সময়ভ্রমণ -৫৩
আগের পর্বে
চা বাগানে কুলিদের উপর অত্যাচার নিয়ে নানা ইত্তিহাস ও কাহিনি লোকমুখে প্রচলিত। তবে সেইসব কাহিনি প্রায় সবই অসমকে ঘিরে। দার্জিলিং-এর কুলিদের অবস্থা সম্বন্ধে জানতে গেলে নির্ভরযোগ্য একমাত্র বেসকির লেখাই। অবশ্য এর আগেও কুলিদের জীবন নিয়ে এবং তাঁদের দুর্দশার কথা লিখেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক সত্যেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার। নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে জেলে থাকার সময় লিখেছিলেন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার ঘুম ভাঙছে’। তাতে ব্রিটিশ সময় থেকে কতভাবে শ্রম আইন বদলেছে, তারও বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। অবশ্য এই সমস্ত আইনের ফলে শ্রমিকদের অবস্থা ক্রমশ আরও খারাপ হয়ে উঠেছিল। এছাড়া পাহাড়ে টিবি ও অন্যান্য শ্বাসজনিত রোগ তো ছিলই।
আসামের বিভিন্ন জেলা ঘুরে গ্ৰুনিং যে নাতিদীর্ঘ রিপোর্ট দেন, তাতে বলা ছিল—
“(কুলি)নিয়োগ সম্পর্কে বর্তমান পদ্ধতি নিম্নরূপ: ঠিকাদার বিস্তর বিধি-বহির্ভুত লোকদের কুলিযোগাড় কাজে লাগাইয়া থাকে... তাহারা(ছোটনাগপুরের, মধ্যপ্রদেশের, উড়িষ্যা ও বাংলা প্রেসিডেন্সির প্রায় সর্বত্র) গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া স্থানান্তরে যাইতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের যোগাড় করে। স্থানান্তরে যাইতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে পঞ্জিকারের নিকট লইয়া যাওয়া হয়, যিনি ওই ব্যক্তি প্রকৃতই ইচ্ছুক কিনা তাহা দেখিয়া লন... অতঃপর উহাকে ঠিকাদারের ডিপোয় লইয়া যাওয়া হয়। তিন দিন ডিপোতে বাস করিতে হয়, যাহাতে সে 'বন্ধুপরিজনদিগের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া মন পরিবর্তন করিবার সুযোগ পায়'। ...আইনের এই অংশটি বস্তুত অকার্যকরি... তিন দিন অতিক্রান্ত হইলে, উপযুক্ত মূল্য পাইলে ঠিকাদার কুলি লইয়া নিকটস্থ সরকারি অফিসারের নিকট যায়, যিনি চুক্তিপত্র তৈয়ার করেন, কুলিকে আসাম প্রেরণ করা হয়। কোন বাগানে সে যাইতেছে সে বিষয়ে মত প্রকাশের সুযোগ সে পায় না, উপরন্তু উহার জন্য যে উত্তম মূল্য পাওয়া গিয়াছে তাহার কিয়দাংশও কুলির নিকট পৌঁছে না... এই ব্যবসায়ে এত লাভ যে কী পদ্ধতিতে কুলি জোগাড় হইল তাহা লইয়া ঠিকাদার ও তাহার কর্মচারীরা চিন্তিত নহে। কুলিপিছু ৮০ হইতে ১৫০ টাকা দাম পাওয়া যায়... পূর্বের তুলনায় অনাচার অবিচার কম হইয়াছে, কিন্তু বন্ধ হয় নাই। যতদিন না ঠিকাদার-নিয়োজিত পেশাদার, যাহাদের 'আড়কাঠি' বলা হয়, তাহাদের মাধ্যমে কুলি যোগাড়ের বর্তমান পদ্ধতি বন্ধ না হইবে, অবিচারও বন্ধ হইবে না। আমার সিদ্ধান্ত এই যে বর্তমান ব্যবস্থার তুলনায়...সরদারি ব্যবস্থা অধিক কার্যকরী।…
