চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ(সাত)

সময়ভ্রমণ - ৬১
আগের পর্বে

গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সঙ্গে আদিবাসী ভাবনাকে মেলাতে চাইলেন সুভাষ ঘিসিং। কিন্তু পাহাড়ে ক্ষমতাবানদের অধিকাংশই উচ্চবর্ণের। তাঁরা আদিবাসী হতে রাজি হলেন অনেকে। কিন্তু পাথর এবং বাঁদর পুজোয় স্বীকৃত হলেন না। ফলে আন্দোলনে চির ধরল। ২০০৭-০৮ সালে দল ভেঙে গেল। প্রায় প্রত্যেকেই এলেন নতুন দলে। এর মধ্যে নানারকম সরকারি নীতি এসেছে। দার্জিলিং-এর চা জি-আই তকমা পেয়েছে। তবে তার পরেও রাতের অন্ধকারে নেপাল থেকে আসা চা মিশে যায় দার্জিলিং-এর কারখানায়। ‘ফেয়রা ট্রেড’-এর প্রতিশ্রুতিও অলীক হয়ে থাকে। মালিকপক্ষের মুনাফা বাড়তে থাকে। কিন্তু শ্রমিকদের অবস্থার কোনো উন্নতিই হয় না। এমনকি দার্জিলিং-এর আনাচে কানাচে নানা পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বহুতল উঠতে শুরু করেছে। শুরু হয়ে গিয়েছে প্রোমোটার রাজত্ব।

কেভেন্টার্সের সামনে দিয়ে গান্ধী রোড ধরে খানিকদূর গেলে বাঁ-ধারে বিখ্যাত এভারেস্ট হোটেল। পাথরের বাড়ির ওপর শ্যাওলা পড়েছে, পিছনে জঙ্গল, আবর্জনা। নেতার নজরে এই বাড়িজমিও ছিল, কোনো কারণে সেটা নেওয়া যায়নি। এক পর্যটন ব্যবসায়ীর কাছে শুনেছিলাম, এভারেস্টের বাড়িটা কেউ একটা কিনেছেন, সেখানে নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি বানানো হবে। 

জলাপাহাড়ের পথের বাঁ ঢালে তুংসুং এলাকার বস্তি। স্টেশনের নিচ দিয়ে স্যানেটোরিয়ামের আর চাঁদমারির দিকে যেতেও তাই। টিন, কাঠ, রঙিন প্লাস্টিক দিয়ে কোনক্রমে বানানো ঘুপচি ঘরে মানুষ গাদাগাদি করে আছেন। না থাকলে ট্যুরিস্ট,  ব্যাপারি এবং ঠিকাদারের মাল টানবে কে, কে-ই বা হোটেল পরিষ্কার করবে, চৌরাস্তার আস্তাবলের ঘোড়াদের দেখাশুনা করবে? সমতলের লোক পাহাড়ে আসবেন, দার্জিলিং দেখবেন, তাঁদের খিদমৎ খাটবে কে? একজনের ছুটি, অন্যজনের শ্রম, নিয়মের ব্যতিক্রম হবার জো কোথায়?

শ্রম এবং শ্রমের সায়েবি নৃতত্ব। দার্জিলিংপত্তন, দার্জিলিং বেড়ানো, দার্জিলিং চা, পাহাড়ের বন-সিঙ্কনা এবং দার্জিলিংয়ের গোর্খা, এর প্রত্যেকটিতে শ্রমের নৃতত্ত্ব নিহিত। নৃতত্ত্ব বলছি বটে কিন্তু আসলে অবিমিশ্রিত জাতিবর্ণবাদ, রেসিজম। 

