সৌমিত্র ঘোষ - ৬
আগের পর্বে
তিস্তা উপত্যকার তিস্তা ভ্যালি রোডের কথা হয়েছে আগেই। কালিম্পং আর সিকিম যাওয়ার পথে বাঁদিকের সরু পথ। তিস্তা নদী ছেড়ে ওপরে যাওয়া সত্ত্বেও এমন নাম। এই রোড ধরেই অনেকটা উঠে গেলে রঙলি রঙলিওট বাগান। সেই বাগান ছাড়িয়ে আরও কিলোমিটার খানিক গেলে তাকদা। এই তাকদারই একটা অংশ ক্যান্টনমেন্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেখানে সেনা ছাউনি ছিল। পরে তা উঠে যায়। সেই অঞ্চল ছেড়ে সাহেবরা চলে গেল, কিন্তু রয়ে গেল সেই কাঠের বাংলোগুলো। আর সেনাছাউনির খানিকটা ঢুকে গেল চা-বাগানে। এই তাকদা বা হুম-লিংডিংই নীলপাহাড়ি। আর এই নীলপাহাড়ির খোঁজ প্রথম পেয়েছিলাম, যাদবপুরের এক বাঙালি পড়ুয়া ইংরাজি ব্লকে। যে তরুণী পারিবারিক নথির সন্ধান চালিয়েই পৌঁছে গিয়েছিল সেখানে। খুঁজে পেয়েছিল পাহাড়ের বুকে তাঁদের পারিবারিক বাড়ি।
নীলপাহাড়ি বা হুম-লিংডিং বা তাকদা, যে নামেই ডাকা হোক না কেন, জায়গাটার মধ্যে একটা বন্য নির্জনতা থেকেই গেছে। তাকদা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার নবলব্ধ হেরিটেজ এবং কিলোমিটার খানেক দূরের তাকদা বাজারের(পুরোনো নাম ছিল মানে বাজার) চৌহদ্দি ছাড়িয়ে তিনচুলে বস্তি, যেখানে এখন এথনিক বেড়ানো, প্রকৃতি বেড়ানো ইত্যাদির রমরমা, এসবের মোহ কাটিয়ে যদি ছ'মাইলের জঙ্গুলে রাস্তাটা ধরা যায়, বড়ো ভালো লাগে। সে পথে ধুপি আছে, কিন্তু অন্য গাছও প্রচুর। সেগুলোর বেশিরভাগই বনবিভাগের লাগানো গাছ, তবে পুরোনো বলে লতাগুল্ম ছাওয়া, ভিতর থেকে অন্ধকার। পথের খুব কম জায়গায় রোদ ঢোকে, পুরোটাই ভেজা ভেজা, শ্যাওলামাখানো, ঝাপসা। মাঝে মাঝেই বিরাট পাথরের টুকরো, তাদের ওপরে সেই আদ্যিকালের শ্যাওলা আর মসের পুরু গদি, থেকে থেকে বন ভেদ করে রাস্তায় এসে পড়ছে জলের ধারা। তাকদা থেকে পেশক রোডের ছ'মিল বস্তি অবধি যেতে যে রাস্তাটা, সেটার পুরোনো নাম সম্ভবত ছিল হুম রোড। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ড্যাশের গ্যাজেটিয়ার থেকে জানা যাচ্ছে, রাস্তাটার দেখভাল করত জেলা বোর্ড, সে পথে গাড়িও চলত। গাড়ি যে চলত তা জানা যাচ্ছে রুমার গডেন এর রংলি রঙলিওট বইটা থেকেও। যে ক্রিসমাসটা তিনি এখানে কাটিয়েছিলেন, সে সময় তাঁর ছেলেমেয়েদের আর বাগানের অন্য শিশুদের জন্য উপহার কিনে আনতে গিয়েছিলেন দার্জিলিং-এ, ফিরে আসতে আসতে রাত হয়ে গিয়েছিল। এবড়ো-থেবড়ো, ঘন অন্ধকার বনের রাস্তা দিয়ে জিপ কোনোক্রমে পৌঁছেছিল। এখন সে পথ কিছু চওড়া হয়েছে, পিচও পড়েছে, গাড়িতে যাতায়াত তত কষ্টের নয়। অবশ্য পথ ভাঙাচোরা থাকে প্রায়ই, আর এত মেঘ থাকে যে ফুট দুই পরে দৃষ্টি চলে না।
