সময়ভ্রমণ -৫৯
আগের পর্বে
ব্রিটিশ সরকারের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হতে পারে নতুন যে গোর্খা জনজাতির জন্ম তাঁরা দিচ্ছিলেন তা এক অর্থে সাহেবপ্রেমী জাতি। কিন্তু গোর্খা লিগের প্রথমদিকের কাজকর্ম ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চন্দন সিং নামের এক সেনাফেরৎ ব্যক্তি। তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ঝামেলাবাজ হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। ১৯৩১ সালের এক ভাষণে চন্দন সিং গোর্খাদের ভারতের অংশ হিসাবেই দাবি করেন। তবে তারপরেও সমতলের মানুষদের প্রতি বিদ্বেষ রয়েই যায়। যে কাল্পনিক জাতিসত্তার নির্মাণ ব্রিটিশরা করেছিল, তাই জায়গা পেয়ে যায় পুরোদমে। এমনকি এই জাতিগত আন্দোলনের জেরে হারিয়ে যায় চা-বাগানের শ্রেণি আন্দোলনের জোয়ারও।
সত্যেন্দ্রনারায়ণের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, দার্জিলিং-এ কমিউনিস্ট দল গুর্খা জাতিপরিচয়ের জায়গায় নেপালি জাতিপরিচয়ের জন্ম দিতে সচেষ্ট ছিল। বিশ শতকের প্রথম ভাগ থেকে পাহাড়ে যে জাতিরাজনীতির সূচনা হয়, কমিউনিস্ট দলের সংগঠকদের মনে হয়েছিল সে রাজনীতিতে সায়েবপ্রেম ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সমপরিমাণে মিশে আছে। উপরন্তু, সে রাজনীতিতে বাগিচাশ্রমিক ও অন্যান্য গরিবদের স্থান নেই। থাকার কথাও ছিল না। ব্রিটিশদের তৈরি গুর্খা জাতিপরিচয়ের উৎসে তৎকালীন নেপালি হিন্দু সমাজের জাতিপ্রথা প্রথমাবধি বর্তমান, উঁচু জাতি, শাসক জাতিরাই প্রধানত 'যোদ্ধা' শ্রেণিভুক্ত— গুর্খা সেনাদলে গিয়ে সবাই গুর্খা হয়ে যেতে পারেন বটে, কিন্তু তাতে করে পুরোনো বৈষম্যগুলো চলে যায় না। ফলে ব্রিটিশ গুর্খা সেনাদলের জাতিপরিচয় যখন ঘরমুখী সৈন্যদের মারফৎ দার্জিলিং পাহাড়ে পৌঁছল, সে পরিচয়ে উঁচু জাতিভুক্ত লোকেরাই লাভবান হলেন বেশি, নতুন জাতিরাজনীতি থাকল প্রধানত তাঁদের কবজায়। কমিউনিস্টরা তাঁদের মতো করে অন্য ধরনের জাতিরাজনীতি তৈরি করতে চাইছিলেন, 'গুর্খা' পরিচয় যদি ক্ষমতাবানদের দখলে থাকে, 'নেপালি' পরিচয় হয়ে উঠবে নিম্নবর্গের, ক্ষমতাহীনদের।
বাগিচাশ্রমিক ও অন্য পাহাড়ি গরিবদের সংগঠিত করে কমিউনিস্টরা পাহাড়ে শক্তিবিস্তার করেন। গুর্খা জাতিপরিচয়ের রাজনীতি ফুরিয়ে যায় না বটে, তবে ১৯৮৬-র প্রথম গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের আগ পর্যন্ত পাহাড়ে সে রাজনীতির একচ্ছত্র প্রাধান্য ছিল না।
গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন চলাকালীন ব্রিটিশদের তৈরি পুরনো জাতিপরিচয় নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়া হল, অর্থাৎ পুরনো ঘৃণাবিদ্বেষের, জাতিভেদের গল্পে নতুন করে বানানো ইতিহাসের গল্প মিশল। প্রথম আন্দোলন ততটা নয়, দ্বিতীয় আন্দোলন অনেক বেশি কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটেছে। ফলে, কীভাবে গল্প তৈরি হচ্ছে সেটাও দেখাবোঝা ছিল খানিক।
প্রথম আন্দোলনের সময় নেতৃত্বের বয়ান ছিল, দার্জিলিং যেহেতু ঐতিহাসিকভাবে নেপালের ভূখণ্ড, এবং ব্রিটিশরা সেটা সুগাওলি চুক্তি মারফত দখল করে, ব্রিটিশরা চলে যাবার পর সে জমি কার্যত নো ম্যানস ল্যান্ড, যা না নেপালের না ভারতের। ভারত-নেপালের ১৯৫০-এর চুক্তিকে মানবার প্রশ্ন নেই, পশ্চিমবাংলা সরকারের কোনো দাবিও সেখানে গ্রাহ্য নয়, সুতরাং গোর্খাল্যান্ড। নেপালের জমি বলতে নেপালের গোর্খা রাজাদের দখল করা জমি, সেই কারণে আরো, গোর্খাল্যান্ড। আঠেরো শতকে গোর্খা সেনাদল সিকিম ও লিম্বু রাজত্ব দখল করবার আগে এ জমি যে সিকিম রাজ্যের মধ্যে ছিল, তিস্তার ওপারে সিকিম ও ভুটান রাজ্য যুগপৎ বিস্তৃত ছিল, সেসব কথা গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের নেতৃত্ব মনে করেননি, করানওনি। তাঁদের বক্তব্য, জমি নেপালের, গোর্খারা ভূমিপুত্র, অতএব দার্জিলিং কোনোক্রমেই বাংলার হতে পারে না। দ্বিতীয় গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় পুরনো ইতিহাস-ভূগোলের গল্প বিশেষ সামনে এল না, এলো গোর্খা জাতিসত্তার, অর্থাৎ সংস্কৃতি ও 'অস্মিতা' ইত্যাদি, যার মূল কথা, গোর্খারা বাংলানিবাসী নন, তাঁদের আচারবিচার সংস্কৃতি ভাষা ভিন্ন, অতএব বাংলার সঙ্গে তাঁদের জবরদস্তি জুড়ে রাখাটা অন্যায়, অন্যায্য। আন্দোলনকারীরা ন্যায় বা জাস্টিস চাইছিলেন।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (চার)
দার্জিলিং নিয়ে যে সব সাম্প্রতিক গবেষণাকাজের কথা বলা হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের ল্যাজামুড়ো কিছুই বিশেষ ঠাউরে উঠতে পারা যায়নি। বেসকি অবাক হয়ে দেখেছেন শুনেছেন, বাগিচাশ্রমিকরা বিশ্বাস করছেন, গোর্খাল্যান্ড হলে তাঁদের সব সমস্যা মিটে যাবে, বাগিচার শ্রী ফিরবে, শ্রমিকদের দুর্দশা ঘুচবে। কী করে, বেসকি প্রশ্ন করছেন, বিশেষত যখন আন্দোলনের নেতারা বাগিচামালিকদের বিরোধিতা করেন না, মজুরি বৃদ্ধির কথাও বলেন না? কেউ জানেন না, অথচ জানেন গোর্খাল্যান্ড হলে ভালো হবে, মাটি জল চা সব গোর্খাদের হবে, দার্জিলিং চা 'দার্জিলিং গোর্খাল্যান্ড চা' হবে। মজুরি বাড়ুক না বাড়ুক ভালো হবে। বাগিচার বাইরের শহরে যে সব মিছিল সমাবেশ হচ্ছে, সেখানেও সেই এক কথা। গোর্খাল্যান্ড নামের স্বপ্নপুরীতে সব ভালো হয়ে যাবে, যেমন আগে ছিল। আগে ছিল বলতে সায়েবযুগ, সায়েবসময়। বেসকি একাধিক বক্তৃতার টুকরো তুলে দিয়েছেন। পড়ে মনে হল এই কথাগুলোই কতজনের মুখে, কতবার, কতভাবে শুনেছি:
