সত্যজিতের নাটক-কথা, নাট্য-কথা

দুটো সাক্ষ্য। দুটোর মধ্যে একটু তফাত আছে। জানা নেই কী করে তার সমাধান হবে আর। একটি স্বয়ং সত্যজিতের লেখা তরুণ বয়সের চিঠি। অন্যটি সত্যজিতের শান্তিনিকেতন পর্বের অন্যতম প্রিয় বন্ধু দিনকর কৌশিকের তখন বন্ধুনী, পরে স্ত্রী, পুষ্পা তারভের স্মৃতি। ১৮ জানুয়ারি ১৯৪১-এ সত্যজিৎ মা সুপ্রভা রায়কে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন ‘এখানে স্কুলের ছেলেদের দিয়ে হ-য-ব-র-ল স্টেজ করবার চেষ্টা করছে। আমাকে প্রোডাকশানে সাহায্য করার জন্য ডেকেছে। কিন্তু আমার মনে হয় ওটা করা ভয়ানক কঠিন হবে। আর তো কখনো ওটা স্টেজ হয়েছে বলে জানি না। দেখি কী হয়।’ অন্যদিকে বিশিষ্ট রবীন্দ্র-গবেষক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য মশাই লিখিত ‘এক দুর্লভ মানিক’ বইয়ে পড়ে-পাওয়া পুষ্পা তারভের স্মৃতি। পুষ্পা জানাচ্ছেন, ‘মানিক একবার শারদোৎসবে সুকুমার রায়ের হয়বরল থেকে কাকেশ্বর কুচকুচে অভিনয় করিয়েছিলেন। সেটা ছিল পুজোর ছুটির আগে শান্তিনিকেতনে শারদোৎসব কাম নাট্যোৎসব। মঞ্চ তৈরি করে এক-এক ভবন নিজের নিজের মতন নাটক নামাত। কলাভবনের প্রোডাকশন কাকেশ্বর কুচকুচে--- সত্যজিৎ রায়ের পরিচালানায়। মঞ্চ করা হয়নি। দাঁড়কাক কাকেশ্বর তো গাছেই বসেছিল। ভূতনাথ কলাভবনের ছাত্র, এমনিতেই গায়ের রং কালো ছিল। তার ওপর তার মুখে কাগজের তৈরি বিশাল লম্বা কালো ঠোঁট লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই লম্বা ঠোঁট একবার ফাঁক হচ্ছে একবার বুজছে কাকেশ্বরের কথা বলার সময়।’ দুটি সাক্ষ্য সত্যজিতের জীবনী রচনার উপাদান হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সারা জীবন সৃষ্টিশীল এই মানুষটির শিল্পকাজের সূচনা তাহলে এই সৃজনটিই? দরকারি তথ্য, সারাজীবন যিনি সিনেমা করবেন, তাঁর কাজ তাহলে শুরু নাটক দিয়ে, এবং তিনি পরে আর কখনো নাটক করালেন না। লক্ষণীয়, দুটি তথ্যসূত্রে সময়কাল ও প্রসঙ্গ কিছুটা ভিন্ন। মা-কে  সত্যজিৎ চিঠি লিখছেন ১৯৪১-এর ১৪ জানুয়ারি আর পুষ্পার স্মৃতিতে ‘হয়বরল’ মঞ্চস্থ হয়েছিল পুজোর ছুটির আগে। শুধু তাই নয়, সত্যজিৎ লিখেছিলেন এই অভিনয় করানো হয়েছিল ‘স্কুলের ছেলেদের নিয়ে’ অন্যদিকে পুষ্পার মনে রয়েছে যে-নাট্যঠির কথা, সেটি কলাভবনের ছাত্রদের দ্বারা অভিনীত এবং সত্যজিৎ রায় পরিচালিত! পুষ্পা নিজে কলাভবনে ১৯৪২-এর নতুন শিক্ষাবর্ষে। অর্থাৎ তাঁর পক্ষে ১৯৪১-এর জানুয়ারির শো দেখা সম্ভবও তাহলে নয়। এর থেকে তাহলে কি মনে হয় না যে, ‘হয়বরল’ অবলম্বনে একবার নয়, দুটি নাট্যাভিনয় হয় এবং সেই দুটিতেই দুইভাবে যুক্ত ছিলেন হয়বরল-র লেখকের পুত্র সত্যজিৎ। একটিতে প্রোডাকশনের কিছু কাজে সাহায্য করলেও অন্যটি তিনি পরিচালনা করেন। পুষ্পাজির সাক্ষ্য থেকে লক্ষণীয়, সেই অর্থে কোনো মঞ্চ করা হয়নি--- স্বাভাবিক গাছের ওপরেই বসানো হয়েছিল কাকেশ্বর-রূপী ভূতনাথ পালকে। এক অন্য ধরনের নাট্য পরিকল্পনা। তখনো সত্যজিৎ ‘নবান্ন’ দেখেননি। কারণ, তখনো ‘নবান্ন’ অভিনীতই হয়নি। সত্যজিৎ ১৯৪১-৪২-এই সেই সুদূর বোলপুরের ছাত্র-উৎসবে অভিনয়-করানো নাট্যে এক অন্য ধরনের মঞ্চ পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছেন--- বলা যায় কি! ভবিষ্যতে সত্যজিতের জীবনী রচনায় ঘটনা দুটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, বলাই বাহুল্য। মনে পড়বেই, ১৯৮৭-তে সুকুমার রায় তথ্যচিত্র তৈরি করার সময়ে সত্যজিৎ এই অংশটি আবার চিত্রায়িত করবেন আরেক আঙ্গিকে। এখনো আমরা জ্যান্ত মানুষের অভিনয়ের সঙ্গে পুতুল মিশিয়ে কোনো সিনেমাগত আর্টফর্ম ব্যবহার করতে পারিনি। সত্যজিৎ তার একটা সূচনা সেই দৃশ্যে আজ থেকে পঁয়তিরিশ বচ্ছর আগে করে গেছেন।   