ঠিকাদারি ব্যবস্থার সহিত সরদারি ব্যবস্থার তফাৎ এই যে ঠিকাদারেরা এক দল পেশাদার লোকের সাহায্যে একদল স্থানান্তরণ-ইচ্ছুক ব্যক্তি জোগাড় করে, যে মালিক সর্বোচ্চ মূল্য দিবে, তাহার নিকট উহাদের বেচিয়া দেয়। বিপরীতে, সরদারেরা, যাহারা সাধারণ কুলিমাত্র, আপন আপন বাগানের জন্য লোক লইয়া আসে।...একজন সরদার আপন জ্ঞাতি ও বন্ধুদের কুলিরূপে লইয়া আসে, ফলে কুলিরা কোথায় যাইতেছে তাহা জানিতে পারে…”
গ্ৰুনিং শেষ পর্যন্ত চুক্তিনিয়োগ বন্ধ করার সুপারিশ করেন। বাজারের নিয়মমাফিক শ্রমিক যেখানে ইচ্ছা নিজের শ্রম বেচবে, যে দেশে ইচ্ছে যাবে, এমন 'মুক্ত শ্রম' ও 'মুক্ত স্থানান্তরণ' ঘটা দরকার, গ্ৰুনিং-এর শেষ কথা।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (সাত)
কালক্রমে চুক্তিনিয়োগ বন্ধ হয়, ঠিকাদার-আড়কাঠি ব্যবস্থার বিলোপ হয় না। সায়েবরা গেলেও না। শুধু এখন যেটা চলছে সেটা উল্টো স্থানান্তরণ বা রিভার্স মাইগ্রেশন। যে শ্রমিকদের ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত ও নেপাল থেকে উত্তরবঙ্গ ও আসামের চা বাগিচায় নিয়ে আসা হয়েছিল, তাঁদের বংশধরেরা কাজ খুঁজতে বাইরে যাচ্ছেন, বহুক্ষেত্রে কোথায় যাচ্ছেন তা না জেনেই। আড়কাঠি-ঠিকাদার ব্যবস্থা ও সরদারি ব্যবস্থা দুইই ভিন্ননামে বর্তমান আছে, বাগানে বাগানে লোক ঘুরছে শ্রমপাচারের উদ্দেশ্যে। এ সবের হিসেব বা বিবরণ রাখার দায় স্বাধীন রাষ্ট্র মানে না।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (ছয়)
দার্জিলিংয়ের বাগিচায় অবশ্য বরাবর সরদারি প্রথারই চল ছিল। সরদারেরা নেপালে নিজের নিজের গ্রাম থেকে লোক নিয়ে আসত, নিজের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোকই। মুশকিল হচ্ছে, বাগিচার ভিতরে প্ল্যান্টার সর্বেসর্বা, তার কাছে কে সরদারের আনা আর কে ঠিকাদারের, তাতে কী যায় আসে। ঠিকাদারকে পয়সা দিতে হত বেশি, ফলে মালিকের সে-টাকা উসুলের দায় থাকত বেশি, অত্যাচার সেকারণে বেশি হত, হতে পারে। পাহাড়ের চা-বাগিচায় মালিকপক্ষের অত্যাচারের কথা বলেছেন সত্যেন্দ্রনারায়ণ। কোনো কারণেই কাজ বন্ধ রাখতে পারতেন না শ্রমিকরা, কাজ না করলে সায়েবরা তাঁদের সপরিবার বাইরে বের করে দিত। বাইরে মানে তো আর বাগিচার বাইরে নয়, নিজের ঘরেরও বাইরে। অধিকাংশ বাগিচাশ্রমিকের জীবন ও পৃথিবী বাগিচার চৌহদ্দিতে আটকা, কার্যত তাঁরা পুরোপুরি নিরাশ্রয়, ছিন্নমূল ও নিরালম্ব হয়ে পড়তেন। কাজ না করলে পরিবারসমেত তাড়িয়ে দেবার এই পদ্ধতিকে বলা হত হটাবাহার বা হপ্তাবাহার। সত্যেন্দ্রনারায়ণ, রতনলাল ও অন্যান্যরা পাহাড়ে যে আন্দোলন গড়ে তুললেন, তার অন্যতম প্রধান দাবি ছিল হটাবাহার বা হপ্তাবাহার প্রথার বিলুপ্তি।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (পাঁচ)
