চারুলতার সময় কথা

মানিকলমকারি – ২৩

আগের পর্বে

চারুলতার দ্বিতীয় খেরোর খাতায় সিনেমার দৃশ্যায়নের কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। তবে তার সঙ্গে অন্তিম পরিণতির পার্থক্য অনেক। এখানে সমগ্র গল্পটিকে সময়ের হিসাবে ভাগ করেছেন সত্যজিৎ। প্রথম পাতায় যদিও কোনো কালের উল্লেখ নেই। তবে বোঝা যায় এখানে গ্রীষ্মকালের কথাই বলা হচ্ছে। এরপর আসে বর্ষাকাল। তারপর শরৎ এবং শেষে বসন্ত। অমল এবং চারুলতার দীর্ঘ কথোপকথনের দৃশ্যটি বাগানে নয়, প্রথমে বর্ষার ছাদে করার কথা ভেবেছিলেন চিত্রনাট্যকার। এখানে যদিও স্বাভাবিক আভিজাত্যের মধ্যে বেশকিছু অসংগতি চোখে পড়ে। সেগুলো পরে সংশোধন করেছিলেন তিনি। সম্ভবত খসড়ার সঙ্গে লেখা বেশ কিছু প্রশ্ন ও ভাবনার সূত্র ধরেই ক্রমশ রূপ পেতে থাকে ‘চারুলতা’-র চিত্রনাট্য।


রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় উপন্যাস নাকি ছোটোগল্প? ১৯০১ সালে ভারতী পত্রিকার পাতায় প্রকাশের সময় লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ধারাবাহিক উপন্যাস হিসেবে। এরপর রবীন্দ্র-গ্রন্থাবলী নামে রবীন্দ্রনাথের যে রচনা সংকলন বেরোয়, সেখানেও এই লেখাটি ছিল উপন্যাস বিভাগে। তবু, হয়তো সবচেয়ে বেশি আত্মজীবনীর উপকরণ ছিল বলেই, স্বল্প সংখ্যক উপন্যাসের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক ছোটগল্পের ভিড়ে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ প্রচ্ছন্ন করলেন নষ্টনীড় কাহিনিটি। অনেক সহজ ছিল নিঃসন্দেহে ভূপতি, চারু আর অমলের মধ্যে কবির নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কবির নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবী আর রবীন্দ্রনাথের আন্তঃসম্পর্কের গল্পটাকে চিনে নেওয়া। কাজের জগতে ব্যস্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে মিলে যায় নিজের কাগজ দি সেন্টিনেল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া ভূপতি। কাজের জগতে ব্যস্ততার কারণে স্ত্রী কাদম্বরীর প্রতি নতুন দাদার ঔদাসীন্য আর ভূপতির চারুর প্রতি উদাসীনতা, জীবনে কাদম্বরীর আর কাহিনিতে চারুলতার একাকিত্বকে সহমর্মী করে তোলে। ব্যক্তি জীবনে নতুন বউঠান কাদম্বরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সুন্দর হৃদয়-সম্পর্ক কথাসাহিত্যে রূপান্তরিত হয় চারু- অমলের সম্পর্কের কাহিনিতে। কিশোর এবং তরুণ রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর চেয়ে দুই বছরের বড়ো কাদম্বরীর জীবনেও ছিল এক অবিস্মরণীয় বাগান, চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়ি, সেই বাগানবাড়িতে এক সময়ে ছিলেন জ্যোতিদাদা, নতুন বউঠান আর কিশোর রবীন্দ্রনাথ। সেই অভিজ্ঞতা রূপান্তরিত হয়েছে নষ্টনীড়ের বাগান পর্বে আর তাই অবশ্যই তা চারুলতা ছবিরও এক গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। চারুলতা ছবির খসড়া পাণ্ডুলিপিতে সত্যজিৎ এক সময়ে রেখেছিলেন এই বাড়ির তিনতলার ছাদ। রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনীর সাক্ষ্যে ঠাকুরবাড়ির তিনতলার ছাদের ঘরেই ছিল কাদম্বরীর ঘর। তবে সেই ডিটেইলসের সন্ধান এক অন্য বৃত্তান্ত। কিন্তু এর মধ্যেই কৌতূহলপ্রদ বিষয় হল, সত্যজিৎ কীভাবে তাঁর ছবিতে সেই কবির জীবনের কাহিনিকে যুক্ত করেছেন। 

