সময়ভ্রমণ - ৫৭
আগের পর্বে
উনিশ শতকের শুরু থেকেই দাসপ্রথা বিলোপের কথা ওঠে ইংল্যান্ডে। ১৮০৭ সালে দাসব্যবস্থা বে-আইনি ঘোষণা করা হয়। তারপরেও ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলির উপনিবেশে বহাল তবিয়তে টিকে ছিল দাসপ্রথা। আর এই ব্যবস্থার অন্যতম বড়ো ক্ষেত্র ছিল বাগিচাগুলি। তবে ভারতের চা-বাগানগুলিতে যে ব্রিটিশরা দাসপ্রথা চালাতেন, এমনটা জোর গলায় বলা যায় না। বরং নানা দেশীয় রাজ্যে যে খোলা বাজারে দাস কেনাবেচা হত, তা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের লেখা থেকে জানা যায়। তারপরেও ব্রিটিশরা শ্রমিকদের কী চোখে দেখত, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বিশেষ করে যখন দেখা যায় শ্রমিক পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে ভ্যান্সিটার্ট বার্ষিক অপচয় বলে উল্লেখ করছেন। তবে নেপাল থেকে এত এত শ্রমিক নিয়ে যাওয়ায় খুশি ছিলেন না নেপালের রাজাও।
নেপালের তৎকালীন মহারাজা, প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাপতি, হিজ এক্সেলেনসি স্যার চন্দ্র সমশের জঙ্গ বাহাদুর রানা ব্রিটিশ রেসিডেন্টকে লম্বা লম্বা চিঠি ও বড় বড় মেমো পাঠাচ্ছিলেন। বেশিটাই পুনরাবৃত্তি, এখানে বলার প্রয়োজন নেই। রাজামশাইয়ের মোদ্দা বক্তব্য ছিল, নেপাল ব্রিটেনের মিত্রশক্তি, যা জনসংখ্যা তার চাইতে অনেক বেশি অনুপাতে দেশ যুদ্ধে লোক পাঠিয়েছে, আরো লোক নেওয়া হতে থাকলে, দেশ চলবে কী করে? রাজার হিসেবে, যুদ্ধের চার বছরে ২০০০০০ জন গুর্খা সেনাদলে ভর্তি হবে বলে দেশ ছেড়েছে, সত্যি ভর্তি হয়েছে কজন? বড় জোর একলাখ। বাকিদের খবর নেই, তারা গেল কোথায়? রাজা, কাঠমান্ডুর রেসিডেন্ট বেইলি এবং সেনাদপ্তরের সাধারণ বক্তব্য, লেবার এজেন্সির লোক ও অবৈধ আড়কাঠি ইত্যাদিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা ফুঁসলে লোক নিয়ে যাচ্ছে চা বাগিচায়, কয়লাখনিতে, আরো কোথায় কোথায়। বেসরকারি এবং বে-এক্তিয়ার লোক-তোলা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে শুধু সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বন্ধ করে কী হবে?
ওদিকে, নেপালরাজ খুবই বিচলিত হয়ে পড়ছিলেন। সক্ষম-দেহ পুরুষদের(এবল-বডিড মেল, রাজা মেয়েদের নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না) এভাবে দেশ থেকে শুষে নিলে('ড্রেইন' শব্দটা বারবার ব্যবহার হয়েছে), ভবিষ্যতে কী হবে? রাজা একবার বলছেন, যোদ্ধা জাতিদের(ছেত্রী, ঠাকুরি, গুরুং, মাগর, লিম্বু, রাই, সুনওয়ার ইত্যাদি) কুলি-মজুরের কাজে লাগানো অনুচিত, তারা যখন সেনাদলে কাজ করছে, তখনও তাদের জল দেওয়া(ভিস্তি) ও রান্না করার কাজে(রাঁধুনি) নিচজাতির লোক--যথা কামি, সার্কি ও দামাইদের--লাগানো উচিত না। এটাও বলছেন, নেপালের সমাজে এই সব নিচ জাতির লোকদের নির্দিষ্ট অবস্থান ও কাজ আছে, তারা বাইরে চলে গেলে সে কাজ করবে কে? এ তো গেলো সেনাদের কথা। কুলিচালানের জন্য লোক ঘুরছে, দার্জিলিং এবং গোরখপুর ডিপো থেকে সেনাভর্তির বাতিল লোকজন দেশে ফেরত আসার মুখে, ভারত-নেপাল সীমান্তে আড়কাঠিরা দাঁড়িয়ে থাকছে লোক ধরবে বলে। দার্জিলিংয়ের ডিপোফেরতা লোক ধরার জন্য ধানকুটায় আড়কাঠি ঘুরছে, এসব চলতে পারে না। নেপালের মাটি থেকে স্রেফ সেনাভর্তির জন্য লোক নেওয়া যাবে, কুলিকাজের জন্য নয়, রাজা সাফ বলছেন।