তাকদার পুরোনো বাড়িঘর পিছনে ফেলে ছ মাইলের দিকে একটু গেলেই বন শুরু হয়ে যায়। সেই বনের মধ্য দিয়ে আরো সরু সরু পথ নেমেছে ঝর্ণার মতো। একটা গিয়েছে পুবঙ বস্তিতে, যেখানে নাকি খাঁটি দুধ মাখন পাওয়া যায়, যার কথা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন। যাব যাব করেও সে পথে যাওয়া হয়ে ওঠেনি এখনও। অন্য আর একটা পথ গিয়েছে বনের অনেক ভিতরে রামপুরিয়া বস্তিতে। যদ্দূর মনে পড়ছে, নেপালি ভাষাভাষী মানুষদের সঙ্গে সেখানে থাকেন কয়েক ঘর লেপচাও। বনের বাঁশ কেটে নানারকম জিনিসপত্র বানাতেন রামপুরিয়ার বাসিন্দারা, কোনটা কাজের, কোনটা ঘর-সাজানোর। রামপুরিয়া বস্তিটা ফারেস বা ফরেস্ট বস্তি, বনের কাজের জন্য নিয়ে আসা মজুরদের থাকবার জন্য তৈরি গ্রাম। পাহাড়বনের দুর্গম অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা এইসব গ্রামগুলোকে সে আমলে বলা হতো টঙ্গিয়া বা টঙিয়া বস্তি।
টঙিয়া একরকমের প্ল্যান্টেশন তৈরি করার মানে গাছ লাগানোর পদ্ধতি। পুরোনো বন কেটে নতুন গাছ লাগানোর কাজটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বত্র হত। নিজেদের দেশে যেখানে যা প্রাকৃতিক বন তা তাঁরা আগেই শেষ করে ফেলেছিলেন, দেশের বাইরে গিয়ে যখন বন কাটতে শুরু করলেন, নতুন গাছ আর গজায় না। কি করা যায় কি করা যায় ভাবতে ভাবতে সায়েব ফরেস্টারেরা শরণাপন্ন হলেন জরমন বনকাটাই(সায়েবরা ইংরেজিতে সুন্দর করে বলতো ফরেস্ট্রি) বিশারদ ডিয়েট্রিস ব্রান্ডিসের। ব্রান্ডিস সায়েব ভারতে এসে ইংরেজদের বনকাটাই বিজ্ঞান শেখালেন। সে বিজ্ঞানের মূল কথা, যত গাছ কাটবে ততটাই লাগাবে। আবার কাটবে আবার লাগাবে। বার্মা সে সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ, ব্রান্ডিস খুঁজে বার করলেন সেখানকার আদিবাসীদের কাজে লাগিয়ে এই বনকাটার আর গাছ লাগানোর(বার্মার টিক বা সেগুন সেকালে বিখ্যাত ছিলো) কাজটা দিব্যি চলছে। যে পদ্ধতিতে কাজটা হয়, তাকে বলা হয় টঙিয়া। উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে আসাম, নেফা হয়ে বার্মা ও শ্যামদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত যে পাহাড়বন, সেখানকার প্রায় সব আদিবাসীরা জুম চাষ করতেন। জুম মানে বন পুড়িয়ে পোড়া জমি সাফ করে সে জমিতে চাষ দেওয়া। তিন চার বছর চাষের পর অন্য বনে চলে যাওয়া। ফেলে রাখা জমিতে বন ফিরে আসবে ধীরে ধীরে। বনে আগুন লাগলে গাছ ঘাস লতা গুল্ম পুড়ে জমিতে মিশলে সে জমিতে গাছ বাড়ে তাড়াতাড়ি।
টঙিয়ার মূলে জুম। কিন্তু নিজেদের পাহাড়ে, বনে নিজেদের মতো জুম করতেন স্থানীয়রা। সায়েবদের বনে সে কাজ করে কে? আদিবাসীদের খোঁজ পড়ল আবার। তাঁরা না এলে কে বন কাটবে, পোড়াবে, পোড়া জমিতে ছিটিয়ে দেবে নতুন গাছের বীজ? গাছ উঠলে, বড় হতে শুরু করলে কে তার যত্ন নেবে, বাঁচিয়ে রাখবে সায়েব সরকারের দামী বাগান?
