সময়ভ্রমণ - ৫৬
আগের পর্বে
বাগিচায় কী ধরনের শ্রমিক নিয়োগ করা হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হিন্দু জাতিভেদ প্রথাই অনুসরণ করেছিলেন সাহেবরা। এই উদ্দেশ্যে এক প্ল্যান্টার সাহেব রীতিমতো জাতিগোত্র বিচার করে শ্রমিকদের কাজের দক্ষতা হিসাব করেছিলেন। তবে সাহেবদের রাজত্বে পুরনো জাতিপরিচয়ও অক্ষত থাকল না। ব্রিটিশদের হাতেই তৈরি হল নতুন জাতিপরিচয়, গোর্খা। গোর্খা মানে আদৌ সমগ্র নেপালের মানুষ নন। কাঠমাণ্ডু থেকে কিছু দূরের শহর গুর্খা। সেখানকার যুদ্ধবাজ জাতিকে ব্রিটিশরা মূলত সেনাবাহিনীর কাজে লাগিয়েছিল। সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীতে গোর্খাদের আনুগত্যের কথা ছিল সর্বজনবিদিত। বিশেষ করে সিপাহী বিদ্রোহের সময় তা কিংবদন্তি হয়ে ওঠে। কিন্তু পূর্ব নেপালের এই অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনীতে প্রচুর কর্মী নিয়োগ করার ফলে বাগিচায় শ্রমিকের অভাব দেখা দেয়।
ভ্যান্সিটার্ট জানাচ্ছেন, গুর্খাদের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগের সময় জাতগোত্র মেনে কাজ দেওয়া হত। যাদের নেওয়া হত, তাদের সবাই টিঁকে থাকতেন না সম্ভবত, সুতরাং ভ্যান্সিটার্ট 'বার্ষিক অপচয়'(য়্যানুয়াল ওয়েস্টেজ) শব্দবন্ধটি ব্যবহার করছেন।
অপচয় মানে? গুর্খাদের প্রচুর প্রশংসায় ভরিয়ে দেবার পর, তাঁদের প্রসঙ্গে যখন এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়, মনে করা যেতেই পারে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একনিষ্ঠ সেবক, বিশ্বস্ত গুর্খা সেনাদের দেখা হতো নিছক প্রয়োজনীয় রসদ বা মাল হিসেবে। মাল বহন ও শারীরিক পরিশ্রম করার জন্য যে কুলির দরকার, সেও যেমন মাল, তেমন সাম্রাজ্যবিস্তার ও রক্ষার কাজে যে সৈন্য দরকার, তারাও মাল।
উনিশ শতকের ব্রিটিশরা ক্রীতদাস প্রথা পছন্দ করতো না, জোর দিয়ে বলা যায় না। ব্রিটিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তীর্ণ আখবাগিচা ছিল, সেগুলো গড়ে উঠেছিল দাসশ্ৰমে। বাগিচার ও অন্যান্য কাজের জন্য পৃথিবী জোড়া ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোয় নামে বেনামে দাসপ্রথা ও দাসব্যবসা চলছিলই। সেই ব্যবসায় বহু ইংরেজ বা ব্রিটিশ যুক্ত ছিল, সমাজে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। আঠেরো শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের প্রায় মধ্যবিন্দু অবধি দাসব্যবসা(স্লেভ ট্রেড, দাস চালান দেবার ব্যবসা) ও দাসপ্রথা(স্লেভারি) বেআইনি ঘোষণার দাবিতে ধারাবাহিক প্রচার আন্দোলন, ব্রিটিশ সংসদের নিম্ন 'সাধারণ' কক্ষে(কমন্স) ওই সংক্রান্ত প্ৰস্তাব, কিছুতেই কাজ হয়নি। ১৮০৭-এ দাসব্যবসা বেআইনি ঘোষিত হচ্ছে, অথচ দাসশ্রমনির্ভর বাগিচা-অর্থনীতির, কেতাবি ভাষায় যাকে বলে প্ল্যান্টেশন ইকনমি, তার টাকায় ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব দানা বাঁধছে, বলছেন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক মাইকেল টেইলর। দাসপ্রথা বিলোপের বিরুদ্ধে কিভাবে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত অর্থনৈতিক কারণেই একজোট হয়, সেই ইতিহাস নিয়ে টেইলরের বই, দি ইন্টারেস্ট প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালে। ১৮৩১-এ জামাইকার দাসেরা বিদ্রোহ না করলে, রক্তারক্তি খুনজখম না হলে ১৮৩৪-এর দাসপ্রথা বিলোপ আইন পাস হত কিনা সন্দেহ।
