ন হন্যতে : মৈত্রেয়ী, মংপু ও রবীন্দ্রনাথ

সময়ভ্রমণ – ৯

আগের পর্বে

বালিকা রানু অধিকারী সিমলা থেকে যখন পাহাড়ের বর্ণনা লিখে চিঠি পাঠান রবীন্দ্রনাথকে। তখন তাঁর প্রত্যুত্তরে কবিগুরু বলেছিলেন তাঁর পাহাড় ভাল লাগে না। তবে শেষ বয়সে বেশ করেকবার ছুটে গেছেন মংপুতে। মৃত্যুর কয়েকমাস আগেও সমস্ত নিষেধ অমান্য করে। সেখানে মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে ছিলেন চারবার। সেই ‘হেরিটেজ’ এখনও ট্যুরিস্ট পণ্য হয়ে গেছে। মংপুর মাইল খানেক দূরেই সুরেল। সুরেলের বাংলোয় উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথও। তবে এখন আর সেই বাংলো নেই। প্রথম গোর্খা আন্দোলনের সময়ই পুড়িয়ে ফেলা হয় সেই বাংলো।

বাঙালির ভাবনায় সুরেল-মংপু এলাকার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অনুষঙ্গ যেভাবে জড়িয়ে আছে, সেভাবেই মৈত্রেয়ী দেবীর। না থাকলেও থাকা উচিত। সুরেল-মংপুর পাহাড়বনে, সিনকোনা বাগানে রবীন্দ্রনাথ এসে ছিলেন, সেই থাকার কথা মৈত্রেয়ী যত্ন ও শ্রদ্ধার সঙ্গে লিখেছেন, শুধু সেকারণে নয়। রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের কাহিনিতে মৈত্রেয়ী এক অপরিহার্য চরিত্র, সে গল্প মৈত্রেয়ীকে ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না, শুধু সেকারণেও নয়। সে সময়ের আরো অনেকের মতোই, মৈত্রেয়ী এক অসামান্য মানুষ। ন হন্যতে নামের আশ্চর্য ঘোর-লাগানো লেখাটা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা সবাই তা জানেন। এই লেখাটা পরিচিত উপন্যাস বলে, কিন্তু এটা লেখকের আত্মজীবনী, বিশ শতকের গোড়ার দিকের আর মাঝামাঝি সময়ের শিক্ষিত বাঙালি জীবনের নির্মোহ দলিল, সে সময়কার এবং পরের সমাজসংস্কৃতির বয়ান, এর সবগুলোই হতে পারে। 

অথচ, মৈত্রেয়ী নিজে বারবার বলছেন, লেখাটার মূল বিষয় প্রেম। আজ থেকে প্রায় বছর পঞ্চাশ আগে ন হন্যতে যখন প্রথম বেরোয়, তখন আমি স্কুলের শেষধাপে। বাড়িতে মংপুতে রবীন্দ্রনাথ বইটা ছিল, সিনকোনা বাগানের উচ্চপদস্থ কোনো অফিসারের সঙ্গে বাবার যোগাযোগ ছিল, সেই সূত্রেও মংপুর নাম শুনতাম। এর বাইরে মৈত্রেয়ীর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা ছিল না। ন হন্যতে পড়ে যে অলৌকিকপ্রায় বিষাদমিশ্রিত মুগ্ধতার অনুভুতি হয়েছিলাম, তার মূল উপাদান ছিল প্রেম। সে প্রেম ধরাছোঁয়ার বস্তু না, অন্য কিছু, যা মনকে দখল করে রাখে, ভেজা শ্যাওলা আর সাদা মেঘের মতো ঢুকে পড়ে চৈতন্যের ভিতর। সে বয়সে এরকমই হবার কথা, ফলে লেখাটার ভিতর আরো যা যা আছে, সেদিকে নজর যায়নি। 

