মানিকলমকারি – ১৩
আগের পর্বে
‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ থেকে শুরু করে ‘সোনার কেল্লা’ কিংবা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। সত্যজিতের গল্পে বারবার ফিরে এসেছে ভণ্ড সাধুদের কারসাজির ছবি। আবার ‘বহুরূপী’ বা ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপে’ সন্ন্যাসী চরিত্রকে দেখানো হয়েছে অন্যভাবে। সেখানে একরকমের মজা যেমন আছে, তেমনই রয়েছে তাঁদের আশ্চর্য ক্ষমতার উল্লেখও। আবার তাঁর শেষের দিকের ছবি ‘আগন্তুক’-এ চরিত্র মনোমোহন মিত্রের কণ্ঠে ফুটেছে কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামের খানিক অংশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সন্ন্যাসীচরিত লিখতে গিয়ে সত্যজিতের মন-মেজাজের বদল হয়েছে স্পষ্টভাবেই।
আজ একেবারেই অন্য এক কলমকারির কথা। কলমে লেখাও হয়, আঁকাও হয়। আজ ওই দ্বিতীয় কাজের গল্প।
সত্যজিতের ছেলেবেলার কথা 'যখন ছোট ছিলাম'- এ তিনি নিজেই বলেছিলেন, তাঁর ছেলেবেলায় ছিল এক সই-সংগ্রহের খাতা। সেই সই-বইয়ের খাতাটি তিনি যখন কেনেন, তখন তাঁর বয়স বছর নয়। লিখেছিলেন, "গিয়েছিলাম শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলায়। নতুন অটোগ্রাফের খাতা কিনেছি, ভীষণ শখ তার প্রথম পাতায় রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে একটা কবিতা লিখিয়ে নেবো।" তাঁর ছেলেবেলার সেই সই সংগ্রহের কাহিনি সকলেরই জানা। সকলেই জানেন, সেই খাতায় শিশু সত্যজিতের জন্য কবি লিখে দিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা, "বহু দিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে"। তারিখ ছিল সাতই পৌষ ১৩৩৬। মানে ১৯২৯-এর ডিসেম্বর মাসের তেইশ। অবশ্য এর আগেই সেই খাতায় আশ্বিনের ৬ আর ২১-এ সত্যজিতের নিনিদিদি, মানে নলিনী রায়, পরে যিনি নলিনী দাশ আর তাঁর মেজো পিসিমা, মানে, পুণ্যলতা চক্রবর্তী মানিকের প্রতি তাঁদের স্নেহাশিস জানিয়ে সই করেছেন। সাতই অক্টোবর ১৯২৮-এ কবিতা লিখে, সই করেছেন, তাঁর রুবিদিদি। মানে, কল্যাণী কার্লেকর। সেখানে অপূর্ব সুন্দর এক বটগাছের ছবি এঁকে দিয়েছিলেন লীলা মজুমদার, সত্যজিতের লীলুপিসি। এইসব ছবি আর ছড়া আছে 'যখন ছোট ছিলাম'-এ। তার মানে, খুদে সত্যজিৎ বাড়ির সবাইকে দিয়ে লেখাচ্ছেন, কিন্তু প্রথম পাতাটি কবিগুরুর জন্য ছাড়া।
এই রকম সই সংগ্রহের গল্প তিনি আবার বলেছিলেন 'ভক্ত' নামের গল্পটিতে। শিশু সাহিত্যিক অমলেশ মৌলিক ভেবে জীবন বিমার চাকুরিজীবী অরূপরতন সরকারের কাছে অমলেশবাবুর ভক্তরা তার কাছে চেয়েছিল সই। কিন্তু অন্যের সই নিজে কী করেই বা করে সে, তাই মৌলিকের ভক্তদের কাছে অরূপবাবু কিছু কিছু ছবি এঁকে দেয়। আর এই গল্পের শেষে আসল অমলেশের কাছে তাঁর বইতে সই করিয়ে নেয় অরূপবাবু। এর সঙ্গেই মনে পড়বে সোনার কেল্লা-তে তোপসেকে বই উপহার দেওয়ার সময় আর জয় বাবা ফেলুনাথ ছবির শেষে খুদে রুক্মিণীকুমারকে নিজের লেখা বই উপহার দেওয়ার সময় জটায়ু নিজের নাম স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন। এ যেমন এক রকমের স্বাক্ষর, তেমনই নিজের আঁকা ছবির নীচে স্বাক্ষর করার একটা ব্যাপারও তো আছে।
