চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (চার)

সময়ভ্রমণ - ৫৮
আগের পর্বে

নেপাল থেকে ব্রিটিশ সরকারের সেনা সংগ্রহের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন খোদ নেপালরাজ। ব্রিটিশ সরকারকে চিঠি লিখে আপত্তি জানান এই বিষয়ে। তাই যুদ্ধের পরিস্থিতিতেও শেষ পর্যন্ত নেপাল থেকে সেনা সংগ্রহ না করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু সেনা সংগ্রহ না হলেও চা বাগান ও অন্যত্র কুলির কাজের জন্য তো নেপালিদের প্রয়োজন। তাই শেষ পর্যন্ত এক বিকল্প ব্যবস্থা নিল ব্রিটিশ সরকার। বলা হল, স্বেচ্ছায় যাঁরা ভারতে চলে আসবেন তাঁদের কাজে লাগানো যেতে পারে। এই প্রস্তাবে নেপাল সরকারও সম্মত হল। কিন্তু কারা স্বেচ্ছায় চলে আসছে, আর কাদের অর্থের লোভ দেখিয়ে বা জোর করে নিয়ে আসা হচ্ছে – তা কে বিচার করবেন?

ইতিপূর্বের বিবরণ থেকে মনে হতে পারে গুর্খা সেনাদল ফেরত পয়সাওলা এবং ক্ষমতাবানেরা, সায়েবদের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায়, মদতে, গোর্খা রাজনীতির জন্ম দেয়, যা প্রথম থেকেই সমতল বিদ্বেষী এবং সায়েববন্ধু। 

ঠিক কীভাবে কী ঘটছিল, বোঝা মুশকিল। মহাফেজখানার একটা ফাইলে(সন ১৯৩১-ফাইল ২৫৮) গোর্খা রাজনীতির শুরু সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া গেল। গোয়েন্দা দপ্তরের নোট অনুযায়ী, অখিল-ভারতীয় গোর্খা লিগের জন্ম আসামে, ১৯২৫ সালে। ওই ফাইলেই 'গুর্খা সনসার' বলে একটি পত্রিকার কথা আছে। দলের প্রথম ইংরেজি বুলেটিনে লিগের তৎকালীন সভাপতি চন্দন সিং ঠাকুরির(ওরফে ঠাকুর চন্দন সিং) দীর্ঘ ভাষণ প্রকাশিত হয়। 'ভারতের গুর্খা' শীর্ষক সেই ভাষণে লিগের জন্মকাল বলা আছে ১৯২০। চন্দন সিং-এর দাবি, ১৯৩১ সাল নাগাদ ভারতে অন্তত ত্রিশ লক্ষ গুর্খার বাস, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাঁদের রাজনৈতিক মর্যাদা দিচ্ছে না। নেপাল রাজসরকার ভারতে সে দেশের লোকের স্থায়ী বসতি পছন্দ করে না, নেপালে ব্রিটিশদের সেনাভর্তির কাজও চলবে, সুতরাং ব্রিটিশরা নেপাল দরবারকে চটাবে না। ওই ভাষণে আরো বলা ছিল, সংযুক্ত প্রদেশের(আজকের উত্তর প্রদেশ) গুর্খা বাসিন্দারা সবাই সেনা থেকে অবসর নিয়ে ওইখানে থিতু হয়েছেন বটে, কিন্তু নানা কাজে নেপাল থেকে গুর্খারা দার্জিলিং এবং সিকিমে আসছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোথায় তাঁরা নেই? ব্রিটিশ সরকার যদি ভাবে নেপাল থেকে যারা এসেছে তারা সবাই দেশে ফিরে যাবে, এমনকি সেনারাও, সেটা নেহাৎ বাচ্চামো, ভারত কি গুর্খাদের দেশ নয়? ভারতের অন্য মানুষদের সঙ্গে গুর্খারা কি একাত্ম বোধ করবে না? ভারতীয় গুর্খাদের সঙ্গে ব্রিটিশ সায়েবদের এই ব্যবহার অন্যায়, তাঁদের সেটা আশু বোঝা দরকার। 

