ইতি সত্যজিৎদা—

তারিখটা ১২ এপ্রিল ১৯৯৬। বিজয়া রায় একটি চিঠিতে লিখলেন, ‘দেখতে দেখতে চারটা বছর হতে চল্ল, ভাবা যায়? এবার তো উনি থাকলে ওঁর ৭৫ বছর বয়স হত! এখনও বিশ্বাস হতে চায় না যে, যে মানুষটি ১০০ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন, তাঁকেই চলে যেতে হল। কতবার বলেছেন আমাকে, ‘‘Gift of life টা কি precious, আর সেইটা নিয়ে মানুষ কি ছিনিমিনি খেলে--- কত কি করা যায়, কত কি করার আছে?’’ কথাগুলো আমার কানে বাজে, সব সময়।’ লেখাটি ভারি দরকারি। বিজয়া রায় এইভাবে কি আর কোথাও, আর কারো কাছে বলেছেন সত্যজিৎ সম্পর্কে! যার কাছে লিখছেন বিজয়া এই কথা, তিনিও তাহলে তেমনই দুজনের কাছের মানুষ! এতটাই কাছের আপনজন তিনি, যে তাঁকে ওই চিঠিতে লিখলেন বিজয়া, ‘আমরা যারা অতি সাধারণ মানুষ, বেঁচে রইলাম আর অত বড় একজন creative genius-কে চলে যেতে হল--- এ দুঃখ ভোলার নয়। কারুকে এসব কথা বলি না, তুমি বুঝতে পারবে বলে, তোমাকে বলছি।’ বিজয়া রায় ‘মঙ্কুদি’ নাম-স্বাক্ষরিত এই চিঠিটি লিখেছিলেন জনা-কে--- নীলাঞ্জনা সেনকে। সেই চিঠির পিছনের পৃষ্ঠায় নীলাঞ্জনা সেনকে লেখা সত্যজিতের একান্নটি চিঠি ছাপার অনুমতি দিয়েছিলেন বিজয়া। তিনি থাকতেন শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লীতে। সেখানে ১৯৭২-এর ১৯ ডিসেম্বর থেকে ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ পর্যন্ত লিখেছেন চিঠি--- আর সেইসব চিঠি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। সে এক নতুন সত্যজিতের কলমকারির নিদর্শন। আমরা আগেও বলেছি, আবার মনে করিয়ে দিই, এই পত্রলেখক সত্যজিতের সম্পূর্ণ পরিচয় উন্মোচিত হওয়া দরকারি। এই জনাকে সত্যজিৎ চিঠিতে লিখেছিলেন কত রকম বিষয়। কখনো জানা যাচ্ছে, ‘সুকুমার সাহিত্য সমগ্র’- ভূমিকা লেখার জন্য সত্যজিৎকে পড়তে হয়েছে সুকুমারের লেখাগুলি নতুন করে--- ‘বাবার অনেক লেখা আবার নতুন করে পড়তে হল। সংকলনটা ভালো হবে মনে হয়।’ কখনো চিঠি লিখতে দেরি হওয়ার কারণস্বরূপ লিখছেন নিজের অসুস্থতার কথা। ১ অগস্ট ১৯৭৩-এ মজা করে বলছেন, ‘তোমায় যে এতদিন চিঠি লিখতে পারিনি সেটা ব্যস্ততার জন্য নয়--- অসুস্থতার জন্য। সাইনাস ও ফ্লুয়ের যুগপৎ আক্রমণে প্রায় সাতদিনের জন্য বিছানা নিতে হয়েছিল। তাও হয়ত কাজ করতাম, কিন্তু চোখের যন্ত্রণার জন্য সেটা সম্ভব হয়নি।’