সেই 'টিনটোরেটোর যিশু'- কাহিনিতে নিজের আঁকা ছবির নীচে শিল্পী চন্দ্রশেখর নিয়োগীর স্বাক্ষরে "এস নিয়োগী" দেখে ফেলুদা জিজ্ঞাসা করে, "এস নিয়োগী লেখা দেখছি কেন? ওঁর নাম তো ছিল চন্দ্রশেখর।" জানা যায়, ইতালিতে গিয়ে বাঙালি চন্দ্র-ই গ্রহণ করে রোমান নাম স্যানড্রো। আরেকটি ছোটগল্প 'মানপত্র'-তেও বেশ সুন্দর দুটো সইয়ের মধ্য দিয়ে দুটি মানুষের কথা বেঁধেছিলেন লেখক সত্যজিৎ। শেষ মুহূর্তে ছোটো ক্লাবের সংবর্ধনার প্রস্তাব খারিজ করে চিঠি পাঠালেন ফিল্মস্টার সমরকুমার। গল্পকারের ভাষায়, "হ্যাঁ, সমরকুমারেরই সই বটে, ফিল্ম পত্রিকার দৌলতে এই সই কারুর চিনতে বাকি নেই--- বিশেষ করে হ্রস্ব উ-এর ওই ডবল প্যাঁচ।" ফিল্মস্টার এইভাবে ডোবানোর পরে, ঠিক করা হল, সংবর্ধনা দেওয়া হবে এক সময়কার এক অলংকরণশিল্পী, এখন সকলের কাছে ভুলে যাওয়া নাম, হরলাল চক্রবর্তীর নাম। কিন্তু কে ইনি? কারো মনে যখন পড়ল না এক অখ্যাত অলংকরণ শিল্পী হরলাল চক্রবর্তীর নাম; তখন কারো কারো মনে পড়ে ছেলেবেলায় ছোটদের কাগজে ছাপা ছবির নীচে নাম সই থাকত বটে, এইচ চক্রবর্তী। মানুষটিকে চেনে না কেউ, চেনে তাঁর কাজ আর সই।
আরও পড়ুন
বিরিঞ্চিবাবা আর ভবানন্দের চ্যালাদের বদল-বৃত্তান্ত
সত্যজিতের নিজের স্বাক্ষরের কলমকারি তো বিশ্ববিখ্যাত। সেই প্রবাদপ্রতিম স্বাক্ষর বাদ দিয়েও, নিজের ছবির রেখা-অনুযায়ী কত ধরনের আলাদা আলাদা সই-ই না তিনি করতেন।
আরও পড়ুন
মানিক বন্দ্যোর গল্প থেকে মানিকবাবুর না-হওয়া ছবি
যেখানে ছবির রেখার ঘনত্ব বেশি, সেখানে টানা রেখায় সই আর যেখানে ছবিতে ব্যবহৃত রেখার মধ্যে দূরত্ব থাকে, সেখানে নামের হরফগুলির মধ্যেও রাখেন দূরত্ব। এটা একটা মূল হিসেব, তার বাইরেও নিজের আঁকা ছবিতে আরো কত না তাঁর স্বাক্ষরের বৈচিত্র্য। এই কথা ভাবতে গিয়ে মনে হল, আচ্ছা, সত্যজিৎ কবে নিজের ছবির সঙ্গে সই করতে শুরু করলেন? নিজের আঁকা প্রথম দিকের অলংকরণে সই করতেন না সত্যজিৎ, সাধারণভাবে নিজের আঁকা প্রচ্ছদেও তিনি কখনোই সই করতেন না। তবে কীমাশ্চর্যম্!! তিনি তাঁর আঁকা একেবারে প্রথম প্রচ্ছদটিতে সই করেছিলেন। তাও আবার ইংরিজিতে। তখনো তিনি কলাভবনের ছাত্র। ১৯৪১-এ এম সি সরকার থেকে প্রকাশিত সুকুমার রায়ের 'পাগলা দাশু'-র প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ। সেটিই তাঁর আঁকা প্রথম প্রচ্ছদ। সেখানে ছবির কোণে একটু নজর করলে দেখা যায়, সত্যজিৎ নিজের নাম সই করে একটানে লিখেছিলেন, এস রে। এইভাবে আর কখনো তিনি নিজের নাম স্বাক্ষর করেননি। 'এস আর' লিখেছেন, কিন্তু 'এস রে' লেখেননি। আর এটাই তাহলে তাঁর নিজের কোনো কাজে প্রথম নাম-সই।