কানাই, রতন, গঙ্গারাম আর সুজনের গপপো

মানিকলমকারি – ১৬

আগের পর্বে

উপেন্দ্রকিশোরই হোক কিংবা সুবিমল রায়— সত্যজিতের রক্তেই যেন মিশে আছে রূপকথা। আর সত্যজিৎ সেই রূপকথার হাত ধরবেন না এমনটা তো হতেই পারে না। ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পর পর চারটি রূপকথার গল্প লিখলেন সত্যজিৎ। নিজের গল্পের ধরণ ছেড়ে। তবে আরও একটি গল্পের কথা উল্লেখ করতেই হয়। ‘কানাইয়ের কথা’। সে গল্পে ‘শুখনাই’ নামক এক মাড়কের কথা বলেছেন সত্যজিৎ। রূপসা রাজ্যের প্রজাদের মধ্যে ছড়িয়েছে এই অসুখ। গল্পের শেষে এই অসুখে আক্রান্ত হন স্বয়ং দুরাচারী রাজাও। তবে সেই রাজার ছবি আঁকতে গিয়ে হীরকরাজের মুখকেই যেন কল্পনা করে ফেলেছেন সত্যজিৎ। তাঁর চাদরেও ধরা দিয়েছে হীরক রাজদরবারের সেই জ্যামিতিক মোটিফ।

কথা ছিল সত্যজিৎ রায়ের রূপকথার গল্প নিয়ে কিছু কথা হবে। আগের কিস্তিতে বলেছিলাম ‘কানাইয়ের কথা’ গল্পের শুখনাই অসুখের কথা। শুখনাই অসুখের মড়কের গল্প কীভাবে হাবেভাবে লক্ষণে-লক্ষণে মিলে যায় এখনকার সময়ের অতিমারির সঙ্গে কিছু কিছু সামান্যলক্ষণে। রূপকথার গল্প যেমন শুরু হয় ‘এক রাজা আর এক রানি’-র গল্পে, সত্যজিতের গল্পে কিন্তু ব্যাপারটা তেমন নয়। ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর যেমন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘ভুতো-ঘোঁতো’-র গল্পে শুনিয়েছিলেন সাধারণ একটি বা দুটি ছেলের বড়ো হয়ে ওঠার গল্প, তাঁর পৌত্র সত্যজিৎও ঠিক সেই পথই নিয়েছিলেন। চারটি গল্পের নায়ক চারটি ছেলে কানাই, রতন, গঙ্গারাম আর সুজন নিতান্ত সাদমাটা সহজ ছেলে। নন্দীগ্রামে জমি আর দুটো বলদ নিয়ে থাকে কানাই, শিমুলিগ্রামের রতনদের গানের গলা ভালো বলে সে পুরুতগিরি না করে গান নিয়েই থাকতে চায়, গঙ্গারামের গ্রামের নাম বৈকুণ্ঠগ্রাম, বাপ-মা-মরা মামার কাছে-মানুষ গঙ্গারামও সামান্য জমিজমার চাষ করে আর সুজন তো একেবারে গুপী কাইনের মতোই মুদির ছেলে। তার ঠিকানা ক্ষীরা গ্রাম। সেখানে মুদির দোকানদারিতে নয়, গুপীর মন ছিল গানে আর সুজনও দোকানে বসতে চায় না, সে পশুপাখির ডাক শুনে নিজের গলায় তুলতে পারলেই সবচেয়ে খুশি।

