মানিকলমকারি – ১৮
আগের পর্বে
বিজ্ঞাপনের কাজ দিয়েই যাত্রা শুরু সত্যজিৎ রায়ের। তবে সেটা হাতে আঁকা বিজ্ঞাপন। তবে পরবর্তীকালে বিজ্ঞাপনের জন্য চিত্রনাট্যও লিখেছেন তিনি। একটি পিটার পাখার। সেই বিজ্ঞাপন দর্শকের মন জয় করেছিল সমানভাবে। পরবর্তী বিজ্ঞাপন আরও চমকপ্রদ। যদিও সেই বিজ্ঞাপন মুক্তি পায়নি। পেপসি-র জন্য চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সত্যজিৎ। আর সেই বিজ্ঞাপনে চিত্রায়িত হয়েছিল বাঙালির অতি প্রিয় গুপী এবং বাঘা। গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমার দৃশ্য অনুকরণ করে তৈরি হয়েছিল বিজ্ঞাপন। অনুপ ঘোষাল গান গাইবেন, আর পরিচালনা করবেন সন্দীপ রায়। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই বিজ্ঞাপন মুক্তি পায়নি।
‘পিকুর ডায়রি’ গল্পটা যত নিষ্ঠুর, ‘পিকু’ সিনেমাটা তার তুলনায় কিছুই নয়। সত্যজিৎ রায় এত নিষ্ঠুর গল্প বোধ হয় আর কখনো লেখেননি। সময়টা ১৯৭০। পুজোর ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় প্রকাশিত এই গল্পটি থেকে ২৪ মিনিটের যে ছবিটি তৈরি করেন তিনি তার কাহিনি অনেক সরল, একরৈখিক আর তাই বোধ হয় তা নিয়ে অনেকের মনে নানাবিধ প্রশ্নও জমা হয়ে থাকে। কিন্তু গল্পটির কলমকারি দেখলে বেশ আশ্চর্য হতে হয় এই ভেবে যে, অকস্মাৎ এতটা নিষ্ঠুরএকটা গল্প তিনি লিখলেন কী করে? কখনো কখনো মনে হয়, ছবিতে যে নিষ্ঠুরতা আমরা দেখি আর মূল গল্পে যে নিষ্ঠুরতাটা ছিল, তার পুরো চেহারাটাই আসলে বদলে গিয়েছে গল্পটা কে বলছে, সেই তফাতটা ঘটে যাওয়াতেই। লেখা-গল্পে কাহিনিটি বলে পিকু নামের বাচ্চাটি নিজেই আর সিনেমাতে তো আর তা হওয়ার নয়, সেখানে গল্পের কথকের দিক থেকেই শুনতে হয় গল্প। একটা ভুল বললাম, গল্পটা তো পিকু বলছে না, সে লিখছে। পিকুর ডায়রি মানে আক্ষরিক অর্থেই তা পিকুর ডায়রি। যেহেতু পিকু গল্পটা লিখছে আর তার বয়স মাত্রই বছর ছয়-সাত, তাই তার ভাষাটাও তার মতো, তার হাতে লেখার বানানটাও তার মতো। এই বাংলা গল্পের এক অসামান্য অভিনব নতুন শিল্পরীতির জন্ম দিয়েছিলেন সত্যজিৎ--- ডায়ারি। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর লেখা প্রবন্ধে ব্যবহার করতেন নানা রকম লিখিত ফর্ম। কখনো আইনি বয়ান লেখার ধরন আবার কখনো মহাভারতীয় গল্পকথনের ভাষাকে তিনি ব্যবহার করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন চিঠিপত্রের ধরন প্রবন্ধ লেখার দরকারে। গল্প লেখার ক্ষেত্রেও সেই পত্র লেখার ধরন ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘স্ত্রীর পত্র’, প্রতিটি চরিত্র নিজেরা- নিজেরা কথা বলছে, এই ধরনটা ব্যবহার করে উপন্যাস লিখেছেন বঙ্কিমচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথ দুজনেই। মনে পড়বে, বঙ্কিমের ‘রজনী’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস লেখার ধরন।