মার্কিনি দাসব্যবসার সঙ্গে বাগিচা অর্থনীতির নিগূঢ় সম্পর্ক, বাগিচা ও অন্যত্র দৈহিক পরিশ্রমের কাজ করার জন্য যে দাসশক্তি দরকার ছিল, সেটার সরবরাহ নিশ্চিত করাও দরকার ছিল। সুতরাং, কিছু বাগিচায় 'ভালো', 'মজবুত' দাস তৈরি করা হত, বিক্রিযোগ্য মাল হিসেবে। এ নিয়ে অসংখ্য লেখাপত্র, ফিল্ম, গান ইত্যাদি আছে, বেশি কথা বলার দরকার নেই।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ
ব্রিটিশ ভারতের সায়েব কর্তারা দাসপ্রথা চালাচ্ছিলেন, বা দাসপ্রথার সমর্থক ছিলেন, এহেন সিদ্ধান্তে যাওয়া ঠিক হবে না। সত্যি কথা বলতে কি, ভারত বিষয়ে আদিতম সায়েববিবরণেও দিশি রাজ্যগুলোয় দাসপ্রথার প্রচলন নিয়ে মন্তব্য পাওয়া যায়। যেমন, জর্জ বোগলের পর তিব্বতে কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে যাচ্ছেন স্যামুয়েল টার্নার, তাঁর বৃত্তান্তে কুচবিহারে খোলাবাজারে দাসবিক্রির কথা বলা আছে। সিকিম নেপাল ভূটানে দাসপ্রথার প্রচলন নিয়ে মন্তব্য করছেন হ্যামিলটন-বুকানন, লয়েড, ক্যাম্পবেল, হুকার। এতদসত্ত্বেও, বুঝতে কষ্ট হয় না যে সাদা-চামড়া য়ুরোপীয়-আমেরিকান ছাড়া বাকি যাবতীয় মানুষজনকে সায়েবরা ঠিক কি চোখে দেখতেন। গুর্খা সেনানিয়োগ সম্বন্ধে ভ্যান্সিটার্ট বলছেন:
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (নয়)
‘বার্ষিক অপচয়জনিত ঘাটতি পূরণ করিবার জন্য, প্রতি বৎসর ১৮০০ হইতে ২০০০ নিয়োগ প্রয়োজন…’
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতি-নির্মাণ (আট)
ঘাটতি মেটাতে নেপালের এ মাথা ও মাথা জাল ছড়ানো হল, যদিও সেনাযোগাড়ের মূল এলাকা ছিল মধ্য ও পূর্ব নেপাল। মধ্য নেপাল থেকে ঠাকুর, খস, মাগর এবং গুরুংদের নেওয়া হত, সঙ্গে কিছু নেওয়ার। নেপালি সমাজের জাতিপ্রথা মেনে যুদ্ধ ছাড়া অন্য কাজের জন্য 'নীচ' জাতের লোকজন নেওয়া হত। দামাইরা বিউগল বাজাতেন, ব্যান্ডে কাজ করতেন। কামি এবং সার্কিরা মুচি ও কামারের কাজ করতেন। এই অনুযায়ী কোন কোন অঞ্চলে কী জাতের লোক কত, তার সারণী তৈরি করা হয়েছিল। ভ্যান্সিটার্টের বই যখন বেরুচ্ছে, প্রতি বছর নেপাল থেকে বিভিন্ন ধরনের কাজ মিলিয়ে বিভিন্ন জাতির মোট ৭৫০ জনকে তোলা যায়--তাঁর বই থেকে দেখা যাচ্ছে মোট মাল যা আছে, এই কজন লোক হামেহাল অনায়াসে পাওয়া যাবে(শুড বি অলওয়েজ অবটেইনড উইদআউট এনি ডিফিকাল্টি)।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (সাত)
লোক পাওয়া যেত কীভাবে? যেভাবে অন্য কাজের জন্য লোক তোলা হতো সেভাবেই— ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর খরচায় রিক্রুটার (বা লোক যোগাড়ের লোক) নিজেদের গ্রাম এবং আশপাশের গ্রাম থেকে লোক যোগাড় করত। ভর্তি হবার জন্য যাচ্ছে যারা, তাদের যে পাস দেওয়া হত, সেখানে প্রত্যেকের বিশদ জাতিপরিচয় লেখা থাকত। যাদের নেওয়া হত, প্রথমে পাঠানো হত তাদের নিজের নিজের রিক্রুটারদের ব্যাটেলিয়নে।
অর্থাৎ এখানেও সর্দারি প্রথার রকমফের। ফারাক এইমাত্র যে এক্ষেত্রে জাতিনির্মাণের একটা ব্যাপারও ছিল। সেনাবাহিনীতে কর্মরত 'গুর্খা'রা দেশেগাঁয়ে ফিরছে, সঙ্গে নিয়ে আসছে সম্ভাব্য নতুন 'গুর্খা'দের। সেনাবাহিনীতে একবার ঢুকে গেলে পুরোনো জাতিপরিচয় ছাপিয়ে রিক্রুটদের গায়ে পাকাপাকি লেগে যাচ্ছে নতুন জাতিপরিচয়। পূর্ব নেপালের লিম্বুরা গুর্খা সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেদের দেশ হারিয়েছে, তারা গুর্খা, মধ্য নেপালের নেওয়াররা, যাদের হারিয়ে কাঠমান্ডু উপত্যকায় গুর্খা রাজত্ব কায়েম হচ্ছে, তারাও গুর্খা। যে কামিরা অন্য জাতির হয়ে বিনা মজুরির শ্রম দেবার জন্মদাস, গুর্খা সেও।