এর পরের পাঠগুলো অগোছালো, খণ্ডিত, হয়তো মংপু বেরিয়ে এসে একবার চোখ বুলোনো, কিম্বা রবীন্দ্রনাথ নামক মহারহস্যের সন্ধান করা। ন হন্যতে বইটা যে মৈত্রেয়ী নামের এক কিশোরীর, তরুণীর, মধ্যবয়সী গৃহবধুর, প্রৌঢ়ার, কবির, গদ্যলেখকের, তেজি সমাজকর্মীর এবং সর্বোপরি প্রেমিকের নিজের এবং নিজের সঙ্গে চারপাশের অন্যদের সম্পর্কের ইতিবৃত্ত, সে বিষয়ে আলাদা করে খোঁজ নেবার কথা মনে আসেনি। 

মৈত্রেয়ীকে দেখার, তাঁর কথা শোনার সুযোগ ঘটেছিল। তখন তাঁর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ন হন্যতের নায়িকা এবং সে বইয়ের কুয়াশাঘন প্রেম, এ সবের সঙ্গে, যাঁকে দেখেছিলাম তাঁকে মেলানো যায়নি। সেও প্রায় বছর চল্লিশ হল, মৈত্রেয়ী চলে গেছেন অনেকদিন। তাঁর জানাচেনা পৃথিবী তাঁর চোখের সামনেই ভাঙচুর হয়েছে, যেটুকু সামান্য কথা হয়েছিল, মনে হয়েছিল সেই পরিবর্তন তিনি মেনে নিতে পারেননি। এতদিন পর তাঁর লেখা পড়ে মনে হল, কিছুই সেভাবে বুঝিনি এতকাল, না তাঁকে না তাঁর লেখাকে। সে সময় চারপাশে বিপ্লবের ঝোড়ো হাওয়া, সামনে দীর্ঘ সময় পড়ে রয়েছে, যে কোনো দিন যে কোনো সময়ে যা ইচ্ছে ঘটে যেতে পারে, একজন বয়স্ক 'রাবীন্দ্রিক' ব্যক্তি আগ্রহের বস্তু হয়ে উঠবেন, তা সম্ভব ছিল না। এখন মনে হচ্ছে, যদি ফিরে যাওয়া যেত? সময় ব্যাপারটাকে চেপেচুপে ছোটো করে তিরিশের দশকের মংপুতে ফিরে যাওয়া যেত? কিম্বা, নিদেনপক্ষে আশির দশকে, যখন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল? এখনকার মংপু সুরেল দেখে, মৈত্রেয়ীর লেখাগুলো, সে সব লেখায় বর্ণিত রবীন্দ্রনাথের লেখাছবি আবার দেখেপড়ে ইস্তক যে নিরাবয়ব মন খারাপ আর ভালোলাগা আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে, তার সুলুকসন্ধান নেওয়া যেত তাহলে। 

আরও পড়ুন
মংপু, সুরেল ও ‘পাহাড়ী’ রবীন্দ্রনাথ

উনিশশো চৌত্রিশ সালে মৈত্রেয়ী যখন প্রথম মংপু আসেন, তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি। রোমানিয় পণ্ডিত, ভারত বিশেষজ্ঞ, লেখক মির্চা ইউক্লিডের সঙ্গে যখন তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ভাঙে, তখন তিনি ষোলো বছরের। রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথমবার মংপুর বাড়িতে আসেন, তাঁর বয়স আটাত্তর, মৈত্রেয়ীর চব্বিশ। ন হন্যতে-তে মৈত্রেয়ী বলছেন বাইশ বছরের মংপুবাসের মধ্যে তিনি সত্যিকারের অর্থে বেঁচে ছিলেন মোটে তিন বছর, যে সময়ে রবীন্দ্রনাথ এসে তাঁর ওখানে ছিলেন। বাকি সময়টা পুনরাবৃত্তি মাত্র। রসায়নবিদ স্বামীর সঙ্গে তিনি দীর্ঘ জীবন কাটিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের মন বইত আলাদা খাতে। মৈত্রেয়ীর ভাষায়, তাঁদের মধ্যে এক ধরণের সাংস্কৃতিক জাতিভেদ ছিল। বনের মধ্যে মংপুর বাড়ি, সে বাড়ির বারান্দায় বিকেলসন্ধ্যায় বসে থাকতেন দুজনে, বাইরে বনঝিঁঝিঁ ডাকত, অথবা নিশাচর পাখি, ঘন হয়ে চেপে বসতো নির্জনতা। দু চারটি কথা হত, তারপর দুজনেই চুপ। কোন ভাষায় কথা বলব, আমাদের ভাষাই যে আলাদা, বলছেন মৈত্রেয়ী। 