১৯৫৫ সাল, সত্যেন্দ্রনারায়ণ তখন কমিউনিস্ট দলের হয়ে রাজ্যসভার সদস্য, কার্সিয়াঙের মার্গারেটস হোপ চাবাগিচার আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর গুলি চলল। এর আগে কমিউনিস্ট দল ও অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগ দলের সঙ্গে যুক্ত দুই ইউনিয়ন হটাবাহার বিলোপ সহ অন্যান্য দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। ২২শে জুন থেকে ধর্মঘট শুরু হবার কথা, ২০ তারিখ আনন্দ পাঠক ও মনোরঞ্জন রায় সমেত অন্য কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তার করা হল, বাকিরা ফেরার হলেন। ২৫শে জুন আশপাশের বাগান থেকে দলে দলে শ্রমিক মার্গারেটস হোপ বাগিচার দিকে রওনা দিলেন, খবর ছিলো দিলারামের কাছে শ্রমিকদের জোর করে কাজ করানো হচ্ছে। আগে থেকেই পুলিশ মোতায়েন ছিল, শ্রমিকদের মিছিল আটকে দেওয়া হল। এরপর, সম্ভবত মার্গারেটস হোপ বাগানের জনৈক ম্যানেজার অকল্যান্ডের প্ররোচনায় পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করে। বহু শ্রমিক জখম হন, ছ জন মারা যান, তাঁদের ভিতরে মৌলিশোভা রাই নামের এক গর্ভবতী তরুণীও ছিলেন। এই গুলিকাণ্ডের পর হটাবাহার প্রথার আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে, ধরে নেওয়া যায়। শ্রমিকদের মজুরিও কিছু বাড়ে, গ্রেফতার হওয়া নেতাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতি-নির্মাণ (চার)
এদিকে কার্সিয়াং, ওদিকে মিরিক। দুই পাহাড়ের মধ্যে তিন-চার হাজার ফুট গভীর গিরিখাত তৈরি করে বয়ে যাচ্ছে বালাসন। মিরিক থেকে বাংকুলুং হয়ে আর কার্সিয়াঙ থেকে অগুনতি ঢালু রাস্তায় নদীতে পৌঁছনো যায়। নদীর দুদিকের ঢালে অসংখ্য ছোটো-বড়ো বাগিচা। মিরিকের দিক থেকে এলে নাগরি, ধজে। কার্সিয়াং থেকে এলে সিঙ্গেল, নামসু, আমবুটিয়া, মার্গারেটস হোপ, বালাসন। কার্সিয়াং থেকে দার্জিলিং যাবার বড়রাস্তার বাঁদিকে, ফিকে আর ঘন সবুজে যেখানে মেঘের সাদা ছোপ লেগে থাকে, পথের পাশের ঘরবাড়ির ফাঁক দিয়ে নিচের নদী উপত্যকা দেখা দেয়। খুব বৃষ্টি হয়ে কুয়াশামেঘ মাটিতে ঝরে পড়লে, বাতাসের ধুলোনোংরা পরিষ্কার হয়ে গেলে, কিম্বা শরৎশেষ এবং হেমন্তশুরুর রোদ্দুরের দিনে স্পষ্ট বোঝা যায়, পাহাড়ের ঢাল নদীকে ছুঁয়ে আছে। দীর্ঘ আন্দামানজীবন শেষে সত্যেন্দ্রনারায়ণ ও তাঁর সহযোগীরা এইসব ঢালে, বালাসনের দুধারের বাগিচায় শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেছেন, যাঁদের অনেকের কথা সত্যেন্দ্রনারায়ণের বইদুটোয় আছে। সম্ভবত সে কারণেই খুঁজলে সে সব নাম আর গল্প এখনো পাওয়া যায়। খুঁজতে হয় কেননা এমনিতে সব উধাও হয়ে গেছে।
