সত্যজিতের কলমকারির একটা আশ্চর্য দিক হল তাঁর অনুবাদে ঠাকুর্দা উপেন্দ্রকিশোর আর বাবা সুকুমার রায়ের লেখা গল্প আর কবিতার অনুবাদ। সত্যজিৎ-কৃত সুকুমার কবিতার অনুবাদ নিয়ে বহু আগেই এই কলমকারির এক কিস্তিতে গল্পগাছা হয়েছে--- আজ পালা গল্প-অনুবাদের কথা বলার। গল্পগুলি অনূদিত হয়েছিল মোটের ওপর গত শতকের আটের দশকে। মানে সত্যজিৎ নিজে তখন ষাট পেরিয়েছেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ সালে মূলত ‘টার্গেট’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় সত্যজিৎ করেন এই অনুবাদগুলি। এখন সত্যজিতের জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত ‘থ্রি রে-জ্’-এর মধ্যে সেই অনুবাদগুলি একত্র হয়েছে--- সেগুলির সঙ্গে সত্যজিতের নিজস্ব খাতায় লিপিবদ্ধ অথচ এখনও অপ্রকাশিত কিছু অনুবাদও উদ্ধার করেছেন সম্পাদক সন্দীপ রায় ও সহ-সম্পাদক ঋদ্ধি গোস্বামী। এই লেখাগুলি সাধারণভাবে আমাদের চোখের আড়ালেই থাকে, তাই এখানেও যে সত্যজিতের কলমকারির কী অসামান্য কারিকুরি আছে, তা সেভাবে আলোচিত হয় না।
সত্যজিৎ অনুবাদ করেছেন উপেন্দ্রকিশোরের ‘টুনটুনির বই’ থেকে ‘টুনটুনি আর রাজার কথা’, তিনি অনুবাদ করেছেন ‘নরহরি দাস’, ‘দুষ্টু বাঘ’। অন্যদিকে সুকুমারের লেখা বিখ্যাত ‘হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি’ আর ‘রাজার অসুখ’-ও ইংরাজিতে অনুবাদ করেছেন সত্যজিৎ। এই খবরটুকু শুনলেই যেকোনো বাঙালির প্রথম মনে হবে, কীভাবে সত্যজিৎ অনুবাদ করলেন ওই উপেন্দ্রকিশোরীয় মুখে-মুখে গল্প-বলার ভাষা? কীভাবে অনুবাদ করা গেল সেইসব গল্পের ভেতরের সব দু-চার লাইনের মুখে-বলা ছড়া! মজা হল, সত্যজিৎ ‘টুনটুনি আর রাজার কথা’-র সব ছড়াকে ছড়ার মতোই রেখেছেন এক্কেবারে অন্ত্যমিলসুদ্ধ! তাই সেখানে বাংলা ‘রাজার ঘরে যে ধন আছে/ টুনির ঘরেও সে ধন আছে’ অনুবাদে হয়েছে ‘What the king has in his chest/ Toony too has in her nest’। কী সহজ ইংরাজিতে, কী ছন্দোময় এ অনুবাদ। লক্ষ করার মতো, গল্পের টুনটুনি কিন্তু অনুবাদে নারী! আর হবে না-ই বা কেন? ‘টুনটুনির বই’-এর প্রথম গল্পেই তো সেই দুষ্টু বিড়াল তাকে বলেছিল, ‘কী করছিস লা টুনটুনি?’ সেখানেই তো টুনটুনি ঠোঁট দিয়ে বাসা বাঁধে আর নিজের বাচ্চাদের বড়ো করে। ফলে টুনটুনির স্রষ্টার মনে টুনটুনি তো স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দই! আবার এই গল্পেই পরে ‘রাজা বড়ো ধনে কাতর/ টুনির ধন নিল বাড়ির ভিতর’ আর ‘রাজা ভারি ভয় পেল/ টুনির টাকা ফিরয়ে দিল’ যথাক্রমে অনুবাদে হয়েছে এই রকম--- ‘The king must be very needy/ If my silver makes him greedy’ আর ‘The king is scared of me, I see/ To send my silver back to me’।
