চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও নিসর্গ

সময়ভ্রমণ - ৬৪
আগের পর্বে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ‘ইউরোপিয়’ জাতিপরিচয় আর রইল না। শত্রু দেশ, শত্রু জাতিদের চিহ্নিত করাই তখন লক্ষ্য। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, ইংরেজরাও ইহুদিদের সন্দেহের চোখে দেখছে। অথচ তাঁরা ততদিনে জেনে গিয়েছেন, ইহুদিরা আর যাই হোক, নাজিপন্থী নন। ইতিমধ্যে জার্মানি, অস্ট্রিয়া থেকে বহু মানুষ আশ্রয় নিতে কলকাতায় ছুটে এসেছেন। তাঁদের সবাইকেই নানাভাবে হেনস্থা করছে ব্রিটিশ পুলিশ। কাটাপাহাড়ে তৈরি হয়েছে বিশেষ জেলখানা। সেখানেও ইহুদি এবং আর্য ভেদ করা হচ্ছে। অর্থাৎ নাজিদের তৈরি করা জাতিতত্ত্ব মানছেন ব্রিটিশরাও। কাটাপাহাড়ে বন্দি সেইসব মানুষদের গল্প আর কতটুকুই বা মনে রাখা হয়?

লেডি পাইওনিয়র বা নিনা মাজুসেল্লির কথাটা এ আখ্যানে এল কেন বলি। দার্জিলিংয়ের নিসর্গ, বিশেষত চা-বাগিচা(বাগান কথাটা তিনিও ব্যবহার করেননি) নিয়ে নিনা আহাবাহা তো করেনইনি, উল্টে তাঁর দেখায় শ্লেষ এবং দুঃখের ছায়াপাত ঘটেছে। দার্জিলিং প্রথমবার ওঠার পথে কার্সিয়াং-এ তাঁদের যাত্রাভঙ্গ হয়। ওই এলাকার এক বাগিচায় ভ্রমণের বিবরণ দিয়েছেন নিনা:

‘এক ঘণ্টাকাল অশ্বপৃষ্ঠে ভ্রমণ করিয়া, সহসাই আমরা এস্টেটের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। এস্থলে চা রোপণ নিমিত্ত অরণ্যমধ্যের মহান বৃক্ষরাজি নিধন করা হইয়াছে, চারিদিকের পর্বতই বৃক্ষশূন্য, কৃষ্ণ। 

যে কোন চা-বাগিচা প্রভূত পরিমাণে অ-চিত্রবৎ। কল্পনা করিতে পারি, প্ল্যান্টার ভিন্ন কেহই উহা দেখিয়া আনন্দ লাভ করিবে না। দূর হইতে ইহাকে দেখিলে ভ্রম হয়, যেন একটি বৃহৎ ও অ-রোমান্টিক বাঁধাকপি বাগান দেখিতেছি--একরের পর একর খর্বকায় হরিৎ গুল্ম, সারিবদ্ধভাবে রোপিত...যেইদিকে দৃষ্টি যায়, ভিন্নতর কিছু নাই, না বর্ণ না রূপ…’

সেই তুলনায় পাহাড়ি মানুষজনের মধ্যে এবং তাদের গ্রামে অনেক বেশি রঙ এবং সৌন্দর্য দেখেছিলেন নিনা:

আরও পড়ুন
সায়েবদের জাতবিচার, শত্রু-মিত্র ও কাটাপাহাড়ের গল্প

‘কেবলমাত্র বাসিন্দারাই যে চিত্রবৎ, তাহা নহে, উহাদের পরিপার্শ্বও...নিসর্গশোভা বাড়ায়, নিসর্গের সহিত উহারা একাত্ম হইয়া যায়। পর্বতগাত্রে উহাদের পাটল কুটিরগুলি বিন্দুবৎ দেখা যায়, খড়ের মধ্য দিয়া সুললিত নীল ধূম্রজাল বাহির হইয়া আসে, উজ্জ্বল বস্ত্র পরিহিত মানুষগণ দরোজার নিকট দাঁড়াইয়া অথবা বসিয়া, এই সমস্তই যেন নিরন্তর চলমান বর্ণশোভার এক প্রদর্শনী।.......ভগ্নপ্রায় কুটিরে, সকল প্রকারের আবর্জনা পরিবৃত হইয়া, তন্মধ্যে সুড়ঙ্গ করিয়া থাকিতে উহারা ভালোবাসে...উহাদিগের সঙ্গে উহাদের অসংখ্য সন্তানাদি--ছাগ, মেষ, শুকর, মুর্গী--সকলে একত্র একটিই কক্ষে বাস করে, একই সুখী ও সন্তুষ্ট পরিবারের সদস্যরূপে…’

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ(সাত)