পাহাড়ের বাগিচা শ্রমিকদের মধ্যে কমিউনিস্ট দলের যে ট্রেড ইউনিয়নগুলো ছিল, সেগুলোকে হিসেব কষে নষ্ট করা হয়েছে গোর্খাল্যান্ড ১ আন্দোলনের সময়। ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত সংগঠকদের ভয় দেখানো হয়েছে, ঘরবাড়ি ভাঙা হয়েছে, অসংখ্য মানুষের গলা কেটে খাদে ফেলে দেওয়া হয়েছে, লাশ উদ্ধার হয়নি। হিংসা খুনজখমের এসব ভয় পাওয়ানো গল্প পাহাড়ি বন্ধুদের মুখে অসংখ্যবার শুনেছি। বেসকির বইটায় সেই একই সংবাদ উঠে এসেছে। বেসকি সেসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও দিয়েছেন। গোর্খাল্যান্ড ১ আন্দোলনের পিছনে পাহাড়ের প্ল্যান্টারদের পর্যাপ্ত অর্থসাহায্য ছিল, প্ল্যান্টাররা পাহাড়ের বাগিচা থেকে 'লাল ঝামেলা' চিরদিনের মতো হটাতে চাইছিলেন। চূড়ান্ত দারিদ্র্য, বহুদিন ধরে তৈরি হওয়া পুঞ্জীভূত সায়েবশাসনের ভয়, স্বাধীন দেশের পুলিশি অত্যাচার, গুলি, শ্রমিকমৃত্যু, এসব মিলে যা করতে পারেনি, গোর্খা আন্দোলন তা করে ফেলল অনায়াসে।
গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন ২ চলাকালীন পাহাড়ে ঘোরাঘুরির সময় বারবার নজরে পড়েছে, আন্দোলনের নেতারা বাগিচামালিকদের বিরোধিতা করতে চাইছেন না। পাহাড় জুড়ে লম্বা বন্ধ চলছে, গাড়িঘোড়া দোকানপাট সব বন্ধ, বাগিচার কাজ বন্ধ হচ্ছে না সচরাচর, হলেও অল্পদিনের জন্য। বাগিচাশ্রমিকদের মজুরিবৃদ্ধি নিয়ে ডুয়ার্স তরাইয়ে কথা উঠছে, ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন শুরু হচ্ছে, পাহাড়ের বাগিচায় তার প্রভাব না থাকার মতোই। শুধু ২০১৭য় গোর্খাল্যান্ড ২-র দ্বিতীয় পর্ব শেষ হব-হব, দার্জিলিং চকবাজারের চাপা ঘিঞ্জি জমিতে চা-শ্রমিকরা বোনাসের দাবিতে একসঙ্গে মিলে সভা করছেন, দেখেছিলাম।
ওই একবারই। আন্দোলনের নেতারা কেউ দল বদলালেন, কেউ পালিয়ে থেকে আবার ফিরে এলেন, কেউ নতুন দল তৈরিতে মন দিলেন। বাগিচাশ্রমিকদের প্রতিদিনের জীবনে এসবের ছাপ পড়ল না তেমন। মিছিল সভা এসবের জন্য সব নেতা, সব দল ছোটো-বড়ো গাড়িতে চাশ্রমিকদের চাপিয়ে নিয়ে গেলেন কোথায় কোথায়, সে সব মিছিল থেকে শ্রমিকদের মজুরিবৃদ্ধি, পিএলএ অনুযায়ী অন্যান্য প্রাপ্য সুবিধা কিম্বা ফাটকাবাজ লোভী মালিকদের অবহেলায় জীর্ণ, ধুঁকতে থাকা বাগিচার হাল ফেরানোর দাবি উঠলই না।