এরপরে টুনির সেই গা-জ্বালনিয়া বিদ্রুপ ‘বড়ো মজা, বড়ো মজা/ রাজা খায় ব্যাঙ ভাজা’--- তারও অনুবাদ করতে গিয়ে সত্যজিৎ তাকে করেছেন, ‘Who is the winner? I’m the winner/ The king has had a toad for dinner’। এমন সব সহজ তরতরে অনুবাদ ভালো লাগার পরেই মনে হয়, আচ্ছা উপেন্দ্রকিশোরের ছড়ার ওই শব্দবন্ধ ‘টুনটুনালো’-র অনুবাদ কী হতে পারে? সেই যে আছে না? ‘এক টুনিতে টুনটুনালো/ সাত রানির নাক কাটালো।’ দেখা যাচ্ছে, সেখানে টুনটুনালো শব্দটাকে অন্যভাবে মানের দিক থেকে এনেছেন অনুবাদক। ‘টুনটুনালো’ মানে তার চালাকি আর চাতুরি দিয়ে বাজিমাত করল টুনি--- তাই তা অনুবাদে হয়েছে, ‘When clever Toony so disposes/ Seven queens loose seven noses’।
আরও পড়ুন
প্রোফেসর শঙ্কুর চিত্রনাট্য
শুধু তো টুনটুনির গল্প নয়, ‘নরহরি দাস’ গল্পে যে আছে ‘দূর হতভাগা! তোকে দিলুম দশ বাঘের কড়ি,/ এক বাঘ নিয়ে এলি লেজে দিয়ে দড়ি।’ এই ‘কড়ি’-র কথা তো ইংরাজি অনুবাদে আসবে না--- ফলে এক্কেবারে তা হয়ে গিয়েছে ‘You good for nothing/ See what you have done,/ I paid for ten tigers/ And you’ve brought only one’।
আরও পড়ুন
গুগাবাবা চিত্রনাট্য লেখার আগের গল্প!
আরও পড়ুন
গুগাবাবা: চিত্রনাট্য লেখার আগের গল্প!
এমনই আরেক মজার কাণ্ড ঘটল ‘কুঁজো বুড়ির কথা’ গল্পের অনুবাদে। মূল গল্পে হাড়-জিরজিরে কুঁজো বুড়ি চলেছিল নাতনির বাড়ি। পথে তাকে খেতে এলো শিয়াল, বাঘ আর ভাল্লুক। তাদের বুড়ি বলল, এমন হাড়-জিরজিরে বুড়িকে খেয়ে আর তাদের কী লাভ? তার চেয়ে সে নাতনির বাড়ি থেকে খেয়েদেয় মোটাসোটা হয়ে আসুক--- তারপর না হয় দেখা যাবে। নাতনির বাড়িতে তো খেয়েদেয়ে ভালোই চেহারা হল বুড়ির! তাকে তখন একটা লাউয়ের ভেতর পুরে গড়িয়ে দিল নাতনি--- সঙ্গে দিল খাবার জন্য চিঁড়ে আর তেঁতুল। এই লাউ গড়াতে থাকে আর তার ভেতর থেকে বুড়ি গান গায়, ‘লাউ গড়গড়, লাউ গড়গড়/ খাই চিঁড়ে আর তেঁতুল/ বিচি ফেলি টুলটুল/ বুড়ি গেল বহু দূর।’ এটা সত্যজিতের অনুবাদে পেল একেবারে যথাযথ ছন্দোবন্ধ। তিনি একে অনুবাদে করলেন, ‘Pumpkin, pumpkin, roll along/ Keep on rolling all the way,/ Eat your pickles, sing your song---/ Skin-and-bones is miles away.’ মূল কথাটাকে একদম এক রেখে কী চমৎকার অনুবাদ। আসলে, বুড়ি তো নিজেকে লুকিয়ে রেখে ফেরার পথে নিজে যে বেশ ভালো চেহারা পেয়েছে, সেটা বলবে না--- সে বলছে সে এখনো ওই একটু চিঁড়ে আর তেঁতুলই খাচ্ছে। ফলে সে এক রকমই হাড়-জিরজিরে আছে! তাই বুড়ি চলল বহুদূর-এর অনুবাদ ইংরাজিতে হল ‘স্কিন অ্যান্ড বোনস ইজ্ মাইলস অ্যাওয়ে’।