রবীন্দ্রনাথকে না দেখলে যার দিন কাটত না, যার প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছে ষোলো বছর বয়সে, যার প্রথম প্রেম পারিবারিক বাধায় ভেঙে গেছে, সেই মেয়েটি এসে পড়লো মংপু-সুরেলের বনে, যেখানে কথা বলবার মতো লোক নেই, চারপাশের বন কোথাও কোথাও এত আদিম, নিবিড় ও দুর্গম যে হাতি নিয়ে সেখানে ঢুকতে হয়। অসুখ করলে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় অর্থাৎ টেলিগ্রাফ টেলিফোন এসব কিছুই নেই। নিচের তিস্তা ভ্যালি রোড থেকে মংপু ওঠার যে পথ তা এত চড়াই যে গাড়ি সোজা হয়ে ওঠে, এত সরু যে একটু এদিক ওদিক হলে খাদে পড়তে হবে। সামাজিক জীবন মানে গুটিকয় সায়েব পরিবার, যাঁদের বিনোদন বলতে প্রচুর মদ্যপান, শিকার ও প্রমত্ত হই-হুল্লোড়। রবীন্দ্রনাথ যখন এসে পড়লেন, মৈত্রেয়ীর জীবনের বদ্ধ জলায় ঝর্ণার গতি ফিরে এল, যা যা ভুলে যেতে বসেছিলেন তা আবার মনে পড়তে থাকল। একেকবার থাকা শেষ করে ফিরে যাচ্ছেন কবি, মৈত্রেয়ীর পূর্ণ ভাঁড়ার খালি হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির কাজ করছেন তিনি, বাড়ি সাজাচ্ছেন দিনরাত, মেঝেতে মোমপালিশ, কাঁচের জানলা ঝকঝকে পরিষ্কার, বাইরের সিঁড়িতে জিরেনিয়াম, বাগানে ফুল আর অর্কিড, বাগান লাগোয়া ক্ষেতে সব্জি। কিন্তু মন ভরে না, যে দুস্তর শূন্যতা সঙ্গে নিয়ে মংপু এসেছিলেন তা কিছুতেই পেরনো যায় না।

আরও পড়ুন
বনের মধ্যে আরো : টঙিয়া, এফ ডি হোল্ডিং আর ইয়েসলু

এই শূন্যতার বোধের সঙ্গে লড়াই করতে নিজেকে কতভাবে ব্যস্ত রাখতে হত। সায়েবদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতেন, কিন্তু নিজের বাড়িকে, জীবনকে ওদের থেকে আলাদা রাখতেন। সিনকোনা বাগানের অফিসারদের বাড়িতে বাড়িতে পার্টিমোচ্ছব হত, সেখানে আশপাশের চা বাগান থেকে প্ল্যান্টার সায়েবরাও আসত। পুরুষরা মূর্খ ও বেহেড মাতাল, মেয়েরাও তথৈবচ। ফ্লার্টিং চলছে অবিরত, কিম্বা আরো কিছু। একবার এক সায়েব তাঁর পায়ের কাছে বসে পড়ে কেঁদে বলেছিল, আই ওয়ন্ট টু বি ইওর ডিয়ার। ডিয়ার শব্দটিতে খেলা ছিল, কারণ সেসময়ে মৈত্রেয়ী একটা হরিণ পুষেছিলেন। পার্টি ছাড়া ছুটির দিনে দলবেঁধে শিকার কিম্বা পিকনিক। এসবের মধ্যে মৈত্রেয়ীকে ঢুকতেই হত। ফলে মদ খাওয়ার এবং খাওয়ানোর জন্য সামাজিক চাপ থাকতই। সে চাপ মৈত্রেয়ী মেনে নেননি, নিজের বাড়ির পার্টির জন্য আনানো দামী বিলিতি মদের অনেকগুলো বোতল বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন একবার। সে বোতল পরে সিনকোনা শ্রমিকরা( যাদের বলা হতো কুলি) নিয়ে যায়। সায়েবরা এতে বেদম চটে গিয়েছিল। 

