মানিকলমকারি – ১০
আগের পর্বে
সত্যজিতের গল্প, অথচ সত্যজিতের লেখা নয়। বিষয়টি কেমন? সত্যজিতের গল্প সংকলনের শুরুর দুটো গল্প ‘পুরস্কার’ এবং ‘বর্ণান্ধ’। দুটি গল্পই লেখেননি সত্যজিৎ। ১৯৪১ সালে অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের প্রথম গল্প ‘অ্যাবস্ট্রাকশন’। কিন্তু সেই গল্প ছিল ইংরাজিতে। এমনই আরেকটি ইংরাজি গল্প ‘শেডস অফ গ্রে’। সত্যজিতের মৃত্যুর পর দেশ পত্রিকায় ১৯৯৫ সালে বাংলায় অনূদিত হয়েছিল এই গল্প দুটি। তারপরে সংকলনে অন্তর্ভুক্তি। কিন্তু সত্যজিতের মূল শৈলীটাই রক্ষা করতে পারেননি অনুবাদক।
মানিকলমকারি-র আগের এক কিস্তিতে বলেছিলাম, সত্যজিৎ রায়ের ‘সিনেমার কথা’ লেখাটির কথা। বলেছিলাম তাঁর লেখা এই সচিত্র প্রবন্ধটিকে অবিলম্বে সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। যদিও তাঁর এই লেখাটি এক অসমাপ্ত প্রবন্ধ--- কিস্তিতে কিস্তিতে বের হতে-হতে মাঝপথে হঠাৎ থমকে-যাওয়া একটি লেখা, তবুও এই প্রবন্ধটির শেষ না-হওয়া যে নবীন বাংলা সিনেমা-শিক্ষার্থীর পক্ষে কত বড়ো ক্ষতি তার একটা খতিয়ান দিতেই আজকের কলমদারি।
‘সিনেমার কথা’- প্রথম কিস্তি ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় বেরোয় ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর- অক্টোবর সংখ্যায়। পরের দ্বিতীয়, তৃতীয় চতুর্থ কিস্তি প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮, মে ১৯৬৮, সেপ্টেম্বর- অক্টোবর ১৯৬৮-তে আর তারপরে পঞ্চম কিস্তি প্রকাশিত হয় দীর্ঘ ব্যবধানে প্রায় এক বছর পরে সেপ্টেম্বর- অক্টোবর ১৯৬৯-এ। শেষ কিস্তির শেষে লেখা ছিল ‘ক্রমশ’। এমনকি, পরের কিস্তিতে কী বিষয়ে আলোচনা করবেন, তার একটা ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন প্রাবন্ধিক, কিন্তু হায়, তা আর কখনো বের হয়নি!
ধারাবাহিক এই প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য ছিল ছোটোদের সিনেমা ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচিত করা। শুধু সিনেমা দেখা নয়, শিশু-কিশোররা যাতে সিনেমা সম্পর্কে আগ্রহী হয়, নিজেরা সিনেমা কীভাবে লিখতে হবে শেখে, তা নিয়ে এক আশ্চর্য প্রবন্ধ এটি। আধুনিক শিক্ষার পরিভাষায় রীতিমতো একটা ইন্টারঅ্যাক্টিভ ক্লাস যেন সে লেখা। সত্যজিৎ নিজে শুধু লিখছেনই না, একটা কিস্তি লিখে তাঁর খুদে পাঠকদের জন্য হোম-ওয়র্ক দিচ্ছেন। বলছেন, বিষয়টা তোমাদের ধরিয়ে দিলাম--- এবার তোমরা চেষ্টা করো লিখতে একটা গল্প, সিনেমার মতো করে। তারা উত্তর দিলে, সেই উত্তরগুলোর ঠিক ভুল নিয়ে আলোচনা করছেন। বেছে নিচ্ছেন তার থেকে সেরা তিনটি লেখা। শুধু বেছেই নিচ্ছেন না, তার ভেতর থেকে ষোলো বছর বয়সী এক খুদে লেখকের একটি লেখা নিয়ে ছোটোদের জন্য সেই দৃশ্যটির শট ডিভিশন করে দেখাচ্ছেন, কীভাবে একটা শটের সঙ্গে জুড়তে হয় আরেকটা শট--- কীভাবে দুটো-তিনটে শট পরপর জুড়ে একটা গল্প তৈরি হয়। আরো বেশি মজাটা কোথায়? সেই শট ভেঙে ভেঙে বোঝাতে গিয়ে, নিজে তাঁর ছবির জন্য যেমন তাঁর সেই বিখ্যাত লাল খেরোর খাতায় লেখার পাশে পাশে ছবি এঁকে রাখেন, ঠিক সেভাবেই ছবি এঁকে বোঝাচ্ছেন, একটা শটে ঠিক কতটা দেখা যাবে, কাকে দেখা যাবে, কোথা থেকে তাকে দেখা যাবে আর কাকে দেখা যাবে না। এক্কেবারে আদর্শ মাস্টারমশাই যেভাবে হাতে-কলমে শেখান এ যেন ঠিক তেমনভাবেই শেখানো।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের বইতে ‘এ কাহাদের কণ্ঠস্বর?’
