চারুলতার খেরোর খাতা

মানিকলমকারি - ২০
আগের পর্বে

দুটি সিনেমাতেই প্রথম দৃশ্যে বাবা-মাকে গাড়ি করে অফিসে চলে যেতে দেখবে ছোট্ট শিশু। তাদের একাকিত্ব নিয়েই তৈরি ‘টু’ এবং ‘পিকুর ডায়রি’। একদিকে হিংসা, ক্রোধ আর অহমিকা গ্রাস করেছে ‘টু’-এর শিশুটির জগত। পিকুর জগত কিন্তু তখনও আপাপবিদ্ধ। কিন্তু সিনেমা শেষের অভিঘাতই হয়তো বদলে দেবে পিকুর জীবন। এভাবেই শিশুদের একাকিত্বের গল্প বলে গিয়েছেন সত্যজিৎ। শাখা-প্রশাখা এবং আগন্তুকেও দেখব শিশুদের জগতে বৈষয়িক চিন্তা এবং সন্দেহের অনুপ্রবেশ। ছোটদের নিয়ে খুব কম গল্পই বলেছেন সত্যজিৎ। কিন্তু তার মধ্যেও ফুটে উঠেছে গভীর মনস্তত্ত্ব।

খেরোর খাতা সাক্ষী। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে, ১৯৬১-তে, সত্যজিৎ রায় হয়ত ‘চারুলতা’ বানাবেন ভেবেছিলেন। কারণ, এক খেরোর খাতার প্রথম পাতায় লেখা তাঁর ছয় নম্বর ছবির নাম হতে পারত ‘নষ্টনীড়’ আর এর চিত্রনাট্য লেখা আর তা নিয়ে ভাবনার শুরু ২১ জানুয়ারি ১৯৫৯ সালে। তখন তিনি ‘অপুর সংসার’ ছবির শুটিংয়ে আছেন মহেশগঞ্জ। সেখানে রওয়ানা হয়েছেন ১৬ জানুয়ারি। এরপর ‘অপুর সংসার’ ছবির শুটিং শেষ হয়েছে, সত্যজিৎ সপরিবার বাড়ি শিফট করেছেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে তাঁরা উঠে এসেছেন লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে। এই বছরেরই পয়লা মে মুক্তি পেল ‘অপুর সংসার’। এই মে মাসেই তাঁর অকস্মাৎ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ায় পরিবারে একটু চিন্তার রেখা দেখা গেছে। আর ঠিক এর মধ্যেই ২২ মে তারিখে সত্যজিৎ লিখতে শুরু করলেন ‘নষ্টনীড়’। চিত্রনাট্যের প্রথম পাতাতেই লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড়’। গুরুদেবের সইয়ের ধাঁচে ‘রবীন্দ্রনাথের’ শব্দটি লেখা। তার নীচে একটু বড়ো হরফে লেখা ‘নষ্টনীড়’। জুন মাসে তিনি গেলেন পুরী আর বিজয়া রায় লিখেছিলেন, এখানে সম্ভবত একটি চিত্রনাট্য লিখছিলেন। তাহলে সেই চিত্রনাট্যটিই কি ছিল ‘চারুলতা’-র প্রথম চিত্রনাট্যের খসড়া?

‘চারুলতা’-র এই খেরোর খাতায় প্রথমেই চমক লাগল এটা দেখে যে, এর কথা সত্যজিৎ ভেবেছিলেন ‘তিন কন্যা’-রও আগে! আর সেই পাতা ওল্টাতে না ওল্টাতেই আবার চমকে ওঠার পালা! দেখা যাচ্ছে, ‘চারুলতা’ নয়, সত্যজিৎ ভেবেছিলেন চারু চরিত্রটির পুরোনাম ‘চারুবালা’। প্রথম পাতাতেই তিনি লিখেছেন, উমাপদ-র পরিচয় ‘চারুবালার ভাই’। এমনকি শুধু নাম-ভাবা নয়, চারুবালা লিখে দৃশ্য-পরিকল্পনা পর্যন্ত করেছিলেন তিনি। যদিও রবীন্দ্রনাথের গল্পে শুধু ‘চারু’ নয়, স্পষ্টই লেখা ছিল ‘ধনীগৃহে চারুলতার কোনো কাজ ছিল না।’