মৈত্রেয়ীর মংপুবাস সময়পর্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল সিনকোনা বাগানের পুরোনো সামাজিক ধাঁচটাকে ভাঙা। সে ধাঁচ ছিল ঔপনিবেশিক, সামন্তিয়। সায়েব অফিসারেরা অ-সায়েব অফিসারদের হেয় জ্ঞান করত। শ্রমিকদের সঙ্গে সামাজিক মেশামিশির প্রশ্নই ছিল না। রবীন্দ্রনাথই মৈত্রেয়ীকে প্রথম বলেন, সিনকোনা বাগানের যে সংখ্যাগুরু শ্রমিক সমাজ, তার সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করাটা দরকার। এত মানুষ তোমাকে ঘিরে আছে, অথচ তুমি কথা বলার লোক পাও না, এটা কি সম্ভব? ১৯৪০ এর পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালিত হয় মংপুতে। প্রচলিত প্রথা ভেঙে সেই অনুষ্ঠানে সিনকোনা বাগানের সমস্ত শ্রমিককে নিমন্ত্রণ করা হয়। এর আগে দার্জিলিং অঞ্চলেই এহেন ঘটনা ঘটেনি, অফিসারের বাড়ির অনুষ্ঠানে মজুরদের আসা বারণ তো ছিলই, এমনকি বাড়িতে ঢুকতে হলেও খালি পায়ে ঢুকতে হত। অফিসারের সামনে মজুরেরা ঘোড়ায় চড়তে পারত না, হঠাৎ সামনে পড়ে গেলে ঘোড়া থেকে নেমে সেলাম দিতে হত। না নামলে মার। মৈত্রেয়ী বলছেন রিচার্ডস নামের একজন সায়েব অফিসার ঘোড়া থেকে নামেনি বলে এক শ্রমিককে চাবুক মেরেছিল।