নেপালের তৎকালীন শাসকদের সঙ্গে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক কৌশলজনিত সম্পর্ক ছিল, যাকে বলে স্ট্র্যাটেজিক রিলেশানশিপ। মানে, এ ওকে পুরোটা বিশ্বাসও করত না, বিশেষ ঘাঁটাতও না। নেপাল থেকে শ্রম পাইকিরি ধাঁচে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এদিক ওদিক চালান হচ্ছে, এতে নেপাল রাজাদের পুরো সায় ছিল না। এটা জানা গেল আচমকাই পাওয়া পুরোনো কিছু চিঠিচাপাটি থেকে। নেপাল রাজ ও ব্রিটিশ ভারতের সরকারের মধ্যে চিঠিচালাচালি, এবং ভারত সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে তদসংক্রান্ত চিরকুট(মেমো) বিনিময়, বিষয় 'গুর্খা সেনা' ভিন্ন অন্যান্য নেপালিদের ব্রিটিশদের কাজে নিয়োগ। জাতীয় মহাফেজখানায়, ১৯১৯ সালের জুন মাসের এক কার্যবিবরণী বা প্রসিডিংস থেকে এই কথোপকথন পাওয়া গেল। অন্যান্য আখ্যানে এই উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে, চোখে পড়েনি। সে-কারণে, কিছু বিশদেই ব্যাপারটা হাজির করা গেল।
১৯১৯-এর ফাইল, তবে কথাবার্তা শুরু হচ্ছে ১৯১৭-র অগস্টে। সেটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, প্রচুর শ্রমিক দরকার, সেনায় তো বটেই, বাইরেও। চাবাগিচায় শ্রমিক আগে থেকেই যাচ্ছিল, অন্য কাজেও নেপালের মানুষ নিয়োজিত হতে থাকলেন। সেনাবাহিনী থেকে রিক্রুটার হিসেবে যে বাধ্য 'গুর্খা' নেপালে ফিরছে এবং সেখান থেকে লোক যোগাড় করে নিয়ে আসছে, সে কাকে সঙ্গে করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা কে জানে? নেপালের রাজার আপত্তি ব্রিটিশ রেসিডেন্ট মারফৎ ভারত সরকারে পৌঁছোলে, লোক(কিম্বা কুলি) চালানের এই অবাধ প্রক্রিয়ায় লাগাম পরানোর চেষ্টা খানিক হল। ১৯১৭-র শেষে সেনাদপ্তরের একটি চিরকুটে বলা হল:
‘...নেপাল হইতে শ্রমিক নিয়োগ...নিষিদ্ধ করা হইযাছে।...সকল গুর্খা ব্যাটালিয়নের সমস্ত অফিসারদের জানানো হইয়াছে...সকল রিক্রুটারের নিকট সিলছাপ সমেত উপযুক্ত নিয়োগপত্র থাকিতে হইবে। যাহাদের নিকট এই সরকারি কাগজ থাকিবে না, নেপাল সরকার তাহাদের বেআইনি রিক্রুটার রূপে গ্রেফতার করিবেন। সকল নিয়োগ একমাত্র সরকারি রিক্রুটমেন্ট অফিসারের মাধ্যমেই করা হইবে।’
এই মেমোর উত্তরে রাজনৈতিক দপ্তর জানায়, সেনাদল থেকে যারা ছুটিতে গিয়ে ফেরে না কিম্বা পালিয়ে যায়, তারা কি করে তার খোঁজ কি সেনাদপ্তর রাখে? দ্বিতীয়ত, নেপাল সরকারকে 'নেপাল দরবার' বলে সম্বোধন করার নিয়ম। সেনাদপ্তর বলে, এই সব অপরাধীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এ উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে বিদেশ ও রাজনৈতিক দপ্তর সেনাদপ্তরের ফাইল চেয়ে পাঠায়। ১৯১৮-র জানুয়ারিতে দপ্তর থেকে নেপালের রেসিডেন্টকে জানানো হচ্ছে:
‘তিনটি বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন:
ক) নেপালের প্রধানমন্ত্রী কতৃক যোদ্ধা নহে এমন(নন-কমব্যাটান্ট) সকল নিয়োগসংক্রান্ত ডিপো বন্ধ করিবার অভিলাষ
খ)গোরখপুর এবং দার্জিলিং ডিপোয় যাহারা প্রত্যাখ্যাত হয়, তাহাদের নিরাপদে নেপালে ফিরাইবার সুব্যবস্থা
গ)নেপাল সেনাদল হইতে পলায়নকারীদের ব্রিটিশ গুর্খা সেনাদলে নিয়োগ
প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী যোদ্ধা ভিন্ন অন্যদের নিয়োগ বন্ধ করিতে হইলে, আর্মি বিয়ারার কর্পস(সেনাদলে যারা মালবহন করে)-এ নিয়োগ বন্ধ করিয়া দিতে হয়, তৎসহ অন্য নিচ জাতি(আদার মেনিয়াল ক্লাসেস, যথা যারা কসাই-এর, ডোমের এবং মেথরের কাজ করত) হইতে নিয়োগও।...’
Powered by Froala Editor