গোর্খাল্যান্ড ১ আন্দোলনের পর, পাহাড়ে স্বশাসিত দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল বা ডিজিএচসি, ২-এর পর আরো ক্ষমতাশালী গোর্খা টেরিটোরিয়াল য়্যাডমিনিষ্ট্রেশন, বা জিটিএ। স্বশাসন কিন্তু বাগিচাশ্রমিকদের জন্য নয়। ডিজিএচসি বা জিটিএ বাগিচার কাজকর্মে মাথা গলাতে পারে, এমন আইনি ব্যবস্থা ছিল না। বাগিচায় পুরোনো প্ল্যান্টাররাজত্ব চলছে তো চলছেই, রাস্তা, ইস্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এসব বানাতে গেলেও মালিকদের সম্মতি লাগে। এখনো, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও। কমবেশি একই হাল টঙিয়া গ্রামগুলোর, সিঙ্কনা বাগিচার। যাঁরা ওখানে বাস করেন তাঁরা জমির মালিক নন। মালিক হয় সরকার(টঙিয়া, সিঙ্কনা) নাহয় সরকারের কাছ থেকে জমি ইজারা নেওয়া বাগিচামালিক, যেমন চা-বাগিচায়।
নানা জায়গা থেকে এসে দার্জিলিং তৈরি করলেন শ্রমিকরা। দার্জিলিংয়ের প্ল্যান্টার এবং নানা ধরনের ব্যাপারিরা অনেক বছর ধরে অনেক লাভ করল, শ্রমিকরা না থাকলে, সস্তায় শ্রম না দিলে, যা সম্ভব হত না। সবাই জানে, বাগিচাশ্রমিকদের সমর্থন না থাকলে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনও হত না। অথচ, দার্জিলিংয়ের ভূগোলইতিহাসরাজনীতি থেকে শ্রমিকরা অদৃশ্য হয়ে গেছেন, কিংবা থেকেও নেই, চেষ্টারটনের সেই গল্পের মতো, খুনি খুব চেনা পোস্টম্যান বলে তাকে হিসেবের মধ্যেই আনেনি পুলিশ। কার্সিয়াং ছাড়িয়ে টুং, দিলারাম, সোনাদা। বাঁদিকের পাহাড় আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে নেমে যাচ্ছে নিচে। সেই পাহাড়ের অনেকটা জুড়ে ছবি হয়ে থাকা মার্গারেটস হোপ বাগান। বাগানের মালিক বিখ্যাত বিদেশি কোম্পানি, যার বড়কর্তা এখনো ইংল্যান্ডনিবাসী সায়েব। দিলারাম আসার কিছু আগে, কাঠ কাঁচ পাথর দিয়ে পথের ধারে সুরম্য একটি বাড়ি বানিয়েছেন কোম্পানিকর্তারা। সে বাড়িতে মহার্ঘ্য চা ও অন্যান্য খাবারদাবার পাওয়া যায়। লম্বা কাঠের মেঝে উপত্যকায় ঝুঁকে আছে, ফুলগাছে ছাওয়া রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালে দেখা যায় সবুজ চা গাছের ভিতর দিয়ে সরু মোটা ছেঁড়া আস্ত মেঘ উঠে আসছে, ভিতরে ঢুকলে চায়ের সুঘ্রাণ। তাকিয়ে দেখার মতো, অনেকক্ষণ বসে থাকবার মতো জায়গা। ঢোকার মুখে, কোম্পানির টাঙানো পোস্টার, বোর্ড, সেখানে সুন্দর করে লেখা, প্রথম প্ল্যান্টার সাহেবের মেয়ে মার্গারেটের কথা, দেশ থেকে ভারতে ফিরবার পথে জাহাজে তাঁর মৃত্যু হয়। শোকার্ত পিতা মেয়ের নামে ‘বড়া রিঙটঙ’ বাগানের নাম রাখেন, মার্গারেটের আশা, হোপ। যে ট্যুরিস্টরা আসেন তাঁরা পড়েন, ছবি তোলেন, চা খান, চলে যান। এই আনন্দময় সুন্দরের কোথাও ৫৫-য় গুলি খেয়ে মরা মৌলিশোভা এবং তাঁর খুন হওয়া সঙ্গীরা চোখের আড়াল হয়ে লুকিয়ে থাকেন। অথবা, থাকেন না। এই সব মরে যাওয়া শ্রমিকদের গল্প কেউ করতেও চায় না, না সরকার, না কোম্পানি, না পর্যটনব্যবসায়ী, না গোর্খাল্যান্ডওয়ালা নেতা। হাওয়ার আর বৃষ্টির আওয়াজের সঙ্গে কি গুলির আওয়াজ, শ্রমিকদের স্লোগান মিশে থাকে কোনোভাবে? কে জানে?
Powered by Froala Editor