চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (ছয়)

সময়ভ্রমণ - ৫১
আগের পর্বে

দার্জিলিং ঘিরে চায়ের বাগিচা গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশ কোম্পানি, তা নিছকই বাণিজ্যিক স্বার্থে। আর সেইসঙ্গে ছিল সস্তা শ্রমিক সংগ্রহের বিষয়টিও। ক্রমশ সেই শ্রম-সম্পর্ককেই বানিয়ে তোলা হয়েছে দার্জিলিং-এর ঐতিহ্য। এমনকি ভারত রাষ্ট্রও সেই বাণিজ্যিক ইতিহাসকে নিসর্গ নির্মাণের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছে। এই বিষয়গুলি নিয়ে গবেষণা করেছেন আমেরিকার সারা বেসকি। দীর্ঘদিন চা-বাগিচার শ্রমিকদের সঙ্গে কাটিয়েছেন তিনি। বহু তথ্যও সংগ্রহ করেছেন। সেই সময় থেকেই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার আন্দোলন নানাভাবে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। এই আন্দোলনের মধ্যেও দার্জিলিং-এর শ্রমসম্পর্ককে ঐতিহ্য বানিয়ে তোলার চেষ্টা রয়েছে বলেই দেখিয়েছেন বেসকি।

দার্জিলিংয়ের চা শ্রমিকদের মধ্যে ইউনিয়ন, বা সংগঠন বানানোর কাজ ঠিক কবে, কিভাবে শুরু হয়েছিল, এখন বুঝবার কোন উপায় নেই। সম্ভবত চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে সেসময়কার নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি দার্জিলিং অঞ্চলে সংগঠন তৈরির কাজ শুরু করে। প্রামাণ্য নথিপত্র বা অন্য লেখাজোখার সন্ধানও পাওয়া যাচ্ছে না, হালের যেসব গবেষণাকাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানেও এ প্রসঙ্গ অনুপস্থিত। বেসকির লেখায় বিষয়টা নিতান্তই আলগোছে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে, যথাযথ তথ্যসমাবেশ ঘটেনি। কমিউনিস্ট পার্টিকে তিনি বলছেন সিপিআই(এম), পাহাড়ে সে পার্টির আদি নেতাদের নামধামও যোগাড় করে উঠতে পারেননি। এমনকি অবিসংবাদিত ও প্রসিদ্ধ রতনলাল ব্রাহ্মণ, যিনি ১৯৪৬-এ অবিভক্ত বঙ্গের বিধানসভায় অন্যতম কমিউনিস্ট সদস্য, তাঁর নামটাও বেসকির বৃত্তান্তে ঠিকনামে আসেনি। রতনলাল পাহাড়ে সমধিক পরিচিত ছিলেন 'মায়লা বাজে'(মেজ দাদু) নামে, বেসকিও সেই নাম ব্যবহার করেছেন। 

অপ্রতুল তথ্য, সেইসঙ্গে অন্যান্য কারণ, সব মিলিয়ে দার্জিলিংয়ে চা-শ্রমিক আন্দোলনের শুরুর স্মৃতি ক্রমশ ঝাপসা। অন্যান্য কারণ বলতে প্রধানত সামুহিক স্মৃতির অভাব--সেই আন্দোলনশুরুর মধ্যে যে কমিউনিস্ট সংগঠকেরা ছিলেন তাঁদের কেউই প্রায় জীবিত নেই। তাঁদের কাজের উত্তরাধিকার বলতেও কিছু নেই। পুরোনো আন্দোলন, পুরোনো সংগঠন, পুরোনো কাজ সব নিশ্চিহ্ন, ফলে স্মৃতি বেঁচে থাকবে কোন ডাঙায়, কোন গাছে লতিয়ে উঠবে? 