প্রতিটি ছেলেই অত্যন্ত সৎ আর ভারি সরল। কানাইয়ের কাছে তার বাবা-ই সব। গল্পে বলা হয়, ‘বাপকে সে দেবতার মতো ভক্তি করে’। রতন তো ঋষির অভিশাপে রাক্ষস হয়েও শান্তশিষ্ট একটি চরিত্র, গঙ্গারামের কপাল-ফেরায় যে পাথর, তা এক রাজকুমারীর হারিয়ে-যাওয়া পাথর শুনেই তাকে পৌঁছে দিতে চায় সে। অন্যদিকে সুজনও তো অকারণে গ্রামের মানুষের ভালো হবে ভেবে জবরনগরের বিহঙ্গভুক পাক্ষসকে মারতে এগিয়ে যায়। তার মানে, সত্যজিতের গল্পের আর সব চরিত্রাবলি থেকে তাঁর রূপকথার নায়করা একেবারে আলাদা। তাঁর ছোটগল্পের চরিত্ররা বেশ জটিল। তাদের মনের নানান জটিলতা দিয়েই তৈরি হয় সেই সব গল্পকাহিনি। কিন্তু অন্যদিকে এইরূপকথা সিরিজের চরিত্ররা বেশ সাদামাটা সোজা মানুষ। মজার ব্যাপার হল, সত্যজিতের গল্পে যখন বলা হয়, প্রায় নারী চরিত্র নেই, তখন আমাদের মনে থাকে না এই গল্পগুলির কথা। কারণ, চারটি রূপকথার গল্পের তিনটিতেই রয়েছে চারজন নায়িকাচরিত্র। ‘রতন আর লক্ষ্মী’ গল্পে নায়িকা লক্ষ্মী, ‘গঙ্গারামের কপাল’ গল্পের নায়িকা রাজকন্যা সুনয়না আর ‘সুজন হরবোলা’ গল্পের নায়িকা জবরনগরের রাজকন্যা শ্রীমতী।

কানাইয়ের কথা গল্পের অলংকরণ

 

ঠিকই লক্ষ করেছেন, তিনজন নায়িকাই রাজকন্যা। তিনজন নায়িকার সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে আর কখনো তাকে বিয়ে করার জন্য চঞ্চল হয়েছে নায়ক-চরিত্র। গুপী-বাঘার গল্পের চিত্রনাট্যে যেমন গুপী-বাঘা বলেছিল, রাজকন্যা সম্পর্কে তাদের উৎসাহের কথা, এই গল্পগুলিতেও ঠিক সেই উপাদান ফিরে এসেছে। গুপী-বাঘা-র সেই রাজপ্রাসাদের ঝরোখায় রাজকন্যা দেখে হতবাক হওয়ার উপাদানও এই তিনটি গল্পেই পুনরাবৃত্ত। ‘রতন আর লক্ষ্মী’ গল্পে উজলপুরের সংক্রান্তির মেলায় রাজকন্যা লক্ষ্মী এসেছে শুনে রতনের কী মনে হয়? রাজকন্যাকে দেখার পর গল্পকার লিখছেন ‘শুধু দেখা নয়, একেবারে চোখে চোখে দেখা… রাজকন্যা লক্ষ্মীর চোখে চোখ পড়তেই রতনের মন খুশিতে ভরে উঠল। এমন সুন্দর মেয়ে সে দেখেনি কখনো। আহা, একে যদি গান শোনাতে পারত সে, তাহলে কেমন ভালো হত।’ গঙ্গারাম আবার রাজকন্যাকে তার সাতশিরা পাথর ফেরত দিয়ে, তার বাবা রাজামশাইকে সরাসরি বলে, ‘যাকে এনে দিলাম সাতশিরা পাথর, সেই রাজকন্যাকে বড়ো দেখতে ইচ্ছা করছে। আমি কোনোদিন রাজকন্যা দেখিনি।’ হরবোলা সুজন আবার রাজকন্যাকে দেখেনি আদৌ, সে শুধু রাজকন্যার ‘ছবি দেখেই সুজনের মনে হয়েছে এ যেন স্বর্গের অপ্সরী’। অবশ্য সুজনের গল্পে নায়ক-নয়িকার দেখা হওয়ার একটা উল্টো গল্প আছে। সেটাও রূপকথার গল্পের উপাদান হিসেবে বেশ কৌতূহলপ্রদ। সাধারণত, নায়কই যায় নায়িকার সন্ধানে, কিন্তু নায়িকার নায়কের কাছে পৌঁছনোর গল্প হল ‘সুজন হরবোলা’। একদিন রাত্রে সখী সুরধুনীকে সঙ্গে নিয়ে নায়িকা পৌঁছয় নায়কের ঘরে। রূপকথার গল্পে নায়ক-নায়িকা, বিয়ের কাহিনি অনুষঙ্গ স্বাভাবিকভাবেই রূপকথার গল্পের উপাদান।

