মূলত মহাফেজখানার ফাইলের ওপর নির্ভর করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাটাপাহাড় ব্যারাকে আটক থাকা বন্দিদের নিয়ে একটি অসমাপ্ত গবেষণা ও পাণ্ডুলিপির কথা বলেছিলাম। সেখান থেকে কিছু গল্প ও তথ্য দিলে বোঝা যাবে কেন ওয়েরনিকে পরিবার দার্জিলিং ছেড়েছিলেন, অবস্থাটা ঠিক কিরকম ছিল। যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যাবার পর, সরকারের নজরে 'ইউরোপিয়' জাতিপরিচয় বলে আর কিছু রইলো না। জেলার পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেওয়া হল শত্রুদের তালিকা বানাতে। শত্রু কে বা কারা?
‘...শত্রু নাগরিক, শত্রু দেশ থেকে আসা অভিযোজিত(ন্যাচুরালাইজড)ব্রিটিশ নাগরিক, ব্রিটিশ কিম্বা ব্রিটিশ-ভারতীয় প্রজা যাদের সঙ্গে সম্ভাব্য বিরোধী শক্তির' যোগাযোগ আছে...’
নাজিশাসিত ও নাজি-নিয়ন্ত্রণাধীন ইউরোপ জুড়ে ইহুদিদের তাড়া করে করে ঘেটোয় আটকানো হচ্ছে তখন, অথবা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে খুন করা হচ্ছে। ইংরেজরা ততদিনে জেনে গেছেন, ইহুদিরা আর যাই হোন, নাজিপন্থী নন। অথচ, তাড়া-খাওয়া জার্মন ইহুদিদের শত্রু বলে জেলে পোরা হল, যে সে জেল নয়, পাহাড়ের মাথায় কাটাপাহাড়ের স্যাঁতসেঁতে হিমঠান্ডা ব্যারাক, সারাক্ষণ সেখানে কনকনে হাওয়া। বহু নাম, মানুষ, গল্প কাটাপাহাড়ের সেনাছাউনিতে ঢুকে আছে, কে সেসবের সন্ধান রাখে?
যেমন, দার্জিলিংয়ের ডাক্তার আলেকজান্ডার রোনাল্ড। অস্ট্রিয়া থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। তাঁর বাড়িতে এরিয়াল সমেত রেডিও কেন বসানো হয়েছে, সে অপরাধে পুলিশ তাঁকে জেরা করতেই থাকে। দার্জিলিংয়েরই আর একজন ডাক্তার পুলিশের কাছে নালিশ করেছিলেন। রোনাল্ড শেষ পর্যন্ত সুইজারল্যান্ড পাড়ি দেন ১৯৪৭-এ। আর এক অস্ট্রিয়ান ইহুদি, ভিলহেলম স্টার্কম্যান-কে ১৯৩৮-এ গেস্টাপো গ্রেপ্তার করে, দাচাউ ক্যাম্পে পাঠায়। কোনোভাবে ছাড়া পেয়ে ভারতে আসেন, গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ নেন। তাঁকে আবার ধরে কাটাপাহাড়ে পাঠানো হয়। বছর দেড়েক পর, কোম্পানির লোকজন চাপ দিয়ে, কাকুতি-মিনতি করে কোনোক্রমে তাঁকে ছাড়ায়। আর এক ইহুদি, হেলমুট কার্ল অর্থেইলার। দেশ থেকে পালিয়ে কলকাতা এসেছিলেন, কাজ করতেন পলতার বেঙ্গল এনামেলে। তাঁকেও কাটাপাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে অসুখ বাঁধিয়ে, শেষটায় সিমলার রিপন হাসপাতালে তিনি মারা যান ১৯৪৫-এ। অথবা, ম্যাকসিমিলিয়ান বার্নহার্ড বাওয়ার, অস্ট্রিয়ার নাজিবিরোধী লড়াইয়ের কর্মী, কোনোক্রমে ভারতে আসেন। শত্রুর চর বলে কাটাপাহাড়ে আটক হন। তাঁর আত্মীয়রা তাঁকে ছাড়ানোর নিষ্ফল চেষ্টা করে যান, শেষমেশ চিলি থেকে তাঁর শ্বশুরমশাইয়ের পাঠানো চিঠি পড়ে ব্রিটিশদের মনে হয়, লোকটা তো সত্যি কথাই বলছিল। ১৯৪৩-এ যখন ছাড়া পাচ্ছেন, বাওয়ার মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত, অসুস্থ। এরকম কত নাম, মানুষ। ফ্রেডেরিক ফকেনস্টাইন, জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক দলের সদস্য, কোলোনের নগরপরিষদের নির্বাচিত সদস্য। ডাক্তার এমিলি শুসম্যান, জার্মানি অস্ট্রিয়া দখল করে নিলে দেশ ছেড়ে পালান। তাঁর স্বামী নিউজিল্যান্ডে যান, তিনি ভারতে।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ(সাত)
এমিলির ঠাঁই হয় কাটাপাহাড়ে। সেখানে আর এক বন্দি গুস্তাভ কার্স, তাঁর সঙ্গে এমিলির প্রেম, সম্পর্ক, সন্তান। ১৯৪১-এ সেই শিশুসন্তানসহ তিনি নিউজিল্যান্ড পাড়ি দিচ্ছেন, স্বামীর সঙ্গে মিলিত হতে। গুস্তাভ থেকে যাচ্ছেন দার্জিলিংয়ে। যুদ্ধশেষে সেন্ট পলস ইস্কুলে কাজ নিচ্ছেন। স্বামী মারা গেলে এমিলি তাঁর কাছে ফিরে আসছেন ১৯৪৬-এ। দুজনে মিলে আমেরিকা চলে যাচ্ছেন ১৯৪৭-এ।
