মানিকলমকারি – ১২
আগের পর্বে
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মানিক অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়। এই দুই মানিকের যুগলবন্দি দেখার সুযোগ হয়নি রুপোলি পর্দায়। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ থেকে সত্যজিৎ ছবি করবেন ভেবেছিলেন এমনটাও শোনা যায়। তবে সত্যজিৎ তাঁর লেখা ‘পথের পাঁচালী’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন এই সিনেমার আগেই তিনি তিনটি চিত্রনাট্য লেখা সম্পূর্ণ করেছিলেন। যার মধ্যে একটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘বিলামসন’। এমনকি এগিয়েছিল ছবি করার কাজও। কিন্তু পূর্ণতা না পাওয়া সেই চিত্রনাট্য কোথায় হারিয়ে গেল?
এ এক বেশ মজার ব্যাপার। ছবি বানানো শুরু করার প্রথমদিকে সত্যজিৎ বানিয়েছিলেন ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’। পরশুরামের গল্প থেকে সেই বিখ্যাত বিরিঞ্চিবাবার গল্প। এই বিরিঞ্চিবাবা ছিলেন এক ভণ্ড সন্ন্যাসী। সেই ভণ্ড সন্ন্যাসীর উত্তরকালীন সংস্করণই বুঝি ‘সোনার কেল্লা’ - ছবির নকল হাজরা অমিয়নাথ বর্মনের ভবানন্দের ছদ্মবেশধারণ। বিরিঞ্চিবাবা কথায় ভুলিয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানাত আর এই ভবানন্দের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। সে কী করত? ‘সোনার কেল্লা’ গল্পে সিধুজ্যাঠা বলেছিলেন, আসল ডাক্তার হেমাঙ্গ হাজরার কাগজে যে খবর বেরিয়েছিল, সেখানে দেখা যায়, খাস শিকাগো শহরে এক ‘চরম ছোটোলোক’ বাঙালি ‘এক আধ্যাত্মিক চিকিৎসালয়’ খুলে বসেছিল, তার কাছে যে সব মার্কিন খদ্দের জুটেছিল, তাদের ওপর ‘হিপ্নোটিজম অ্যাপ্লাই করে দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়ে দেবে বলে ক্লেম করেছিল’। সেই ‘চরম ছোটোলোক’ বাঙালি বুজরুক নাম নিয়েছিল ‘ভবানন্দ’। ‘সোনার কেল্লা’ গল্পে এই ভবানন্দের চ্যালা ছিল মন্দার বোস আর তার গল্পতুতো চ্যালা হল ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর মছলি বাবা। আশ্চর্যভাবে দুই গল্পেই দুই সন্ন্যাসীর কথা আর দুইজনই ভণ্ড-শিরোমণি। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ সিনেমার মছলিবাবার খেলা তবু অল্পের ওপর মিটেছিল, কিন্তু মূল গল্পের মছলিবাবা তো দশাশ্বমেধ ঘাট থেকে দশমীর দিন গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে কত কাণ্ডকারখানাই না করেছে। সে একেবারে ঘটনার ঘনঘটা।
সত্যজিতের লেখায় এমন সন্ন্যাসীর তো বেশ ছড়াছড়ি। সকলে যে এমন বুজরুক, তা নয়। তবে অনেকেই হয়ত খাতায়-কলমে বা অন্যভাবে বললে, দলিল-দস্তাবেজি হিসেবে নকল হলেও, তাদের ওপর এক ধরনের পাঠকের সহানুভূতি নানাভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখেন লেখক। ফেলুদার অন্য একটা গল্প 'ছিন্নমস্তার অভিশাপ'-এই ধরা যাক, হাজারিবাগের পটভূমিতে, ফেলুদার মক্কেল মহেশ চৌধুরি সম্পর্কে ফেলুদার মনে হয়, ‘মহেশবাবু কি সাধু সংসর্গ- টর্গ করেন নাকি?’ কারণ, তাঁর ঘরে ছিল জনৈক মুক্তানন্দের ছবি। মহেশ তাঁর বন্ধু অখিলবাবুর পরামর্শে এই মুক্তানন্দের ছবি রাখেন তাঁর ঘরে, দেখাও করেন তার সঙ্গে। মহেশ সারাজীবন ধর্মকর্ম না-মেনেও শেষ বয়সে এই মুক্তানন্দের ছবি রাখলেন তাঁর ঘরে। অখিলবাবুর কথায়, ‘মুক্তানন্দের প্রভাব খারাপ হবে না। তিনটি মহাদেশে এঁর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে’। পরে জানা যায়, এই সন্ন্যাসীই আসলে মহেশবাবুর উনিশ বছর বয়সে ঘর-ছেড়ে চলে-যাওয়া মেজো ছেলে, বীরেন্দ্র বা দুরি। সেই দুরি বা এখন তিন মহাদেশে প্রভাব-বিস্তারকারী সন্ন্যাসী ছেলেবেলায় কেমন ছিল? গল্পে তার বন্ধুর কথায় জানা যায়, তার ‘পড়াশুনায় মন ছিল না। সে ছিল বেপরোয়া, রোমান্টিক প্রকৃতির ছেলে।’ গল্প যারা পড়েছে, তারা জানে, এই সন্ন্যাসীও আসলে জাল-সন্ন্যাসী। সেও পরচুলা-পরা সন্ন্যাসী। আর তার একেবারে অন্য পরিচয়ও আছে সেটা নয়, গল্পের পাঠকদের জন্য তোলা থাক। কিন্তু সত্যিকারের এই ভণ্ড-সন্ন্যাসীর প্রতি কিন্তু পাঠক হিসেবে আপনার ক্ষোভ জন্মাবে না, বরং সহানুভূতিই তৈরি হবে।
জয়বাবা ফেলুনাথ ছবি করার পাশাপাশি প্রায় সেই সময়েই ১৯৭৮ সালে লেখা এই ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ কাহিনির আগে পরে আরো কত কাহিনিতে এমন সাজানো সন্ন্যাসীর ভিড়। তবে, সর্বত্র গল্পের মজাটাই হল, তাদের ভণ্ডামির দিকে নজর যাবে না। তারা সবাই অন্য রকম মানুষ। যেমন কিনা, ‘বহুরূপী’ গল্পের ভেতরে গল্পের নায়ক নিকুঞ্জ সাহার মজার খেলা হল মেক-আপ নিয়ে চেনা মানুষের কাছে অচেনা চেহারায় হাজির হওয়া। সেই খেলা খেলতে খেলতেই তার মনে হয়, ‘শুধুমাত্র তিনজন কি চারজন বন্ধুকে ঠকিয়েই কি তার কাজ শেষ?’ সেইসূত্রেই স্বয়ং কালিকানন্দ স্বামীর সামনে আরেক নকল সন্ন্যাসী সেজে হাজির হতে চায় নিকুঞ্জ। সন্ন্যাসীর মেক আপ নিয়ে সে পৌঁছে যায় একেবারে তারাপীঠে। এমন চমৎকার তার সে সাজ, যে তার সেই দুর্দান্ত সাজ দেখে তার চেনা মানুষও বলে বসে, ‘ওফ নিকুঞ্জদা এ যা হয়েছে না--- কার বাপের সাধ্যি তোমাকে চেনে। নেহাত তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি বলে, নইলে আমিও ব্যোমকে যেতুম।’ এই নতুন সাজে নিকুঞ্জ নাম নেয় ঘনানন্দ। কেউ বুঝতে না পারলেও, তার এই অসাধারণ সাজ মাঠে মারা যায় আর কারো কাছে না, স্বয়ং কালিকানন্দের কাছে। তিনি তাকে দেখেই বলে ওঠেন, ‘বাবাজির ভেক ধরা হয়েছে? গেরুয়া পরলেই সাধু হয়? গলায় মালা পরলেই সাধু? গায়ে ছাই মাখলেই সাধু? অ্যাঁ? তোর আস্পর্ধা তো কম নয়। তোর জটা ধরে যদি টান দিই, তখন কী হবে? কোথায় যাবে তোর সাধুগিরি?’ এক আসল সন্ন্যাসীর কাছে, এই নকল সন্ন্যাসী ধরা পড়ে যায়। গল্পটা নকল সন্ন্যাসীর কাহিনি বলে কিন্তু পড়ুয়াদের মনে থাকে না--- গল্পটা এক মজার চেহারা নেয়। আর আসল সন্ন্যাসীর আশ্চর্য ক্ষমতার কথাটাও মনে থেকে যায়। এই সূত্রেই মনে পড়ে যাবে, সুবোধ ঘোষের লেখা একই নামের অন্য গল্প ‘বহুরূপী’-র কথা। সেখানে বহুরূপী হরিদাও সাজে সন্ন্যাসী। তবে সে গল্পের স্বাদ একেবারে অন্য রকম। সেখানে সন্ন্যাসীর সাজ নিয়ে নিজের ভেতরের মনটাও যেন বদলে যায় নকল সন্ন্যাসী হরিদা-র।
আরও পড়ুন
মানিক বন্দ্যোর গল্প থেকে মানিকবাবুর না-হওয়া ছবি
আরও পড়ুন
সত্যজিতের চিত্রনাট্যের কর্মশালা