আরও পড়ুন
শুখনাই, তাই সুখ নাই

রতন ও লক্ষ্মী গল্পের অলংকরণ

 

এই রূপকথার গল্পেই যুক্ত থাকে এমন একটি বিশেষ চরিত্র, যে হল সর্বশক্তিমান। তার প্রচুর ক্ষমতা। অদ্ভুতভাবে গুগাবাবা-র চিত্রনাট্যে আর ‘হীরক রাজার দেশে’ এই দুটি চরিত্রই ছিল বিজ্ঞানী। গুগাবাবা-তে ছিল জাদুকর বরফি আর ‘হীরক রাজার দেশে’-তে এমন চরিত্রই ছিল একমেবাদ্বিতীয়ম্ গবেষক। বিজ্ঞানীর ক্ষমতাকে রাষ্ট্রশক্তি কীভাবে ব্যবহার করে বারেবারে, তার ইঙ্গিত ছিল ওই দুই চরিত্রেই। অন্যদিকে এই গল্পমালায়, সেই জায়গাটি নিয়েছে ভবিষ্যদ্বক্তা জ্যোতিষী ধরনের লোক বা গণৎকারের চরিত্র। সত্যজিৎ সাধারণভাবে নিজে এই বিষয়ে মুক্তমনা হয়েও গল্পের খাতিরে এই ধরনের গণৎকার চরিত্র কিন্তু এখানে বারেবারে এনেছেন। রতনকে অভিশাপ দেয় যে প্রচণ্ড রাগী সাধু, সে যেমন এক ক্ষমতাশালী লোক, তেমনই ক্ষমতাশালী লোক নরহরি জ্যোতিষী। রতন তাঁর থেকেই জেনে নেয়, ওই দুষ্ট সাধুর অভিশাপে সে রাক্ষস হলেও, তার শাপমুক্তি হবে কি না আর হলে কবে হবে? গঙ্গারামের ‘কপাল-ফেরা’-র ব্যাপারটাতেই তো রয়েছে ওই জাদু-পাথরের ভূমিকা। তবে সেখানেও ছিল হরিতাল গ্রামের অঘোর গনৎকার। তার কাছ থেকেই গঙ্গারামের দুষ্টু মামাতো দাদা রঘুনাথ ভাইয়ের সৌভাগ্যের খবর পায়। সিনেমার গল্পের বিজ্ঞানী এখানে বদলে গেল গনৎকারে!  

আরও পড়ুন
অতিথি যখন আগন্তুক

এছাড়াও, সত্যজিতের প্রতিটি রূপকথার গল্পে একটি আলাদা করে অন্য মাত্রা সব সময়েই যুক্ত হয়ে থাকে। এটাও সেই গুপী-বাঘার চিত্রনাট্য লেখা থেকে সত্যজিতের নিজস্ব একটা ধরন। যেমন ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এ ছিল যুদ্ধের বিষয়টি, যেমন ‘হীরক রাজার দেশে’-তে ছিল অপশাসন আর শিক্ষার বিষয়, তেমনই এই চারটি কাহিনিতেই রয়েছে চারটি ভিন্ন উপাদান। উপাদানগুলি মূল গল্পের সঙ্গেই যুক্ত, তবে তা ঠিক রূপকথার গল্পের ধরন নয়, সে মাত্রাটি সমকালীন। এক দুই করে বলি?