ঘোড়া থামিয়ে গ্রামে ঢুকে ছবি আঁকতে চাইছেন নিনা, লোকে লজ্জা পাচ্ছে। কারুর বাড়ির চাল ভাঙা, কারুর দরজায় ছেঁড়া জুতো ঝুলছে, কারুর উঠোন নোংরা। এসবের কেউ ছবি আঁকে? একবার নিনা গ্রামে গিয়ে রংতুলি ইজেল নিয়ে বসেছেন, তাঁর সামনে গ্রামের কুঁড়েঘরগুলো, হঠাৎই মহিলারা তাঁদের ঘরের আঙিনা পরিষ্কার করতে শুরু করলেন। নিনা যারপরনাই বিরক্ত হলেন:

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ(ছয়)

‘সহসা সকলে হাঁচড়পাঁচর করিয়া অঙ্গন পরিষ্কার কাজে ব্যস্ত হইয়া পড়িল… স্তূপীকৃত সুমিষ্ট আবর্জনা মুহূর্তে দূরীভুত হইল— বহু বৎসরের সঞ্চয়, যাহাতে আমার শিল্পীমন নিবদ্ধ ছিল...’

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (পাঁচ)

নিনা বর্ণবাদী ছিলেন, তাঁর লেখা পড়ে এরকম মনে হয় না। স্থানীয়দের সম্পর্কে তাঁর মনোভাব ছিল, যে যেখানে আছে, ভালো আছে। দারিদ্র্য, নোংরা, এসবই সেই ভালো থাকার অংশ। স্থানীয়দের গ্রাম পাহাড়ি নিসর্গের বিপুলতায় বহুরঙের জীবন্ত ছিটে, ছবি হবার মতো, শিল্পকর্মের বিষয়। নিনা যে সময়ের বাসিন্দা, ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের মধ্যবিন্দু, উপনিবেশেও নিসর্গবদল আরম্ভ হয়ে গেছে, যা নিনার লেখাতেও ধরা পড়েছে। ভিক্টরিয় ব্রিটেনের বাসিন্দাদের দারিদ্র নিয়ে মোহাবিষ্ট হবার কারণ ছিল না, ডিকেন্সের লেখা পড়লেই তা বোঝা যায়। অথচ, নিনার দেখার ধরণে যে রোমান্টিকতা ও  মুগ্ধতাবোধ, তাতে দেখা যতটা, না দেখাও ততটাই। স্বামী রাজকর্মচারী, তায় ধর্মযাজক, সম্ভবত সেকারণেও গোলমেলে প্রশ্নের ভিতর নিনা ঢুকতে চাননি। এখানে ওখানে বেড়াতে গিয়ে যেরকম আমাদের হয়, যেরকম আমরাও মুগ্ধ হয়ে ছবি দেখি, ছবির ভিতরে কদাচ ঢুকি না, ঢুকতে চাই-ই না। 

বড়ো বাড়ি, ছোটো বাড়ি, বস্তি, বাজার। পাহাড়ি শহরের একটাতেও আবর্জনা ফেলার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। নিকাশি বা সুয়ারেজ সে-ই সায়েবি আমলের, তার ক্ষমতা নেই এত মানুষের চাপ নেবার। প্রতিদিনের ব্যবহারের জল তো নেই-ই। শহরের বাইরের ঝোরা থেকে কে প্লাষ্টিকের ট্যাঙ্কে করে জল নিয়ে এসে কোথায় কত দামে বেচবেন, তা নিয়েও গুন্ডামি চলছে। 

দু-দুটো গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন গেল। মানুষ কীভাবে আছেন, কীভাবে থাকবেন, শহরগ্রামের মাটি কার দখলে থাকবে, সে মাটিতে কী থাকবে, এসব নিয়ে সে আন্দোলনের নেতাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা আছে, মনে হয়নি। ডিজিএচসি গিয়ে জিটিএ এল, বালাসন নদী থেকে তুলে দার্জিলিং শহরে জল নিয়ে যাবার একটা প্রকল্পের কথা গত তিরিশ বছর জুড়ে শুনছি। কিছুই হয় না। গোর্খাল্যান্ড রাজ্য হলে কি সুরাহা হবে? 

২০১০-এর মে মাসে, দার্জিলিংয়ের ক্লাবসাইডে, ভরা দুপুরবেলায় গোর্খা লিগ নেতা মদন তামাং খুন হলেন। কারা খুন করল সবাই জানে, জানত। খুন হওয়া মদন তামাংকে চিনতাম না, শুনেছি মানুষটি পড়াশুনো করতেন, সুবক্তা ছিলেন। গোর্খাল্যান্ডওয়ালাদের দাপটে পাহাড় যখন কাঁপছে, তিনি একাই সভা করে বেড়াচ্ছেন। শুনেছি, প্রত্যেক সভায় তিনি প্রশ্ন করতেন, গোর্খাল্যান্ড তো হল, তারপর কী?(বেসকিও এ প্রশ্নের কথা উল্লেখ করেছেন) বহু বহু বহু চাঁদ আগে যাজ্ঞবল্ক মুনি শিষ্যা গার্গীকে বলেছিলেন, গোলমেলে প্রশ্ন করলে মাথা খসে পড়ে। মদন তামাংয়ের মাথা খসে না পড়লেও কাটা গেল। প্রশ্নের উত্তর, বলা বাহুল্য, পাওয়া গেল না। 

