চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (নয়)

সময়ভ্রমণ - ৫৪
আগের পর্বে

অসমের নানা জেলা ঘুরে গ্রুনিং তাঁর রিপোর্ট দিলেন। তিনি ঠিকাদারী ব্যবস্থা বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পরেও ঠিকাদারী ব্যবস্থা থেকে গেল। ক্রমে শ্রমিকদের উপর অত্যাচারও লাগামছাড়া হল। একদিনও কাজ বন্ধ করতে পারতেন না তাঁরা। কাজ বন্ধ হলে বাগিচা ছেড়ে, এমনকি বাসস্থান ছেড়ে চলে যেতে হত পরিবার নিয়ে। এই ব্যবস্থার নাম ছিল হটাবাহার। সত্যেন্দ্রনারায়ণ এবং কমিউনিস্ট ইউনিয়নগুলির রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে হটাবাহার ব্যবস্থার বিলোপ ঘটল। তবে পরিকল্পনামাফিক কমিউনিস্টদের সরিয়ে দেওয়ার কাজও চলল। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের নেতারাও কিন্তু বাগিচা মালিকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তেমন সরব নন। বরং পাহাড়ে দীর্ঘ বন্ধ চললেও চালু থাকে চা বাগানের কাজ।

চা-শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা স্বাধীন দেশের সরকার জানত না, এমন নয়। না জানলে তদন্ত কমিশন তৈরিই হত না। ১৯৫৬-র বাগিচা সম্পর্কিত সরকারি তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে বলা হল: 

‘শ্রমিকদের আরো উৎপাদনক্ষম করে তোলার কথা হলেই শ্রমিকদের আশঙ্কা হয় যে উদ্বৃত্ত উৎপাদন থেকে যে লাভ হবে তার সমস্তটাই মালিকের কাছে যাবে। এরকমটা যে ঘটবে না সে বিষয়ে শ্রমিকদের আশ্বস্ত করতে হবে। আগে কোনটা সেটাই প্রশ্ন--বাড়তি উৎপাদন থেকে প্রাপ্ত লাভের অংশ ভাগ করার শর্ত রেখে তবে উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলা, না শর্ত ছাড়াই উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা? বর্তমান (শ্রম) সম্পর্কের নিরিখে, একমাত্র প্রথমটাই উৎপাদনবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু শ্রমিকরা তাঁদের জীবনযাপনের মান উন্নততর করতে চাইলেও, মালিকদের সঙ্গে লাভের অংশ এবং মজুরি নিয়ে দর কষাকষির মতো জায়গায় তাঁরা নেই। সরকারি সহায়তার সে-কারণে প্রয়োজন। আইন পাস করেও কিছু কাজ হবে না যদি না যথাযথ, উপযুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকে। সরকারি পরিদর্শকদের শ্রমসহায়ক, শ্রম-সংগঠক হয়ে উঠতে হবে।।‘

এই কথাগুলো বলা হচ্ছিল মূলত বাগিচা শ্রমিক আইন এবং কিয়দংশে চা আইন নিয়ে। আইন তো হল, কিন্তু মালিকরা সে আইন আদৌ যে মানবেন তা নিশ্চিত করা যায় কী করে? একে তো সায়েবরা দেশ ছেড়ে গিয়েও যাচ্ছেন না, ১৯৫৪ সালের ৩০শে জুন ভারতের চাবাগিচায় মোট লগ্নি ১১৩ কোটি মতো, তার সিংহভাগ অর্থাৎ ৭৩ কোটি বিদিশি। ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং-এ ব্যবসা করছেন এমন কোম্পানির হাতে ৬১ কোটির বেশি। ১৯৩৯ থেকে ১৯৫৪-র মধ্যে ভারতীয়দের লগ্নি ক্রমাগত বাড়ছিল বটে, তবে তখনো পর্যন্ত ভারতীয় চায়ে সায়েবি নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ। তদন্ত কমিশন যে ২৪৭টা বাগানের লাভক্ষতির বয়ান বিশদভাবে খতিয়ে দেখে, তার মধ্যে বেশিরভাগই পুরো সায়েবি, স্টার্লিং কোম্পানি, মোট জমির প্রায় সত্তর শতাংশ তাদের হাতে। ১৯৩৯ থেকে ৫৩-র মধ্যে তাদের স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ বাড়ছে ৫ কোটি টাকার উপর। 

