সময়ভ্রমণ - ৪৯
আগের পর্বে
লয়েডের মাথার উপর সবসময় কৌন্সিলকর্তাদের নজরদারি ছিল। কিন্তু ক্যাম্পবেলকে দেওয়া হয়েছিল অভূতপূর্ব ক্ষমতা। নানা প্রতিবেশি দেশ, বিশেষত নেপাল থেকে শ্রমিক জোগাড় করে আনতেন তিনি। শ্রমজোগাড়ু হিসাবে তাঁর বেশ নামডাক হয়েছিল। এরপর পাহাড় সহ তরাই-মোরাং অঞ্চলের যাবতীয় অঞ্চলকে ভেস্টেড জমি দেখিয়ে জলের দরে বিক্রি করে দিলেন ক্যাম্পবেল। এর আগে এইসব জমিতে ঝুম চাষ করতেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু সেইসব কিছুই ব্রিটিশ সরকার হিসাবের মধ্যে আনলেন না। দার্জিলিং অঞ্চলে পরবর্তী শাসকরাও যথেচ্ছাচার করতে পেরেছেন, কারণ এখানে বাংলা সরকারের আইন খাটত না। ক্রমে সাহেবদের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া জমিকেও আশেপাশের বাসিন্দারা নানারকম কাজে লাগাতে শুরু করেন।
এখন দার্জিলিং পাহাড়ে উঠলেই দেখা যায় রাস্তার পাশে, একটু ওপরেও পাহাড়ি ঢাল ফাটিয়ে কেটে সমান করা হচ্ছে। হচ্ছে তো হচ্ছেই। শরতের শেষে আর হেমন্ত-শীতের প্রথমে পাহাড় যখন রোদ্দুরে ধুয়ে যায়, আকাশের নীল আর কাঞ্চনজঙ্ঘার সাদা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, তখন। জুন-জুলাই-আগস্টের বৃষ্টির ভারে যখন গাছপালা বাড়িঘর নুয়ে পড়ছে এবং পুরু, ভয় পাওয়ানো কুয়াশা ঢুকে আসছে নাকেচোখেমুখে, তখন। ফেব্রুয়ারি মার্চের ধূলোমাখা মরা আলোয় ওপর পাহাড় নিচ পাহাড় আলো করে এখানে ওখানে গুরাসের, মাদারের, শিমুলের লাল, তখনো। ধাঁ ধাঁ করে গরম বাড়ে, হট করে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়, কিম্বা মেঘফাটা উপুড়চুপুড় জলে পাহাড় ধসে পড়তে থাকে, তেতে ওঠা বিশ্বসংসারে বিকল হয়ে যায় ঋতুচক্র, অথচ পাহাড় কেটে সমান করার কাজ চলতেই থাকে। ঢাল কেটে সমান হবে, সেই ঢাল খুঁড়ে রডসিমেন্ট বসিয়ে তিন-চার-পাঁচ তলা বাড়ির ভিত ঢালাই হবে। তারপরে ইঁট আসবে। আরো লোহার রড। লালনীলকমলাসবুজ রং। পাহাড় রং ভালোবাসে।
পাহাড় কেটে সমান করে ইঁট রড বালিপাথর দিয়ে উঁচু বাড়ি তুলবে যারা তারা আসবে নিচ থেকে। পাহাড়ের লোক এখনো এই কাজ রপ্ত করে উঠতে পারেননি, অথচ কাজটা করাও দরকার। দার্জিলিংপত্তনের সময়ে যেমন, রাস্তা বাড়ি বাজার বানানোর লোক এখনো নিচ থেকেই আনতে হয়। রাস্তার কাজ পাহাড়িরা শিখে ফেলেছেন, খুব বড় রাস্তা না হলে তাঁরাই সামলে নেন। বড় বাড়ি, বড় বাজার, এসব বানাতে হলে নিচের লোক ছাড়া উপায় নেই। তরাই থেকে, দিনাজপুর থেকে, এমনকি মালদা-মুর্শিদাবাদের সমতল থেকে দলে দলে লোক কাঁধেপিঠে সস্তার ব্যাগ ঝুলিয়ে পাহাড়ে উঠছেন। দার্জিলিংয়ে, সিকিমে, এমনকি লাগোয়া ভুটানে নেপালে।