বোসপুকুরে খুনখারাপি-র অলংকরণ। শিল্পী: সত্যজিৎ রায়।

 

নিজের এই নাট্যসংযোগের পাশাপাশি তিনি নাটক দেখতেনও। সত্যজিৎ বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব গঙ্গাপদ বসুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘যুবা বয়সে দেখা যেসব নাটক আআমর মনে বিশেষভাবে দাগ কেটেছিল তার মধ্যে ‘নবান্ন’-এর নাম সবচেয়ে আগে মনে পড়ে। এবং ‘নবান্ন’ বলতে যে ক-জন অভিনেতার কথা মনে পড়ে, তার মধ্যে গঙ্গাপদ বসু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।’ গঙ্গাপদ বসুকে সত্যজিৎ অভিনেতা হিসেবে পেয়েছেন ‘জলসাঘর’ ছবিতে--- মহিম গাঙ্গুলির চরিত্রে। স্মরণীয় সে অভিনয়। আবার শিশির ভাদুড়ি মশাইকে সত্যজিৎ চেয়েছিলেন ‘মহানগর’ ছবিতে নায়িকা আরতির শ্বশুর প্রিয়গোপালের চরিত্রে। ভাদুড়িমশাই রাজি হননি। সত্যজিৎ নিজেই পরে ১৯৮৬ সালে শারদীয় ‘এক্ষণ’-এ লিখেছিলেন, ‘প্রিয়গোপালের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য আমি শিশির ভাদুড়ি মশাইকে অনুরোধ করি। তার আগেই আমার শিশিরবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, তিনি ‘পথের পাঁচালি’ দেখে আমাকে ডেকে ছবিটির খুব প্রশংসা করেন। আমার প্রস্তাব শুনে শিশিরবাবু বলেন, ‘সিনেমায় তো অভিনেতা অভিনয় করে না, করে পরিচালক। তার মানে আমার পার্টটিতেও আসলে তুমিই অভিনয় করবে, কাজেই সেখানে আর আমাকে নেওয়া কেন?’’ পাঁচের দশকের শেষে শিশিরবাবুর কাছে শোনা এই সংলাপটিই পরের দশকে তৈরি ‘নায়ক’ ছবিতে অন্যভাবে ফিরে আসবে--- নাট্য-পরিচালকের সংলাপে। উত্তমকুমার অভিনীত অরিন্দম চরিত্রটিকে তাঁর নাট্যগুরু শংকরদা যখন সিনেমা-পরিচালকের কাছে একজন সিনেমার অভিনেতা কীভাবে পুতুল ছাড়া আর কিছুই নয়--- সেটা বোঝানোর জন্য।