এবারে চমক সত্যজিতের ভাবনায় প্রথম-ভাবা অভিনেতা-অভিনেত্রীর তালিকায়। সত্যজিৎ রায় প্রথম থেকেই অমল চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা ভাবলেও, অন্য চরিত্রগুলিতে একেবারে অন্য অন্য নাম ভেবেছেন। যেমন, ভূপতি চরিত্রে এখন আমরা দেখি শৈলেন মুখোপাধ্যায়কে। সত্যজিৎ প্রথমে ভেবেছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা! মজার ব্যাপার হল, তখন ‘চারুলতা’ হল না বটে কিন্তু তখনই হল ‘তিনকন্যা’ ছবিটি। সেই ‘তিনকন্যা’-র ‘মণিহারা’ গল্পে ফণিভূষণ সাহা চরিত্রে সত্যজিৎ বেছে নিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এখানে আর সত্যজিতের একনিষ্ঠ ভক্তদের বুঝি মনে করাবার দরকার নেই যে, ফণিভূষণের চরিত্রে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় আর ভূপতি-র চরিত্রে শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সাজসজ্জা আর চেহারার আশ্চর্য মিলের কথা! আরো কৌতূহলোদ্দীপক হল উমাপদ চরিত্রের ভাবনা। শ্যামল ঘোষালকে যে চরিত্রটি দিয়েছিলেন সত্যজিৎ, সেই চরিত্রটিতে অনুমানও করা যায় না, কাদের কথা পরিচালক ভেবেছিলেন প্রথমে। স্পষ্টত লেখা, প্রথমে ওই ধরনের একটি নেগেটিভ চরিত্রে প্রথমে সত্যজিৎ ভেবেছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়ের কথা। তারপরে একেবারে অন্য কালিতে বেশ পরে আরেকবার লিখেছিলেন বসন্ত চৌধুরির কথা! রইল বাকি, চারু-চরিত্র। চারু-র চরিত্রে সত্যজিৎ প্রথমে ভেবেছিলেন কি না শর্মিলা ঠাকুর! এখানে একটু সালতামামি লক্ষণীয়!

আরও পড়ুন
দুই বালকের গল্প

১৯৫৯ সালে শর্মিলা ঠাকুর প্রথম অভিনয় করলেন ‘অপুর সংসার’-এ, পয়লা মে ১৯৫৯-এ মুক্তি পেল সেই ছবি আর বাইশে মে সত্যজিৎ তাঁর পরের ছবি ‘নষ্টনীড়’ বা ‘চারুলতা’-র জন্য কিনা ফাইনাল করে ফেললেন শর্মিলা ঠাকুরের কথা। অবশ্য সেই ১৯৬০-এ যখন ‘দেবী’ ছবি বানালেন, সেখানেও রইলেন শর্মিলা ঠাকুর আর অনিল চট্টোপাধ্যায়ও সত্যজিতের ছবির সংসারে এসে গেলেন ওই ‘দেবী’-র সময়েই।

আরও পড়ুন
নিষ্ঠুর গল্পের অভিনব শিল্পরূপ

এখানে বলে নেওয়া ভালো, প্রথমে ‘নষ্টনীড়’-লেখা এই খাতাটি কিন্তু শুধুই নষ্টনীড়-এর খাতা নয়। এখানে ‘দেবী’-র পরিকল্পনা আছে, ‘মহানগর’-এর পরিকল্পনা আছে, আছে সন্দেশ পত্রিকার জন্য বেশ কিছু মজার ক্যালিগ্রাফির খসড়া, আছে ‘অপুর সংসার’-এর সময়ে তৈরি হওয়া সত্যজিৎ রায় প্রোডাকসন্সের জন্য একটি লোগো বানাবার খসড়া, ‘দেবী’, ‘মহানগর’, এমনকি ‘মহানগর’ যে-কাহিনি অবলম্বনে তৈরি সেই ‘অবতরণিকা’ গল্পনামেরও ক্যালিগ্রাফি। সঙ্গে আবার বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত প্রমথ চৌধুরীর ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ বইয়ের প্রচ্ছদের ক্যালিগ্রাফির একটার পর একটা পরিকল্পনা। তবে যেহেতু, এই খাতাতেই মহানগর-এর কথা এসে গেছে, তাই এই খাতার শেষদিকে একটি পাতাতেই দেখা যাচ্ছে চারুলতার চরিত্রে ‘মাধবী মুখার্জী’ নামও এসে গেছে। এমনকি ভূপতি চরিত্রে শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের নামও সেখানে লক্ষণীয়। খেরোর খাতাখানা ‘নষ্টনীড়’-এর জন্য হলেও, এই খাতার একেবারে শেষে রয়েছে সত্যজিতের ভাবনাতে তখন কী কী ছবি করার কথা ঘুরছিল, তারও একটি তালিকা। পরবর্তী সত্যজিৎ গবেষণায় সেই তথ্যটি দরকারি বলে, সেই তালিকাটি উদ্ধার করা যাক এখানে। তিনি লিখেছেন: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দ্রবময়ীর কাশীবাস’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সংসার সীমান্তে’, কমলকুমার মজুমদারের ‘তাহাদের কথা’-র নাম। একটি ভাবনা লিখেছেন এইভাবে, ‘মাস্টারমশাইয়ের পুরোনো ছাত্রের সঙ্গে দেখা হলে’। এরপরে এই বিষয়ক একটা গল্পের খসড়াও করতে শুরু করেছিলেন তিনি। এখানে একটি প্রবন্ধের প্রাথমিক পাঠ পাওয়া যায়। বহুলপঠিত সেই প্রবন্ধটির নাম পরে হবে ‘চলচ্চিত্র-রচনা: আঙ্গিক, ভাষা ও ভঙ্গি’। ‘চলচ্চিত্র’-র বার্ষিকী ১৯৫৯-এ প্রকাশিত এই প্রবন্ধের আপাত সহজ ভাষা তৈরির পিছনে যে সত্যজিতের কত পাঠ আর পাঠান্তর আছে, তা একটি আলাদা ‘মানিকলমকারি’-র বিষয় হতে পারে। আসলে সব মিলিয়ে বলার কথাটা হল, সত্যজিতের অন্যান্য খেরোর খাতা থেকে এই খাতাখানি কলমকারিতে স্বতন্ত্র। অন্য খাতাগুলিতে যেমন একটি বিষয়েরই সদরে অন্দরে গভীর চলাচল, এটা ঠিক সে রকম নয়, এ যেন তাঁর একটি সময়ের বিচিত্র কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত পরিচায়িকা।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনি কলমকারি