আরও পড়ুন
নীলপাহাড়ি অঞ্চলের টঙিয়ায়

রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন অনুষ্ঠানের পর থেকেই মৈত্রেয়ী শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান, নানান সামাজিক কাজ শুরু করেন। বিষয়টা সায়েবদের মনঃপুত হয় না। মৈত্রেয়ীর স্বামী ডঃ সেনকে তাঁর সায়েব উপরওয়ালা সতর্ক করে দেন। মৈত্রেয়ীরা সায়েব কর্তৃপক্ষের কতটা বিরাগভাজন হয়ে উঠেছিলেন, তা বোঝা যায় আরো কিছুদিন পরে। ১৯৪২-এ দার্জিলিং অঞ্চলে দাঙ্গা শুরু হয়(এই তথ্যও ন হন্যতে থেকে নেওয়া), ’৪২-এর দুর্ভিক্ষের অভিঘাতে। মৈত্রেয়ী বলছেন সায়েব কর্তৃপক্ষ পাহাড়িদের বাঙালিদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। সে সময় বাংলায় ফজলুল হক সাহেবের মন্ত্রীসভা, ফলে দুর্ভিক্ষ অবস্থার পুরো দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় বাঙালিদের ওপর। বাঙালিরা সায়েব মারে, আর গোর্খারা অনুগত, এরকম একটা প্রচার ছিল। ১৯৩৫-এ ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য এবং রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিং-এর লেবঙ ঘোড়দৌড়ের মাঠে বাংলার লাট জন অ্যান্ডারসানকে গুলি করেন। সমতলের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের উত্তাপ সেই প্রথম পাহাড়ে এসে পৌঁছল। শোনা যায়, ব্যাপারটা এতই অপ্রত্যাশিত ছিল যে পাহাড়িদের মধ্যে এ নিয়ে তুমুল উত্তেজনা তৈরি হয়, বঙালিলে সাহেবলাই গোলি মারেকো, অর্থাৎ বাঙালি সাহেবকে গুলি করেছে, মুখে মুখে এই কথাটা ছড়িয়ে গিয়েছিল দ্রুত। দার্জিলিং এর পুরোনো বাঙালি পরিবারে অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে যা ছিলো তাদের ওপর সেসময় সরকারি নির্যাতন চলে, অনেক বাঙালি দার্জিলিং-এর তিন পুরুষের বাস উঠিয়ে নিচে নেমে যান। বাঙালি আর গোর্খারা যে আলাদা, এই ভাবনাটা থেকে যায়, পরের ইতিহাসকে প্রভাবিত করে।

’৪২-এর দুর্ভিক্ষের সময় স্থানীয় শ্রমিকদের হাতে মৈত্রেয়ীর স্বামী আক্রান্ত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। গন্ডগোল হতে পারে জানা সত্বেও সিনকোনা বাগানের বাঙালি কর্মচারিদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়নি। এর পরেও দীর্ঘ সময় ধরে মৈত্রেয়ী শ্রমিকদের মধ্যে কাজ চালান। মংপুর বাড়িতেই ১৯৫১ সালে মংপু শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্র তৈরি হয়। কালক্রমে এই কেন্দ্র বাড়ির হাতায় তৈরি অন্য এক নতুন বাড়িতে উঠে গেছে, এখন তা পুরোপুরি সরকারি, সেখানে ঠিক কী হয় তা আমার জানা নেই। 

আরও পড়ুন
নীলপাহাড়ির খোঁজে

দীর্ঘদিনের পাহাড়বাসের সুবাদে মৈত্রেয়ী পাহাড়ি মানুষদের জানার সুযোগ পেয়েছিলেন। যে বনজঙ্গল দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, মানুষ, মানুষ কোথায়, সেই বনও প্রিয় হয়ে উঠেছিল। কোন পোকা পাতার মতো পড়ে থাকে, কোন গাছে মৌমাছির বাসা, কোন বনে মস ঝুলে থাকে, পাহাড়ি ঝর্ণার জলে কোন তিতপাতি বা তেতো পাতা ফেলে দিলে মাছেরা ভিড় করে তা খায়, কোন গাছের 'ছায়াচ্ছন্ন মৃত্তিকা শেওলার ভেজাগন্ধে চারিদিক ভরে রাখে' আর 'ঘোড়ার পায়ের নিচে ঘাসফুল আর বন্য ফার্ন' চাপা পড়ে যায়, এসব গূঢ় কথা তাঁর জানা হয়ে গেছে। বন, পাহাড়, আর সেখানকার মানুষ, এর সমস্তটা নিয়ে তাঁর জীবন পরিপূর্ণ, শূন্যতা আর তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে না।

সত্যিই কি তাই? শূন্য কি পূর্ণ হয় কখনো? যদি তাই-ই হয়, জীবনের প্রান্তে পৌঁছে কেন মৈত্রেয়ী ছুটে যাবেন ইউক্লিডকে দেখতে সুদূর শিকাগোয়? কেন নিজের সফল জীবনের মধ্যে ইউক্লিড তাঁকে নিয়ে যে গল্পটা বানান তার করাল ছায়াপাতের আশঙ্কা শেষজীবন অবধি তাঁকে ব্যস্ত রাখবে? সে বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ যাতে তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত না হয় তা নিয়ে তাকে প্রকাশককে একের পর এক চিঠি লিখতে হবে, এমনকি মামলার ভয় দেখাতে হবে?