সরাসরি নাটক নিয়ে কিছু না লিখলেও, একটি অন্য প্রসঙ্গে নাট্য-অভিনয় বিষয়ে সত্যজিৎ বলেছিলেন একটি দরকারি কথা। প্রবন্ধটির নাম ‘দুটি সমস্যা’--- প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। সেখানে সত্যজিৎ নাট্যাভিনয়ের পরিবর্তন সম্পর্কে বলতে গিয়ে কিছুটা আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, নতুন ধরনের নাট্যাভিনয়ের সূচনা হওয়ায় ‘এক ধরনের সাবেক অভিনয় রীতি প্রায় লোপ পেয়ে যাচ্ছে। যে অভিনয় রীতির কথা বলছি সেটার সূত্রপাত গিরিশ ঘোষের আমলে এবং পূর্ণবিকাশ শিশির ভাদুড়ির অভিনয়ে। এটা যে একই ছাঁচে ঢালা কোনো অভিনয়ের রীতি তা নয়। শিশির ভাদুড়ি, নরেশ মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, যোগেশ চৌধুরি--- এঁরা সকলেই সমসাময়িক একই আবহাওয়ায় পরিপুষ্ট ক্ষমতাবান মঞ্চশিল্পী হলেও, এঁদের প্রত্যেকেরই অভিনয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু ফসলে তফাত হলেও, জমি এক।’ অভিনয়ের মধ্যে ‘বাঙালিয়ানার একটা চেহারা’ খুঁজছিলেন সত্যজিৎ, আর লক্ষ করছিলেন ক্রমশ সেই ‘ট্র্যাডিশনটাই উবে যেতে বসেছে’। সত্যজিতের অভিনয়-ভাবনা নিয়ে পরে কথাবার্তা হলে, এই ভাবনাসূত্রটি বেশ দরকারি একটি দিকের প্রবর্তনা করবে।

আরও পড়ুন
টুনটুনি আর হেঁশোরাম-এর অনুবাদে সত্যজিৎ

থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এর প্রতি সত্যজিতের শুভেচ্ছাপত্র।

 