সত্যজিতের প্রায় শেষপর্বের গল্প ‘নিতাই ও মহাপুরুষ’-এ ফিরে আসবেন এক মহাপুরুষ। এও এক অদ্ভুত মহাপুরুষ জীবানন্দ মহারাজ। কলকাতা-কাঁপানো এই মহাপুরুষ একই সঙ্গে বাগ্মী, তাঁর গীতার ব্যাখ্যা শুনে লোকে মোহিত হয়ে যায়, তাঁর চরণস্পর্শ পেলে ভক্তরা নিজেদের ধন্য মনে করে। এহেন ‘মহাপুরুষ’-এর সামনে উপস্থিত হয়ে অকস্মাৎ তাকে নিজের ছোটবেলার বন্ধু হিসেবে চিনে ফেলেন নিতাইবাবু। এ তো তাঁর ছেলেবেলার সেই বন্ধু শ্রীনাথ ওরফে ছেনো! সে ছিল ‘ইস্কুলের নামকরা শয়তান ছেলে। তিনবার পরপর প্রোমোশন না পেয়ে অবশেষে নিতাইয়ের সহপাঠী হয়।… তবে তার চেহারাটা ছিল ভালো, ভালো গান গাইত আর ভালো অ্যাক্টিং করতে পারত।’ সেই ছেনো ফিরে এসেছে জীবানন্দ স্বামী হয়ে। যে ছেনো তাকে ছেলেবেলায় নানাভাবে হেনস্থা করে গেছে অনবরত, যে ছেনোকে নিতাই চেনে অত্যন্ত ধূর্ত একটি ছেলে হিসেবে, সেই ছেনোই ফিরে এসেছে কি না অন্য চেহারায়। সবটা বুঝতে পেরেও তার সত্যিকারের চেহারা কি প্রকাশ করে দেয় নিতাই, সেটাই গল্পের শেষের চমক।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের বইতে ‘এ কাহাদের কণ্ঠস্বর?’
এই নিতাই যে প্রথম ওই জীবানন্দ স্বামীর কাছে যায়, তার কারণ সে নিজেকে ‘মাঝারি’-র দলে ফেলে। আবার ‘নিধিরামের ইচ্ছাপূরণ’ গল্পের নিধিরামেরও সমস্যা যেটা, সেটা হল তার মনে ‘অনেক অপূর্ণ বাসনা আছে। শুধু অপূর্ণ বাসনা নয়, ঈশ্বর তাঁকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন তাতেও তাঁর আপত্তি।… নিধিরাম নিজের চেহারা সম্পর্কেও সন্তুষ্ট নয়’। নিজেকে নিয়ে নিয়ত অসন্তুষ্ট-থাকা নিধিরাম আর নিতাইয়ের জীবনে দুইভাবে দুই সন্ন্যাসী প্রভাব বিস্তার করে যান। নিতাইয়ের সেই ছেলেবেলার দুষ্টু বন্ধু একভাবে তাকে অনেকটা বড়ো করে দেয় আর এই নিজের সম্পর্কে অসন্তুষ্ট নিধিরামকে পুরীর সমুদ্রের তীরে এক সন্ন্যাসীর হঠাৎ-বলা কিছু কথা অকস্মাৎ বদলে দেয় তাকে, সে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে।
আরও পড়ুন
এক গল্পই দু-বার দু-ভাবে লিখলেন সত্যজিৎ
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস-৩
যাঁরা সত্যজিতের ছবি নিয়ে মনোযোগ দিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা বলেন, সত্যজিতের শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এ কাহিনিকার, পরিচালক সত্যজিৎ কিছুটা হলেও পরলোক, ঈশ্বর, ভক্তি নিয়ে কথা বলেন। যে সত্যজিৎ সারাজীবন মোটের উপরে নাস্তিক, তিনিও কিনা নিজে মনোমোহন মিত্রের কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামের দুই চরণ--- এ যেন এক নতুন সত্যজিতের সন্ধান। কিন্তু লেখক সত্যজিতের এই কাহিনিগুলি পড়তে পড়তে, সত্যজিতের পাঠক কি ১৯৯১-তে ‘আগন্তুক’ তৈরির বহু আগেই ধীরে ধীরে একজন অন্য সত্যজিতের সন্ধান পাচ্ছিলেন না? এই পর্বের মানিকলমকারি-র পাঠক লক্ষ করবেন, যে গল্পগুলির কথা বললাম, সবই কিন্তু তাঁর শেষ পর্বের গল্প। তাই সত্যজিতের গল্পখোর পাঠক যাঁরা, তাঁদের কাছে, সেই ‘আগন্তুক-পর্ব’ নিশ্চয়ই আকস্মিক ছিল না। লক্ষণীয়, নিজের কেরিয়ারের প্রথম পর্বে তৈরি বিরিঞ্চিবাবা, মধ্যপর্বে তৈরি ভবানন্দ- মছলিবাবা থেকে ক্রমশ অন্য রকমের সন্ন্যাসীচরিত লিখছিলেন তিনি আর সেখানেই যেন তাঁরও মন-মেজাজের বদল-বৃত্তান্ত লুকিয়ে আছে।
Powered by Froala Editor