কিছুকাল দার্জিলিং বসবাসের সুবাদে আমার বাবা পাহাড়ের কমিউনিস্ট নেতাদের ভালো করে চিনতেন, রতনলাল ও পরবর্তী নেতাদের--যেমন আনন্দ পাঠক--সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। বাবার কাছ থেকে শোনা গপ্পোগাছায়, গল্পের বাইরের প্রতিদিনের জীবনেও, একরকম জন্মের পর থেকেই দেখে এসেছি পাহাড়ে কমিউনিস্টরা মজুদ, বিশেষত চা এলাকায়। কমিউনিস্ট দল ভাঙতে থাকল, পাহাড়ে গোর্খাপন্থী দলের আধিপত্য বাড়ল, কংগ্রেস দলের নতুন শ্রমিক সংগঠন তৈরি হল বাগিচা অঞ্চলে, অথচ কমিউনিস্টদের চা সংগঠন নষ্ট হল না। 

৪৭-এ দেশ স্বাধীন হল, কমিউনিস্ট দল বলল স্বাধীনতা মিথ্যা, মানি না। দল আবার নিষিদ্ধ, সংগঠকরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, বাগিচায় বাগিচায় সায়েবরাজ তখনো চলছে, কুলি-খ্যাপানো ইউনিয়নওয়ালাদের শায়েস্তা করতে দিশি পুলিশ লাগানো হচ্ছে। চল্লিশের দশক শেষ হয়ে পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর এল। স্বাধীন দেশের সরকারের ইচ্ছায় চা-কর রাজত্ব মানে প্ল্যান্টাররাজ খতম করে সরকারিরাজ তৈরি করার একটা চেষ্টা হল নতুন বাগিচা শ্রমিক আইন(প্ল্যান্টেশন লেবার য়্যাক্ট) তৈরির মাধ্যমে, ১৯৫১-য়। আশু ফল তাতে কিছু হল না বটে, তবে ধীরে ধীরে, শ্রমিকদের অনেকদিনের চেষ্টায়, অনেক লড়াই ঝগড়া রক্তপাতের পর অবস্থা কিছুটা হলেও বদলাল। সায়েবরা দার্জিলিং ছেড়ে দেশে ফিরলেন কিম্বা অন্যত্র গেলেন। শ্রমিকদের কী শর্তে কি মাইনেয় খাটানো যাবে তা নিয়ে সরকার এবং ইউনিয়নগুলো কথা বলতে, মাথা গলাতে শুরু করল। ফলে, যে শ্রম একসময় সস্তা, খুব সস্তা ছিল, তা ততটা সস্তা থাকল না। দিনহাজিরার ওপরে শ্রমিকদের জন্য নানারকম 'সুবিধা' বা 'ফেসিলিটি' দিতে বাধ্য হচ্ছিলেন বাগিচামালিকরা--নিয়মিত ছুটি, প্রতিদিনের খাবার বা ব্যবহারের জল, খাদ্যশস্যের রেশন, জ্বালানি, শ্রমিক পরিবারের শিশুদের জন্য ইস্কুল, চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, পোকামারার ওষুধ যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁদের জন্য বিশেষ পোশাক। 

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতি-নির্মাণ (চার)

এসব একদিনে ঘটেনি। আই টি এ ও অন্যান্য চা-কর সংগঠনগুলোর পুরোনো বার্ষিক রিপোর্ট খুঁজে দেখা যাচ্ছে, কুলিদের কি হাজিরা দেওয়া হবে, বোনাস দেওয়া হবে কি না, এবং কি শর্তে কাজ করানো হবে তা নিয়ে মালিকে মালিকে বিবাদ চলছে। কুলি তো চাইলেই পাওয়া যায়, তবে বিবাদ কেন? 