ভাষণটি চোস্ত ইংরেজিতে। হবার কথাও। চন্দন সিং ছিলেন নেপালের সেনাধ্যক্ষ করক সমশের জঙ্গ-এর জামাই, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে বিকানির মহারাজার দরবারে কাজ করেছেন, রাজকীয় উট বাহিনীর(রয়্যাল ক্যামেল কর্পস) সঙ্গে যুদ্ধেও গিয়েছেন। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, বিকানির রাজার সঙ্গে ঝামেলা করে তিনি দেরাদুনে চলে আসেন, সেখানেও ঝামেলা করেন। তাঁকে বলা হচ্ছে 'সুপরিচিত ঝামেলাবাজ', ওয়েল-নোন এজিটেটর। আরো বলা হচ্ছে, অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। নাভার মহারাজার হয়ে তিনি 'শৃগালবৃত্তি' করেন এবং রাজার গোলমেলে কাজে তাঁর মদত ছিল। তাঁর শ্বশুরমশাই এসবের কারণে তাঁকে ত্যজ্য করেন। 

চন্দন সিং-এর ভাষণে বলা ছিল, জনৈক সিআইডি অফিসারের লিগ বিষয়ে ভুল তথ্য পাঠানোর জন্য তাঁদের সম্বন্ধে ভুল ধারণা তৈরি হয়, বিশেষ করে সেনাদলে। পরে সেই অফিসার নিজের ভুল বুঝতে পারেন (বেনারসের এক ব্রাহ্মণ তাঁকে ভুল বোঝায়), ব্যাপারটা মিটে যায়। 

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (তিন)

মিটে যে যায়নি, গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে তা বোঝা যাচ্ছে। সায়েবরা ভারতবর্ষে গোর্খা রাজনীতি পছন্দ করতেন না।  জাতি বানানো, সমতলের লোকজনের ওপর ঘৃণা, বাঙালি বিদ্বেষ, এসব এক রকম, তাতে ব্রিটিশদের স্বার্থরক্ষা হয়। আর গুর্খারা দল পাকিয়ে রাজনীতি করবেন, সেটা অন্য রকম, কী থেকে কী হয় কে বলতে পারে।

রিপোর্টে বলা হল, গুর্খা সেনাদের মধ্যে ঝামেলা পাকাচ্ছিলো যে খড়্গ বাহাদুর সিং এবং দলবল, তাদের সঙ্গে লিগের সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। যাই হোক, মোটের ওপর, সেনার লোকজন লিগকে স্বীকার করে না, যাবতীয় কর্মরত  গুর্খাদের বলে দেওয়া হয়েছে, এদের সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ না রাখতে। 

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (দুই)

যে ফাইল নিয়ে কথা হচ্ছে, সেটা তৈরি হবার কারণ, লিগের পক্ষ থেকে গুর্খাদের রাজনৈতিক মর্যাদা দাবি করে বড়লাটের সঙ্গে দেখা করতে চাওয়া হয়েছিল। ভারতে স্বশাসন বা সেল্ফ রুল চালুর একটা কথা উঠেছিল, অসহযোগ আন্দোলনের ধাক্কায়। সেই 'স্বশাসন' পরে মনটেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার(রিফর্ম) মারফত কেন্দ্রীয় আইনসভা বা সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে পরিণত হয়। ১৯১৯-এর ভারত সরকার আইন, ১৯২৭-এর সাইমন কমিশন, পরবর্তী ১৯৩৫-এর নতুন আইন, এসব ভারতীয় রাষ্ট্রের বড় রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশ, যাকে বলে মেইনস্ট্রিম, সে চর্চায় এখানে না ঢোকাই বিধেয়। মোটের ওপর, জাতি, প্রদেশ এবং ধর্মের ভিত্তিতে নির্বাচিত(সীমিত ভোটে সবার ভোটাধিকার ছিল না) এবং মনোনীত দেশীয় প্রতিনিধিরা সায়েবদের সঙ্গে মিলে স্থানীয় শাসন চালাবেন, এরকম কিছু ভাবনার অবতারণা হচ্ছিল। আমরা বলছি ১৯৩১-এর কথা, ঠিক তার আগেই জাতীয় কংগ্রেস ১৯৩০-এর নির্বাচন বয়কট করে। গোর্খা লিগ চাইছিল, শাসনপ্রক্রিয়ায় সামিল হতে। ভারতীয় গোর্খা হিসেবে এই অধিকার তাদের প্রাপ্য, সেই দাবি নিয়ে বড়লাটের কাছে যাওয়া। চন্দন সিং খুব গোলমেলে ব্যক্তি, এই কারণে সরকার সাক্ষাৎকারের অনুমতি দেয় না। 