লেখাটি শুরু হয়েছিল এইভাবে, ‘যেকোনো একটা নতুন আবিষ্কার প্রথম-প্রথম যে চমক জাগায়, কিছুদিন পরে মানুষের অভ্যাস হয়ে গেলে আর সে চমকটা থাকে না।’ বোঝালেন, ইলেকট্রিক আলো দেখা, টেলিফোনে কথা-বলা, গ্রামোফোনে গান-শোনা সবই এইভাবে একদিন আবিষ্কার হয়েছে, মানব সভ্যতার সঙ্গে তারপরে তা এমনভাবে জুড়ে গেছে যে, এখন আর তাতে মানুষ চমকিত হয় না। ঠিক সেই সূত্রে তিনি চলে এলেন, চলমান ছবির কথায়। একে ছবি নিজেই এক বিস্ময়, তায় আবার চলমান ছবি। লুমিয়ের ভাইদের দেখানো স্টেশনে এসে দাঁড়ানো ট্রেনের কথা বলে, তিনি এগিয়ে গেলেন চলমান ছবি কীভাবে গল্প বলতে পারে তার কথায়।
আরও পড়ুন
এক গল্পই দু-বার দু-ভাবে লিখলেন সত্যজিৎ
এই কথাটা বলতে গিয়ে ভেবে দেখার মতো ব্যাপার, সেকালে একেবারে নতুন একটা কথা শোনালেন তিনি। বললেন, আমাদের দেশীয় পটুয়া-শিল্পীরা যখন একটা ছবির পর আরেকটা ছবিকে সাজিয়ে, তাকে রোল করে, একটা গান বা গল্প বলার ঢংয়ে পরপর ছবিগুলি দেখাচ্ছে ধীরে ধীরে ছবির রোল খুলতে খুলতে, সেও যেন একটা আমাদের নিজস্ব চলচ্চিত্র!
আরও পড়ুন
সত্যজিতের গল্পে 'জাদু'
এই কথা বলতে বলতেই, তিনি বলে রাখলেন, আসল কথাটি--- তাঁর এই লেখার প্রাথমিক উদ্দেশ্যটি। বললেন, তাঁর ছোটোবেলায় ছবি দেখার সময়, এইসব ছবির মজা কীভাবে তৈরি হত, তা নিয়ে আদৌ মাথাব্যথা ছিল না তাঁর, ‘এসব ছবি যখন দেখেছি, তখন এর গল্পে এমন মেতে গেছি যে, কোনো সময় মনে হয়নি যে এসবের পিছনে আবার খরচ আছে, পরিশ্রম আছে, কারসাজি আছে।’ লিখলেন, ‘ছেলেবেলায় যে ব্যাপারটা জানার সুযোগ হয়নি, কিন্তু আজ খুব ভালো করেই জানি, সেটা হল এই যে, সিনেমা তৈরির মতো মেহনতের কাজ খুব কমই আছে।’ এই মেহনতের কথা, সেই মেহনতের সঙ্গে যুক্ত থাকা যন্ত্রপাতির কথা, তার খুঁটিনাটিসহ পর্দার মাপ কীভাবে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে--- এই কথাগুলোও গল্পচ্ছলে বোঝাতে থাকলেন তিনি।
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস-৩
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমার ক্লাস - ২
সহজ কথায় বললেন, পরিচালকের সঙ্গে আর কারা কারা কাজ করেন? লক্ষণীয়, অভিনেতা অভিনেত্রীর কথা বললেন না, তাদের কাজের ধরনটা তো জানাই সবার। বললেন, পরিচালক সহ তাঁর মূল চারজন সঙ্গী ক্যামেরাম্যান বা আলোকচিত্রশিল্পী, সাউন্ড রেকর্ডিস্ট বা শব্দযন্ত্রী, আর্ট ডিরেক্টর বা শিল্প নির্দেশক আর এডিটর বা সম্পাদকের কথা। প্রথমে সংক্ষেপে তাঁদের কাজের কথা বলে নিয়ে ভেবেছিলেন, বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবেন এঁদের প্রত্যেকের কাজের কথা, পরিচয় করাবেন, তাঁদের কাজের সঙ্গে যুক্ত যন্ত্রগুলোর সঙ্গেও। যদিও সেই বিস্তারে আর তো গেল না এই লেখা।