ঘরে বাইরে’ থেকে চিত্রনাট্য করার পরেও ছবি তৈরি করতে কোথায় বাধছিল সত্যজিতের, তার একটি অন্য রকম ইঙ্গিত আছে এই পত্রধারায়। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩-এ তিনি জানালেন, ‘যদ্দূর মনে হচ্ছে ঘরে বাইরে হল না এ যাত্রা। হয়ত শাপে বর হয়েছে। নতুন করে একাধিকবার বইটা পড়ে, মনে হচ্ছিল শেষের দিকে মুসলমান সংক্রান্ত কয়েকটা গোলমেলে ঘটনা আছে যেগুলোকে বোধ হয় কোনোভাবেই ম্যানেজ করা যেত না। (নিখিলেশের মৃত্যু হয় মুসলমানের হাতেই)।’ সত্যজিতের এই রবীন্দ্র-উপন্যাস পড়াটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কেন তাঁর ওই টেক্সট থেকে এমন মনে হল, প্রশ্ন থাকতে পারে তা নিয়েও। তবে এমন একটা পাঠ-ই যে তাঁর মনের মধ্যে ছিল, সেটা জানা জরুরি ছিল। আর এই পত্রধারা সেই জানার পথটা করে দেয়। ছবি করার বাধা নিয়ে কথা বলেছেন সত্যজিৎ। জনাকে চিঠিতে জানালেন, ‘সোনার কেল্লা’ করার জন্য এগিয়ে এসেও এক প্রযোজক শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে গেলেন, সত্যজিতের নিজস্ব ভাষায়, ‘হঠাৎ পিছিয়ে গিয়ে আমাকে একেবারে পথে বসিয়ে দিলেন’। গুপি-বাঘার ছবি করার সময়েও ইনিই পিছিয়ে গেছিলেন, তাই পত্রলেখক লিখলেন, ‘সেই একই লোক একই কথা বলে (‘নায়িকা নেই, প্রেম নেই’) এবারেও ডোবালেন’। লক্ষণীয় চিঠির ভাষা--- ‘পথে বসিয়ে দিলেন’ বা ‘এবারেও ডোবালেন’--- কথাগুলো বেশ অন্য রকম গদ্যের ইঙ্গিতবাহী।এই চিঠিতেই সত্যজিৎ স্পষ্টত জানিয়েছিলেন, রাজ কাপুরের বিখ্যাত ‘ববি’ ছবিটি সম্পর্কে তাঁর মতামত। তেইশে নভেম্বর ১৯৭৩-এ মেট্রোতে সত্যজিৎ দেখেছিলেন। দেখে লিখলেন, ‘যেতে হয়েছিল। নির্লজ্জ কমার্শিয়াল ছবি--- কিন্তু ডিম্পল কাপাডিয়া অসম্ভব রকম ভালো। যেমন চেহারা, সেরকম ট্যালেন্ডেড। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে খুব ভুল করেছে মেয়েটা।’--- এই সত্যজিৎকে তো তাঁর প্রবন্ধের পাঠক জানবেন না, এ তো পত্র-পাঠকের প্রাপ্তি।

নীলাঞ্জনা সেন ও তাঁর 'সত্যজিৎদা'

 

