মানিকলমকারি – ১৪
আগের পর্বে
সই সংগ্রহ যে সত্যজিতের একটা নেশা ছিল তার পরিচয় মেলে একাধিক লেখায়। ছোটবেলায় শান্তিনিকেতনে একটা আস্ত খাতাই কিনেছিলেন সই সংগ্রহের জন্য। তার প্রথম পাতাটিই ফাঁকা রেখেছিলেন কবিগুরুর থেকে কবিতা লেখানোর জন্য। লিখেও দিয়েছিলেন তিনি। সে খাতায় নলিনী দাশ ও লীলা মজুমদার এঁকে দিয়েছেন ছবি। সইয়ের সঙ্গেই। এই সত্যজিতের সই-প্রেমিক সত্তা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর লেখাতেও। জয় বাবা ফেলুনাথে জটায়ুর স্বাক্ষর দেওয়া তেমনই এক ঘটনা। শুধুই কি জটায়ু? টিনটোরেটোর যীশু, মানপত্রেও ফিরে ফিরে এসেছে সেই দৃশ্য। নিজেও বিভিন্ন ছবি আঁকার ক্ষেত্রে একেক রকমের স্বাক্ষর ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ।
সত্যজিৎ তাঁর ‘আগন্তুক’ ছবির চিত্রনাট্যের খাতা লেখা শুরু করেছিলেন বাইশে সেপ্টেম্বর ১৯৯০ সালে আর সেই ছবির শুটিং শুরু হয় ১৯৯০ সালেরই বাইশে নভেম্বর। তারিখটি মজাদার। কারণ, ওইদিনই সত্যজিতের পৌত্র সৌরদীপের জন্ম হয়। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, মাত্র দুমাস আগে যে ছবির চিত্রনাট্য লেখার কাজ শুরু হয়, সেই ছবির শুটিং কী করে ঠিক দুমাসের মাথায় শুরু হতে পারে, বাদ বাকি সব প্রস্তুত করে। সেই চিত্রনাট্য লেখার প্রথম পাতাতেই দেখা যায়, সত্যজিৎ বেশ কিছু গল্পের নাম লিখে রেখেছিলেন। নিজেরই আগে লেখা গল্প সব কটি। মোট পাঁচটি গল্প। ‘তারিণীখুড়ো ও বেতাল’, ‘অনুকূল’, ‘খগম’, ‘বহুরূপী’ আর ‘অতিথি’। সহজেই অনুমেয়, তার মানে নিজের লেখা এই-এই গল্পগুলি থেকে তার মানে তখন ছবি করার কথা ভেবেছিলেন তিনি! অথবা হয়তো, টিভির জন্য যে ‘সত্যজিৎ রায় প্রেজেন্টস’ তৈরি হচ্ছিল, তার জন্য লিখবেন ভেবেছিলেন চিত্রনাট্য। সত্যজিতের গল্পপ্রেমী পাঠক এই অবধি পড়েই নিশ্চয়ই উত্তেজিত এবং আক্ষেপে হাত কামড়াচ্ছেন। কারণ, এই গল্পগুলি থেকে তাহলে একটা করে ছবি পেতাম আমরা! ‘অনুকূল’-এর মতো সাই-ফাই, ‘খগম’-এর মতো অলৌকিক কাহিনি আর ‘বহুরূপী’-র মতো ছদ্মবেশ-নিতে-চাওয়া এক শিল্পীর কাহিনি। তবে লক্ষণীয়, সেখানে ‘খগম’ আর ‘অতিথি’-র উপস্থিতি। ‘তারিণীখুড়ো ও বেতাল’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৩-র বৈশাখে, তার মাস দুয়েক পরে বেরোয় ‘বহুরূপী’। ‘অনুকূল’ বেরোয় ১৯৮৬ সালে।
অন্যদিকে ‘খগম’ আর ‘অতিথি’-ই বেশ পুরোনো লেখা। ‘খগম’ তো ১৯৭৩-এ লেখা আর ‘অতিথি’ লেখা ১৯৮১ সালে। এই ‘অতিথি’ গল্পটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, এটাই সত্যজিতের লেখা একমাত্র গল্প, যেটি হাতে-লেখা পাণ্ডুলিপি থেকে সরাসরি ‘আরো বারো’ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। অন্তত ‘গল্প ১০১’ বইয়ের গল্প-পরিচিতি অংশে তো তা-ই জানানো হয়েছে।
যাই হোক, এই খাতার মধ্যেই দেখা গেল, প্রথম পাতায় কয়েকটি গল্পের নাম লেখা হলেও, খাতাটিতে রয়েছে ‘আগন্তুক’ ছবির চিত্রনাট্য। আরো অন্য কিছুও ছিল, সে কথায় পরে কোনো কিস্তিতে আসা যাবে। মোট কথা, সেই সব আশপাশের কিছু-কিছু কথার পর, শুরু হচ্ছে একটি ছবির চিত্রনাট্য। সত্যজিতের শেষ ছবি ‘আগন্তুক’। সত্যজিতের গল্পপ্রেমী পাঠক জানেন, এই ছবি তিনি তৈরি করেছিলেন তাঁর নিজেরই লেখা, তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত গল্প ‘অতিথি’ থেকে। খাতা শুরু হয়েছিল অনেক গল্পের মধ্যে অন্যতম একটি গল্প হিসেবে ‘অতিথি’-র নাম লিখে, দেখা গেল এরপরে এই ‘অতিথি’-ই হয়ে গেল ‘আগন্তুক’। একবার আগে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গল্পের নাম ছিল ‘নষ্টনীড়’ আর তা থেকে ছবি হল ‘চারুলতা’। ১৯২৯ সালে ‘নষ্টনীড়’ নামে ছবিটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল বলেই তাঁকে ‘নষ্টনীড়’ বদলে নাম রাখতে হয়েছিল ‘চারুলতা’। সেখানে ‘অতিথি’ তো কিংবদন্তিপ্রতিম ছবি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ছবির নাম বদলে ‘অতিথি’ হল ‘আগন্তুক’। ‘অতিথি’ নামে অর্থের ব্যঞ্জনা ছিল অনেক বেশি। অভিধান অনুসারে ‘অতিথি’ শব্দের অর্থ একদিকে ‘যার গমনাগমনের কোনো নির্ধারিত তিথি নেই’ তেমনই তার মানে আবার ‘গৃহস্থের গৃহে এক রাত্রের অধিক যার স্থিতি নেই’। শুধু তাই নয়, অভিধানে দেখবেন, এই ‘অতিথি’ শব্দের অর্থই আবার ‘যিনি বিদ্বান, সর্বত্র ভ্রমণকারী এবং যিনি প্রশ্নোত্তররূপ উপদেশ দ্বারা জনসাধারণের হিতসাধন করেন।’ ‘আগন্তুক’ শব্দের মধ্যে আকস্মিক আগমনের ব্যাপারটা আছে, কিন্তু অতগুলো অর্থ তাৎপর্য তো সেই শব্দের গায়ে লেগে নেই। তবু হয়ত, হয়ত কেন নিশ্চয়ই তপন সিংহের ‘অতিথি’-র কারণেই সত্যজিতের গল্প ‘অতিথি’ থেকে তৈরি-ছবির নাম হল ‘আগন্তুক’। অভিধান বলছে, ‘অতিথি’ শব্দের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে আসলে ‘অস্থিতি’। অতিথি শব্দটার বহুমাত্রিক তাৎপর্য কিন্তু ‘আগন্তুক’-এ নেই!
আরও পড়ুন
সই আর সত্যজিৎ
গল্পে চরিত্রদের নাম ছিল অন্যরকম। গল্পের ওই ‘অতিথি’ পুলিন রায় ছবিতে হয়েছেন ‘আগন্তুক’ মনমোহন মিত্র। গল্পের গৃহকর্তা সুরেশ বসু ছবিতে হয়েছে সুধীন্দ্র বসু। তার স্ত্রীর নাম গল্পে ছিল সুহাসিনী, সে ছবিতে হয়েছে অনিলা। সুরেশ-সুহাসিনীর ছেলের নাম অবশ্য গল্পেও যা ছবিতেও তা-ই। সাত্যকি। গল্পে অবশ্য ওই ভালোনামের চেয়ে ডাকনামটাই বেশি শোনা গেছে, মন্টু। সেখানে সাত্যকির আবার বড়ো দুই দাদা-দিদি ছিল, যদিও গল্পে তারা ছিল না। ছবিতে সুধীন্দ্র বসু ছিল চাকুরিজীবী, এক দুঁদে উকিল ছিল তার বন্ধু। সেই, যে মনমোহনকে প্রায় জেরা করেছিল আর কী। গল্পের সুরেশ বসু নিজেই উকিল। প্রশ্ন তার মনেই তৈরি হয়ে উঠছিল একে একে। আর গল্পের পটভূমি ছিল মামুদপুর নামে এক মফসসল, কলকাতা হয়ে সেখানে উপস্থিত হন আগন্তুক ওই ভদ্রলোক আর ছবিতে তো পটভূমি খাস কলকাতা। প্রথমে চিত্রনাট্য লেখার সময় অনিলাদের বাড়ির ঠিকানা লিখেছিলেন লাভলক প্লেস, পরে ছবিতে সেটি হল একশো বাহাত্তর বাই দুই, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। সকল সন্দেশির জানা এই ঠিকানাটি। কারণ, এই ঠিকানাতেই ছিল সন্দেশের সম্পাদকীয় দপ্তর। যারা ছবিটি দেখেছেন, তাদের বলে রাখা ভালো, যে দৃশ্যে আমরা মনমোহন মিত্রকে এই সুধীন্দ্র বসুর বাড়িতে আসতে দেখি, সেই বাড়িটিই কিন্তু সন্দেশের আপিস। মানে বাইরে থেকে যে-বাড়িটির সামনে মনমোহনকে নামতে দেখি আমরা।
আরও পড়ুন
বিরিঞ্চিবাবা আর ভবানন্দের চ্যালাদের বদল-বৃত্তান্ত