আরও পড়ুন
নীলপাহাড়ির খোঁজে
টঙিয়া বস্তিগুলো তৈরি হল এইবার। নেপালের বন থেকে, দার্জিলিং এর বন থেকে তাড়িয়ে দেওয়া লেপচাদের নিয়ে এসে নতুন টঙিয়া গ্রামে বসানো হল। তাঁরা মজুরি বলতে সেরকম কিছু পেতেন না প্রথমটায়। নতুন লাগানো গাছের সারির মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায় শাকসবজি, ধান যব ভুট্টা লাগানোর অনুমতি দেওয়া থাকত। গাছ বড় হলে গ্রাম উঠে অন্য বনে চলে যেত। পুরোনো টঙিয়া গ্রামের প্রত্যেকটা এভাবে বারবার ঠাঁইনাড়া হয়েছে। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে থেকে এই গ্রামগুলোর সঙ্গে সবে যখন পরিচয় ঘটছে, দু চার জন বয়ষ্ক মানুষকে পাওয়াই যেত যাঁরা পুরোনো ডেরাগুলোর কথা মনে করতে পারেন, ডাইনে বাঁয়ে ওপরে নিচে হাত নেড়ে দেখান, ওই যে, ওই পাহাড়ের মাথায় ছিলাম আমরা, ওই নদীটার পাশে। ওই আমাদের পুরোনো ধুপিগাড়ি(যেখানে ধুপি লাগানো হয়), ওই বিছনবাড়ি(যেখানে চারা বড় হয়)।
আরও পড়ুন
পেশকের পথ ধরে
টঙিয়া গ্রাম বসানোটা বন্ধ হয়ে গেল ক্রমে। পুরোনো সায়েবরা গিয়ে নতুন সায়েবরা এলেন, নিয়ম বদলাল, কায়দাও। গাছ কাটার আর বন সাফ করার বড় বড় মেশিন এল। পেল্লায় সব করাত, মুহূর্তে সারি সারি গাছ কাটা হয়ে পড়ে যাচ্ছে, তা উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিশাল সব ক্রেন। টঙিয়া দিয়ে কি হবে? লোকেও বজ্জাত হয়ে যাচ্ছে, তাদের মজুরি চাই, জমি চাই, খুব ঝামেলা। তারপরে এদিকে শুরু হয়ে গেছে গাছ রাখার জন্য সোরগোল, পাহাড়ের গাছ কাটা যাবে না, প্রাকৃতিক বন কাটা যাবে না, ওই বনে বুনোরা মানে ওয়াইল্ড লাইফ থাকে, ফলে ওই বনে কোনো কাটাকাটি চলবে না। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে এসব যখন হচ্ছে, দার্জিলিং পাহাড়ের বন বলতে তখন এখানে ওখানে দু এক টুকরো, যেমন টাইগার হিল থেকে রমবি টঙিয়া অবধি ঢাল কিম্বা সেভক-শুকনা। বড় বন, সত্যিকারের বন বলতে পাহাড়ের একদম মাথায়, নেপাল-সিকিম সীমান্ত বরাবর যে সিঙ্গালীলা গিরিশিরা, যা গিয়ে শেষ হয় কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারশিখরে, সেইখানে। বাকি পাহাড়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই ধুপিগাড়ি, অন্য গাছ নামমাত্র। ধুপির বন আর অন্য পাহাড়ি গাছের এলোমেলো লাগানো জঙ্গলের কোণাঘুপচিতে অযত্নে পড়ে রইলো পুরোনো টঙিয়াগ্রামগুলো। তাদের নাম সরকারি কাগজে এক এক রকম, সব গ্রামের নাম যে আছে তা'ও নয়।
আরও পড়ুন
লেপচা-দুনিয়ায়
রামপুরিয়ার ঠিক পিছনের পাহাড়টা ধরে ওঠা গেলে টাইগার হিলের বনে পৌঁছনো যায়। সে বনে ঢোকার আর একটা পথ পেশক রোডের তিন মাইল বস্তি থেকে সোজা, রাম্বি টঙিয়া হয়ে। রাম্বির পথে না গিয়ে নিচের দিকে যেতে মংপুর বড় রাস্তা, সে রাস্তাও বনের মধ্য দিয়ে। কয়েক মাইল গিয়ে সেঞ্চল অভয়ারণ্যের ভিতরে কালীখোলা নদীর উচ্ছল ছায়াচ্ছন্ন স্রোত। এ নদীতে সারাবছর জল থাকে। ফলে আশেপাশের পাহাড়ের সব জলধারা যখন শুকিয়ে যায়, এক ফোঁটা জলের জন্য ঘুম থেকে দার্জিলিং হাহাকার করতে থাকে, ট্যুরিস্টরা জল পায় না, ছোট ছোট ট্রাকের ওপর প্লাস্টিকের ট্যাঙ্কে বোঝাই হয়ে কালিখোলার জল শহরে যেতে থাকে।