তবু এই খাতা ছিল মূলত ‘নষ্টনীড়’-এরই খাতা। এখানে রয়েছে ‘নষ্টনীড়’ গল্পটাকে সিনেমার জন্য কীভাবে সাজাচ্ছিলেন সত্যজিৎ, তার একটা বিরাট পুঙ্খানুপুঙ্খ খতিয়ান। এখানে একটি অংশে আছে, তিনি কীভাবে পাশে রবীন্দ্রনাথের বইটিকে রেখে গল্পটিকে সিনেমার মতো সাজাচ্ছিলেন, তার খসড়া আর তারই সঙ্গে আছে, যে-ছবি আমরা শেষমেশ দেখি কীভাবে সেটি ১০-১১টি সিকোয়েন্সে ভেঙে চিত্রনাট্যের প্রাথমিক চেহারাটি বানাচ্ছিলেন, তারও ঠিক-ঠিকানা। পরিচালক তথা চিত্রনাট্যকারের এই পড়াটিকে আমরা লক্ষ করব পরের কিস্তিতে শুধু ‘চারুলতা’ ছবিটিকে বোঝার জন্যই নয়, পাশাপাশি যখন ছবিমুক্তির পরে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় অরূপ রুদ্র ‘চারুলতা’ নিয়ে তাঁর আপত্তি জানালেন, তার যে-উত্তর সত্যজিৎ দিলেন, তার পশ্চাৎপটটিকে আবিষ্কার করার জন্যেও। ফলে আগামী কিস্তিতে চলবে এই ‘চারুলতার খেরোর খাতা’-পড়াই।     

আরও পড়ুন
কানাই, রতন, গঙ্গারাম আর সুজনের গপপো

শেষে একটি অদ্ভুত ব্যাপার উল্লেখ করে আজকের কিস্তি শেষ করা যাক। ১৯৪৫-৪৬-এ সত্যজিৎ ঘরে-বাইরে থেকে ছবি করবেন ভেবেছিলেন, সেই তথ্যটি আমাদের জানা। কিন্তু আমাদের  ভারী আশ্চর্য করে এই ১৯৫৯-এর খাতাতেই এক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, সত্যজিৎ তাঁর নিজের হাতে ‘ঘরে বাইরে’-র জন্য দুই ধরনের ক্যালিগ্রাফি করেছেন। একটি ক্যালিগ্রাফি রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখার ধরনটিকে মেনে, আরেকটির সঙ্গে ১৯৮৪-তে সত্যজিৎ যখন এই ছবি করলেন, তার ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে বেশ মিল। সেই ‘ঘরে-বাইরে’-র ‘বাইরে’ শব্দের হ্রস্ব-ই-এর ইলেক বা চৈতনটির সঙ্গে আগুনের রূপকল্পকে মেলানো সেই লেখাঙ্কন। তার মানে কি, রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে দ্বিতীয়বার সত্যজিৎ ভেবেছিলেন ‘ঘরে-বাইরে’ করবেন?

Powered by Froala Editor