আর ডি ওব্রায়েনের লেখা ‘দার্জিলিং: দি স্যানিটোরিয়াম অফ বেঙ্গল য়্যান্ড ইটস সারাউনডিংস’ প্রকাশিত হচ্ছে ১৮৮৩ সালে, কলকাতার নিউম্যান অ্যান্ড কোম্পানি থেকে। নিউম্যানের দোকানটা ডালহৌসিতে দীর্ঘকাল যাবৎ রয়েছে, বেড়ানোর জন্য দরকারি ম্যাপ, গাইডবই এবং রেল ও অন্যান্য যানবহনের খবরে ভর্তি পাঁজির মতো মোটা ব্র্যাডশ ওই দোকানে পাওয়া যেত। ওব্রায়েনের বইটা সেসময়কার প্রসিদ্ধ গাইডবই, দার্জিলিংয়ে যারা ছুটি কাটাতে যাচ্ছে তাদের কাছে থাকতই। সে বইতে দার্জিলিংয়ের দ্রষ্টব্য ইত্যাদি নিয়ে বলা ছিল, সেইসঙ্গে ছিল স্থানীয় লোকজন সম্পর্কে টিপ্পনি, কাকে দিয়ে কী কাজ করানো যায়, কোন জাত কেমন, এইসব। 'চাকরবাকর' বলে একটা আলাদা অংশই ছিল বইতে। পাহাড়ে চাকর যোগাড় হয় কিনা, সমতল থেকে নিয়ে আসতে হয় কিনা, কার মজুরি কীরকম, এইসব সেখানে লেখা। পাহাড়ের চাকরে খুব খরচ, তাদের সামলানোও মুশকিল, ওব্রায়েনের মন্তব্য। অতঃপর তিনি বিশদে বলছেন:

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (চার)

‘অনেক পার্বত্যপ্রজাতির লোকই অতি উত্তম ভৃত্য হইয়া থাকে। স্বল্প বয়সে পাকড়াইতে পারিলে ভুটিয়া এবং লেপচাদিগে অতি উত্তম রাধুনি ও খিদমতগার তৈয়ার করা যায়, ইহাদের জাত লইয়া সংস্কার নাই, যে কোনো কর্ম ইহারা করিতে পারে। ভুটিয়া এবং লেপচা মহিলারা শিশুদের উত্তম আয়া হয়, পূর্ব হইতেই কোনো মনিব ইহাদিগে যদি আদর দিয়া খারাপ না করে, ইহারা মেথরানিকর্ম করিতেও ইতস্তত করে না। ভুটিয়াদের দিয়া সহিসের কাজ হয় না, লেপচা দিয়েও না, কিন্তু নেপালিরা এই কাজ মন দিয়া করে… অশ্বের যত্ন পরিচর্যার কাজে সহিসকে সাহায্য করে পাত্তাওয়ালা, যে প্রতি অশ্বের জন্য বহুদূর হইতে বংশপত্র আনিয়া দেয়। ...ভিস্তি এবং ধোবিরা সমতলবাসী। ডান্ডিবাহকরা ভুটিয়া অথবা লেপচা। ইহারা সচরাচর নোঙ্গরা, অবাধ্য এবং গুন্ডা প্রকৃতির হইয়া থাকে...আশা করা যায় পাহাড়ি কুলিদের মজুরি লইয়া মি. ম্যাককাউলের বিল আসিলে ইহারা ঢিট হইবে।...’

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (তিন)


আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (দুই)

পর্যটকদ্রষ্টব্য হিসেবে দার্জিলিং বাজারের কথা বলতে গিয়ে আবার পাহাড়ি মানুষদের কথা আসছে:

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ

‘নোংরা হইলে কী হয়, ইহারা চিত্ৰবৎ: লিম্বু, লেপচা, নেপালি, ভুটিয়া, কাবুলি এবং ষণ্ডাগোছের তিব্বতীয়...জিলাস্থ সব শ্রেণির ও জাতির লোক রহিয়াছে, তৎসহ বাগিচার গরিব কুলিও…’