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (তিন)
‘দাজু(দাদা), ভাই, দিদি, বহিনহরু(বোনেরা)...আমরা ছিলাম ব্রিটিশের চাকর, মালি, ঘরের কাজের লোক...আমরাই তাদের বিখ্যাত চা তৈরি করেছি--দার্জিলিং চা--পৃথিবীর সবচেয়ে দামি চা।….ভারতীয় ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি সত্ত্বেও সেই চা আজ অবধি আছে...দার্জিলিং বাংলার নয়, আমাদের। আমরা বানিয়েছি! ...কলকাতা নেয়, নেয়, নেয়। আমাদের চা নিয়ে কলকাতায় নিলাম করে, আমরা কিছুই পাই না। ব্রিটিশরা বাগানে নতুন গাছ লাগাত, চিকিৎসার সুবিধা দিত...ভারতীয় মালিকরা বাগানের পিছনে খরচা করে না।...আমরা ব্রিটিশ সেনাদলে কাজ করেছি। আমরা সেই বিখ্যাত, সাহসী গুর্খা। বাংলা সেটা কেড়ে নিতে পারবে না, কিন্তু তারা আমাদের জমি নিয়ে নিয়েছে: আমরা ব্রিটিশের চাকর ছিলাম, জমি তৈরি করেছি, চা শিল্পও... দার্জিলিং চা আমাদের চা, গোর্খাল্যান্ড আমাদের স্বপ্ন, ভবিতব্য।’
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (দুই)
গোর্খাল্যান্ড ১ এবং ২-এর গল্পে ফারাক ছিল, আছে। প্রথম আন্দোলনের সময় সায়েবপূর্ব ইতিহাসের কথা বলা হয়েছিল, নেপালের সঙ্গে গোর্খা জাতির ঐতিহাসিক যোগাযোগের কথা। দ্বিতীয় আন্দোলনে সে ইতিহাস পরিত্যক্ত, সে তুলনায় সামনে বেশি আসছে ঔপনিবেশিক দার্জিলিংয়ের কথা— চা বাগান, টয় ট্রেন, হিল স্টেশন, পর্যটন। সে সঙ্গে আরো জোরের সঙ্গে আমদানি হচ্ছে ভূমিপুত্রের ধারণা, দার্জিলিংয়ে যে গোর্খারা আছেন তাঁরা আবহমান কাল থেকেই আছেন, কেউ বাইরের নন, স্থানান্তরিত হয়ে কেউই এখানে আসেননি।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ
দার্জিলিং রিকনসিডার্ড নামের যে সংকলনগ্রন্থের কথা বলা হয়েছে, সেখানে একটি লেখায় গবেষক নীলাম্বর ছেত্রী দেখাচ্ছেন, গোটা বিশ শতক জুড়ে পাহাড়ে একের পর এক জাতিসমাজ ভিত্তিক সামাজিক সংস্থাসংগঠন তৈরি হচ্ছে, মানুষ নিজেদের আদিবাসী উৎসও খুঁজে দেখতে চাইছেন। কিরান্তি খামবু রাইদের, গুরুংদের, তামুদের, মঙ্গরদের, থামি(তামি)দের, ইয়াখা ও তামাংদের, আরো অনেকের। বড়ো সংস্থা না হলেও গ্রামে বাগিচায় ছোটো ছোটো সংগঠন তৈরি হয়েছে, কিছু না হলে গ্রামসমাজ তো আছেই। বহু বাগিচায়, টঙিয়া গ্রামে এখনো একটি কি দুটি জাতির বসবাস, যে সর্দার বা মন্ডল(টঙিয়া গ্রামে সর্দারকে বলা হতো মন্ডল) লোক বসিয়েছিল, সম্ভবত তার জাতিপরিচয় অনুযায়ী।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারি চাকরি ও অন্যান্য সুবিধার জন্য জাতিপরিচয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। কেউ নাম বদলাচ্ছেন, কেউ সংঘ গড়ে নিজেদের সরকারিভাবে আদিবাসী বানাচ্ছেন, নিদেনপক্ষে তফসিলি জাতি। গোর্খাল্যান্ড-২ আন্দোলনের শুরুর সময় দেখেছিলাম, পরিচিত একজন আন্দোলনকর্মী মঙ্গরদের তফসিলি উপজাতি অর্থাৎ আদিবাসী বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন(অথচ মঙ্গররা প্রথম থেকেই সেনাদলে আছেন, যাকে বলে স্বীকৃত গুর্খা)।
গোর্খা জাতিপরিচয়ের পাশাপাশি অন্য আদি পরিচয়কে স্বীকার করার যে সামাজিক ঝোঁক, দার্জিলিং-এ তা কখনোই পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। কালক্রমে তা রাজনৈতিক দাবি হয়ে উঠেছে, অনেক জাতি নতুন করে তফসিলি উপজাতি হতে চাইছেন। গোর্খাল্যান্ড-২ আন্দোলন ভাঙার উদ্দেশ্যে বাংলার সরকার একের পর এক জাতি বোর্ড গঠন করেছেন। সে সব বোর্ডগুলো এখনো আছে।
প্রথম আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে দার্জিলিং পাহাড়কে স্বশাসিত আদিবাসী অঞ্চল বলে ঘোষণার দাবি উঠেছিল, ভারতের সংবিধানের ছ নং তফসিল অনুযায়ী উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে যেমন হয়, তেমন। যেহেতু সরকারি হিসেবে এ অঞ্চলে তফসিলভুক্ত উপজাতিরা সংখ্যালঘু, সুভাষ ঘিসিং ও তাঁর চ্যালারা চাইছিলেন পাহাড়ের লোক তাঁদের পুরোনো আদিবাসী পরিচয়ে ফিরে যান। নেপাল থেকে দার্জিলিংয়ে লোকজন আসতে শুরু করার পর থেকে একশো-দেড়শো বছর কেটে গেছে ততদিন, দূর পাহাড়ি গ্রামে কে কী করত কার মনে থাকে! ঘিসিং সাহেবের মাথাটা সেসময় বিগড়ে যাচ্ছিল সম্ভবত। তাঁর সঙ্গে পরিচিত, পর্যটন ইত্যাদি নিয়ে কাজ করত এমন একজনের কাছে শুনেছি, তিনি সারাদিন চোখ মুদে থাকতেন, কাজের কথা হলেও। তার দুই কানে নাকি দুই দেবদূত নিরন্তর মন্ত্রণা দিত, একজন কু, অন্যজন সু। ঘিসিং সুমন্ত্রণা নিতেন, বলা বাহুল্য। সেই মন্ত্রণার কারণেই বোধহয়, তিনি ফতোয়া দিলেন, সব পাহাড়িই আদিবাসী, আদিবাসীরা গাছ পাথর বাঁদর ইত্যাদির পূজা করে, মূর্তি নৈব নৈব চ। সেটা ২০০৬ সাল হবে, দূর্গাপুজোর মুখটায়। স্বচক্ষে দেখা, পাহাড়ের সর্বত্র পাহাড়িরা যে সব পুজো করতেন, সেখানে মূর্তিটুর্তি কিছু নেই, পুরুত এসে লাল সিঁদুর মাখানো, সাইপত্রির মালা পরানো পাথর পুজো করছেন। বাঁদরদের ঢিল মারা ইত্যাদি অত্যাচারও বারণ হয়ে গেল।
Powered by Froala Editor