সমসাময়িক সরকারি দলিলে দেখা যাচ্ছে, ইহুদিদের রাখা হচ্ছে অ-ইহুদি শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে, যাঁদের বলা হচ্ছে 'এরিয়ান', অর্থাৎ আর্য। অর্থাৎ, নাজিরা যেভাবে জাতিপ্রথা মেনে আর্য-অনার্য ভাগ করত, সেই জাতিনিয়ম বা রেস কোড ব্রিটিশরাও মানছে। জাতিনিয়মের কথায়, ডি এন মৈত্র নামের এক কলকাতাবাসী বাঙালি ডাক্তার এবং তাঁর প্রেমিকা মিসেস সর্জের গল্প চলে আসে। ডাক্তার মৈত্র আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন কাটাপাহাড়ে আটক সর্জকে ছাড়াতে। সর্জকে সরকারি খাতায় 'জার্মন আর্য বংশীয়' বলে দেখানো ছিল, তাঁকে ছাড়া হচ্ছিল না। ডাক্তার দার্জিলিংয়ে চলে গেলেন, কাটাপাহাড়ে ঘোরাঘুরি করলেন, লাভ হল না।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ(ছয়)
অনেক গল্পের মধ্যে স্ট্যারি পরিবারের, অর্থাৎ টিবর স্ট্যারির গল্পটা আলাদা করে বলতে হয়। এঁরাও তাড়া খাওয়া অস্ট্রিয়ান ইহুদি। পুলিশের নথিতে বলা আছে, পরিবারের সবাই গানবাজনায় দক্ষ। স্ট্যারি ভাইবোনেদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ টিবর সস্ত্রীক কলকাতা আসেন ১৯৩৭-এ, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে কাজ নেন। ১৯৩৯-এর ফেব্রুয়ারি নাগাদ তাঁর কনিষ্ঠ ভাই সিগফ্রিড এবং বোন এলিজাবেথ কলকাতায় চলে আসেন, সঙ্গে তাঁদের মা, মেরি। সরকারি রিপোর্টে বলা ছিল, টিবরের বাবা ছিলেন 'বিশেষ খ্যাতিমান সঙ্গীতকার', যাঁকে বেলজিয়ামে থেকে যেতে হয়েছিল। তিন স্ট্যারি ভাইবোনকেই ১৯৪০-এর গোড়ায় দার্জিলিং পাঠানো হয়, টিবরের স্ত্রীকেও।
বন্দি অবস্থাতেই টিবর ঠিক করেন আবার বিয়ে করবেন। বন্দিশিবিরের বাইরের কারুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। সেই বিয়ে নিয়ে শিবিরের বাকি বন্দিরা প্রচুর চেঁচামেচি করেন। কাটাপাহাড় শিবিরের এম ও(মেডিক্যাল অফিসার) ডব্লিউ. এ. গার্সনের(ইনিই রোনাল্ডের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন) পাঠানো এবং সেন্সর করা একটা চিঠি থেকে কী হয়েছিল জানা যাচ্ছে। টিবরকে নাকি জেলের মধ্যেই তাঁর প্রেমিকার সঙ্গে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। বাকি বন্দিরা এতে ক্ষেপে যান। তাঁদের যেখানে বাইরের কারুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেই আগে থেকে অনুমতি নিতে হয়, টিবরের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা কেন? সে যাই হোক, টিবর বিশেষ এলেমদার লোক ছিলেন সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় বিয়ের পর তিনি মিসেস ক্লাইন নামে আর এক মহিলাকে 'ভয় দেখান ও মারধোর করেন'। টিবরের নববিবাহিত বধূ সন্দেহ করছিলেন ক্লাইনের সঙ্গে টিবরের সম্পর্ক আছে। ডাক্তার গার্সন হাঁ করে দেখছিলেন জেলের বড় অফিসারের ঘরের সামনে টিবর এসব করছেন, কেউ আপত্তি করছে না, তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরস্থান। গার্সন তাই দেখে আহমদনগর জেলে আটক এক জার্মন বন্দিকে চিঠি লিখে এসব জানান। মিসেস ক্লাইনের স্বামীও তখন আহমদনগর জেলে আটক, তিনি যাতে জানতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে। জর্মন বন্দীর সঙ্গে এম ও-র ঘনিষ্ঠতা সরকার সুনজরে দেখেনি, গার্সনকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (পাঁচ)
টিবর বিশেষ সুবিধা পাচ্ছিলেন কেন? তাঁর বিরুদ্ধে জেল কতৃপক্ষ ব্যবস্থা নেননি কেন? এ সব প্রশ্নের উত্তর নেই, টিবরের ফাইলে এই প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য ছিল না। পুলিশের নথিতে দেখা যাচ্ছে, টিবরের দ্বিতীয় বৌ-এর বাবা বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার, রীতিমতো প্রভাবশালী ব্যক্তি। টিবর ছাড়া পাওয়ার পর তাঁর কাজ খুঁজে দেবার দায়িত্ব তিনিই নেবেন, এমন কথা ছিল। শ্বশুরের তদবিরে মুক্তি পেয়ে টিবর গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে তাঁর পুরোনো কাজে ফিরে যান। তাঁর প্রথম স্ত্রী এবং শিশুকন্যার কী হল? আরো অনেক গল্পের মতো, এই গল্পটাও হুট করে এখানেই শেষ হয়, ফলে অনেককিছু অজানা, অমীমাংসিত থাকে।
Powered by Froala Editor