বইতে বাগিচা নিয়েও অনেক কিছু বলা ছিল। পাহাড়ে বাগিচাশুরুর আদিপর্বে কী করে ঠগ-প্রতারকরা এক টুকরো বাগিচা দেখিয়ে বাইরে থেকে সদ্য আসা লোকজনের কাছে কার্যত অস্তিত্বহীন বাগিচা(না জমি, না চাগাছ) বিক্রি করত, সে বৃত্তান্তও। ১৮৬৫-৬৬ নাগাদ চা-ব্যবসায় যে মন্দা দেখা দেয়, তার কারণ এইজাতীয় প্রতারণা, ওব্রায়েনের মত। সে যাই হোক, বাগিচা দেখা প্রত্যেক দার্জিলিং ভ্রমণার্থীর অবশ্যকর্তব্য:

‘বাগিচাগুলি শৃঙ্খলা এবং পরিছন্নতার প্রতিমূর্তিবৎ...নেপালি কুলিগণও খুবই আগ্রহজনক। নোংরায় সর্বাঙ্গ ঢাকা, তৎসত্ত্বেও কতিপয় মহিলা সুদর্শনা, পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সকলেই প্ৰফুল্লচিত্ত, এবং উত্তম অবস্থায়...সত্য বলিতে কি, বাঙালি মজুরদিগের সম্পূর্ণ বিপরীত। ইহারা উত্তম বেতন পায়, উত্তম স্থানে বাস করে, প্রত্যেক পরিবারের নিজস্ব ভূমি রহিয়াছে, যাহাতে উহারা ভুট্টা ও মারওয়া ফলাইয়া থাকে...’

শ্রমের নৃতত্ত্ব, শ্রম-জাতির আন্তঃসম্পর্ক ছাড়াও ও'ব্রায়েনের বই থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং সন্ধান মেলে। এক, গাইডবইতে বলা হয়েছে উনিশ শতকের শেষদিকের দার্জিলিংয়ের কথা, অথচ, অধিবাসীদের বর্ণনায় কোথাও 'গুর্খা' জাতির উল্লেখমাত্র নেই, বারবার বলা হচ্ছে নেপালিদের কথা। অথচ, সেসময় দার্জিলিংয়ে গুর্খা রিক্রুটিং শুরু হয়ে গিয়েছে, লাগোয়া পূর্ব নেপালে আরো আগে থেকেই। স্পষ্টত, সেনাদলে যারা কাজ করবে একমাত্র তারাই 'গুর্খা' এবং নেপাল থেকে আসা পাহাড়ি কুলিরা নিতান্তই 'নেপালি', এভাবেই দেখা হত। দুই, কোথাও 'টি গার্ডেন' বা 'চা বাগান' শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয়নি। আগাগোড়া, 'প্ল্যান্টেশন' বা বাগিচা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ, ওব্রায়েনের গাইডবই প্রকাশের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে অনাম্নী প্ল্যান্টার-লিখিত নোটস অন টি বেরুচ্ছে, সেখানে বারবার গার্ডেন বা বাগান শব্দের ব্যবহার হচ্ছে। এর কারণ কি এই, দার্জিলিং অবধি রেল পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই পর্যটকদের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যায়? এবং যেহেতু পাহাড়ের সিংহভাগ(সেকারণে রেলপথের আশপাশও) ছবির মতো সুন্দর চাবাগিচায় ঢাকা, সেগুলোকে 'বাগান' বলাটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়ায়? 

তিন, ওব্রায়েনের বইটা পর্যটকদের জন্য লেখা। সুখী, ছবির মতো, ছবি বাগান, যেখানে নোংরাও সুন্দর এবং সমস্ত গরিব নেপালি কুলিরাও সর্বদা সুখী, এই পর্যটকতোষ বয়ান, যা পুরোনো-নতুন রাষ্ট্ৰ, বাগিচামালিক এবং পর্যটন-ব্যবসায়ীরা সবাই মিলে প্রচার করে থাকে, তার শুরুটা হয়েছিল সায়েবি দার্জিলিংয়ের এবং বাগিচাশিল্পের আদিকালে। চালের মতো পুরোনো মিথ্যাও ভাতে বাড়ে, এক গল্প এখনো চলছে। শুধু, বেসকি যেমন দেখিয়েছেন, সেই গল্পের ওপর আধুনিকতম ব্যাপারকৌশলের আস্তর পড়েছে, এই ফেয়ার ট্রেড, এই জি আই।   