ব্রিটিশ সরকার নেপালরাজের এইসব চিন্তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছিল। সেনা দপ্তর, বিদেশ ও রাজনৈতিক দপ্তর এবং বাণিজ্য ও শিল্প দপ্তরের মধ্যে এ নিয়ে বিস্তর চিরকুট-চালাচালি হয়। সেনা ও রাজনৈতিক দপ্তরের কথা বলা হয়েছে, রাজার অভিযোগের পরপরই নেপাল থেকে ব্রিটিশ গুর্খা সেনাদলের জন্য অ-যোদ্ধা শ্রমিক তোলা বন্ধ হয়। যুদ্ধের সময় বলে, এতে কিছু অসুবিধাও হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, রাজার কথা মেনে নেওয়া হয়। ঝামেলা লাগল অন্য কাজে যাওয়া 'কুলি'দের নিয়ে। আসাম সরকার এবং বাংলা সরকারের তরফে আপত্তি জানানো হল, চাবাগিচা শ্রমিক যোগাড় করার সায়েবি 'এজেন্টদের' সংগঠনগুলোও আপত্তি করতে থাকল। আসাম সরকার জানাল, বনের কাজে নেপালি কুলি না হলে চলবেই না। বনের কাজে নেপালি কুলি লাগত বাংলার ডুয়ার্সে, তরাইতেও। চাবাগিচায় তো লাগতই। কুলি তোলা বন্ধ হলে মহাসংকট।
অনেক চিন্তাভাবনার পর ভারত সরকার ঠিক করল, 'নেপালি' কে, সে বিষয়টা আগে ঠিক করা দরকার। নেপাল থেকে সরাসরি যাদের আনা হচ্ছে, তারা তো নেপালি বটেই, মানে তাদের শ্রমের(ও শরীরের) ওপর রাজার দাবি রয়েছে। কিন্তু যারা 'স্বেচ্ছায়' ভারতে চলে এসে এখানে কাজ করছে, তারা কার প্রজা, তাদের ওপর কার দাবি বেশি? ফি বছর নেপাল থেকে যে কুলিরা কাজ খুঁজতে সীমান্ত পেরিয়ে এদিক ওদিক যায়, বাগিচায়, বনে তাদের কাজে লাগানো যায় কি যায় না? অনেক ভেবে ঠিক হল, 'নেপালের নেপালি'দের সঙ্গে ভারতে স্বেচ্ছায় বসবাস করছে এমন নেপালিদের(রাজা এবং ব্রিটিশ সরকার, দু তরফেই 'নেপালি' ও 'গুর্খা' শব্দদুটো সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে), যাদের বলা হল ডমিসাইলড ইন ইন্ডিয়া, ফারাক করা দরকার। রাজা ইতিমধ্যে নেপাল ছেড়ে সিকিম, ভুটান এবং দার্জিলিংয়ে নজর দেবার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছেন। সে সব জায়গা থেকে লোক তোলার সুবিধার জন্য তিনি সরকারকে এক লক্ষ টাকা দিতেও চাইলেন, কিছু টাকাকড়ি হাতে দিলে লোক বাইরে যেতে রাজি হবে দ্রুত, এই বিবেচনায়। এ প্রস্তাব ব্রিটিশরা বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করে।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (দুই)
সায়েব প্রশাসক ও সরকারি কর্মচারিদের একাংশ চাইছিলেন, নেপাল থেকে কুলি আনার ক্ষেত্রে আসামের ধাঁচে সরকারি নিয়ন্ত্রণ চালু হোক, তাহলে এলোমেলোভাবে লোক তোলা বন্ধ হবে। এ প্রস্তাবও কাজে লাগেনি, কারণ নেপাল থেকে আসা লোকজন ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে কী করে? তা না হলে, আসামের আইনের আওতায় তাদের আনা যায় কী করে? আর একটা কারণ অবশ্যই সরকারি হস্তক্ষেপের বিষয়ে দার্জিলিংয়ের প্ল্যান্টারদের প্রবল বাধা, মিডলটনের লেখায় যে প্রসঙ্গ এসেছে।