চন্দন সিং-এর ভাষণে বলা ছিল, শুধুমাত্র জন্মের কারণে ভারতবাসী গোর্খাদের মধ্যে ফারাক করা চলবে না, যদি না জন্মের সঙ্গে 'স্বভাবচরিত্র, পড়াশুনো, ইত্যাদি গুণাবলিও' যুক্ত হয়। সম্ভবত এই 'সংযোগের' কারণেই লিগের কমিটিতে যাঁরা ছিলেন তাঁরা প্রত্যেকে আগমার্কা, উঁচু জাতির কিম্বা সেনাফেরত গোর্খা। চন্দন সিং প্রথমে সহ-সভাপতি ছিলেন, সভাপতি প্রাক্তন নেপাল রাজার ছেলে, রাজপুত্র নরেন্দ্র সমশের জঙ্গ বাহাদুর রানা। পরে চন্দন সিং সভাপতি হন, নরেন্দ্র সমশের রানা লিগ ছেড়ে দেন। বাকি সদস্যদের মধ্যে ছিলেন নেপাল রাজপরিবারের আর এক সদস্য ক্যাপ্টেন হেম সমশের জঙ্গ বাহাদুর রানা, সাধারণ সম্পাদক, এবং আরো জনা ছয়েক ব্রাহ্মণ(পান্ডে), ক্ষত্রিয়(সিং) এবং মঙ্গর(থাপা)। লিগ ব্রিটিশরাজের(কিং অ্যান্ড কান্ট্রি) প্রতি 'নিঃশর্ত আনুগত্য' ও 'দায়িত্বপূর্ণ সেবার' অঙ্গীকার করে। বড়লাটকে লেখা চিঠিতে চন্দন সিং সে কথা আবার বলছেন। আরো বলছেন, সরকার ভারতীয় গুর্খাদের যথাযথ গুরুত্ব না দেবার ফলে:

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ

‘সম্প্রদায়ের অসন্তুষ্ট যুবারা প্রকাশ্যেই অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করিতেছে...গুর্খাদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের উদাসীন মনোভাবের কারণেই ইহাদের হঠকারী ও প্রচারমূলক কাজ গতি পাইতেছে...বিশেষত, অনভিজ্ঞ ও অপরের কথায় প্রভাবিত হয় এমন তরুণেরা...গুর্খাদের নূতন প্রজন্মের উপর অরাজক শক্তির প্রভাব খুবই উদ্বেগজনক।’

এবং,
‘আমাদের উদ্দেশ্য, ভারত সরকার এবং নেপালের মধ্যে যে সুখদ মৈত্রী ও সৌহার্দ্য বিরাজ করিতেছে, তাহাকে শক্তিশালী করা…(সেই উদ্দেশ্যে) ব্রিটিশ-ভারতীয় গুর্খাদের মন্মহারাজের(হিজ ইমপিরিয়াল ম্যাজেস্টি) অনুগত প্রজা হিসাবে রাখা…’

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (নয়)

চন্দন সিংকে নিয়ে অধ্যাপক মহেন্দ্র পি লামা একটা ছোট বই লিখেছেন, দেখলাম। সাহিত্য একাডেমি থেকে প্রকাশিত সে বইতে চন্দন সিংকে সমাজ-সংস্কারক, সুলেখক, সুবক্তা এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার দিকে ঝুঁকে পড়া অসামান্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গুর্খা সনসার বলে যে পত্রিকা চন্দন দেরাদুন থেকে বার করতেন, আধুনিক ভারতীয় নেপালি সাহিত্যের জন্মও সে পত্রিকায়, এমনও বলা হয়েছে। অধ্যাপক লামা পণ্ডিত মানুষ, দার্জিলিংয়ের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়ে ছিলেন, সম্ভবত আছেন এখনও। চন্দন সিং-এর লেখাপত্র ধরে তাঁর বইটা লেখা, মহাফেজখানার এই ফাইলটা তিনি দেখেছিলেন কি? সন্দেহ আছে। 