পত্র-প্রাপক নীলাঞ্জনা সত্যজিৎকে চিঠি লিখতেন নিশ্চয়ই, ‘সত্যজিৎদা’ সম্বোধনে। তাই সত্যজিতের প্রায় সব চিঠিতে তিনিও নিজে নাম লিখেছেন ‘সত্যজিৎদা’ বলেই। এমনকি, একটি চিঠির শেষে অভ্যাসবশত নিজের নামে ‘মানিকদা’ লিখেও তারপরে নীচে বন্ধনীর মধ্যে ছোটো করে লিখেছেন, ‘ভুলে যাই যে, তুমি আমার ডাকনামটা ব্যবহার করো না’। কত আন্তরিক এক সম্বোধন আর চিঠি লেখার ভাষা ওই অসামান্য ব্যক্তিত্বের। নীলাঞ্জনার বিয়ের পর তাকে লিখলেন, ‘ভাই জনা, তোমার চিঠি পেলাম। তুমিও--- Sorry--- তোমরা দুজনেই আমার নতুন বছরের শুভেচ্ছা নিও।’ জনা যখন সন্তানসম্ভবা, তখন সেই সুখবর পেয়ে লিখছেন, ‘মা হতে চলেছ সেটা সুখবর। ঘটনাটা কবে ঘটবে, সেটার একটু আন্দাজ দিলে ভালো হয়। ‘অসুখের’ কারণটা জানতে পেরে নিশ্চিন্ত লাগছে।’ জনা তাঁকে পাঠিয়েছে নিজের হাতে-তৈরি কাপড়। কিন্তু সেটা দিয়ে জামা তৈরি করতে পারেননি সত্যজিৎ। সে কথা জানালেন প্রেরককে। বললেন, ‘তুমি যে বাটিকের কাজ করে কাপড়টা দিয়েছিলে, সেটা সম্বন্ধে তোমার মনে স্বভাবতই যে প্রশ্ন আর অভিযোগ রয়েছে, সেটার উত্তর হল, কাপড়টা আমার হাফশার্টের পক্ষেও একটু কম হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ওটাকে হয়ত স্কার্ফ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। আমাকে শার্ট বানানোর জন্য কাপড় দিয়ে এ ভুলটা আরো অনেকেই করেছে, তুমিই প্রথম না।’ শেষে সত্যজিৎ জানালেন, ‘এ নিয়ে আমার আক্ষেপ তোমার চেয়ে কিছু কম নয়। কারণ কাজটা আমার সত্যিই ভালো লেগেছিল।’ একটি চিঠির ভাষা লিখে মনে হচ্ছে, যথেষ্ট আন্তরিক নয়, তাই সত্যজিৎ চিঠি শেষ করে, চিঠির মাথায় লিখে দিলেন, ‘চিঠিটা কাঠখোট্টা হয়ে থাকলে তার জন্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা দায়ী’।  

আরও পড়ুন
চিঠি লেখেন সত্যজিৎ

আরও পড়ুন
সত্যজিতের নাটক-কথা, নাট্য-কথা

এমন ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আন্তরিক কথা বলার পাশাপাশি নিজের এমন আসন্ন ছবি, যার কথা তখনো প্রেসকেও জানাননি, তার কথাও লিখেছেন সত্যজিৎ। বাইশে ডিসেম্বর ১৯৭৪-এ নীলাঞ্জনাকে চিঠিতে লিখেছেন তিনি, ‘যে ছবিটা করব বলে ভাবছিলাম, সেটা আসছে বছর শীতকালে হবে। হিন্দি ছবি--- ঊনবিংশ শতাব্দীর লক্ষ্নৌ-এর পটভূমিকা। গল্প প্রেমচাঁদের লেখা, নাম দ্য চেস প্লেয়ার্স। অসাধারণ গল্প এবং অত্যন্ত ভালো ছবি হয়।’ তখনো কাউকে জানাননি--- গুণমুগ্ধ পাঠিকার কাছে এই কথা বলে সাবধান করে বলছেন, ‘আমার প্রথম হিন্দি ছবি--- তাই কথাটা প্রচার করতে চাইছিলাম না। তুমি বারবার জিগ্যেশ করছিলে, তাই তোমাকে বললাম। আশা করব, তুমি আর কাউকে বলবে না।’ ছবির পাশাপাশি ফেলুদার বিখ্যাত উপন্যাস ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর লিখনপর্ব নিয়ে একটি অদ্ভুত তথ্য জানা গেল এই পত্রমালার একটি চিঠির পাতা থেকেই। ২৫ জুন ১৯৭৫-এ নীলাঞ্জনার কাছে সে চিঠি পৌঁছেছিল। এখানে সত্যজিৎ লিখছেন, ‘পুজোয় এবার ফেলুদা লিখবো না, সেটা সাগরদাকে বলেই দিয়েছিলাম। কিন্তু দেখছি যথারীতি আমার নাম ছাপিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে আমাকে ফোন করে জানিয়েছে যে আমার জন্য পাবলিকেশন ডেট একমাস পেছিয়ে দিয়েছে।’ ভাবা যায়, এমন একটি ঘটনাও তাহলে আছে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর পশ্চাৎপটে! কত রকম তথ্য আর সত্যে মোড়া এক মানুষ সত্যজিৎকে চেনার পাঠশালা এই পত্রমালা। ‘নন্দন’ প্রতিষ্ঠার পর সেটা সম্পর্কে নিজের আগ্রহের কথাও লিখছেন আবার তার পাশাপাশি নিজের সংশয়ের কথাও জানাচ্ছেন। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫-তে সরকারি উদ্যোগে ‘নন্দন’-এর উদ্বোধন করলেন তিনি আর ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫-তে লিখলেন, ‘নন্দন-এর উদ্বোধন সম্বন্ধে কাগজে দেখে থাকবে। ব্যাপারটা বেশ ইম্প্রেসিভ হয়েছে, কিন্তু ঠিক ভাবে চালাতে পারবে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’ 