শ্রমের কথা হচ্ছিল। সায়েবদের আসার আগের যে দার্জিলিং, সায়েবরা এসে সেটা বদলালেন। সায়েবরা চলে যাবার পর, সেই বদলে যাওয়া অন্য দার্জিলিংও বদলাতে থাকল, এখনো বদলাচ্ছে। পাহাড়ে যাই, পাহাড় থেকে নিচে নামি, এই মেঘ এই রৌদ্র, নাকে বুনো ফুলপাতা আর মেঘের গন্ধ, চোখে প্রকৃতির রং। আগের মতো কিছু নেই, থাকে না, জানি, বদলটা যদি বেশিরকমের হয়, চেষ্টা করি মন বন্ধ করে রাখতে। পথ দিয়ে গাড়ি ছোটে, পথের পাশে মানুষ কাজ করে, পাহাড় ভাঙে, পাথর ফাটায়, বালিতে সিমেন্ট মেশায়। সেসব আবছা মানুষকে চোখের কোণ দিয়ে দেখি, অথবা দেখি না। আমার গাড়ির পিছনে বা মুখোমুখি, নীল রঙের ছোটো ট্রাক উঠতে থাকে, কোনোটায় পেঁচিয়ে থাকা মেটেলাল রডের কুন্ডলি, কোনটায় ইঁট, কোনোটায় বস্তাবন্দি সিমেন্ট। রড ইঁট সিমেন্ট কিছুই এ পাহাড়ে তৈরি হয় না, অন্য জায়গা থেকে আসে। আসে মানে সেই সব জায়গাগুলো, সেখানকার নানান রকমের শ্রম, তারাও আসতে থাকে। শুধু আমরা দেখতে পাই না।
দার্জিলিং কালিম্পঙ ভুটানের পাহাড় যেখানে সমতলে মিশছে, পাহাড়ের নদীরাও সেখানে পাহাড় চিরে নিচে নামছে। শুকনা থেকে পশ্চিমে মেচি নদীর দিকে, বা পূর্বে তিস্তা পার হয়ে জলঢাকা, তোর্সা, রায়ডাক, সঙ্কোশ, যেদিকেই যাওয়া যাক, ছোটো বড়ো সব নদীর উজানে, দুপাশের মাঠ ধানক্ষেত দখল করে ভেঙে রাশি রাশি ইঁটভাঁটা। মাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে জমি নষ্ট হচ্ছে, মাটির নিচের জলস্তর নামছে ক্রমাগত। নদীর বুকও খোবলানো, গর্তে ভর্তি, সেখান থেকে বালিপাথর উঠছে। বালিপাথর ওঠানো, ভাঙা, গাড়িতে ভরা আর ইঁট বানানোর কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের কেউ স্থানীয়, কেউ বাইরের। কী মজুরি পান, কী শর্তে কী অবস্থায় কাজ করেন সে সব খবর কালেভদ্রে পাওয়া যায়— অত্যাচারের, শোষণের, দারিদ্র্যের। ইঁট বালি পাথর ট্রাকে বোঝাই হয়ে এ শহর ও শহর এই বাজার ওই গঞ্জে পৌঁছোতে থাকে, পাহাড়েও ওঠে। নতুন বাড়ি হোটেল বাজার তৈরি হয়।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ (তিন)
পাহাড়ছোঁয়া উত্তরবঙ্গ থেকে বহুদূরে, গঙ্গা দামোদর পেরিয়ে রাঢ়বাংলার জঙ্গলমাহাল। বীরভূম বাঁকুড়া বর্ধমানের খানিকটা, ওদিকে পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া। বাংলা শেষ হলে ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, তার পর ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ। লালমাটি, ছোটবড় টিলাপাহাড়, শালমহুয়ার পাতলা ও ঘন বন। অনেকবার ওই সব বনে যাওয়া হয়েছে। বনের প্রান্তে মাঠের ওপর একের পর এক নরম লোহার কারখানা। আকরিক লোহায় খাদ মিশিয়ে নরম লোহা বা স্পঞ্জ আয়রন তৈরি হয়। সেই নরম লোহা দিয়ে রড তৈরি হয়। উড়িষ্যা ঝাড়খন্ড ছত্তিশগরের লোহাখনি থেকে লোহা আসে। শ্রম আসে পূর্ব ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, উত্তরবঙ্গ থেকেও। দিনাজপুর মালদা থেকে আসা কমবয়সী শ্রমিকদের দেখা পেয়েছি ছত্তিশগড়ের রায়পুরে, উড়িষ্যার সম্বলপুরে, বাঁকুড়া বর্ধমান মেদিনীপুরে। লোহা কারখানা থেকে উড়ে আসা কয়লার গুঁড়ো চাষের ক্ষেতে, বসতবাড়িতে, শালের পাতায়, মানুষের বুকে ফুসফুসে। রড তৈরি হচ্ছে তো হচ্ছেই।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতি-নির্মাণ (দুই)