গল্পই হচ্ছে যখন, আর একটা পুরোনো গল্পের কথাও একটু বলি। দার্জিলিংয়ের গল্প খুঁজতে খুঁজতে একেবারেই হারিয়ে যাওয়া একটা বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেল। এ-ও ডিজিটাল বই, বিবর্ণ, আবছা হয়ে যাওয়া ছাপা বই থেকে তৈরি। ১৮৭০ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত এ বইয়ের নাম ‘দি ইন্ডিয়ান আল্পস অ্যান্ড হাউ উই ক্ৰসড দেম’। লেখক মহিলা, নামপত্রে লেখা আছে 'এ লেডি পাইওনিয়ার'। সেসময়ের অনেকের মতো, তিনি ছবিও আঁকতেন, বই জুড়ে দার্জিলিং ও সিকিমের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে অসংখ্য স্কেচ। লেখাটা খানিক পড়ে মনে হল, এই বই এতদিনে আবার ছাপা হয়নি কেন? সাবলীল, কাব্যময়, ছবি-বলা গদ্যে লেখা, তির্যক হাসিতে ঠাসা এমন উপাদেয় ভ্রমণবৃত্তান্ত খুব বেশি কেন, আর একটাও লেখা হয়েছে কি? 

লেডি পাইওনিয়রের আসল পরিচয় জানতে ইচ্ছা হল। খুঁজে খুঁজে একটা ছোট্ট, সম্ভবত স্কুলপড়ুয়াদের জন্য লেখা বইয়ের সন্ধান পেলাম। ২০০০-এ আমেরিকার মিনেসোটা থেকে  প্রকাশিত, পাঁচজন মহিলা অভিযাত্রীকে নিয়ে মার্গো ম্যাকলুনের লেখা এই বই শুরুই হচ্ছে নিনা মাজুসেল্লি বা 'দি লেডি পাইওনিয়ার'কে দিয়ে। নিনার পুরো নাম এলিজাবেথ সারা মাজুসেল্লি, তিনি জন্মেছিলেন ইংল্যান্ডে, ১৮৩২ সালে, বেঁচে ছিলেন ১৯১৪ অবধি। ১৮৫৩ সালে, নিনার বয়স যখন ২১, তাঁর বিয়ে হয় ফ্রান্সিস মাজুসেল্লির সঙ্গে। বিয়ের আগে নিনার কী নাম ছিলো, জানা যায় না। ফ্রান্সিস ব্রিটেনের সেনাবাহিনীতে পাদ্রি হিসেবে যোগ দেন ১৮৫৭-য়। ১৮৫৮-তেই তাঁকে ভারতে পাঠানো হয়, নিনা সঙ্গে আসেন। 

দক্ষিণ ভারতের রৌদ্রদগ্ধ সমতলে এবং অন্যত্র বছর দশ কাটানোর পর ফ্রান্সিস দার্জিলিংয়ে বদলি হন ১৮৬৯-য়ে। নিনা এবং ফ্রান্সিস এ অঞ্চলে থাকেন দু বছর। দার্জিলিং সবে তৈরি হচ্ছে তখন, বন কেটে শহর, ক্ষেত, বাগিচা বসছে। টাট্টুর পিঠে চড়ে, আঁকার সাজসরঞ্জাম নিয়ে নিনা বনেপাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, গ্রাম দেখলে ঢুকে পড়ছেন। এটুকু ঘুরে মন উঠছে না, স্বামীকে রাজি করিয়ে সিকিম হিমালয়ের গভীরে চলে যাচ্ছেন অভিযানে। সে গল্প এখানে নয়।

Powered by Froala Editor