মানিকলমকারি - ১৯
আগের পর্বে
১৯৭০ সাল। আনন্দবাজার পত্রিকার পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত হল সত্যজিৎ রায়ের ‘পিকুর ডায়েরি’। একটি ছোট্ট ছেলের লেখা ডায়েরির ভেতর দিয়ে ফুটে উঠছে বড়োদের কৃত্রিম জগৎ। ছোট্ট ছোট্ট ঘটনার ভেতর দিয়ে তার প্রকাশ। সেখানে আছে ভয়, মা-বাবার দাম্পত্য সমস্যা, এবং তৎকালীন পরিস্থিতি। ডায়েরি সাহিত্যকে অন্য স্তরে নিয়ে গেলেন সত্যজিৎ। কয়েক বছর পরে এই গল্প থেকেই ২৪ মিনিটের সিনেমা তৈরি করলেন তিনি। ‘পিকুর ডায়েরি’ হয়ে গেল ‘পিকু’। তবে সিনেমার অভিঘাত গল্পের থেকে যেন খানিক কমই রাখলেন সত্যজিৎ।
দুটি গল্পের মধ্যে ব্যবধান ছ-বছরের। দুটি গল্পই একটি বালকের গল্প তবে কিনা আবার দুটি গল্পই সেই অর্থে ছোটোদের ছবি নয়। দুটি গল্পের মধ্যেই ভারী মিল, তার বলায় আর তার উপস্থাপনের গড়নে। তবে দুটি গল্পই আলাদা, দুটি গল্পই বেশ তাৎপর্যপূর্ণভাবে দুটি স্বতন্ত্র কাহিনি। আবার বেশ অদ্ভুত ব্যাপার হল, দুটি গল্প থেকেই সত্যজিৎ দুটি ছোটো ছবি তৈরি করেছিলেন। কীমাশ্চর্যম সমাপতন! দুটি গল্পেরই নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বৈদেশিক দুটি সংস্থার নাম। এতক্ষণ যা যা সূত্র দেওয়া হল, সত্যজিতের বুদ্ধিমান ভক্তকুল দুটি কাহিনিকে চিনে ফেলেছেন বুঝি। প্রথম গল্পটি হল ১৯৬৪ সালে তৈরি ছোটো ছবি ‘টু’-এর কাহিনি আর দ্বিতীয় ছবিটি হল ১৯৭০-এ লেখা ‘পিকুর ডায়রি’। এই গল্প থেকে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘পিকু’ তৈরি হল অবশ্য আরো ১১ বছর পরে ১৯৮১-তে। লক্ষ করে দেখব, ‘টু’ ছবিটি তিনি তৈরি করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক টেলিভিশনের জন্য আর ‘পিকু’ তো তৈরি ফরাসি টেলিভিশনের জন্য। মজাটা অন্য জায়গায়।
‘টু’ গল্পটি দেখি এমন একটি বালকের চোখে যেখানে প্রথম দৃশ্যেই দেখি তার বাবা-মা বেরিয়ে যাচ্ছেন গাড়িতে চেপে। বড়ো বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে সেই বাচ্চাটি নীচে গাড়ি চালিয়ে তার বাবা মা-কে চলে যেতে দেখে। ‘পিকু’ যারা দেখেছেন তারা জানেন, ঠিক ওই একই দৃশ্য এই ছবিতেও আছে। দোতলার বারান্দা থেকে পিকু দেখে নীচে তার বাবা আপিসে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ‘টু’-র বালকটি ঠিক তারপরে সম্পূর্ণ একাকী এই বাড়িটিতে আর ‘পিকু’-র ছেলেটিও তাই। দুটি বালকের এই একাকিত্বটুকু-ই দুই গল্পের সাধারণ ধর্ম। এরপরে বড়ো বাড়িতে এই দুই বালকের একাকী সময় কাটানোর মুহূর্তগুলি জুড়ে তৈরি হয় ছবি-কাহিনি। কিন্তু ওইটুকুই। দুটি গল্পের দুই শিশুর ধরন দুই রকম। দুটি গল্পে দুটি শিশুর মানসিক পরিণতিও দু-রকম।