দার্জিলিং পাহাড়ের, চায়ের, চা শ্রমিকদের কথা থেকে অন্য কত কিছু এসে গেল। আসবেই। আসতেই হবে। আপনি আমি চোখ বুজে কুয়াশা আর বুনো ফুলের ঘ্রাণ নিতে পারি, তাতে কিছু এসে যায় না। নিয়ম করে, ছক কেটে পাহাড় সমতল বন নদী মানুষ সবকিছু ভাঙা হচ্ছে, ইধারকা মাল উধার। বিশেষত শ্রম। শ্রম না থাকলে পাহাড়ের জমি বাসযোগ্য লাভযোগ্য হবে না, বাড়ি হোটেল বাজার উঠবে না, তৈরি হবে না দার্জিলিং চা-ও। আমাদের গল্পটাও বেঘোরে মারা যাবে।
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ
ক্যাম্পবেলের চৌকস তত্বাবধানে বাংলার সমতল ও পড়োশি সিকিম, ভূটান এবং নেপাল থেকে শ্রম আসতেই থাকলো দার্জিলিং-এ। শ্রমিকেরা মাটি কাটলেন, বন পরিষ্কার করে পুড়িয়ে চাষের জমি বানালেন, চায়ের বীজ থেকে ছোটো চা চারা তৈরি করে সেই চারা জমিতে লাগালেন। পোকামাকড় আগাছা রোগব্যাধি থেকে গাছ বাঁচিয়ে রেখে ক্ষেত পরিষ্কার রাখলেন। গাছ বড় হলে সেখান থেকে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তুলে গুদামে কারখানায় নিয়ে গেলেন মহিলা শ্রমিকরা। পাতায় হাওয়ারোদতাপ দিয়ে শুকোলেন, মেশিনে দিলেন, শুকনো পাতা ভেঙে বা না ভেঙে চকচকে ঝকঝকে প্যাকেটে ভরলেন, সেই চা পৌঁছে গেল কলকাতা হয়ে লন্ডন, সেখান থেকে বিশ্বের সর্বত্র।
শুধু চা নয়, চায়ের মালিকদের দেখভাল করাও শ্রমিকদের কাজ। বাগানের সুন্দরতম অংশে ছবির মতো বাংলো উঠল, সেই বাংলোয় সায়েব মালিক থাকতে এলেন, সঙ্গে তাঁদের সায়েব ম্যানেজার, অন্য কর্মচারী। নিজের চোখে দেখা, বড়ো বড়ো বাগানের সায়েববাংলোয় ষোলো থেকে তিরিশজন অবধি কাজ করছে, খানসামা, খিদমতগার, রাঁধুনি, মালি, জমাদার। সে সায়েবরাজ এখন নেই, বহু বাগান তাদের বাংলো ভাড়ায় দিচ্ছে, সেখানে বাইরের ট্যুরিস্টরা রাজগন্ধ শুঁকতে আসে। খুব বনেদি জাতের নয়, ছোটখাটো দু একটা চা বাংলোয় থেকেছি কয়েকবার, দার্জিলিংয়ে, দক্ষিণ ভারতেও। পুরোনো আমলের সাদাকালো ছবি কাঠের দেয়ালে টাঙানো, কিছু পুরোনো আসবাব, বড়ো বড়ো পালঙ্ক, যেগুলোকে ফোর পোস্টার বলা হয়। এলাহি খাওয়াদাওয়া। অন্তত বারোচোদ্দ জন বাংলো সাফসুতরো রাখছে।
ছবির মতো জায়গায় ছবির মত সায়েবি বাংলো, কিন্তু এখন সায়েবরা কোথায়? বাংলোয় ঢোকার মুখে ওঁ চিহ্ন লাগানো, ভিতরে আগরওয়াল ও বনসল মিত্তাল ইত্যাদি মালিক পরিবারের সিঁদুর লেপা ফ্রেম বাঁধানো ছবি। যাঁরা রাজ খুঁজতে এবং সায়েবরা কি এলাহি কায়দায় থাকত তা দেখতে আসেন, তাঁদের খুশি করার জন্য কোথাও কোথাও ইংরিজি জানা, এমনকি ইংরিজি নামের লোককেও অতিথিসৎকারের কাজে লাগানো হয়েছে।
পর্যটন বা বেড়ানো ব্যবসায় পাহাড়ের বহু মানুষ যুক্ত, অনেকের রুটিরুজি বেড়ানো দিয়ে চলে। দার্জিলিং-এর চা, চা বাগান সেই বেড়ানোর অবশ্যম্ভাবী অংশ, চা খাওয়া, চা বাগান দেখা, 'ট্র্যাডিশনাল' 'গোর্খা' পোশাকে চা গাছের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা, কপাল ভালো হলে পিছনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। যাঁরা দার্জিলিং পছন্দ করেন, দার্জিলিংয়ে আসেন, তাঁদের সবাই হয়তো এই রকম বেড়ানো পছন্দ করেন না। তাতে কিছু আসে যায় না বিশেষ। এই রকম ওই রকম দশ রকমের বেড়ানো নিয়ে দার্জিলিং তৈরি হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
Powered by Froala Editor