আরও পড়ুন
পেশকের পথ ধরে

মৈত্রেয়ী ও ইউক্লিডের মৃত্যুর পর, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা থেকে ইউক্লিডের লা ন্যুই বেঙ্গলি বা বাঙালি রাত এবং ন হন্যতের ইংরেজি অনুবাদ একত্র প্রকাশিত হয়। ইউক্লিড শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন, ফলে বিষয়টা বোধগম্য। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, দুটো বইই এখনো বহুল পঠিত। আমাদের বাংলায় ন হন্যতে এই প্রজন্মের কতজন পড়ে বা পড়েছে তা নিয়ে সংশয় আছে। রবীন্দ্রনাথের অনুষঙ্গের বাইরে মৈত্রেয়ী বিস্মৃতপ্রায় চরিত্র। 

মংপুর সিনকোনা বাগান এবং আশেপাশের টঙিয়া বস্তি ও চা বাগানের চৌহদ্দিতে পুরোনো সায়েবরা কেউ নেই। বাঙালিরাও বিশেষ নেই। যে আদিম বনের কথা মৈত্রেয়ী বলেছেন তার প্রায় কিছুই বেঁচে নেই। বন কেটে যে সিনকোনা বাগান তৈরি হয়েছিল, তার অবস্থাও ওইরকম, গাছ বড় হয়ে বনের চেহারা নিয়েছে, পাতায় লাল দাগ, পোকা ধরেছে। মংপুর ঠিক নিচে তিস্তায় বাঁধ, পাহাড়ে ধস নামার দগদগে ক্ষত। সিনকোনা শ্রমিকদের বেশির ভাগের স্থায়ী কাজ নেই। মংপু সুরেল সিটঙ, নিচের রাম্বি তিস্তাবাজার জুড়ে গোর্খা জাতিসত্তার নামে অসৎ রাজনৈতিক গুন্ডা আর ঠিকাদার প্রোমোটারদের রাজত্ব। এইসব সময়ে মৈত্রেয়ীকে, তার মংপুর বাড়িটাকে মনে করতে বড় ইচ্ছে হয়। সন্ধ্যা নেমেছে, বড় বড় গাছের তলায় অন্ধকার। রবীন্দ্রনাথ চলে যাবেন পরদিন। মৈত্রেয়ী রবীন্দ্রনাথের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, শ্রদ্ধা, আবেগ আর ভালবাসার যে দান মৈত্রেয়ীর কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন, এ তাঁর জীবনে আগে ঘটেনি। প্রথমবার মংপু গিয়ে যা লিখেছিলেন, তা মনে পড়ছে: রবিঠাকুরের পালা শেষ হবে সদ্য/ তখনো তো হেথা এই অখন্ড অদ্য/জাগ্রত রবে চির দিবসের জন্যে/এই গিরিতটে এই নীলিম অরণ্যে/তখনো চলিবে খেলা নাই যার যুক্তি/বার বার ঢাকা দেওয়া বার বার মুক্তি।

মংপু থেকে রাম্বির দিকে নামছি সেদিন। দূরের পাহাড় নিচের উপত্যকা মেঘে ঢাকা। হঠাৎই মেঘ সরে গেল, রোদে ধুয়ে দিল পাহাড়শ্রেণী, উপত্যকা, সমতল। সবুজের ওপর নীলের ছোপ, তাকে ঘিরে মেঘের সাদা, পাহাড়ের ঢালে বাড়িঘর, আচমকা লালের ছোঁয়া। বারবার ঢাকা দেওয়া বারবার মুক্তি।

অলংকরণ - বিপিন খুজুর ওঁরাও

Powered by Froala Editor