আরও পড়ুন
তিস্তা বা রঙ-ন্যিয়োর গল্প
রামপুরিয়া বস্তির মধ্য দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ কালিখোলার ওপরের দিকটায় পৌঁছেছে। টাইগার হিল-রঙ্গারুনের বিখ্যাত পুরোনো বনের শেষ টুকরোটা এখানে। শীতের শেষে আর বসন্তের শুরুতে এই দিকটায় যাওয়া গেলে বড় চমৎকার ফুল দেখা যায়। নিষ্পত্র ডালে গাছভর্তি গোলাপি ম্যাগনোলিয়া, ফুলে ছাওয়া রক্তবর্ণ গুরাস, গন্ধভুরভুর, থোকা থোকা সাদা চাপ। শুধু ফুল কেন? রামপুরিয়া-রাম্বি-টাইগার হিলের গিরিশিরাটা চলে যায় সোনাদার ওপরের পাহাড় আর বাগোড়া চিমনি হয়ে সোজা কার্সিয়াঙের ওপরে ডাউহিল পাহাড় অবধি। দার্জিলিং যাবার পুরোনো পথ এটা, ওল্ড মিলিটারি রোড। এই পথের ডাইনে বাঁয়ের বনে এখনও কিছু অবিনশ্বর বুনোরা টিঁকে আছে। সোনাদা-টাইগার হিল একসময় হিমালয়ের কালো ভালুকের পছন্দের জায়গা ছিলো, লেপচা ভাষায় সুনাদা বা সোনাদা নামটার মানেই ভালুকের আস্তানা। বনের ভালুক সামনাসামনি দেখিনি, তবে গাছের ওপর নখের আঁচড়, জমি খুঁড়ে মাটি বের করে রাখা আকছার চোখে পড়েছে। পুরো অঞ্চলের বস্তিবাসীরা বলেন, ছ ছ ভালু ছ। দুই কিসিম কো ভালু। রুক ভালু র ভুঁই ভালু। রুক ভালো সেয়ানু, ভুঁই ভালু ঠুলো। মানে ভালুক আছে, দু রকমের ভালুক, গাছ-ভালুক আর মাটি-ভালুক। গাছ-ভালুক ছোটো, মাটি-ভালুক বড়। এ গল্পে ফেরা যাবে।
আরও পড়ুন
মরে-যাওয়া মাঠের ওপর অলৌকিক কালো সারসের মতো নেমে এসো, মেঘ
ভালুক তো আছেই, সেসঙ্গে চিতাবাঘ। তাকদার কিছু আগে, ছ'মিল-তাকদা পুরোনো হুম রোডের ওপরে একবার একটাকে দেখেছিলাম। হালকা কুয়াশার মধ্যে হলুদের ওপর কালো ছোপ ছোপ চিতাবাঘটা রাস্তা পেরুতে চাইছিল। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম পথের পাশের ঝোপ থেকে ভীতসন্ত্রস্ত একটা মুখ মাথা তুলছে, জ্বলজ্বল করছে চোখ। ৮ নং বাংলোয় লামাদার বাড়িতে পৌঁছে উত্তেজিত ভাবে বাঘ দেখার এই গল্পটা করতেই লামাবৌদি নির্বিকার মুখে বললেন, আরে সে আর এমন কি? কত চিতুয়া(চিতাবাঘ) আছে এখানে। আমাদের বাড়িতে তো হামেশা আসে, কুকুরটাকে খেতে। এই তো পরশুই এসেছিলো।
চিতাবাঘ নয়, তবে ওই রকমই আর একটি প্রাণীকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল একবার। সেটা এই পথে নয়, সোনাদা ছাড়িয়ে দিলারামের পথে, হিল কার্ট রোডের বড় রাস্তায়, যে পথে সারাক্ষণ গাড়ি চলে, ট্রেন যায়। খুব মেঘ ছিলো পথে, কিছু দেখাই যাচ্ছিলো না প্রায়। হঠাৎই গাড়ি দাঁড়িয়ে গেলো জোরে ব্রেক দিয়ে। সামনে তাকিয়ে দেখলাম, কুয়াশার মধ্যে হলুদ কালো ঝলক, এক লহমায় রাস্তা পেরিয়ে কোথায় চলে গেল। ছাগলছানার মতো সাইজ হবে, হুবহু চিতাবাঘের মতো দেখতে। মনে পড়ল, টাইগার হিল-সোনাদার বনে একসময় নানান ছোট বেড়াল বা লেসার ক্যাটের বাস ছিল। চিতাবিড়াল, সাধারণ বনবিড়াল, বিরল মর্মর বিড়াল, বিরলতর সোনালি বিড়াল, এই সব। কোনদিনই তাদের দর্শন সুলভ ছিল না, আর এইভাবে গাড়ি-চলা বড় রাস্তায় তো নয়ই। যে জায়গাটায় আমাদের দেখা চিতাবিড়ালটা রাস্তা পেরুচ্ছিল, সেই পাহাড় জুড়ে এখন ধুপিবন। চিতাবাঘ, চিতাবিড়াল, কালো ভালুক, এরা থাকে কোথায়, খায় কী?
