এ এমন এক সময়ে আমরা চলমান, যেখানে চিঠি-লেখার কাল প্রায় উধাও। সত্যজিতের কলমকারির এ এক অনাবিষ্কৃত প্রান্তর--- সত্যজিৎ চিঠি লেখেন। কে না জানে, সত্যজিৎকে চিঠি লেখার পর তার উত্তর পায়নি, এমন বাঙালি দুর্লভ। শত ব্যস্ততার ভেতরেও ঠিক সময় করে, গতে বাঁধা এক বয়ানে নয় বা কোনো ব্যক্তিগত সচিবের সাহায্যে লিখিত হওয়ার পরে তার নীচে স্বাক্ষর-অলংকৃত করে নয়, সত্যজিৎ তাঁর উদ্দেশে লেখা প্রতিটি চিঠির উত্তর দিতেন। সকলের জন্য আলাদা আলাদা তাঁর বক্তব্য, ফলত সে চিঠি নির্বিশেষ নয়, নির্দিষ্টভাবে বিশেষ ছিল তাঁর বক্তব্য। এই সত্যজিৎকে খুঁজতে চাওয়াটাও বোধ হয় দরকার। পূর্বের একাধিক কিস্তিতে আমরা বলেছি, মা সুপ্রভা রায়ের কাছে লেখা পুত্র সত্যজিতের শান্তিনিকেতন-বাস-পর্বের চিঠির কথা। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায় সে চিঠির নিদর্শন সম্প্রতি প্রকাশিত। এছাড়াও, কারিগর প্রকাশ করেছে ‘মানিকদার চিঠি দেবযানীকে’, ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায় ক-বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল বিশিষ্ট শিল্প-তাত্ত্বিক অশোককুমার দাসকে লেখা চিঠি, সম্প্রতি বিচিত্রপত্র থেকে প্রকাশিত ‘পত্রাবলী’-তে ‘সন্দেশ’-এর নিয়মিত লেখক অজেয় রায়কে লেখা সত্যজিতের চিঠি আবার ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ ছবির প্রযোজক সুরেশ জিন্দলকে ইংরাজিতে লেখা চিঠিপত্র সবগুলিই বিভিন্ন দিক থেকে উন্মোচন করে পত্রলেখক সত্যজিতের নানা রকম সম্বোধন, নানা রকম ভাষা, নানা রকম বক্তব্যকে। সেই চিঠি সত্যজিতের ভবিষ্যতের জীবনী লেখার উপাদান যেমন, তেমনই অন্তরঙ্গ সত্যজিৎকে চেনার এগুলি এক-একটি সুন্দর গৌরচন্দ্রিকাও বটে।
সম্পাদক সত্যজিতের মূর্তিকে চিনিয়ে দেয় অজেয় রায়ের প্রতি লেখা সত্যজিতের চিঠির অংশগুলি। সেই পত্রধারার প্রথম চিঠিটি লেখা হচ্ছে ১৯৭১ সালের ২৬ জুন। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার জন্য অজেয় রায়ের একটি লেখা, নাম ‘সাগর-গৌরব’ নির্বাচিত হয়েছে। নির্বাচন করে পাঠিয়েছেন লীলা মজুমদার। সত্যজিতেরও সে গল্প পড়ে ভালো লেগেছে। সে কথা জানিয়ে চিঠিতে লিখলেন, ‘গল্পটি ছাপার আগে একটা জিনিসের অথিন্টিসিটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দরকার। শেলস সম্পর্কে যা পড়েছি তাতে ‘কনিয়াস গ্লোরিয়া মারিস’-এর উল্লেখ অবশ্যই পেয়েছি। কিন্তু তার বিষাক্ততা সম্বন্ধে কোনো উল্লেখ দেখিনি।’ গল্পে উল্লিখিত এই বিষয়টি তথ্যগতভাবে নির্ভুল কি না জেনে নিতে চেয়ে সত্যজিৎ তাঁকে লিখলেন ‘এ জাতীয় গল্পের ডকুমেন্টারি দিকটা নির্ভুল হওয়া দরকার।’ এরপরের চিঠিতে এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরে সত্যজিৎ তাঁকে লিখলেন, সত্যজিৎ কী ধরনের রদবদল সেই গল্পের মুদ্রিত-পাঠে করেছেন তার উল্লেখ। লেখককে বুঝিয়ে দিলেন, গল্পকে ‘আরেকটু সংবদ্ধ ও সাসপেন্সফুল করার চেষ্টা’ করার কাজে তিনি কী করতে চেয়েছেন। বলেছেন, গল্প-বলার ব্যাপারে অজেয়বাবুর ‘একটা স্বাভাবিক ন্যাক আছে’ বলে সেখানে তিনি সামান্য বদল করলেও, অন্য একটি গল্পে কোন যুক্তিতে তিনি পাঠ-বদল করেছেন, তার কথাও বুঝিয়ে দিয়েছেন সত্যজিৎ। এই ৬ জুলাই ১৯৭১ সালে লেখা চিঠিটি সত্যজিৎ শেষ করলেন নিজের আরো গল্প লেখার ইচ্ছে নিয়ে। লিখেছিলেন, ‘আরো অনেক গল্প লিখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তাহলে ছবির কাজ বন্ধ করে লিখতে হয়। সেটাও ভাবতে ভালো লাগে না।’ এর বছর দুয়েক বাদে সত্যজিৎ লিখলেন, কী ধরনের লেখা লিখতে ভালো লাগে তাঁর--- সে কথাও। লিখলেন, ‘রহস্য-রোমাঞ্চ জাতীয় গল্পই যে পাঠক বেশি পছন্দ করে সেটা আমার প্রথম থেকেই বিশ্বাস।’ কত গভীরভাবে পাণ্ডুলিপি পড়তেন আর সে সম্পর্কে মন্তব্য করতেন সত্যজিৎ। ১৯৭৩-এর জুনে বললেন, অজেয় রায়ের একটি গল্পে ‘তুমি সোজা ম্যাজিকের পটভূমি তৈরি করে’ ‘শেষটায় ভূতের গল্পে চলে গেলে কেন।’ এই চিঠি লেখার এক হপ্তা পরে এই লেখা প্রসঙ্গেই আবার বললেন, ‘সেদিন তোমার ম্যাজিকের গল্প নিয়ে একটা খুঁৎখুঁতে চিঠি লিখেছি।’ নিজেই মনে করিয়ে দিয়ে, পত্রপ্রাপককে কিছু মনে না-করার এক সৌজন্যমূলক উচ্চারণ। তবে আগামী গল্পের পাণ্ডুলিপি পড়েও নতুন গল্পের কিছুকিছু খামতি নিয়ে একেবারে এক-দুই করে বুঝিয়ে দিলেন সম্পাদকমশাই। পুজো সংখ্যার লেখা বলে কথা, তবুও কিছু খামতি থেকে গেল, সে কথাও বলছেন আবার বলছেন, এক্কেবারে শেষ মুহূর্তে তিনি কিছু কিছু পরিবর্তন করছেন। অজেয় বাবুর অন্য একটি গল্প বেছে আবার সত্যজিৎ জানিয়েছেন এক-দুই করে মোট সাতটি গল্পে প্লটের সমস্যা নিয়ে। সম্পাদকীয় ভাষা ব্যবহার করে বলেছেন, গল্পে ‘মালমশলা খুব ভালো--- কিন্তু রন্ধনপ্রণালীতে অর্থাৎ প্লটিং-এ গণ্ডগোল।’ এই প্লটগত পরিবর্তন বিষয়ক পরামর্শ দিয়েছেন যেমন, তেমনই কখনো বলছেন ভাষায় ‘সঙ্গে’-র জায়গায় কক্ষনো ‘সাথে’ না লিখতে--- বলছেন, ‘ওটাতে লীলা মজুমদার এবং আমার দুজনেরই আপত্তি।’ অন্য একটি চিঠিতে লিখলেন, ‘কেবল একটি মুদ্রাদোষ সংশোধন করার চেষ্টা কোরো--- পরপর অতিরিক্ত ছোটো সেনটেন্স বারবার ব্যবহার কোরো না। দীর্ঘ বাক্যের একটা আলাদা মজা আছে, সেটাকেও আয়ত্তে আনা চাই। গল্পের টেনশন বাড়ানোর জন্য ছোটো সেনটেন্সের প্রয়োজন আছে বৈ কী। কিন্তু সেটা যত্রতত্র ব্যবহার করলে আসল জায়াগায় তার মজাটা খোলে না।’ পরামর্শ দিচ্ছেন, কেন ‘দাঁড়ির পরিবর্তে কমা-র ব্যবহার সম্পর্কে আরেকটু সচেতনতা’ দরকার। কোন লেখার নাম কী হবে, কী ধরনের নামকরণ ঠিক জমাটি হয় না--- তা বদল করা দরকার, পরামর্শ দেন তা নিয়েও।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের নাটক-কথা, নাট্য-কথা
সম্পাদক হিসেবে এই ধরনের পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি সমকালের একজন সহলেখক-রূপে জানাচ্ছেন কোন পত্রিকায় কবে কোন লেখা দিচ্ছেন, কখন হাতে লেখা থাকা সত্ত্বেও মাথায় তেমন কোনো গল্প বাসা বাঁধেনি--- তাও। এই ধরনের তথ্যাদি নেহাত তথ্যের ভূমিকায় গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই--- পাশাপাশি এই কথাগুলি দরকারি সমকালের সবচেয়ে নামজাদা লেখক হয়েও যে আন্তরিকতায় নিজের লেখার কথা প্রায় সমানে সমানে তাঁর সময়ের নবীন লেখককে জানান তিনি, সেদিক থেকেও। এ এক আশ্চর্য আন্তরিক উচ্চারণ।
আরও পড়ুন
টুনটুনি আর হেঁশোরাম-এর অনুবাদে সত্যজিৎ
এর সঙ্গেই রয়েছে নিজের ছবির লিখন-পর্ব বিষয়ে কিছু কথা। এই বিষয়ে বিভিন্ন চিঠিতে ‘সোনার কেল্লা’ ছবির চিত্রনাট্য বিষয়ে সত্যজিতের কথাগুলি পরপর সাজালে বেশ বোঝা যাবে এই কথা বলার ধরনটি কেমন।
আরও পড়ুন
প্রোফেসর শঙ্কুর চিত্রনাট্য
v ১৬ অক্টোবর ১৯৭৩-এ লিখছেন, ‘সোনার কেল্লার চিত্রনাট্য সবেমাত্র শেষ করেছি। ডিসেম্বরে শুটিং শুরু। অন্যের গল্প যেভাবে ঢেলে সাজাই, নিজেরটাও তাই করেছি। দুর্দান্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’
v ২৭ অক্টোবর ১৯৭৩-এ লিখছেন, ‘আমার আগামী ছবি সোনার কেল্লা। সে খবর হয়ত ইতিমধ্যে পেয়েছ। গল্প একেবারে ঢেলে সাজিয়ে মিস্ট্রি স্টোরির বদলে একটি কমেডি থ্রিলারে দাঁড় করিয়েছি। মনে হচ্ছে দারুণ হবে।’
v ১৯ জানুয়ারি ১৯৭৪-এ লিখছেন, ‘সোনার কেল্লার যেটুকু কাজ হয়েছে তা কুবই ভালো। অভিনয় এ ছবির অন্যতম আক্রষম হবে বলে মনে হয়। জটায়ুর ভূমিকায় অভিনয় করছেন সন্তোষ দত্ত। গল্পটা আর মিস্ট্রি স্টোরি নেই--- কারণ হুডানইট থেকে ভালো ছবি হয় না, শেষ পর্বের দীর্ঘ এক্সপ্লানেশনে ছবি থেমে যায়। ছবিতে তোপসের পয়েন্ট অফ ভিউ বদলে হয়ে গেছে পরিচালকের পয়েন্ট অফ ভিউ। অর্থাৎ ফেলুর কার্যকলাপের পাশে পাশে ভিলেনদের কার্যকলাপ দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দর্শক সবই জানবে। টেনশনটা আসবে--- ফেলু কখন কীভাবে জানতে পারবে সেই থেকে। এতে ছবি অনেক বেশি জমবে বলে মনে হয়।’