রবীন্দ্রনাথের কাহিনিতে গল্পটির পটভূমি নির্দিষ্ট করা ছিল না অথচ সত্যজিৎ তাঁর ছবিতে সেই সময়টি নির্দিষ্ট করেছেন ১৮৭৯ সালে। আগের পর্বে এই সময়টি নিয়েই কথা বলার কথা ছিল আর সেই সূত্রে এই কথা বলার আরম্ভ। রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে চারুলতা ছবির চিত্রনাট্য প্রস্তুতিতে এই ছবির সময়কাল সত্যজিৎ ১৮৭৯ কীভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন। দেখি, ছবিটিতে অমল একটি নির্দিষ্ট দিনে আসে ভূপতির বাড়িতে। সেই দিনটি হল, ১৮৭৯ সালের এপ্রিল মাসের আট তারিখ। কারণ, অমল আসার পর ভূপতি তাকে তার কাগজের পরের দিনের যে সংখ্যাটির কপি প্রেস থেকে টেনে নিয়ে দেখায়, তার তারিখটি সে নিজেই বলেছে,  ‘24th issue of The Sentinel, dated April the 9th 1879’। ন-তারিখের কাগজ তৈরি হচ্ছে আটে। নির্দিষ্ট এই দিনটিকে মাঝখানে রেখেছেন বলেই, সেই অঙ্ক মেনেই ছবিতে আসে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্টের কথা থেকে ভূপতির সংলাপে "আজ একজন গরিব বিধবাও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে'। আবার বঙ্কিমচন্দ্র লিখিত উপন্যাসের কথা থেকে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের কথা। ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, এই সকল ঘটনাই তখনকার সমকালীন ঘটনা পরম্পরা। 

ঠিক এখানেই একটি কথা, অমল প্রথম ভূপতির বাড়ির ভেতর আসে এক ঝড়ের মতো। তারিখ ছিল আটই এপ্রিল ১৮৭৯। সেই দিনটিতেই তার প্রথম আবির্ভাবে "হরে মুরারে মধুকৈটভারে" উচ্চারণ সকলের স্মৃতিতে অম্লান। আর ঠিক তারপরেই সে চারুলতার কাছে জানতে চায়, "বউঠান, আনন্দ মঠ পড়ছো?" সমস্ত সাবধানতা মেনে চলেও এ এক আশ্চর্য অনভিপ্রেত ভ্রান্তি। কারণ, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা যে উপন্যাস, আনন্দমঠ, তা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদিত পত্রিকা বঙ্গদর্শন-এ প্রকাশিত হতে শুরুই করে ১৮৮১ সালে। যে ছবির পটভূমি রূপে ১৮৭৯ নির্দিষ্ট করা হল, সেখানে তার দুই বছর পরের উপন্যাসের কথা এল কী করে?

আরও পড়ুন
চারুলতার খেরোর খাতা-৩

সময় বিষয়ক দ্বিতীয় কথাটি একেবারেই অন্যরকম। মনে আছে? ভূপতি অমলকে বলে, দিনের পর দিন সরকার যে একের পর এক ট্যাক্স বসাচ্ছে সেটা বড়ো ট্র্যাজেডি নাকি রোমিও ও জুলিয়েটের সাহিত্যগত ট্র্যাজেডি বড়ো ট্র্যাজেডি? গায়ের জোর দরকার বলেই এরপর ভূপতি অমলের একটি ছোট্ট পাঞ্জা লড়ার দৃশ্য। তার আগে, ভূপতি অমলের কাছে জানতে চায় তার বয়স। অমল বলে, তেইশ। ভূপতি তার উত্তরে নিজের বয়সটিও জানিয়ে দেয় ছবির দর্শকদের। তার বয়স পঁয়তিরিশ। রবীন্দ্রনাথের জীবন নিয়ে যাঁরা সামান্য পড়াশোনা করেন, তারা চমকে ওঠে অমলের এই তেইশ বছর বয়স শুনে। কারণ, রবীন্দ্রনাথের লেখাতে বারবার ফিরে এসেছে, তাঁর তেইশ বছরে পাওয়া শোকের কথা। আর সেটি বলা বাহুল্য, কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা। ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী দেবীর আত্মহননের সময়, রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল, তেইশ আর কবির নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ছিল পঁয়তিরিশ। রবীন্দ্রনাথের কাহিনিতে যে ইঙ্গিত ছিল, সত্যজিতের লেখা সংলাপের মধ্যে কি সেই কথাটিই আরো স্পষ্ট করলেন সত্যজিৎ রায়? আচ্ছা, কাদম্বরী দেবীর জীবৎকালের সীমান্তে নষ্টনীড় অবলম্বনে সত্যজিৎ তাঁর তৈরি-ছবির পটভূমি আনতে চেয়েছিলেন বলেই কি চিত্রনাট্য ছবির ঘটনাকাল ১৮৭৯ স্থির করলেন তিনি?

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
চারুলতার খেরোর খাতা-২