যন্ত্রের দরকার শুটিং পর্ব থেকে। শুটিং পর্বের আগে, চিত্রনাট্য লেখার কাজ দিয়ে শুরু সিনেমার কাজ। তাই সিনেমার জন্য চিত্রনাট্য লেখার ব্যাপারটা তিনি বোঝালেন আশ্চর্য উপায়ে।
সামান্য একটা লাইন, ‘রাম বড়ো ভালো ছেলে’। এই চিরপরিচিত লাইনটা থেকে তিনি তাঁর খুদে পাঠকদের বললেন একটা চিত্রনাট্য ফাঁদতে। কেন বললেন এই লাইনটার কথা। কারণ, গল্পে এই লাইন থেকে পাঠক অনেক কিছু মেনে নেন। অথচ সিনেমায় এই কথাটা সরাসরি বলার জো নেই। হয় কাউকে দিয়ে বলাতে হবে, অথবা, কোনো ঘটনা দিয়ে বোঝাতে হবে। আরেকটা উপায় আছে, তিনিই মনে করিয়ে দিলেন আর তিনিই বললেন সেটা ভালোভাবে সব সময় নাও খাটতে পারে। মানে, সিনেমাতে ভালোমানুষের মতো দেখতে কাউকে রামের চরিত্রে অভিনয় করালে, দর্শক তাকেও ভালো ছেলে বলেই মেনে নেবেন। এ কথা বলেই বললেন, অবশ্য ভালোমানুষের মতো দেখতে হলেই যে সে ভালো হবে, এমন কথা নেই। ফলে, সবচেয়ে ভালো উপায়, কোনো একটা ঘটনা দিয়ে তাকে ভালো ছেলে বোঝানো। কী সুন্দর আর অভিনব এই শেখাবার পদ্ধতিটি! কাজটা পড়ুয়াদের হাতে দিয়ে তিনি তাদের সঙ্গেই থাকলেন। বললেন, ধরে নাও, ছেলেটির বয়স বারো, ধরে নাও ছেলেটি একটি স্কুলে পড়তে যাচ্ছে--- এবার বোঝাও একটা চিত্রনাট্যের ধরনে যে রাম ভালো ছেলে।
পাঠকদের কাছ থেকে উত্তর এল। তিনি তিনটি সেরা উত্তর বেছে নিলেন। তাঁর লেখার সঙ্গেই ছাপা হল সেই তিনজন খুদে পাঠকের লেখা। এবার সত্যজিৎ তার একটি লেখা থেকে একেবারে ছবি এঁকে এঁকে শেখালেন, কীভাবে সেটা সিনেমাতে একটা-একটা শটে ভেঙে তোলা হবে। সেই শটগুলো থেকে বোঝালেন, দর্শকের কাছে কীভাবে স্পষ্ট হল যে, রাম বড়ো ভালো ছেলে। ভাবা যায়, পনেরোটা শট পরপর আঁকলেন, আঁকার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক তার পাশে পাশে বসালেন চরিত্রদের মুখের সংলাপ, তারা কে কী বলছে, কে কী করছে সমস্ত ডিটেলস। আর পাশে তার ছবি। মানে, ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ওই লেখাটা কীভাবে ছবিতে দেখা যাবে। পাশাপাশি এই দুটো পড়ে গেলেই একজন নবীন শিক্ষার্থী শিখে যাবে, ঠিক কীভাবে তৈরি করা যায় একটা চিত্রনাট্য আর কীভাবেই বা তা থেকে বানানো যাবে শুটিং স্ক্রিপ্ট।
