ্যাতে। সব জায়গাতেই তা 'দুষ্টু লোক'-এর অস্ত্র। কিন্তু গল্পের যুক্তিতে এই জগৎ সম্পর্কে সত্যজিতের লিবারল মন-টাই যেন লুকিয়ে থাকে তাঁর কাহিনি-উপাদানে। শঙ্কু অলৌকিক সম্পর্কে লিখেছিল, "এই সবই যে একদিন না একদিন বিজ্ঞানের আওতায় এসে পড়বে, এ বিশ্বাস আমার অনেক দিন থেকেই আছে।" আচ্ছা, তাহলে শঙ্কু-র লেখা ওই লাইনগুলি কি কোনোভাবে তার স্রষ্টারও মনের কথা?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
চারুলতার খেরোর খাতা-৩