আরও পড়ুন
প্রোফেসর শঙ্কুর চিত্রনাট্য

এই নাট্যসংযোগের কথা বলতে গিয়েই এখানে মনে পড়বে ১৯৭৮-এ সত্যজিৎ রায় লিখিত একটি শুভেচ্ছাবার্তার কথাও। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, এখানে বলে নেওয়া ভালো, ভবিষ্যতে সত্যজিতের পূর্ণাঙ্গ রচনাবলির জন্য বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা আর নানা প্রতিষ্ঠানকে সত্যজিতের পাঠানো শুভেচ্ছাবাণীও সংগ্রহ করার কাজও এখন থেকেই শুরু করার দরকার। যাই হোক, ওই ১৯৭৮-এ বিশিষ্ট নাট্যদল থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এর দ্বাদশ বর্ষপূর্তিতে সত্যজিৎ লেখেন, ‘বর্তমান পশ্চিমবাংলার সংস্কৃতির কথা বলতে গেলে সর্বাগ্রে বলতে হয় বাংলার নাট্যমঞ্চের কথা।’ তারপরে তখনকার বাংলা সিনেমা আর নাটকের তুলনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলা চলচ্চিত্র যেখানে অধঃপতনের দিকে চলেছে (কারণ যাই হোক না কেন) সেখানে এখনকার একাধিক নাট্যগোষ্ঠীর উদ্যোগ ও উদ্যম বাংলা সংস্কৃতির মান বাঁচিয়ে রেখেছে।’ এরপর থিয়েটার ওয়ার্কশপের কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন তাঁদের কাজে ‘নিষ্ঠা আছে, শিল্পবোধ, কল্পনাশক্তি ও সমাজসচেতনতার পরিচয় আছে।’ শেষে নাট্যদলের প্রতি শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বলেছেন, দীর্ঘকাল যেন এই নাট্যদল ‘দর্শকদের একাধারে নাট্যরস ও চিন্তার খোরাক পরিবেশন করতে সক্ষম’ থাকে।

আরও পড়ুন
মানিক এক অন্য লেখক

মনে পড়বেই, সত্যজিতের দু-দুটো ফেলুদার গল্প নাটক আর যাত্রার জগৎকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। একটি হল ‘অপ্সরা থিয়েটারের মামলা’ আরেকটি ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’। সেখানে রয়েছে নাট্যজগতের ভেতরের কথা। বড়োলোক বাড়ির ছেলের নাট্যপ্রীতি থেকে নাটক লেখার কাজে নেমে পড়া থেকে নাট্যদল আর যাত্রাদলের ভিতরের দলাদলি আর পারস্পরিক প্রতিযোগিতাও যে অপরাধের গল্প তৈরি করতে পারে, রয়েছে এ কাহিনি তারও উদাহরণ। তবে সেই অপরাধকাহিনির মধ্যেও রয়েছে এমন বাক্য, যেখানে একজন নাট্যকারের ভাবনা থেকে বললেন সত্যজিৎ, ‘সব নাটক সব সময় চলে না, ভালো নাটকও অনেক সময়ে মার খেয়ে যায়।’ আবার উল্টোদিকে এমন কথাও সেখানে লেখা থাকে, ‘আমাদের বন্ধু রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর পাল্লায় পড়ে শেষটায় যাত্রা দেখতে হল।’ সেই অভিনয় দেখে তোপসের উপলব্ধি এই রকম, ‘এটা বলতেই হবে, যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ জমে যেতে হয়। কোথাও কোনো ঢিলেঢালা ব্যাপার নেই, অ্যাক্টিং একটু রং চড়া হলেও কাউকেই কাঁচা বলা যায় না।’     

আরও পড়ুন
গুগাবাবা চিত্রনাট্য লেখার আগের গল্প!

নাটকের প্রতি সত্যজিতের ওই গভীর ভালোবাসা আর আগ্রহের কথা অনেকাটই সাধারণ্যে অনুল্লিখিত। বরং সাধারণভাবে, তিনি যে কথার মাত্রা হিসেবে বিভিন্ন সময়ে ‘নাটুকেপনা’ বা অত্যধিক ‘নাট্যধর্মিতা’-কে সিনেমায় বর্জন করার কথা বলেন, সেই বাক্যগুলিই পুনরুদ্ধৃত হতে দেখা যায়। এর থেকে মনে হয় সত্যজিতের ছবি যেন নাট্যসংস্কৃতির বিপরীত এক প্রকল্প। এদের সম্পর্কটা বুঝি আড়াআড়ির। নাটক আর সত্যজিতের সম্পর্ক বিষয়ে এখন থেকে একটু অন্য কথাও হোক--- সেটা সত্যজিৎ চর্চার জন্যেও ভালো আর ভালো নাটক আর সত্যজিতের সিনেমার মধ্যবর্তী প্রাচীরটিকে ভাঙার জন্যেও।  

Powered by Froala Editor