দুটি বালকই ধনীগৃহের সন্তান। তবে ‘টু’-এর বালকটির একাকিত্ব তাকে করে তুলেছে নিষ্ঠুর আর ‘পিকু’-র পরিপার্শ্বটি যত নিষ্ঠুর, পিকু ততই নিষ্পাপ আর অপাপবিদ্ধ। সেই নিষ্ঠুরতার মাঝখানে তার একাকিত্ব সম্পর্কে সে তত বোঝে না, যতটা তার একাকিত্বের শরিক হয় তার গল্পের পাঠক আর সেই ছবির দর্শক। সেখানেই কাহিনিটি নির্মম হয়ে ওঠে। টু গল্পের বালকটির একাকিত্ব তাকে দিয়েছে তার ধনাঢ্যতার অহমিকা। শুধু তার একাকিত্ব নয়, পাশ্চাত্য খেলনাও তাকে করে তুলেছে হিংস্র। পাশ্চাত্য খেলনার মধ্যে যে আক্রমণের প্রতিরূপ আছে, তা-ই তার মধ্যে সঞ্চারিত করে হিংসার অনুভব। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শৈশবের অন্যতম ভাব হিসেবে যে শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হল ক্রোধ। একই সঙ্গে অহমিকা আর ক্রোধ তার স্বভাবের সঙ্গে জুড়ে যায়। বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ, শৈশবেই যে ধীরে ধীরে বিজাতীয় ক্রোধ আর হিংসা কীভাবে ক্রমশ একটি শিশুমনে সঞ্চারিত হয়, ‘টু’ যেন তার একটি প্রতিবেদনও বটে। আর ঠিক এর উল্টোদিকে রয়েছে পিকুর জগৎ।
পিকুর পৃথিবীতে পিকু এখনো বড়োদের পৃথিবীর অন্ধকার পা রাখেনি। বুঝি বা, এই ছবির গল্পটি যেখানে শেষ, সেখান থেকেই বদলাতে শুরু করবে পিকুর ভাবনার জগৎ।এই ছবিটি সময়ের পরিসরে ছোটো হলেও এ এক অদ্ভুত বড়ো-মুহূর্তের গল্প। যেন ছবির শুরুতে যে পিকু-কে আমরা দেখি, তার নিষ্পাপ জগতে তার কাহিনি শুরু হয়, গল্পের শেষে সেটাই বদলে গেল নির্মমতার আঘাতে। এ যেন সেই বদলেরই কাহিনি। কোন দুটি আঘাত তাকে বড়ো করে তোলে? একদিকে নিজের চোখে কিছু না দেখলেও, তার মায়ের প্রেমিক হিতেশকাকুর সঙ্গে তার মায়ের বন্ধ ঘরের অন্য-পারের ঝগড়া তার ভালো লাগে না। আর এই প্রথম এই বয়সে সে প্রত্যক্ষ করে একটি মৃত্যু। তার দাদুর অসহায় মৃত্যু। এই অবৈধতার জগৎ আর মৃত্যুর দুনিয়া তার শৈশবের পৃথিবীটাকেই পুরোপুরি বদলে দেয়। সেই পরিবর্তনের কাহিনি হিসেবেই তাৎপর্যপূর্ণ পিকুর গল্প।
আর এই বড়োদের পৃথিবীতে বদলে যাওয়া আরো দুই খুদের কাহিনি দিয়েই তো শেষ হবে সত্যজিতের পর্দাতে গল্প বলার পালা। 'শাখা প্রশাখা'-র বাচ্চাটির বিস্মিত দুনিয়ায় টাকার এক দুই তিন চার নম্বরি এক নতুন শব্দ সংযোজন। আর অন্যদিকে মনমোহন মিত্রের মতো মানুষকে অবিশ্বাস করতে শেখার বৈষয়িক বিদ্যাবুদ্ধি অর্জন করে কিশোর সাত্যকি। সত্যজিতের গল্পের ক্ষেত্রে এ এক আশ্চর্য প্যাটার্ন।
আর কেন জানি না, এটাই বেশ মজার। একেই বলছিলাম, শিশুর একাকিত্বের কাহিনি। ঠিক একই ধরনের বাস্তবতার মধ্যে স্থাপন করে, একই ধরনের কাহিনি-গড়নে দুটি আলাদা গল্প গেঁথে তোলেন সত্যজিৎ। বড়োদের গল্প আরো বেশি যে কেন তিনি লিখলেন না? সে আক্ষেপ বুঝি কোনোদিনই যাওয়ার নয় আমাদের।
Powered by Froala Editor