কিন্তু ১৯৮১-র ছোটগল্পটিতে ছিল শুধু মন্টুর চোখে ওই অতিথি ভদ্রলোক তার পঁয়তাল্লিশ বছর আগে বাড়ি-ছেড়ে-চলে-যাওয়া দাদু-কি-দাদু-না, তার সাসপেন্স। সঙ্গে বাড়ির বড়োদের চোখে ঘনিয়ে ওঠা সন্দেহ আর তার উল্টোদিকে তার ওই ভদ্রলোককে ভালো লাগার একটা গল্পও ছিল। বড়োদের সন্দিহানময় জগৎ কীভাবে একটি শিশুর মনে রেখাপাত করে, নিঃসন্দেহে সেই গল্পেরও একটা হালকা ইঙ্গিত মূল গল্পে ছিল। এছাড়া, এই গল্পও শুরু হয়, ভাগ্নীর কাছে মামার লেখা চিঠি দিয়েই, এই বাড়িতে এসেই গল্পেও ছবির মতোই খুদে সাত্যকি বোসকে মনমোহন জিজ্ঞাসা করেন, সে কি ‘অর্জুনের সারথি? না সুরেশ বোসের পুত্র?’ গল্পেও দাদুর কাছে বসে মন্টুর দেশ বিদেশের মুদ্রা পাওয়ার গল্প আছে। গল্পে আছে স্থানীয় একটা মাঠে বসে মন্টুর বন্ধুদের নিয়ে মন্টুর দাদুর গল্প বলার গল্প। সেখানে তিনি সাহারা মরুভূমির পটভূমিতে তুয়ারেগদের হাত থেকে তাঁর শিহরণ জাগানো রক্ষা পাওয়ার গল্প। অবশ্য রক্ষা-পানেওয়ালা যে স্বয়ং তিনিই, সে কথাটি তাদের আর সেই গল্প-বলার সময় বলেননি। ছবিতে এই গল্পবলার স্থান হয়েছিল কলকাতার ময়দান। এমনকি গল্পের শেষে নিজের লেখার জন্য পাওয়া পুরস্কারের সমস্ত টাকা পয়সা ভাগ্নীর জন্য দিয়ে যাওয়ার চমকটিও গল্পে ছিল। মানে সেখানেই গল্পেরও শেষ, সেখানেই ছবিরও শেষ।
আরও পড়ুন
মানিক বন্দ্যোর গল্প থেকে মানিকবাবুর না-হওয়া ছবি
এ তো গেল গল্পে আর ছবিতে, দুই জায়গাতেই যা-যা আছে, তার কথা। লক্ষণীয় এবার কী কী নেই? মানে ছবি তৈরি করার সময়ে বাইরের গল্পের অংশে প্রায় কিছুই যোগ করেননি সত্যজিৎ। ছবিতে শুধু যেটা যোগ করলেন, তা হল সত্যজিতের নিজস্ব একটা ভাবনার জগৎ। ইতিহাস, সভ্যতা, ধর্ম, আধুনিকতা, অগ্রগতির মানদণ্ড ইত্যাদি নিয়ে তাঁর বিশ্বদর্শন যেন ওই গল্পটিকে এক অন্য শিখরে পৌঁছে দেয়। গল্পের বহিরঙ্গ নয়, একটি গল্পকে আশ্রয় করে একজন যথার্থ শিল্পী, একজন বড়োমাপের ব্যক্তি তাঁর চিন্তার জগৎকেই যে একটি ছবির মুখ্য বা কেন্দ্রীয় বিষয় করে তুলতে পারেন, এই ছবি যেন তারই নিদর্শন। সভ্যতার সংজ্ঞা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে দিতে পারে এই ছবি। সেই ক-বে, ‘পথের পাঁচালী’ ছবি করারও আগে, ১৯৫০ সালে, সত্যজিৎ ভিন্ন এক প্রসঙ্গে মৃদু কিন্তু প্রখর ব্যঙ্গে বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞান গবেষণায় অকল্পনীয় উন্নতির পরিণতি ঘটেছে পরমাণুর চরম বিস্ফোরণে’। মনের মধ্যে থেকে-যাওয়া সেই ভাবনাটিই এতদিন পরেও ছবির সংলাপ হয়ে পুনরায় ফিরে এলো মনমোহনের সংলাপে। ছবির মনমোহন আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত ক্যানিবালিজম্ সম্পর্কে বলেন, ‘সভ্য? সভ্য কোথায়? বর্বর! বার্বেরিক! সভ্য কে জানেন? সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ, যে আঙুলের একটি চাপে একটি বোতাম টিপে একটি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে সমস্ত অধিবাসীসমেত একটি গোটা শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। আর সভ্য কারা জানেন? যারা এই অস্ত্র-প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারে উইদাউট টার্নিং এ হেয়ার।’ এক বিরাট সত্যোপলব্ধির অভিজ্ঞতা আর ইতিহাস-বিজ্ঞান আর মানবসভ্যতা সম্পর্কে তাঁর ভাবনা আর মন্তব্যে পৌঁছে যায় যে ছবি, ভাবাই যায় না তার অবলম্বন কত সামান্য একটি গল্পসূত্র!
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
সত্যজিতের চিত্রনাট্যের কর্মশালা