v ১০ এপ্রিল ১৯৭৪-এ লিখলেন, ‘সোনার কেল্লার আর তিনদিন শুটিং বাকি। কাজ করে খুবই আনন্দ পাওয়া গেছে--- মনে হয় ছবিটা জমবে। যারা মূল গল্পটা ভালো করে জানে, তাদের কাছেও ছবিটায় অনেক অপ্রত্যাশিত চমক থাকবে বলে মনে হয়।’
v এরপরে অজেয় রায় সোনার কেল্লা ছবিটি দেখে তাঁর ভালো লাগা আর কিছু প্রশ্ন সত্যজিতের কাছে পত্রমারফত জানাবার পরে, তার উত্তরে ১৬ মার্চ ১৯৭৪-এ সত্যজিৎ লিখছেন, ‘সোনার কেল্লা ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। ইচ্ছে আছে দু-বছরে অন্তত একটা করে বাচ্চাদের ছবি করব, না করার কোনো মানে হয় না।’ ছোটোদের ছবি বানানোর বিষয়ে সত্যজিতের এই ইচ্ছাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তারপরে লিখছেন, ছবিতে ‘ফেলুর ডিডাকশন সম্বন্ধে তোমার যে খটকাটা লেগেছে, সেটা সঙ্গত। এডিটিংয়ে ফেলু-তোপসের একটি দৃশ্য বাদ যাওয়াতেই ও ব্যাপারটা হয়েছে, যদিও তাতে ছবির কোনো বড়ো রকম ক্ষতি হয়নি বলেই আমার ধারণা।’ অজেয় রায়ের দিক থেকে লেখা চিঠিগুলি থাকলে, তাঁর ভাবনাটিও আমাদের কাছে সময় পার হয়ে পৌঁছতে পারত।
আরও পড়ুন
মানিক এক অন্য লেখক
অলংকরণ-শিল্পী সত্যজিতের আরেকটি সুন্দর সচেতনতার কথা বলে এবারের কিস্তি গুটিয়ে নেওয়ার পালা। ৩ জুন ১৯৭৭-এ সত্যজিৎ অনুজ লেখকের কাছে স্পষ্টত জানাচ্ছেন তাঁর লেখার সঙ্গে সত্যজিতের আঁকা ছবির স্বত্ব বিষয়ে। জানিয়েছেন, ‘তোমার গল্পের জন্য আমি যে ছবিগুলো আঁকি, সেগুলো বইয়ে ব্যবহাররে জন্য ঢালাও পারমিশন এখনই দিয়ে রাখছি, ভবিষ্যতে আর লিখলেও চলবে।’ সমকালের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলংকরণশিল্পী নিজের ছবি ব্যবহারের বিষয়ে এমন দ্ব্যর্থহীন অনুমতি দেওয়ার মধ্যে শিল্পীর ঔদার্যই লক্ষ করবেন উত্তরকালের পাঠককুল--- পরিচিত হবেন এক অন্য মনের মানুষ সত্যজিতের সঙ্গে। এই পত্রলেখক সত্যজিৎকে আরো বেশি করে জানা দরকার। সংকলিত হওয়া প্রয়োজন তাঁর আরো আরো চিঠিপত্র সুসম্পাদিত হয়ে। আজ অজেয় রায়কে লেখা সত্যজিতের কলমকারির খবর দিয়ে এই কিস্তি শেষ করা গেল। আগামী কিস্তিতে ব্যক্তি সত্যজিতের কিছু নতুন পত্রগত কলমকারির কথা বলে এই পর্যায়ের মতো মানিকলমকারি-র পাট গুটিয়ে নেওয়ার পালা।
Powered by Froala Editor