সত্যজিৎ নিজে প্রফেসর শঙ্কুর গল্পের জন্য ব্যবহার করেছিলেন এক ধরনের ডায়ারি, সেখানে রয়েছে দিনক্ষণের উল্লেখ। দিনের ঘটনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে প্রফেসর লিখছেন তাঁর সারাদিনের অভিজ্ঞতা। সেই ডায়ারিটাই আমাদের হাতে এসে পৌঁছচ্ছে গল্প হয়ে। কিন্তু, ‘পিকু’-তে কাহিনিটা একেবারে অন্য হয়ে যায়। সেখানে পিকু ঠিক দিন ধরে তো তার নিজের কথা লেখে না, তার টুকরো টুকরো মনে হওয়া সে লিখে চলেছে একটা খাতায়। সারাটা দিন সে যা যা দেখছে, যা যা শুনছে, শুধু সেইগুলোই সে লিখে চলে তার ডায়ারির পাতায়। আর ঠিক এখানেই গল্পটি নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে।
ছবিতে গল্পটার যথার্থ বিষয়টাই যেন ধরা পড়ে না। কারণ, এই গল্পের মুখ্য বিষয় ওই ছয়-সাত বছরের ছেলেটির দেখা পৃথিবীটাই। যারা শিশু সাহিত্যের মনোযোগী পাঠক, তাদের কারো কারো মনে পড়বে বুদ্ধদেব বসুর লেখা ‘এলোমেলো’ উপন্যাসটির কথা। সেখানে বড়োদের অনুপস্থিতিতে বাড়ির ছোটোরা বড়োদের নিয়ে খেলর ছলে যে অভিনয় করে চলে, তার মধ্যে একভাবে ধরা পড়েছিল বড়োদের কৃত্রিম জগৎটি ছোটোদের চোখে কতখানি হাস্যকর, তার ছবি। সে এক ধরনের মজা। কিন্তু, সেটা শেষ পর্যন্ত ছোটোদের জন্য লেখা। ফলে, সেখানে বড়োদের পৃথিবীটা সম্পর্কে ছোটদের মনে-হওয়া দিয়েই শেষ হয় উপন্যাস। কিন্তু ‘পিকু’ গল্পের সবচেয়ে কৌতূহলপ্রদ বিষয় হল, এটা একজন ছোটো লিখছে নিজের কথা আর সেটাই হয়ে উঠছে বড়োদের জন্য একটা গল্প। সত্যজিৎ রায়ের যেন এটা একটা নিজস্ব প্যাটার্ন। তাঁর তথাকথিত ছোটোদের জন্য লেখাতে ছোটোরা থাকে না--- সেটা যেমন ঠিক, তেমনই ঠিক তার ঠিক উল্টো পথে হেঁটে একটি ছোটোর কলমে তার বয়ানে বড়োদের গল্প জন্য গল্প-বলা।
‘পিকু’ গল্পটি তৈরি হয়ে ওঠে পাঠকের পড়া-র মধ্যে।
যা লেখা আছে, তা যেন গল্প নয়, সেই লেখা থেকে মন দিয়ে পড়তে হবে, পিকু যা দেখে না সেই গল্পটা। এ এক ভারী নতুন গল্প-বলা। গল্প মানে তো যা বলা হবে, তাকে বোঝা। কিন্তু এই গল্প হল, এমন এক গল্প, যা লেখা হয়নি। লেখা হয়নি মানে, লেখক ইচ্ছে করেই তা পাঠকের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছেন বা তাকে অন্য কোনো ইঙ্গিতে বলছেন, তা কিন্তু নয়। কারণ, এই গল্পের লেখক তো আসলে ওই শিশু বালক পিকু নিজেই। সে তো যা দেখছে, তার বাইরে কিছু আছে বলেই জানে না। অথচ, তার ডায়রি থেকেই পাঠকের মনের ভেতর তার চারপাশে ঘটে-যাওয়া গল্পটা মূর্ত হয়ে উঠছে। আর পিকুর সরল মনে চারপাশটিকে দেখাটাই হল সবচেয়ে করুণ। তাই বলছিলাম, গল্পের ভাষায় যে অদ্ভুত শিশুসুলভ বাক্যরচনার ধাঁচা, তার লেখার যে বানান-ভুলের ঘনঘটা, এমনকি পাংচুয়েশন বা যতিচিহ্ন বসানোর কারিকুরি--- সেটাই ভাষার দিক থেকে গল্পের চেহারাটিকে তৈরি করে তুলেছে। এই শিল্পরূপটি এক্কেবারে নতুন।
একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি দেখা যাক। গল্পটা শুরু হয় এইভাবে: ‘আমি ডাইরি লিখছি। আমি আমার নীল নতুন নীল খাতায় ডাইরি লিখছি। আমি আমার বিছানার উপর বসে ডাইরি লিখছি। দাদুও ডাইরি রোজ লেখে কিন্তু এখন অসুক করেছিল তাই। সেই অসুকটার নাম আমি জানি আর নামটা করোনানি থমবোসি। বাবা ডাইরি লেখে না। মাও ডাইরি লেখে না দাদাও না খালি আমি আর দাদু। দাদুর খাতারচে আমার খাতা বড়।’ ভাষার কথায় পরে আসছি, প্রথমেই দেখব ‘ডাইরি’, ‘অসুক’, ‘করোনানি থমবোসি’, ‘খাতারচে’ শব্দগুলি। ‘খাতার চেয়ে’ কথাটাকে সে মুখে বলে ‘খাতারচে’ তাই লেখেও তাই। পরেও এ রকম কত শব্দ। ‘হকি স্টিক’ হবে ‘হকিস টিক’, ‘আওয়াজ’ হবে ‘আওজ’, ‘হর্ন’ হয়ে যাবে ‘হ্রন’, ‘স্বপ্ন’ হয় ‘সপনো’ আবার ‘ফ্রিজ’ হয়ে যাবে ‘ফৃজ’ কিংবা ‘ড্রিঙ্কস’ পিকুর লেখায় হয়ে যাবে ‘ডৃং’। লক্ষ করুন অদ্ভুত জিনিস ওই ফ-এ ঋ-কার আর ড-এ ঋ-কার। কক্ষনো এই লিপিগুলি তো ব্যবহারই হয় না। অথচ, পিকু তার স্বরধ্বনির জ্ঞান দিয়ে সেটাই লিখতে পারে। আর তার সঙ্গে কী অসামান্য সব বাক্য। উপরের অংশেই দেখুন না, ‘আমার নীল নতুন নীল খাতায় ডাইরি লিখছি’। এটা তো কিছুতেই বড়োদের লেখা বাক্যের পদবন্ধ নয়! এমন বাক্যের ছড়াছড়ি পিকুর ডায়রি জুড়ে। যেমন, এক জায়গায় পিকুর ভাষায় সত্যজিৎ লিখছেন ‘আরেকবার মা এলো আর বল্ল একি সোনা জেগে আছো ঘুমো ঘুমো আর আমি বল্লাম একা একা ভয় আর মা বল্ল কিসের ভয় বোকা ছেলে ঘুমো এগারটা বাজে চোখ বোজ আপনি ঘুম বল্লাম দাদা কোথায় মা বল্ল ঢের হয়েছে গুমো বলে চলে গেল।’ এই বাক্যটি সাধারণভাবে লিখলে কেমন হতো? ‘আরেকবার মা এল। বলল, ‘এ কী সোনা জেগে আছো? ঘুমোও ঘুমোও।’ আমি বললাম, ‘একা একা ভয় ভয় করছে।’ তখন মা বলল, ‘কীসের ভয়? বোকা ছেলে। ঘুমোও। এগারোটা বাজে। চোখ বোজো, আপনিই ঘুম এসে যাবে।’ আমি বললাম, ‘মা, দাদা কোথায়?’ মা বলল, ‘ঢের হয়েছে, ঘুমোও।’ বলে মা চলে গেল।’ এই বিষয়টা একটি শিশুর বাক্যে কী চেহারা নেয়, ওই বাক্যটি তার একটা উদাহরণ। আর বিষয়বস্তুর দিক থেকে পিকুর এক দাদা আছে, সে কলেজ রাজনীতি করে, সে বেশ কিছুদিন হল বাড়ি আসেনি অথচ উচ্চবিত্ত বাড়িতে তার জন্য বাড়ির পার্টি থেমে থাকেনি। এই নিষ্ঠুরতা যেমন আছে, তেমনই মা-বাবার সম্পর্ক যে কোন তলানিতে ঠেকেছে তা সামান্য কিছু কথায় ধরা থাকে। সেই সম্পর্কের তলানির খবরগুলো পিকুর চারপাশে ঘোরাফেরা করে কিন্তু সে সেই শব্দগুলো জুড়ে সেই শব্দগুলোর সামগ্রিক অর্থ যে বাবা-মা-র সম্পর্কহীনতা--- সেই সাংসারিক সত্যটাকে বুঝতে পারে না। এখানেই গল্পটা নিষ্ঠুরতর। এর সঙ্গে গল্পটা সেখানেই নিষ্ঠুরতর, যেখানে পিকুর হিতেশকাকু যে ঠিক কে, তা সে জানে না। মজার ব্যাপার হল, হিতেশকাকু কে সেটা যে তার জানা বা না-জানা-র বিষয়, সেটা সম্পর্কেও তার কোনো বোধ নেই স্বাভাবিকভাবেই। হিতেশকাকু বাড়িতে আসে, তার বাবার অনুপস্থিতিতে আসে, তার মায়ের সঙ্গে বড়োদের সিনেমা দেখতে বেরিয়ে যায় দুপুরে, নিজের স্ত্রীর সেই অভিসারের খবর যে পিকুর কাছ থেকেই তার বাবা গ্রহণ করছে, সেই কথাগুলিও সে বোঝে না। সে শুধু পরপর ঘটনাগুলো বলে চলে তার ভাষাভঙ্গিতে। এখানেই বলছিলাম, গল্পটি ক্রমশ নিষ্ঠুর থেকে নিষ্টুরতর হয়ে ওঠে। সত্যিই এটা এমন এক গল্প, যেখানে যা লেখা হল না, সেখানেই বড়োদের গল্পের ঠিকানা। গল্প নিয়ে এমন অভিনব নিরীক্ষা কি বাংলায় হয়েছে! যাঁরা বলে থাকেন, সত্যজিতের গল্পের ভাষা অসামান্য, কত সহজ তাঁর উপস্থাপন ভঙ্গি, তাঁরা কি মন দিয়ে পড়ে ‘পিকু’ গল্পের শিল্পরীতির কথা মনে রাখেন? এ এমন এক গল্প, যার না বিষয় না উপস্থাপনা, কোনোটাই সহজ সরল নয়। ভাষাতে শিশুর মনের কথা থেকে উঠে আসা সারল্যই যেন এই কাহিনির সবচেয়ে জটিল পাঠের সূচনা করে দেয়।
Powered by Froala Editor