পুরোনো বন কেটে, পুরোনো মানুষদের সরিয়ে দিয়ে সায়েবরা নতুন শহর করলেন, রাস্তা করলেন, রেল লাইন বসালেন। নোংরা দুর্গন্ধ গরম সমতল নয়, ঠান্ডা পাহাড়, সুস্থ হবার, ছুটি কাটানোর, শাসন ও ব্যবসা করার জায়গা। মুশকিল হচ্ছে, শাসন ও ব্যবসা করার কিছু সীমা আছে। প্রকৃতিকে কতদূর অবধি শাসনে বাঁধা যায়, প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে ব্যবসাই বা করা যায় কতদিন? শাসন এবং ব্যবসার নিয়মে প্রকৃতি চলবেই, এমন তো নাও হতে পারে। 

যেমন, সায়েবি, সুন্দর, বশ হয়ে থাকা পাহাড়ে পরপর ধস নামতে শুরু করল। পাহাড়ি ঢালে বড়ো গাছ নেই, ঘাস কম, লতাগুল্ম নেই, শহর এবং রকমারি বাগিচা আছে। বাগিচা বানাতে, শহর বসাতে গিয়ে মাটির ওপরের অংশ ক্ষয়ে গেছে, তাতে বৃষ্টির জল লেগে লেগে নরম পাহাড়ের মাটি পাথর আলগা হচ্ছে। সেই মাটি পাথর সঙ্গে নিয়ে পাহাড় নেমে আসছে যখন, কিছুই করার থাকছে না। 

উনিশ শতকের শেষ, বিশের শুরু, মাটি ক্ষয়ে যাওয়া এবং ধসের ঘটনা দার্জিলিং-এ নিত্যদিনের হয়ে দাঁড়ায়। চায়ের উৎপাদন ব্যাহত হতে থাকে, সরকারও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ১৯০৯ থেকে ১৯১৩-র মধ্যে একাধিক সরকারি কমিটি তৈরি হয় বনধংস বা ডিফরেস্টেশনের ফলাফল জানার জন্য। ১৯১১-য় প্রকাশিত 'দার্জিলিং নিরাপত্তা কমিটি'-র রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, পাহাড়িদের পানিক্ষেত(যে চাষে জল লাগে, বিশেষত ধান ও বড় এলাচ) থেকে ধসের বিপত্তি। ১৯০৯ সালের আর একটি রিপোর্টে পাহাড়ি ঢালে পশুচারণকে ধসের জন্য দায়ী করা হচ্ছে, পশুরা ছোটো চারাগাছ খেয়ে নেয় বলে ঢালে বড় গাছের বন হতে পারে না। ১৯০৯-এই, এক বনবিভাগের অফিসার এবং দুই প্ল্যান্টারকে নিয়ে তৈরি আর একটা কমিটি পানিক্ষেতকেই দোষী সাব্যস্ত করে। সে রিপোর্টে বলা হয়, রঙ্গীত নদীর পূবধারের পাহাড়গুলোয় একটাও গাছ নেই, নদী খাত বদলাচ্ছে, যেখানে-সেখানে ধস নামছে। বিভিন্ন কমিটিগুলো ধান ও এলাচের ক্ষেতে নতুন বন তৈরির পরামর্শ দেয়। 

এই সব রিপোর্ট একসঙ্গে পড়লে বোঝা যায়, প্ল্যান্টারদের বিপক্ষে যেতে পারে, এমন কিছু বলা যাবে না, অথচ ধস থামানোর উপায়ও বার করা দরকার, এইরকম একটা অবস্থান থেকে ক্ষেতে গাছ লাগানোর সুপরামর্শ। যেহেতু ক্ষেত করেন যে চাষিরা তাঁরা খাস সরকারি প্রজা, বাংলা সরকার এই পরামর্শ মানলেন না। ১৯১১-র অক্টোবরে রাজস্ব বিভাগকে লেখা চিঠিতে দার্জিলিং-এর জেলাশাসক ই এচ সি ওয়ালশ বলছেন, শুধুমাত্র পানিক্ষেতকে দায়ী করার কোনো মানে নেই। বহু জায়গায়, কর্ষিত খাসজমির আশপাশের বন চা-এলাকার বনের তুলনায় ভালো অবস্থায় আছে। প্রায় বাগিচাই গাছহীন ন্যাড়া ঢালে, ধস তৈরি হচ্ছে সেখান থেকেও। বাগিচা যেমন তুলে দেওয়া যাবে না, চাষ বন্ধ করাও সম্ভব নয়।

Powered by Froala Editor