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (তিন)

বিবাদের কারণ শ্রমিক আন্দোলন নয়, প্রতিযোগিতা এবং শ্রমিক স্বল্পতা। তরাই-ডুয়ার্সের সমতলে ভারতীয় মালিকরা নতুন বাগিচা বসাচ্ছিলেন। সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য পাহাড়ে সরকারি দপ্তর বসে গিয়েছিল। ফলে, নেপাল থেকে নিয়ে আসা সস্তার শ্রমিকরা যে পাহাড়ের বাগিচাতেই ভিড় করবেন, সে নিশ্চয়তা থাকছিল না। বাগিচামালিকদের কাছে যা ছিল অফুরন্ত শ্রমভাণ্ডার, সেখানে মিলিটারি সায়েব, অন্য বাগিচামালিকরা, এমনকি কুলিচালানের ঠিকাদাররা থাবা বসাতে থাকলেন। মিডলটনের কাজ থেকে জানা যাচ্ছে, পাহাড়ের প্ল্যান্টাররা এসবে তীব্র আপত্তি জানাতে থাকেন। ১৮৯০ সালের জনৈক চা-করের সরকারকে পাঠানো নথি উদ্ধৃত করেছেন মিডলটন:

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতি-নির্মাণ (দুই)

‘দার্জিলিং জেলার পক্ষে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হইতেছে স্থানীয় শ্রমিককুলকে আমাদিগের উদ্যানগুলির নিমিত্ত নির্দিষ্ট রাখা..সমতল হইতে শ্রমিক লইয়া আসা এক্ষেত্রে নিরর্থক, উহারা এই স্থলে বাস করে না। আমরা পুরাপুরিই এই পাহাড়ের অধিবাসী শ্রমিকদিগের ওপর নির্ভরশীল। কিছুদিন যাবৎ বর্তমান ব্যাবস্থাটি বিপর্যস্ত হইবার উপক্রম ঘটিয়াছে, কাছাড় হইতে এতদাঞ্চলীয় শ্রমিক নিযুক্ত করা হইতেছে। এতাদৃশ ব্যবহার চলিতে থাকিলে, পার্বত্য চা শিল্প ক্রমে এক অতীত বিষয় হইয়া উঠিবে।’

আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ

সামরিক এবং অন্যান্য কাজে দার্জিলিং থেকে শ্রমচালান অব্যাহত থাকে। ১৮৯০-তেই দার্জিলিংয়ের ডেপুটি কমিশনার ওই বছরের দু মাসের মধ্যে এক বার্মায় কাজের জন্যই ১০০০ শ্রমিক পাঠানো হয়েছে, তিনি সাধ্যমতো বাগান থেকে বাইরে শ্রমিক চালান বন্ধ করতে চাইছেন। মিডলটন দেখাচ্ছেন, পুরো আঠেরোশো নব্বুইয়ের দশক ধরে বাগিচামালিকেরা সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে থাকেন, পুলিশ মিলিটারি এবং উত্তর পূর্বের বাগানে 'তাঁদের' কুলি চালান দেওয়াটা যদি বন্ধ করা যায়। মালিকদের প্রধান দাবি ছিল, দার্জিলিংকে প্রশাসনিক ভাবেই আলাদা করে দেখতে হবে, বিশেষ অঞ্চল হিসেবে। অস্যার্থ, বাগিচা অঞ্চলে সরকার বা অন্য কেউ নাক গলাতে পারবে না। বাগিচাশ্রমিকরা যেহেতু বাগিচার অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা নিয়ে নাড়াঘাঁটা আসলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্র অধিকারে অন্যায্য হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে। যুক্তিটা এইরকম ছিল: ব্যক্তিমালিকের 'বাগানে' যে শ্রমিক জনতা বাস করে, তাদের জন্য পয়সা খরচ করেছে ব্যক্তিমালিক, ফলে তারা তার 'নিজস্ব' সম্পত্তি, সে সম্পত্তিতে বাইরের আড়কাঠি ঠিকাদার ইত্যাদিরা এসে নজর দেবে, সেটি চলবে না। কারুর 'নিজস্ব' সম্পত্তি তো আর খোলা বাজার নয়, যার যেমন ইচ্ছা ঢুকল, দরদাম করে মাল নিল। 

