সময়ভ্রমণ - ৪৭
আগের পর্বে
বিশুদ্ধ প্রকৃতি বলে এই পৃথিবীতে কিছুই নেই। এমনকি আমাজনের অরণ্য পর্যন্ত বানিয়ে তোলা। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন হল, কে বানাচ্ছে? প্রত্যেক নিসর্গের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মানুষের শ্রমসম্পর্কের ইতিহাস। কোথাও কৌমজীবন আবার কোথাও শোষণের ইতিহাস। পাহাড়ে সাহেবরা নিসর্গ তৈরি করেছিলেন তাঁদের বাড়ির মতো করে। অথচ পাহাড়ের নিজস্ব মানুষরা সেখানে সস্তা শ্রমিক ছাড়া কিছুই ছিলেন না। এই সস্তা শ্রমের জোরেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পেরেছিল কোম্পানির চায়ের ব্যবসা। রবার্ট ফরচুন নিশ্চিন্ত ছিলেন, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া সেই ব্যবসায় পাল্লা দিতে পারবে না। কারণ চিনের বাজারকে হারাতে গেলে প্রকৃতি ও জলবায়ুর সঙ্গে সস্তা শ্রমেরও প্রয়োজন। যা আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যাবে না।
চিন ভ্রমণ নিয়ে ফরচুনের দু-নম্বর বই যখন বেরুচ্ছে, দার্জিলিং-য়ে চা চাষ তখনো সেভাবে শুরু হয়নি, যে জায়গাটাকে এখন দার্জিলিং জেলা বলে সবাই জানে, সেটা সবে তৈরি হয়ে উঠছে, ক্যাম্পবেল এবং হুকারকে কয়েদ করার শাস্তি বাবদ কোম্পানি সরকার সিকিম রাজার জমি দখল করে নিয়েছেন। ফলে অল্প অল্প করে সে সব জমিতে নতুন প্রজা বসছে, দার্জিলিং শহরের নতুন বাজারে কাজের সন্ধানে পড়োশি গোর্খা রাজত্ব থেকেও চলে আসছেন মানুষ। দার্জিলিংপত্তনের গোড়ার দিকে, লয়েড পাহাড় ছেড়ে চলে যাবার পরের বছর দশেক ক্যাম্পবেল দার্জিলিং-এ নতুন প্রজা বাড়াতে ব্যস্ত ছিলেন। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিক থেকেই যখন বোঝা যেতে থাকল হিমালয়ের এই অঞ্চলে চা গাছ দিব্যি বাড়তে পারে, পাহাড়-তরাই মিলিয়ে যে এলাকা, সেখানে দিশি অহমিয়া ও বিদেশি চৈনিক, এই দু কিসিমের গাছ লাগানোর মতো উপযুক্ত পরিবেশ-পরিস্থিতি রয়েছে, প্রজা বসানো ছেড়ে ক্যাম্পবেল সস্তা শ্রম জোগাড়ে লেগে গেলেন।
দার্জিলিংপত্তনের গল্প করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, লয়েডের দুর্ভাগ্য ও দুর্ভোগের প্রধান কারণ শ্রমের যোগান নিশ্চিত করতে না পারা। তাঁর শাসনের প্রথম দিকে ক্যাম্পবেলকেও এ নিয়ে ভুগতে হয়েছে, স্থানীয়দের, বিশেষত সিকিম রাজার লেপচা প্রজাদের দিয়ে তিনি কাজ করাতে পারেননি। শ্রম সমস্যা মিটল গোর্খা রাজত্ব থেকে শ্রমিক জোগাড় করে। দেখা গেল, সে রাজত্বের পথেপ্রান্তর দাসত্বে, করভারে ও ঋণে জর্জরিত অত্যাচারিত কৃষক ও অন্যান্য গরিব মানুষ স্থানান্তরিত হতে চাইছেন। শুধু লিম্বুয়ান বা আদি কিরাত রাজত্বের লোকজন নন, নেপালের পাহাড়ের একেবারে ভিতরের বাসিন্দারাও, যথা নেওয়ার, মঙ্গর, গুরুঙ বা তামাং জনগোষ্ঠীর মানুষেরা, এমনকি বহুদূরের সোলো-খুম্বুর শেরপারাও। মুগলানে(নেপাল লাগোয়া ভারতবর্ষকে সাধারণভাবে এই নামে ডাকা হত—মুঘল থেকে মুগলান) গেলে ভাগ্য খুলে যাবে, এমন একটা কথা পাহাড়ে চালু ছিল। মুগল চলে গিয়ে ব্রিটিশ সায়েবরা এসেছে, তাতে এই ভাবনার হেরফের ঘটেনি। গোর্খাদের সঙ্গে কোম্পানির যুদ্ধ হয়েছিল বটে, তবে পরবর্তী সময়ে সায়েবরা নেপালের যুদ্ধবাজ গোর্খা রাজাদের বিশ্বাসযোগ্যই মনে করত একরকম। মুগলানে ব্রিটিশ শাসনের দুশো বছরে একের পর এক যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে, নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়নি। নেপাল থেকে দলে দলে মানুষ দার্জিলিং-এ এসে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছেন, সস্তার কুলিমজুর হিসেবেও কাজ করেছেন, চা বাগানে, বনে, সিঙ্কনা বাগানে, শহরে বাজারে। নেপাল সম্পর্কে ব্রিটিশ শাসকের মনোভাব দিব্যি বোঝা যায় ১৮৯৪ সালে প্রথম প্রকাশিত সিকিম গ্যাজেটিয়ারের এচ এচ রিসলে/লিখিত ভূমিকায়। রিসলে সাহেব সেসময়ের প্রধান রাজপুরুষদের অন্যতম, পণ্ডিত ও গবেষক। তৎকালীন বাংলা ও সিকিম/নেপালের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিয়ে তিনি বিস্তারিত নৃতাত্বিয় অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন, বাংলার জনজাতি(ট্রাইব) এবং জাতি(কাস্ট) প্রসঙ্গে তাঁর কাজের কথা এ আখ্যানে এসেছে। খ্যাতনামা নৃতত্ববিদ হলে কী হয়, রিসলে ঘোরতর, কট্টর সাম্রাজ্যপন্থী ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের বাসিন্দাদের যেমন, পড়োশি দেশের রাজা ও প্রজাদেরও সাম্রাজ্যপন্থীরা দেখতেন, বুঝতেন ও মাপতেন সাম্রাজ্যচোখ দিয়ে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষে ভালো কী ও কোনটা, হোয়াটস গুড ফর দি এম্পায়ার? উনিশ-কুড়ি শতকের নেপালি রাজত্বের সমতুল প্রজাশোষক অত্যাচারী শাসনব্যবস্থা এতদাঞ্চলে কেন, সম্ভবত গোটা এশিয়াতেও বড় একটা ছিল না। তাতে কী আসে যায়? নেপালরাজকে দরাজ প্রশস্তিতে ভরিয়ে দিচ্ছেন রিসলে:
‘অন্য যাহাই হউক না কেন, নেপালের হিন্দু সরকারকে কদাচ দুর্বল বলা চলিবে না। উহাদিগের পদ্ধতিপ্রকরণ আমা হইতে ভিন্নতর, রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রসঙ্গেও উহারা বিশেষ অধৈর্য। তৎসত্বেও, উহাদের অমাত্যবর্গ নিয়মিত আদালত বসাইয়া থাকেন, সাক্ষ্য গ্রহণ করেন, দোষীদিগকে উপযুক্ত ন্যায়বিচার প্রদানপূর্বক...দন্ডদান করেন।...নেপালের রাজস্বব্যবস্থা ভোটান ও সিকিমের অপেক্ষা সহস্রগুন উত্তম। ওই দেশের প্রধান ব্যক্তিবর্গ আমাদিগের বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করিয়াছেন, ভারতীয় রাজনীতি প্রসঙ্গে তাঁহাদের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদাই যথাযথ ও বিবেচক...সিকিমের সহিত বিবাদের ক্ষেত্রে, প্রথমাবধি কাঠমান্ডু দরবার সর্বপ্রকার সহায়তা করিয়াছেন...সংক্ষেপে, এক শক্তিশালী রাষ্ট্রের উপযুক্ত কর্ম করিয়াছেন। যে যে রাজ্যে আমাদের আগ্রহ নাই, তাহা অধিকার করিয়াছেন এবং আমাদিগের স্বার্থ এবং উহাদিগের স্বার্থ বস্তুত যে ভিন্নমুখী নহে, ইহাও উত্তমরূপে অবধাবন করিয়াছেন। আমাদিগের ও একাধিক বর্বর দেশের মধ্যে নেপালের অবস্থান..তদপেক্ষা উত্তম মধ্যভূমি(বাফার) আর কি হইতে পারে?’