রাজা শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন যে নেপাল থেকে স্বেচ্ছায় কাজ খুঁজতে যাওয়া মরসুমি শ্রমিকদের বাগিচা, বন ও অন্যান্য কাজে লাগানো যাবে। ধরে নেওয়া হল, যারা যায় তারা আবার নেপালে ফিরে এসে নিজের নিজের কাজ করবে।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ
নেপাল থেকে কাজ খুঁজতে ভারতে আসার গল্পটা পুরনো। সীমান্ত হিসাবে যে নদী বা পাহাড়গুলো কাজ করত, তা টপকালেই মুগলান, বা মুঘল শাসনাধীন অঞ্চল। দার্জিলিংনিবাসী নেপালি সাহিত্যিক ইন্দ্র বাহাদুর রাইয়ের বিখ্যাত উপন্যাস, আজু রমিতা, সম্প্রতি যারা বাংলা অনুবাদ করেছেন শমীক চক্রবর্তী, সেখানেও এই অনুষঙ্গ— দার্জিলিংয়ে চলে আসছে যারা, তাদের ধারণা মুগলানে সোনা পাওয়া যায়। সত্যেন্দ্রনারায়ণও সীমান্ত পেরিয়ে আসা নেপালি শ্রমিকদের মধ্যে প্রচলিত প্রবাদের উল্লেখ করছেন, চায়ের গাছে নাকি সোনা ফলে। বেসকির লেখাতেও দেখলাম, এই প্রবাদের কথা বলা আছে।
সমস্যা এই, কে স্বেচ্ছায় আসছে, কাকে ফুঁসলে আনা হচ্ছে, কে জানে? দার্জিলিং সিকিম থেকে শুরু হয়ে ভারত-নেপাল সীমান্ত চলে গেছে হাজার দেড়েক মাইল দূরে পূর্ব কুঁমাউয়ের কালি নদী অবধি। এই বিস্তীর্ণ এলাকা দিয়ে কে আসছে কে যাচ্ছে তার হিসেব কে রাখে? যুদ্ধ শেষ হল, ব্রিটিশ গুর্খা সেনাদলে অ-যোদ্ধা জাতির ভর্তির ওপর বিধিনিষেধ রাজা তুলে নিলেন। ধরে নেওয়াই যায়, এরপর থেকে সব আগের মতো চলতে থাকল, নেপালের লোক ব্রিটিশ শাসিত মুগলান ও সাম্রাজ্যের অন্যত্র যাত্রা করতে এবং চালান হতে থাকলেন। গুর্খা লিগের প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতীয় গুর্খাদের আদি নেতা ঠাকুর চন্দন সিং-এর দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, ১৯২৭ সাল নাগাদ কলকাতার বিভিন্ন কারখানা ইত্যাদিতে ১০০০০০ গুর্খা কর্মরত।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (নয়)
রাজা সব বাধানিষেধই উঠিয়ে নিয়েছিলেন, তা আদৌ নয়। মহাফেজখানায় রক্ষিত ১৯২২ সালের ১৮৫ নং (এক্সটার্নাল) ফাইলে দেখা যাচ্ছে, বার্মা মিলিটারি পুলিশে গুর্খা সেনার সংখ্যা বাড়ানো যাবে কিনা এই নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে চাপানউতোর চলছেই। নেপালরাজ যে এক ব্রিটিশ সেনা ছাড়া অন্য কোথাওই লোক ভর্তিতে আপত্তি করে যাচ্ছেন, সে কথা ঘুরেফিরে আসছে। মনে হয়, ব্যাপারটা খানিক মিটে গিয়েছিল। ১৯৩৪-এর ১৬১-এক্স ফাইলে দেখা যাচ্ছে, বার্মা মিলিটারি পুলিশ এবং আসাম রাইফলস-এ রিক্রুটিং ডিপোফেরত যোগ্য গুর্খাদের নেওয়া যাবে বলে, ভারত সরকার আসাম সরকারকে নোট পাঠাচ্ছে। যা বাকি থাকবে, সে ঘাটতি পূরণ করতে দেরাদুনের গুর্খা কলোনি থেকে লোক নেওয়া যেতে পারে, এমন বলা হয়েছিল।
Powered by Froala Editor