সুকুমার রায়ের ‘হেঁশোরাম হুঁশিয়ার’-এর ডাইরির অনুবাদ তো আরেক রকম চ্যালেঞ্জ। তার প্রধান কারণ হল, সেখানে যেসব কাল্পনিক জন্তু-জানোয়ারের নামকরণ করেন হেঁশোরাম, সেগুলো যে এক্কেবারে মুখ-বোলতি বাংলা বুলির একটা সপ্রতিভ বিজ্ঞানসম্মত মার্কা নাম। এ কথা তো সবারই জানা--- সেখানে যে প্রাণী ল্যাগব্যাগ করে হাঁটে, তার নাম ল্যাগবাগার্নিস, মুখ যার গোমড়া তার নাম গোমড়াথেরিয়াম, আবার চিৎকার করে বলেই কোনো জন্তুর নাম ‘চিল্লানোসরাস’! এই ছদ্ম-বিজ্ঞানসম্মত নামের পূর্বপদে বাংলা শব্দ বসানোর মজা কি অনুবাদে করা সম্ভব? মূল গল্পের ‘হ্যাংলাথেরিয়াম‘ এখানে ‘Voracitherium’। ‘গোমড়াথেরিয়াম’ হয়েছে ‘Glumotherium’, ‘ল্যাগবাগর্নিস’ হয়েছে ‘Zigzagornis’, ‘ল্যাংড়াথেরিয়াম’-এর অনুবাদ ‘Docilosaurus’, ‘চিল্লানোসরাস’ আর ‘বেচারাথেরিয়াম’ হুবহু ‘Chillanosaurus’ ‘Becharatherium’-ই রেখে দিয়েছেন। এমনকি গল্পের শেষের ‘গপ্পোথেরিয়াম’ অনুবাদে হয়েছে ‘Bluffotherium’। ‘Voracious’ শব্দের অর্থ খাইয়ে তাই সেখান থেকে ভোরাসিথেরিয়াম হয়েছে হ্যাংলাথেরিয়ামের প্রতিশব্দ। ‘Glum’-এর মানে বিষাদ বলে গোমড়াথেরিয়াম হয়েছে গ্লামোথেরিয়াম। আর ‘zigzag’ মুভমেন্টের অর্থ তো বলা বাহুল্য--- তাই ল্যাগবাগর্নিস হয়েছে জিগজ্যাগোর্নিস! আর গুলগপ্পো শোনানোর সঙ্গেই যে জড়িয়ে রয়েছে ‘ব্লাফোথেরিয়াম’ শব্দটি, তা কি আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে? ‘ব্লাফ’ মানে যে ধাপ্পা দেওয়া!
শব্দের দিক থেকে সত্যজিৎ একেবারে অন্য একটি শব্দ তৈরি করেছেন একমাত্র ল্যাংড়াথেরিয়াম-কে ডোসিলিওরাস বানিয়ে। কী ভেবেছিলেন সত্যজিৎ? সম্ভবত ‘ল্যাংড়াথেরিয়াম’ শব্দটির মধ্যে একটি মানুষের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে নিয়ে ঠাট্টা করা হয়ে থাকে বলেই বোধ হয়, সেই শব্দটি বদলে নিয়েছিলেন তিনি। তাকে ইংরাজিতে করেছেন করেছেন ‘ডোসিলোসরাস’। এখানে অসুবিধা নেই, গল্পেও এই প্রাণীটি ছিল বিরাট মাপের এক চেহারাওয়ালা জন্তু। তবে নিতান্ত অনুগত শান্তভাবে সে ধরা দিয়েছে, অন্যে তাকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে, তাতেও সে স্পিকটি নট--- তাই ‘ডোসাইল’ বা শান্ত অনুগত বিনয়ী শব্দের সঙ্গে মিলিয়েই বুঝি সত্যজিতের কলমে তৈরি হয়েছে এমন বিনয়ী নামখানি। এইখানে একটি ছোট্ট টিপ্পনী কি যোগ করা যায়? সত্যজিৎ ‘যখন ছোটো ছিলাম’-এ বলেছিলেন, ‘ছেলেবেলায় ডেঙ্গু নামে এক বিটকেল অসুখে আমার ডান পা-টা কমজোর হয়ে যাবার ফলে আমি লম্ফঝম্পে কোনোদিনই বিশেষ পারদর্শী হতে পারিনি।’ তথ্যটি এখানে বলা হল এই কারণে, একটি পা কমজোরি হলে একটি মানুষের নিজের হাঁটাও বদলে যাবে--- সত্যজিৎ নিজে যেহেতু দীর্ঘদেহী আর তাঁর হাঁটার গতি দ্রুত বলেই তাঁর সেই একটু খুঁড়িয়ে হাঁটা সাধারণভাবে চোখে পড়বে না। এই সামান্য খোঁড়ানোকেই তো বাঙালির অপভাষায় ‘ল্যাংড়া’ বলে। তাই না? নিজের এই ছোট্ট শারীরিক সমস্যাটি ছিল বলেও কি তিনি অতিরিক্ত সচেতন ছিলেন ‘ল্যাংড়াথেরিয়াম’ শব্দের অনুবাদে? বেশি ভাবছি, এমন হতেই পারে! তবে এই সমাপতনটি কিন্তু লক্ষণীয়!
Powered by Froala Editor