যুদ্ধবিগ্রহ দেশভাগ ভারতের স্বাধীনতা, বাগিচাজীবনে এর খুব একটা প্রভাব পড়ছিল বলে মনে হয় না। সাদাকালো, দু জাতের চা-কর সায়েবদেরই সম্পত্তি বাড়ছিল। অথচ, সে অনুপাতে বাগিচাপিছু খরচা বাড়ছিল না। চা-গাছ বুড়ো হচ্ছিল—কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, মোট যে ৪২৭২১০ একর থেকে বাগিচার অবস্থা বিষয়ে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, তার প্রায় ৩০ শতাংশ জমির গাছ ১৯০০ সাল বা তারও আগে লাগানো। ১৯৫৩ নাগাদ, নতুন গাছ লাগানো হচ্ছে দশ বছর ধরে মোটে ৮ শতাংশে, ফি বছর ১ শতাংশেরও কম জায়গায়। দার্জিলিংয়ের মোট গাছের প্রায় আশি শতাংশ উনিশ শতকে লাগানো, নতুন গাছ লাগানো হয়নি বললেই চলে। 

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতি-নির্মাণ (আট)

এই অবস্থার বদল না ঘটলে, বাগিচাগুলো ধুঁকতে থাকবে কদিন পর থেকে, বললো কমিশন। পুরোনো গাছ উপড়ে সত্ত্বর নতুন গাছ লাগানো শুরু হোক, এই সুপারিশ করা হলো। নতুন গাছ লাগানো, সেই সঙ্গে কারখানার পুরোনো যন্ত্রপাতি বদলানো। এসবের জন্য বিশেষ তহবিল তৈরি হোক, সেই তহবিলের খরচায় শুল্কছাড় দেওয়া হোক। 

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (সাত)

কমিশনের বেশির ভাগ সুপারিশ মানা হয় না। অবশ্য, নতুন গাছ লাগানোর(রিপ্ল্যানটিং) জন্য বাগিচামালিকদের বিশেষ সুবিধা দেবার রীতি চালু হয়। এখনো অবধি সরকারি টি বোর্ড বা চা পর্ষৎ-এর তরফে বাগিচাগুলোকে রিপ্ল্যানটিং-এর খরচা বাবদ আলাদা করে টাকা দেওয়া হয়। সে টাকায় নতুন গাছ কটা লাগানো হয় সে ভিন্ন প্রশ্ন। 

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (ছয়)

কমিশনের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সায়েবি কোম্পানির বাগিচায় উৎপাদনের খরচা বেশি, বিশেষত দার্জিলিং পাহাড়ের বাগিচায়। তাছাড়া, সায়েবি কোম্পানিরা শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ বেশি খরচ করে। 

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (পাঁচ)

শেষেরটা দেখে মনে পড়ে গেলো, উনিশ শতকের শেষে(১৮৮২ সালে ছাপা) স্যামুয়েল বেইলডন নামের এক সায়েব দি টি ইন্ডাস্ট্রি ইন ইন্ডিয়া নামে একটি বই লিখেছিলেন, সে বইয়ের বিশেষ সুখ্যাত হয়েছিল। হবার কথাও। বেইলডনের বক্তব্য ছিল, চা আদৌ চৈনিক বিষয় নয়, তা আসামের অর্থাৎ ভারতের, অর্থাৎ সায়েবশাসিত ভারতের। চিনারা যেমন তেমন করে চায়ের চাষ করে, আর ইউরোপীয় সায়েবরা বড় করে, গুছিয়ে বসে, ভালো করে চায়ের ব্যবসা করে। মোদ্দায়, চা ব্যাপারটা সায়েবকুলের নিজস্ব, স্ব-উপার্জিত, চিন চিন বলে চেল্লামেল্লি করার কোন মানে হয় না। বেইলডনের দ্বিতীয় বক্তব্য, ইদানিং প্ল্যান্টারদের যে নিষ্ঠুর অমানবিক জল্লাদ গোছের বলে দেখানো হচ্ছে, তা অতীব অন্যায়। অপদার্থ অকর্মণ্য বেয়াদব সব কুলিদের বাগানে পাঠানো হচ্ছে সরকারি তত্ত্বাবধানে, তাদের ঢিট করার জন্য বেচারা প্ল্যান্টার যদি খানিক এটা ওটা করে, সেটা কি তার দোষ? ভালো কুলিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে কোন প্ল্যান্টার? বেইলডন যদিও আসাম প্রসঙ্গে এসব বলছিলেন, তাঁর দুএকটি কথা সব শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই খাটে, তা তুলে ধরা যাক:

‘শ্রমিকরা হইতেছে সেই মহৎ যন্ত্র যদ্বারা চা-ভূমি মূল্যবান হইয়া ওঠে, এবং এই যন্ত্র মহার্ঘ্য... কোনো ব্যক্তি এতাদৃশ মূর্খ কি হইতে পারে যে এইরূপ যন্ত্র ক্রয় করিয়া তাহা স্বেচ্ছায় বিনষ্ট করিবে?...আপন কর্ম বিষয়ে সচেতন প্ল্যান্টার...প্রাত্যহিক কর্তব্য পালন করিয়া সন্ধ্যায় পদচারণ করিতে করিতে কুলি-লাইন অভিমুখে গমন করে...কুলিদিগের খবরাখবর লয়। উহাদের নিকট প্ল্যান্টার ঈশ্বরপ্রতিম...সে উহাদিগে চাউল আনিয়া দেয়, উহাদের জন্য দোকান খুলিয়া দেয়, বাটি কীরূপ হইবে তাহা পরিকল্পনা করে, উপরন্তু, বাগিচা ছাড়িয়া উহারা যেন না যায় সে উদ্দেশ্যে উহাদিগে গরু ক্রয়ের নিমিত্ত কর্জ দেয়, সেই গরুর দুধ স্বয়ং ক্রয় করে...উহারা অসুস্থ হইলে চিকিৎসা করে।’

চা-কর মালিক অপেক্ষা উত্তম মালিক ইহজগতে বিরল, সন্দেহ কি? বেইলডনের কথা থাক, প্ল্যান্টারগুণকীর্তন সেরে তিনি অতঃপর কুলিদের বিভিন্ন বজ্জাতির দীর্ঘ বিবরণ দেন। দার্জিলিং এবং অন্য জায়গার বাগিচামালিকরা এসব পাঠে নির্ঘাত সাতিশয় আনন্দ লাভ করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কুলি-ঠেঙানোর অভিযোগ সেভাবে ওঠেনি, সুতরাং বাইরের লোক কী বলছে তা নিয়ে তাঁরা বিশেষ মাথা ঘামাতেন বলে মনে হয় না। দার্জিলিং পাহাড়ের চাশ্রমিকরা আসতেন যেতেন, বিশেষ করে শীতকালে। বেইলডনের সমসাময়িক জনৈক প্ল্যান্টার লিখিত দার্জিলিংয়ের চা নিয়ে যে নাতিদীর্ঘ পুস্তিকার কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, সেখানে কুলি নিয়েও অনেককিছু বলা আছে। লেখকের বক্তব্য ছিলো, বাগানে পুরোনো কুলি স্থায়ীভাবে রেখে দেবার ব্যবস্থা করা হোক। দার্জিলিংয়ে কুলিদের বড় বেশি মজুরি দেওয়া হয়, কিছু কম টাকা দিলে তাদের দিয়ে বেশি কাজ পাওয়া যাবে। বই বেরুচ্ছে ১৮৮৮ সালে, দার্জিলিংয়ের আশপাশ থেকে সেনাভর্তি শুরু হয়ে গেছে। সুতরাং কম মজুরির প্রস্তাবটা খুব একটা কাজের ছিল কিনা সন্দেহ। লেখক জানাচ্ছেন, টাকায় ৮০ পাউন্ড ভুট্টা পাওয়া যায়, ফলে একটা বাচ্চা বাগিচায় কাজ করে যে রোজগার করে তাতে ৪-৫ জনের পরিবার দিব্যি চলে যেতে পারে, অবশ্য কাপড়চোপড় গয়নাগাটি কেনা যায় না। বেশিরভাগ বাগানে কুলির অভাব নেই:

‘স্বল্প কিছু বাগানে শ্রমিকচালান কম হইতে পারে, দার্জিলিংয়ের নিকট অবস্থানের কারণে বা ম্যানেজারকে অপছন্দ করিবার কারণে, কিম্বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাগান থাকিলে...কিছু বাগান একত্রিত হইলে মজুরি সর্বত্র কমাইয়া দেওয়া যাইতে পারে। অবশ্য কতিপয় বাগান হইতে কুলিরা অকারণে পলায়ন করে, ফলে শ্রমস্বল্পতা থাকিয়াই যায়।’

লেখক জানাচ্ছেন, বাগিচায় দোকানি-মহাজনের বাস থাকলে খুব মুশকিল, কুলিরা ধারে পোশাকআশাক কিনতে একগাদা খরচা করে ফেলে। সুদ দিতে হয় টাকায় এক আনা হারে মাসিক, অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ! অদ্ভুত কায়দায় সুদ বাড়তেই থাকে, ১০ টাকার ধারে ৫০ টাকা সুদ দেবার পরেও কুলি দেখে যে আরো ২০ টাকা বাকি থেকে গেছে। নেপালিদের কোর্টকাছারিতে ভয়, মহাজন যা ইচ্ছা তাই করে। কুলি কমার আর একটা কারণ জুয়া। নেপালি সর্দাররা এক রাতের জুয়ায় ৩০০ টাকা উড়িয়ে দিতে পারে, তার মাসমাইনে ২৫ টাকা, উপরন্তু হারের টাকা সে কুলিদের মজুরি থেকে দিব্যি তুলে নেয়। সর্দারদের সঙ্গে চুক্তি করেও লাভ নেই, তারা সবসময়েই বলে যখন লোক আসতে চায় তাদের কুলি আনতে দেওয়া হয় না। কি করা যায়? লেখক বলছেন:

‘কুলিদিগের নিকট বাগানকে পছন্দের স্থল করিয়া তুলিতে হইবে। এস্টেটের মধ্যে যদি চাষাবাদ থাকে, অথবা পতিত জমি, কুলিরা তাহা ব্যবহার করিতে পারে। নির্দিষ্ট দিনে বেতন ও অগ্রিম দাও, কদাচ উহাদিগের ছুটির দিনে কাজে লাগাইয়ো না। ...অন্যথা হইলে হয় অন্য বাগানের ঘণ্টা বাজিতেছে, নতুবা উহারা আপন কর্মে মন দিবে না।’

বোঝাই যায়, পাহাড়ের বাগানে শ্রমিকদের আটকে রেখে জবরদস্তি কাজ করানোর চল ছিল না, শ্রমিকরা ইচ্ছামতো আসত-যেত। কুলিরা কাজ না করলে সর্দাররা দফাদারদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিত। দফাদারদের কাজ ম্যানেজার দিত না, তারা সর্দারের লোক, সর্দারের হয়ে তারা কুলি যোগাড় করে আনত। 

এই লেখায় শ্রমিক বিক্ষোভ এবং অসন্তোষের প্রসঙ্গ এসেছে:

‘ধর্মঘটের কথা বিশেষ শুনা যায় না, কিছু ক্ষেত্রে কুলিদিগের গুরুতর অভিযোগ থাকে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুই একজন অলস অর্কমা জানোয়ার অপরাপর কুলিদিগে ক্ষেপাইয়া থাকে। ধর্মঘটের নেতাদিগকে যদি খুঁজিয়া পান, সত্ত্বর উহাদিগে গলাধাক্কা ও চাবুকের বাড়ি দিয়া বিতাড়িত করিবেন, সঙ্গে কতজন কুলি লইয়া যাইতেছে তাহা লইয়া ভাবিত হইবেন না। যে কুলি খারাপ কাজ করে, তাহাকে জরিমানাপূর্বক কঠিন শাস্তি দিবেন, কিন্তু যথাইচ্ছা নহে..।’

Powered by Froala Editor