পাহাড়ে অন্য রাজনীতির যে ধারা স্বাধীনতার লড়াইয়ের মধ্যে, কমিউনিস্ট সংগঠকদের কাজে, বাগিচা শ্রমিকদের আত্মত্যাগে পরিশ্রমে পুষ্ট, সে রাজনীতির নেতারা ঐতিহাসিক গোর্খাজাতির বাইরের লোক, গোর্খাল্যান্ডের লড়াইয়ে তাঁরা হয় নির্মূল নিশ্চিহ্ন হয়ে যান, নাহলে জোর করে তাঁদের গোর্খা বানানো হয়। সমস্ত পাহাড়িদের ক্ষেত্রেই এ কথা খাটে, স্থানান্তরিত নেপালি তো বটেই, জুমিয়া লেপচা, তিব্বতি, সিকিম বা ভুটানের ভুটিয়া। 

দার্জিলিংয়ে দশরকম কায়িক পরিশ্রমের কাজ করার জন্য নেপাল থেকে মানুষ এখনো আসছেন। পিঠে বিপুলাকার চেরা কাঠ, রড, পাইপ ইত্যাদির বোঝা এবং ট্যুরিস্টদের মোট, এসব কপালে ফিতে দিয়ে বেঁধে যাঁরা চকবাজারে, চৌরাস্তায় কি তুংসুঙে চড়াই ভাঙেন, তাঁদের অধিকাংশ নেপালের বাসিন্দা, কাজ ফুরোলে দেশে ফিরে যান, আবার আসেন। নেপাল এবং দার্জিলিংয়ের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ থেকেই গেছে; পরিচিত পাহাড়ি বন্ধুদের অনেকেরই বিবাহসূত্রে বা অন্য পারিবারিক কারণে নেপালের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়মিত যাতায়াত আছে। থাকার কথাও। 

ঔপনিবেশিক শাসকদের নিজেদের প্রয়োজনে বানানো সেনাদল, জাতিপ্রথা(কাস্ট) মেনে সেনাভর্তি। সেইসঙ্গে, সমতলের আম-ভারতীয়র প্রতি 'গুর্খা' সেনাদের 'সহজাত' বিদ্বেষ ও ঘৃণা, তাদের শ্বেতাঙ্গপ্রেম। জাতিনির্মাণের(রেস, এথনিসিটি) প্রক্রিয়ার মধ্যে বানানোর, তৈরির - ভালো ভাষায় বললে কল্পনির্মাণের - একটা ব্যাপার যে থেকেই যায়, বেনেডিক্ট অ্যান্ডার্সনের লেখা ইম্যানিজড কমিউনিটি বই যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা তা জানেন। তবে এক্ষেত্রে কল্পনার মাত্রা কিছু বেশি ছিল। যে ভূগোল-ইতিহাস থেকে সায়েবি গুর্খারা জন্মাচ্ছিলেন, সেই পরিসরে ওই পরিচয় নিয়ে কোন আধুনিক(উত্তর-ঔপনিবেশিক সময় অর্থে) জাতি তৈরি হয়ে উঠল না, গুর্খা রাজাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক আধিপত্য সত্ত্বেও। নেপালের বাসিন্দারা আজও বহু জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত, কাঠমান্ডুর শাসন তাঁদের সবাই মেনে নিতে রাজি নন। নেপালের সমতল-পাহাড়ের দ্বিত্ব, মধেসিদের সঙ্গে পাহাড়িদের দ্বন্দ্ব, এসব অবশ্য রয়েই গেছে। তা সত্ত্বেও নেপালের বাসিন্দারা সাধারণত নিজেদের 'নেপালি' বলেই পরিচয় দেন।

Powered by Froala Editor