সে ভাবনাটা এখনো আছে। নষ্ট হয়ে যাওয়া, নষ্ট করে ফেলা বনে পুরোনো বনের বাসিন্দারা থেকে যায় কী করে? যায় যে, সেটা তো নিজের চোখেই দেখেছি, অন্য পাহাড়ি বন্ধুদের দেখা শুনেছি। বাঘ ভাল্লুক জাতীয় বড় প্রাণী শুধু নয়, পাহাড়ি জঙ্গলে থাকত নানানরকমের ছোটখাটো বুনোরা, ঈষৎ কমলারঙের পার্বত্য কাঠবিড়ালি, নিচের দিকের পাহাড়ি বনে মিশকালো বড় কাঠবিড়ালি, নদী বা ঝর্ণার ধারে ভোঁদড়, দু'তিন রকমের বেজি, ভাম, ভাম বা বেজির মতোই দেখতে হলুদ-গলা মার্টেন, কালচে-ধূসর উইজেল, সরুমুখো, মাটি খোঁড়া ব্যাজার। কাঠবিড়ালি, বেজি বা ভাম ছাড়া বাকিদের আগেও দেখা যেত না, এখনো যায় না। বনে যে সরকারি প্রাণীগণনা হয়, তাতে এই সব এলেবেলে ছোট প্রাণীদের গণ্য করা হয় না। ফলে, এরা আদৌ এখনো আছে কিনা, থাকলে কিভাবে আছে, দীর্ঘকাল ধরে ভেবেও কূলকিনারা পাইনি। অথচ এই সেদিন, ভর বিকেলবেলায় একটা নয় এক জোড়া মার্টেন দেখে ফেললাম, সেই-ই বড় রাস্তায়, ঘুম থেকে সোনাদার মাঝামাঝি। বেজির মতো দেখতে কিন্তু বেজি নয়, গলা পেট জুড়ে উজ্জ্বল হলুদ দাগ, মুখটা কালো, শরীর ভরা চকচকে লোম। আমাদের থামতে দেখে তারা পালিয়ে গেলো, ফিরেও এল, পথের ধারের একটা নালা থেকে জল খেলো, খেতে খেতে দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে এদিক ওদিক দেখল, তারপর মিলিয়ে গেলো বনের গভীরে। সম্ভবত পুরোনো, মরেঝরে যাওয়া সময় এভাবে নতুন সময়ের মধ্যেও নিঃশব্দবাস করে, কখনোসখনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে ওঠে, আমরা বুঝতে পারি, আছে, আছে। ধুপিবনে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে অজস্র ছোট গাছ, লতা, গুল্ম জন্মায় প্রতি ঋতুতে, অসংখ্য ফুলে আর রঙিন পাতায় উজ্জ্বল হয় বন। ছ মাইল থেকে জোড়বাংলো যাবার পথে, বর্ষাঘন ও চিরকুয়াশায় ভরা একটি অঞ্চল আছে। পথের ডানদিকে বাঁদিকে, ঝোপের মধ্যে, ঘাসের মধ্যে সেখানে গাঢ় লাল বন্য স্ট্রবেরি ফুটে থাকে। সাত হাজার ফুট থেকে যত ওপরে যাওয়া যায়, স্ট্রবেরি এলাকা বাড়তে থাকে। সে গল্প অন্যসময়।
Powered by Froala Editor