সরকার চা-করদের যুক্তি খানিকদূর মেনে নিচ্ছিলও। তৎকালীন এক নথিতে বলা হয়েছে, শ্রমনিয়োগ নিয়ে যথেচ্ছ 'বেলেল্লাপনা'র দায় দার্জিলিংকে বইতে হচ্ছে। এমনকি স্বয়ং ক্যাপ্টেন ইডেন ভ্যান্সিটার্ট, গোর্খা রেজিমেন্টকে ঠিকমতো গড়ে তোলার সুবাদে এক অর্থে যাঁকে আধুনিক গোর্খা পরিচয়ের জনকও বলা যেতে পারে, তাঁর বক্তব্য ছিল:

‘যে উত্তম মনুষ্য কুলিরূপে চা উদ্যানে কর্ম করিয়াছে, তাহাকে দিয়া সেনাকর্ম যথোচিত সমাধা হইবে না...নেপালস্থ গ্রামনিবাসী কোন যুবা যা করিতে সক্ষম...অতএব, আমার স্পষ্ট মত, যদ্যপি রাষ্ট্ৰস্বার্থে চা-কর সমুদায়ের ব্যক্তিস্বার্থ ক্ষুণ্ন হইতে পারে এমত কর্ম আমার নিকট রুচিকর নহে, কুলিদিগকে (সেনাবাহিনীতে) নিযুক্ত করিবার ক্ষেত্রে আমি বিরুদ্ধমত পোষণ করিয়া থাকি...ইহার প্রতিকারার্থে যাহা করণীয় ও আবশ্যক, যথাসাধ্য তাহা করিতে আমি বচনবদ্ধ থাকিব...’

হায়, বিষয়টা খুব সরল ছিল না। শ্রমবাজারের মেছোহাটায় দার্জিলিংয়ে ইতিমধ্যেই চলে আসা নেপালের লোক তো বটেই, পাহাড়ের লেপচা ভুটিয়ারদেরও খোদ নেপালের লোক হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেত অনায়াসে। চা-বাগিচা থেকে ইচ্ছামতো কুলি ফুঁসলে নিয়ে যেতে পারত আড়কাঠি ঠিকাদারদের দল। কে কুলি কে নয় বোঝা যাবে কী করে? কে ভিতরের(দার্জিলিংয়ের) কে বাইরের(নেপালের) তা-ই বা জানা যাবে কোন পদ্ধতিতে? 

সরকারি নিয়োগকর্তারা এবং চা-কররা একসঙ্গে মিলে ঠিক করলেন, সেনাকর্মের জন্য সদ্যনিযুক্ত সবাইকেই দু হপ্তা ধরে দার্জিলিং ডিপোতে আটক থাকতে হবে। প্ল্যান্টার এবং কুলিসর্দারদের সামনে প্রত্যেক দিন তাদের হাঁটানো হবে, যাতে বাগিচামালিকরা বুঝতে পারে তাদের কুলিরা গোর্খা সেনা হয়ে কেটে পড়ছে না। পরপর দু-তিন দিন এই পরীক্ষায় পাস করত যারা, তাদেরই অন্যত্র যাবার ছাড়পত্র দেওয়া হত। 

এসব সত্ত্বেও লাভ বিশেষ হল না। বাগিচাশ্রমিকের জীবনের চাইতে বহু পাহাড়ির পছন্দ ছিল সেনাদলে নাম লেখানো, সেখানে মজুরি, সুবিধা অনেক বেশি, সামাজিক মর্যাদা তো বটেই। প্ল্যান্টারেরা চিৎকার করতে থাকলেন, দার্জিলিং থেকে কুলিচালানও চলতে থাকল, গোর্খা রেজিমেন্ট, বাইরের চা-বাগান সহ অন্য অসংখ্য জায়গায়।

Powered by Froala Editor