গঙ্গারামের কপাল গল্পের অলংকরণ

 

আরও পড়ুন
সই আর সত্যজিৎ

১। ‘কানাইয়ের কথা’-য় ছিল সেই অন্য বিষয়টি ছিল মড়ক আর মহামারির অসুখ। আর সেখানে ছিল রাজারা কীভাবে সেই মহামরির ওষুধ-ও নিজের কাছে সরিয়ে রাখতে চায়, তার গল্প। সেই সূত্রটি আমরা আগের কিস্তিতে আলোচনা করেছি।

২। ‘রতন আর লক্ষ্মী’ গল্পে ছিল সন্নেসি যদি যথাযথ না হন, তাহলে, একটি বালক চাইলে, অকারণে তার পা-টিপতে যাবে কেন? অত্যন্ত ধর্মীয় আবহাওয়াতে জারিত এই বাংলার সমাজে ছোটদের জন্য লেখা এই কাহিনি-উপাদান বেশ নতুন রকম।              

আরও পড়ুন
বিরিঞ্চিবাবা আর ভবানন্দের চ্যালাদের বদল-বৃত্তান্ত

৩। ‘সুজন হরবোলা’-তে গুরুত্বপূর্ণ হল পরিবেশ-ভাবনা। পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত পশুপাখির ডাক। একটি জায়গায় পৌঁছে পাখির ডাক শোনা যায় না, বলে প্রথম সেই জায়গাটা সম্পর্কে খটকা লাগে সুজনের। সুজন রাজাদের মৃগয়া করা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। রাজা যখন বলেন, ‘শিকার মানেই তো জানোয়ার মারা!’ তার উত্তরে সুজন বলে, ‘কিন্তু বাঘ আপনার কী ক্ষতি করল যে, তাকে মারবেন?’ এখানেই পাওয়া যায়, বিহঙ্গভুক রাক্ষসের কথা। নগরের সমস্ত পাখি যে খেয়ে ফেলে!

নিশ্চয়ই রূপকথারই গল্প। কিন্তু রূপকথার গল্পের ভেতরে এই আরেকটি অন্য-গল্প বলে নেওয়াই বুঝি সত্যজিতের রূপকথার গল্পের নিজস্ব একটা ধরন।

আরও পড়ুন
মানিক বন্দ্যোর গল্প থেকে মানিকবাবুর না-হওয়া ছবি

পুনশ্চ: লেখার শেষে দুটো মজাদার সমাপতনের কথা বলতেই হয়। নিঃসন্দেহে রূপকথার গল্পের আর্কিটাইপটি সত্যজিৎ গ্রহণ করেছেন উপেন্দ্রকিশোরের কাহিনি উপাদান থেকে। তবে, দুটি উপাদান লেখার সময় কি সত্যজিতের মনে হয়নি পিতা সুকুমারের দুই সৃষ্টির কথা। এক, ‘কানাইয়ের কথা’-র জগাইবাবার ছবি দেখলেই মনে হবে সে যেন ‘হয়বরল’-র উদো আর অন্যজন তো ‘গঙ্গারামের কপাল’-এর গঙ্গারাম চরিত্রটি তৈরি করার সময় কি আর তাঁর মনে হয়নি, সুকুমার রায়ের বিখ্যাত ‘সৎপাত্র’ ছড়ার নায়ক চরিত্রটির কথা। সেখানে গঙ্গারামের ভাই জাল করে নোট গেছেন জেলে আর এই গঙ্গারামের এক ভাইও জেল-ফেরত বদমাশ। গল্পের গঙ্গারাম সৎ কিন্তু সবেতেই তার কপাল খারাপ ছিল। আর ছড়ার গঙ্গারামের যেন সব কিছু হয়েও কিচ্ছুটি হয় না! আর সেটাই তার মজা!

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সত্যজিতের চিত্রনাট্যের কর্মশালা