আরও পড়ুন
টুনটুনি আর হেঁশোরাম-এর অনুবাদে সত্যজিৎ

আরও পড়ুন
মানিক এক অন্য লেখক

কখনো ব্যক্তিগত বিষয়, কখনো কাজের খবর, কখনো নিজের কিছু মনে হওয়া আবার কখনো নিজের সময়ের কোনো ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সামান্য মন্তব্য। চিঠির ভেতর দিয়ে এমন একজন অজানা সত্যজিৎকে পড়তে পারার আগ্রহও যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি তাঁকে জানার জন্য সত্যান্বেষী-মন। তবে চিঠি তো--- বিজয়া রায় অনুমতি দিলেও এই চিঠির কোথাও কোথাও এমন কিছু প্রসঙ্গ আছে, যা সত্যজিৎ সহজভাবে একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে তাঁর নিজস্ব পাঠিকাকে লিখেছিলেন কোনো বহুচর্চিত ছবি বা কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে। ধরা যাক, একটি ছবি সম্পর্কে বলেছেন, ‘পাকামিটা একটু বেশি মাত্রায় হয়ে’ গেছে, একটি ছবির পরিচালক সম্পর্কে বলেছেন, সে ছবিতে যে তিনি কী বলতে চেয়েছেন, সেটাই পরিষ্কার নয়, আর যেটুকু পরিষ্কার সেটাও বিশেষ গ্রহণযোগ্য নয়। একজন খ্যাতনামা অভিনেতা বেশি টাকা পাননি বলে, রাজি হননি ‘গণশত্রু’-তে ডাক্তারের ভাইয়ের চরিত্রটি করতে। এমন বেশ কিছু প্রসঙ্গ বর্তমান এখানে পত্রলেখকের স্পষ্টতায়। তবে সেই লেখাগুলি হুবহু এখনই প্রকাশিত হওয়া ঠিক কি না, তা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। হয়ত, সে এক নতুন ধরনের সম্পাদনার কথা বলবে আমাদের। তা ছাপা হবে কি না বা হলেও কীভাবে হবে, সেটা স্থির করাও দরকার। কিন্তু সে প্রসঙ্গ আমাদের এই লেখায় আপাতত বিস্তারিত না হয়ে, উহ্য-ই থাক।

সমগ্র সত্যজিতের কলমকারির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে এই ধারাবাহিকের যাত্রারম্ভ হয়েছিল, অনেকটা হল--- আরো বাকি রইল অনেক কিছু। সেই সব আসছে কোনো সময়ে আবার বসা যাবে আড্ডাতে। আপাতত মানিকলমকারির এই কিস্তির সঙ্গেই এই পর্যায়ের ইতি।    

Powered by Froala Editor