সত্যজিৎ শুধু বাংলা তথা ভারতীয় ছবির জগতে নতুন সময়কেই আনেননি, তিনি চাইছিলেন, নতুন বাঙালি নতুনভাবে সিনেমা দেখতে শিখুক, নতুনভাবে লিখতে শিখুক সিনেমা। আর আমরা ভাবি, সত্যজিতের ভাবনায় ‘মহাভারত’, ‘এলিয়েন’, ‘রাজসিংহ’, ‘চতুরঙ্গ’ করার ইচ্ছে সত্ত্বেও সেই ছবিগুলো না-হওয়া যেমন একটা বড়ো ক্ষতি, এই ধারাবাহিক লেখাটি অসম্পূর্ণ থাকাটাও ততটাই বড়ো একটা ক্ষতি।
মনে আছে, লেখাটির শেষ কিস্তিতে ওই শট ডিভিশনের ব্যপারটা বুঝিয়ে তিনি নবীন পড়ুয়াকে কথা দিয়েছিলেন, পরের কিস্তিতে শট কত রকম আর তা কী কী রকম হয় বোঝাবেন, বোঝাবেন বলেছিলেন, ছবিতে যন্ত্রপাতি, বিশেষ করে, ক্যামেরা-র ব্যবহারের গুরুত্ব। কিন্তু সে ক্লাস আর হল না। তবে সেখানে এ-ও বলেছিলেন যে, সিনেমার শুটিংয়ের মেহনত যে কতখানি সেটাও বলবেন। কী জানি কেন, মনে হয়, আচ্ছা সত্যজিতের ‘একেই বলে শুটিং’-এর প্রবন্ধগুলি ওই শুটিংয়ের মেহনত গল্প করে বুঝিয়ে দেওয়ার এক-একটা মজাদার বকেয়া ক্লাসই নয় তো আরেকটা কথা, ‘সন্দেশ’-এর পাতায় লেখাটি ছাপার সময় সত্যজিৎ একটি অভিনব আর তাৎপর্যপূর্ণ ভঙ্গিতে লেখাটির নাম লেখেন। ‘সিনেমার কথা’--- মানে প্রথমত, দ্বিমাত্রিক তলে ত্রিমাত্রিক ছবির আভাস আর তার ওপরে তা তো ছায়া-ছবি। তাই দেখা যায়, ‘সিনেমার কথা’ লেখাটির হরফগুলি এমনভাবে তিনি লেখেন, যা দেখলেই পাঠকের মনে হবে একটা ত্রিমাত্রিক ব্যাপার যেন আছে সেই লেখাতে। আর ছায়া-ছবি বলেই বুঝি বা লেখার ছায়া থেকে ভেসে ওঠে ‘সিনেমার কথা’ নামটা। কলমকারি মানে শুধু লেখা ভাবছি কেন, এই ছবিও এক কলমকারি নয় কি?
এখন সত্যজিতের ‘সিনেমার কথা’ নামের এই লেখাটি পাঠক পাবেন, তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত, ‘আরো সত্যজিৎ’ বইটিতে। নিঃসন্দেহে এই বইটিতে ওই লেখাটি ‘সন্দেশ’-এর পাতা থেকে তুলে নিয়ে আসা এক উজ্জ্বল উদ্ধার, তাই প্রকাশককে ধন্যবাদ। কিন্তু লেখাটির প্রকাশ-পরিকল্পনা নিয়ে সামান্য একটি অনুযোগ। লেখাটির প্রথম কিস্তিতেই সত্যজিৎ সিনেমার পর্দার মাপ বোঝাতে গিয়ে নিজের হাতে এঁকে তাঁর নিজের হাতের লেখায় NORMAL, WIDE SCREEN, VISTA VISION, CINERAMA, CINEMASCOPE ইত্যাদি শব্দগুলি লিখেছিলেন, নতুন পাঠে, তাঁর সেই হাতের লেখা নেই, লেখাগুলি রোমান হরফে মুদ্রিত! বইটি যদি সপ্রতিভ না হতে চেয়ে, তাঁর হাতের লেখাতেই রাখত ছবিগুলি, যেমন ছিল ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায়, তাহলে কী ভালোই না হত!
Powered by Froala Editor