বর্বর দেশ বলতে রিসলে বোঝাতে চাইছিলেন ভুটান এবং তিব্বতকে। সিকিমের সঙ্গে এই দুই দেশের রাজপরিবারের লেনদেন চলত, বিশেষত তিব্বতের সঙ্গে। তিব্বত নিয়ে ব্রিটিশদের বহুবিধ অজানিত আশঙ্কা। তিব্বত এবং ব্রিটিশ দার্জিলিংয়ের মধ্যে ভুটান, যার ওপরে ভরসা নেই। সিকিম কার্যত দখল করে নেওয়াই হয়েছে। বাকি থাকে হিন্দু, গোর্খা নেপাল। তা শুধু মধ্যভূমি বা বাফার হিসেবে নয়, নতুন প্রজা সরবরাহের কল হিসেবেও বিশেষ কার্যকরী। নেপাল থেকে তুলনায় 'সভ্য' লোকজন এসে সিকিম, ভুটান ও দার্জিলিংয়ের যাবতীয় 'বিপজ্জনক' বৌদ্ধ বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিজভূমে সংখ্যালঘু বানিয়ে দেবে দ্রুত, ফলে সমাজ থেকে তিব্বতীয় প্রভাব অপসৃত হবে। রিসলে বলছেন:
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, শ্রম ও প্রকৃতিনির্মাণ
‘সিকিমের জনবিন্যাসে যে বিপুল...পরিবর্তন পরিলক্ষিত হইতেছে তাহা কালক্রমে আমাদিগের শক্তিবৃদ্ধি করিবে। লেপচাকূল দ্রুত বিলীয়মান, অপসৃয়মান; বিপরীতে, পশ্চিম হইতে পরিশ্রমী নেওয়ার ও গুরখাকূল ক্রমাগত ঢুকিয়া আসিতেছে, বিস্তীর্ণ বেওয়ারিশ ভূমি সাফ হইতেছে, দার্জিলিংয়ের যুরোপীয় চা-কর সাহেববর্গ ওইস্থানে লুব্ধ দৃষ্টিপাত করিতেছেন। তিব্বতের জাতিবৈর এই জনসমূহের বিপুল সংখ্যায় সিকিম আগমন এতদদেশীয় সমাজে তিব্বতীয় প্রভাব প্রতিরোধে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিবে...ধর্মের ভূমিকাও এস্থলে ন্যুন নহে। যথা ভারতবর্ষে ঘটিয়াছে, হিন্দুধর্ম সিকিমেও বৌদ্ধধর্মকে বিতাড়িত করিবে, লামাদিগের প্রার্থনাচক্রের স্থলাভিষিক্ত হইবে ব্রাহ্মণের হোমযজ্ঞবলির সরঞ্জামাদি...এইরূপে, জাতি(রেস) ও ধর্ম...সিকিম সমস্যা আমাদিগের পক্ষে সমাধান করিবে…’
আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প (চার)
সিকিমে লোক পাঠানো নিয়ে নেপালের সঙ্গে এই বোঝাপড়ায় ব্রিটিশরা বহুদিক থেকে লাভবান হয়েছিল। একটা লাভের কথা রিসলে বলছেন--এলাকার জনবিন্যাস বা ডেমোগ্রাফি বদলের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ঝামেলা তৈরির সম্ভাব্য বিন্দুগুলোকে নিশ্চিহ্ন করা। দ্বিতীয় লাভ হচ্ছে শ্রম, সামরিক শ্রম। ১৮৫৭-য় সমতলের সিপাইদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের লড়াইতে নেপালি গুরখারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘদিন অবধি ভারত-নেপাল সীমান্তে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গোটা দুই স্থায়ী 'নিয়োগ দপ্তর' বা রিক্রুটিং অফিস ছিল শুধু গুরখাদের জন্য, একটা সেসময়ের যুক্তরাজ্যের গোরখপুরে, দ্বিতীয়টা দার্জিলিংয়ে। তৃতীয় লাভটাও শ্রম, তবে সামরিক নয়। দার্জিলিংয়ের চা বাগানে, সিঙ্কনা বাগানে আর সরকারি বনে কাজ করার জন্য নেপাল থেকে কুলি চালান হতে থাকল। দার্জিলিংয়ের সদ্য গড়ে ওঠা 'বেড়ানো/ছুটি' শিল্পেও(যাকে এখন লেজার ইন্ডাস্ট্রি বলা হয়), কাজ পেলেন নেপালি শ্রমিকরা। দার্জিলিং থেকে নেপালি শ্রমিকদের চালান দেওয়া হতে থাকলো আসামে ও দেশের অন্যত্র, এমনকি কলকাতায়, তাতে ব্রিটিশ ও তাদের ভারতীয় স্যাঙাত ফড়েরা লাভ করতে থাকল। চতুর্থ লাভের কথাটা আগেই বলা হয়েছে, বিনিপয়সার চাষজমি ও বাস্তুর খোঁজে নেপালি চাষিরা ব্রিটিশ দার্জিলিংয়ের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লেন, পৌঁছে গেলেন ভূটানের কাছ থেকে 'শাস্তিমূলক ব্যবস্থা' হিসেবে নিয়ে নেওয়া তিস্তার পশ্চিম পাড়ের কালিম্পঙ-এ, নিচের দুয়ার এলাকাতেও। ফলে জমি খালি থাকল না, সর্বত্র খাজনাদায়ী প্রজানিবাস বসে গেল।
আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প(তিন)
সবচাইতে বেশি লাভ করলেন দার্জিলিংয়ের সায়েব জমিদারেরা, যাদের চা-কর বা প্ল্যান্টার বলে ডাকা হত। খানিকটা নেপাল দরবারের সঙ্গে দরবারের প্রাক্তন ব্রিটিশ রেসিডেন্ট, উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে দার্জিলিংনিবাসী হজসন এবং নেপালে তাঁর সহযোগী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা ক্যাম্পবেল, এঁদের সুসম্পর্কের কারণে, খানিকটা ব্রিটিশদের কামানবন্দুকের ভয়ে, নেপালের দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হল। অর্থাৎ, সস্তা শ্রমের অনন্ত ভাণ্ডার খুলে গেল, পাহাড়ি বন, চারণভূমি, জুমিয়া এলাকা, নিচের মোরাং-এর ঘাসবন শালবন সব নির্বিচারে হাসিল করে বেড়ে উঠতে থাকল চা-য়ের আবাদি।
আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন: চায়ের বহু গল্প (দুই)
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
চিন, জাপান, হল্যান্ড, ব্রিটেন : চায়ের বহু গল্প (এক)